বৈজ্ঞানিক অসীমা চট্টোপাধ্যায়

ভবানীপুর, কলকাতা

সত্যেন্দ্রনাথ বসু একবার তাঁর প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, "বিজ্ঞান কলেজে সন্ধ্যের পর যখন সব ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তখন যে একটা ঘরে দেখবে আলো জ্বলতে, সেটা অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের ঘর। অসীমা চট্টোপাধ্যায় মানেই তিনটে ডি – ডিভোশন , ডিউটি ও ডেডিকেশন। "

কে এই 'অসীমা চট্টোপাধ্যায়'? ১৯১৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ডাক্তার ইন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায় ও কমলা দেবীর কন্যা 'অসীমা' মুখোপাধ্যায়ের জন্ম। পৈতৃক বাড়ি হুগলী জেলার হরিপালের কাছে গোপীনাথপুর গ্রামে। ছোটবেলায় তিনি পিতা ইন্দ্রনারায়ণের সাথে কলকাতা থেকে দেশের বাড়ি যাবার পথে বাবার মুখে গ্রামের মাঠের নানা গাছপালার নাম ও তাদের গুণাগুণ শুনতেন। এভাবে ধীরে ধীরে ভেষজ গাছপালার প্রতি তাঁর আগ্রহ সেই সময় থেকেই বৃদ্ধি পেতে থাকে ।

বেথুন কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক দুটি পরীক্ষাতেই তিনি সম্মানসূচক বৃত্তি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় তাঁর কাছে সব বিষয়ের দরজা খোলা ছিল। সবকিছুর মধ্যে তিনি স্বেচ্ছায় 'রসায়নবিদ্যা' নিজের পাঠ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। তখন একমাত্র এই কলেজেই মেয়েদের রসায়নে অনার্স পড়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সে সময় কলেজে ছেলে মেয়ে একত্রে পড়াশোনা করার কারণে তিনি পারিবারিক বাধার মুখে পড়লেও নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। স্কটিশ চার্চের রসায়ন বিভাগে স্নাতক পর্যায়ে তিনজন পড়ুয়ার মধ্যে একমাত্র মেয়ে ছিলেন অসীমা। ১৯৩৬ সালে স্বর্ণপদকসহ অনার্স সম্পন্ন করে অনবদ্য কীর্তি স্থাপন করার দুই বছর পরে অসীমা দেবী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এম.এস.সি করেন এবং পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এম.এস.সি পড়বার সময় তৎকালীন নিয়মেই তাঁরও গবেষণায় হাতেখড়ি হয়েছিল অধ্যাপক প্রফুল্লকুমার বসুর কাছে। গবেষণা জীবনের প্রায় শুরুতেই তিনি পেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগমায়া দেবী স্বর্ণপদক (১৯৪০) , নাগার্জুন পুরস্কার (১৯৪২) ও প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ উপাধি। এরপর ১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.এস.সি অর্জন করেন।

এম.এস.সির পরও তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই গবেষণা কাজকে বেছে নিয়েছিলেন নিজের জীবনসাধনারূপে। সে সময় ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষত বাংলায় জন্মায় এরূপ অবহেলিত গাছ-গাছড়াকে তিনি গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নেন। আমাদের চারপাশে চোখে পড়ে এরকম অনেক সাধারণ গাছ গাছড়ার অসাধারণ ভেষজগুণ ও রাসায়নিক ধর্মাবলি তিনি গবেষণাগারে অক্লান্ত ধৈর্য ও পরিশ্রমের সাহায্যে বিশ্লেষণ করেছেন। প্রাচীন বৈদিক ও আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে বর্ণিত বিভিন্ন উদ্ভিদ নিয়েও তাঁর গবেষণা প্রশংসার দাবি রাখে। এছাড়াও তাঁর বিশেষ অবদান দেখা যায় স্টেরয়ডাল অ্যালকালয়েড সম্পর্কিত গবেষণায়।

তবে একজন নারী হিসেবে অসীমা দেবীর জন্য গবেষণা ক্ষেত্রে চলার পথ তৎকালীন সময়ে মোটেই সহজ ছিল না। সে সময়ে গবেষণাগারে আর্থিক আনুকূল্যের অভাব ছিল প্রকট এবং তাঁর এক ছাত্র ডক্টর পাকরাশি জানিয়েছিলেন, তিনি নিজে বৃত্তি পেতেন দেড়শো টাকা করে যেখান পুরো গবেষণাগারে অসীমা চট্টোপাধ্যায়কে ব্যয় করার জন্য অনুদান প্রদান করা হত মাত্র তিনশো টাকা। তাই এসবের পাশাপাশি তাঁকে বোস ইনস্টিটিউট , আইআইটি কিংবা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নির্ভর করতে হত অথচ এমন প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি কাজ করে গিয়েছেন অবিরাম। তাঁর সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ভারতীয় বনৌষধি নামে ছয় খণ্ডের মূল্যবান পুস্তকসহ ট্রিটিজ অন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল প্ল্যান্টস  শিরোনামে ছয় খণ্ডের এক বিরাট তথ্যভাণ্ডার সম্পাদিত হয়েছিল।

১৯৪৫ সালে অসীমা মুখোপাধ্যায় বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন বর্ধমানের বরদানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যিনি সিটি কলেজ থেকে রসায়নে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানস্বরূপ। গবেষণাকার্যে অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের মূল অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন মূলত তিনিই। তাঁদের কন্যা জুলি -ও একজন জৈব রসায়ন বিজ্ঞানী। জামাতা অভিজিৎও ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম রসায়নবিদ। পুরো পরিবারটিই রসায়নে নিজেদের মেধা আর প্রতিভা দ্বারা বিজ্ঞান সাধনায় অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছে। সেজন্য অনেকেই এ পরিবারকে মাদাম ক্যুরির পরিবারের সাথে তুলনা করে ‘ক্যুরি ফ্যামিলি অব ইন্ডিয়া’ আখ্যা দিয়ে থাকেন।

১৯৪৭-৫০ তিন বছর অসীমা দেবী যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় , ক্যালটেক এবং সুইজারল্যান্ডের জুরিখে উচ্চতর গবেষণার দরুণ ছিলেন। ক্যালটেকে থাকার সময় তিনি দুবার নোবেল পুরস্কার জয়ী রসায়নবিদ লিনাস পলিং-এর সাহচর্য লাভ করেছিলেন। আমৃত্যু তাঁদের মধ্যে সেই ঘনিষ্ঠতা বজায় ছিল। জুরিখে তিনি নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পল কারের-এর সঙ্গেও কাজ করেছিলেন। প্রবাস থেকে ফিরে এসে ১৯৫৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদে যোগ দিয়েছিলেন। পরে সে বিভাগেই ‘খয়রা অধ্যাপক’ রূপে কাজ শুরু করেছিলেন। এরপর ১৯৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

তিনি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন তাঁর ভিঙ্কা অ্যালকলয়েডের (নয়নতারা) ওপর গবেষণার জন্য, যেটি কর্কট (ক্যান্সার) রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। মৃগী রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন শুষনি শাক থেকে এবং ম্যালেরিয়া রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন ছাতিম, কুটকি, চিরতা প্রভৃতি থেকে।

বিজ্ঞান গবেষণায় নারী জাতির অক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের মনে যে অযৌক্তিক ধারণাটি চলে এসেছে যুগ যুগ ধরে, অসীমা চট্টোপাধ্যায় সেই ধারণায় মূলে কুঠারাঘাত করতে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন।


নিজস্ব ক্ষেত্রে শান্তিস্বরূপ ভাটনগরসহ বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন বৈজ্ঞানিক অসীমা চট্টোপাধ্যায়। ১৯৭৫ সালে তিনি 'পদ্মভূষণ'- এ সম্মানিত হন এবং ওই বছরই তিনি প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সাধারণ সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। সাম্মানিক ডি.এস.সি. উপাধি পান বর্ধমান, কল্যাণী, বিদ্যাসাগর এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত রাজ্যসভার সদস্য। কাছের মানুষদের বলতেন, “যতদিন বাঁচি, ততদিন যেন শুধু কাজ করেই যাই।“ বাস্তবে তিনি আমৃত্যু কাজই করে গেছেন মানুষের কল্যাণে। ৮৯ বছর বয়সে ২২ নভেম্বর ২০০৬ সালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বৈশাখী ২০২৪