নাম নিয়ে আমার ধাষ্টামো আজ যদি কাউকে আহত করে, তবে ক্ষমা করবেন। একদম ছোটবেলার কথা বলি। প্রাইমারি স্কুলে বাংলা পড়ান পটল স্যার। তাঁর নামের ইতিহাস কখনো জানা হয়নি। তবে স্যারের ছেলেও নাকি বাজারে এই বলে পরিচয় দিত, “আমি পটল স্যারের ছেলে।” তখন কাজের সুবাদে বিহারের গুমলা জেলার ঘাটোবাগিচায় থাকি। অফিসের আর্দালি গুল প্রসাদ। নেহাতই সাদামাটা গুল প্রসাদ। গুলপ্রসাদ যাদব বা এরকম কিছু নয়, যে সারা পৃথিবী তাকে নিয়ে আলোচনা করবে। আমার কিন্তু তার নামটি বড় মনে ধরে গেল। ভেবে দেখলাম গুল প্রসাদ এমন কিছু সাধারণ নাম নয়। সে যদি আফগানিস্তানে জন্মাত তবে সে হয়ত তালিবান নেতা গুল মহম্মদ হত, আবার নেপালে সে-ই মহান বীর গুলবাহাদুর। আরবে সে হয়ত গুল-এ-বকাওয়ালী হয়ে কিস্যা শোনাত হাজার এক রাত ধরে, অথবা গ্রীসে গোলিয়াথ। জার্মানিতে গুলস্টাইন হয়ে সে আবিষ্কার করত, অথবা ইংল্যান্ডে ক্রিকেট ব্যাট হাতে রিভার্স সুইপ মারত রবার্ট গুল হয়ে। ফ্রান্সে ভিনসেন্ট গুলিস্তা হয়ে ভুবনজয়ী ছবি এঁকে সকলের মন জয় করে নিত বা শ্রীলঙ্কায় গণ্ডামারি গুলনায়েকে হত মারকুটে ওপেনিং ব্যাটসম্যান। আষাঢ়ে গপ্পের বাজারে নায়ক গুলিভার হোক বা হিন্দি সিনেমার ভিলেন গুলশান গোবরা, কোনোটাই খারাপ নয়। তবে কলকাতায় থাকলে তার নাম ঠিক হয়ে যেত গুলে বা গুইল্যা। আমার এক ছাত্রীর বাবা মা তার নাম রেখেছেন পিউপা। এখনো সে গুটি কেটে প্রজাপতি হতে পারল না, তবে বিয়ে সামনেই। আমার স্কুলের এক বন্ধু, বাবা মা তার নাম রেখেছেন ‘গুরু’। পদবী 'দেব'। দুর্দশা শুধু পদ্মিনীর। ঠাকুমা শখ করে নাম রেখেছিলেন। পদ্মিনীর বিয়ে হল হিন্দি বলয়ে। বাকিটা ইতিহাস। ‘মাল’ পদবীর পরিবারে বিয়ের পর বান্ধবী মালা রায় 'মালা-মাল' হয়ে গেল। রবি মামা পেশায় পুরোহিত। সবাই ডাকে রবিঠাকুর, এক পাতা না লিখেই তিনি 'know bell' জয়ী। বোন-ধুর বোন-কে একদিন গদগদ হয়ে বললাম, “শেষের কবিতা পড়েছ নিশ্চয়...” বলল, “পড়িনি, তবে শুনেছি অনেকবার সৌমিত্রবাবুর আবৃত্তি।” বললাম, “আরে সে তো কবিতা, একটা মাত্র...” সে বলল, “আমিও তো সেই কথাই বলছি, একটা কবিতা...” চুপ করে রইলাম। কে না জানে, বোন-ধুর বোন আর বোনের বোন-ধু... সহস্র বছরের সাধনার ধন। আমাদের হেডমাস্টারমশাই বলতেন, “দেখ বিলেতে জন্মানোর অনেক সুবিধা আছে। এই দেখ না, আমাদের দেশের ময়রারা লোকের দোকানে কাজ করে, আর বিলেতের ময়রারা লর্ড হয়। যেমন 'লর্ড ময়রা'।” সদ্য ইতিহাস শুরু করা কিশোর কলকাতায় বেড়াতে এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, এই রাস্তার নাম কী?” বাবা বললেন, “আর্মহার্স্ট স্ট্রিট।” “আর যেখানে প্রথম গিয়েছিলাম?” “বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট।” “দেখ বাবা, ব্রিটিশরা কেমন বোকা। আমাদের দেশের রাস্তার নাম দিয়ে কেমন ভাইসরয়গুলোর নাম রেখেছিল!” বারাক ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলে চায়ের দোকানে মিল্টন ঘোষণা করল, “দেখ বাঙালির মতো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা জাত হয় না। সেই কত বছর আগে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামার নাম স্মরণীয় করে রাখতে স্টেশনের নাম রেখেছে বারাকপুর।” বিয়ের রজত জয়ন্তী বর্ষে নিউটনদা অফিস কলিগদের নেমন্তন্ন করেছেন। সন্ধ্যায় তারা এলে নিউটনদা হাঁক দিলেন, “রত্নাবলী, কেকটা নিয়ে এস।“ চুলে গজরা লাগানো রত্নাবলী কেকের ট্রে এনে সেন্টার টেবিলে রাখতেই অবিনাশ বলে উঠল, “বৌদি আপনার নামটা ভুল করে শেফালি লিখেছে দেখুন!” নিউটনদা তাড়াতাড়ি জিভ কাটলেন। পাশের ঘর থেকে প্রসাধনরতা এক মহিলাকে টেনে এনে আলাপ করিয়ে দিলেন, “ইনি হলেন আমার স্ত্রী শেফালি, আর রত্নাবলী হল শেফালির হেল্পিং হ্যাণ্ড!” বাবার খ্যাতির বিড়ম্বনা সইতে না পেরে নিজের নামই বদলে ফেলে ডন ব্র্যাডম্যানের ছেলে হলেন জন ব্র্যাডসেন। লম্বা নামের লিস্টি অনেক বড়, তবে 'শ্রীপোবর্মারা আতাপাত্তু জয়সুরিয়া নটবরা শ্রীরামকৃষ্ণা শিওওয়াচনক রাজশেখরা শ্রীনিবাসনা ত্রিচিপল্লী ইয়াকিপারমপির পেরাম্বদুর চিন্নাস্বামী মুথুস্বামী ভেনুগোপাল আইয়ার' নামটি না মনে পড়লে 'ধামাল' সিনেমাটি আরেকবার দেখে নিতে পারেন। পাড়ার শ্যামলা রঙের শ্যামা নাম্নী তরুণীটির বিড়ম্বনা ছিল নাম নিয়ে। রকবাজেরা তাকে দেখলেই গেয়ে উঠত “নেচে নেচে আয় মা শ্যামা, আমি মা তোর সঙ্গে যাব।” আর থাকতে না পেরে একদিন সকালে পালের গোদাটার বাড়ি গিয়ে হাজির হল শ্যামা। একহাতে আঁশবটি আরেক হাতে সার্ফের কৌটো (তখন অন্যান্য ডিটারজেন্ট বাজারে প্রায় ছিলই না)। গোদাটার বাপকে ডেকে তুলে বলল, “নেচে নেচেই এলুম রে। শুনলুম তোর ছেলে নাকি আমার সাথেই যেতে চায়, তাই নিতে এলুম। পাড়ার লোকের মুখে শুনলুম, তার নাকি গানের খুব শখ। তাই সঙ্গে করে এট্টু সার্ফও এনেছি। জিভটা টেনে এনে ঝামা দিয়ে ঘষে দিয়ে যেতুম, গানের গলাটা পরিষ্কার হত। কই, ডাক তোর ছেলেকে। নাহলে এই আঁশবটি দেখেছিস? আজ করালবদনা হব।” গোদাটার ততক্ষণে ঘুম পালিয়ে গেছে। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতেই একদম পাকড়াও। শ্যামা বলল, “অ্যাও, যাচ্ছিস কোথায় ? চল আমার সঙ্গে।” ছেলে তো সঙ্গে সঙ্গেই কেঁদে ফেলল। বুড়ো বাবা শ্যামার দুটি হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, “মা, আমায় ক্ষমা করো মা। আমি শিক্ষা দিতে পারিনি ছেলেকে। তুমি আমায় সেটা দেখিয়ে দিলে।” শ্যামা বুড়োর পা ছুঁয়ে বলল, “ক্ষমা করুন কাকাবাবু, এছাড়া আমার আর কোনো উপায়ও ছিল না।” কাকাবাবু শেষ পর্যন্ত শ্যামাকেই বৌমা করে এনেছিলেন আর বিয়ের পর মুখ দেখে একটি রুপোর বঁটি উপহার দিয়েছিলেন। কোনো বাঙালি পুরুষের কখনোই 'রুবি রায় সিনড্রোম' হয়নি, একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। রুবি রায় নামটির প্রকৃত উৎস কিন্তু 'ছবি রায়'। কিন্তু 'মনে পড়ে ছবি রায়' হলে গানটির জন্য এই উন্মাদনা থাকত কি? অস্যার্থ, 'গোলাপ - তাকে যে নামেই ডাকো…' ডাহা ভুল কথা। আগেকার মহিলারা স্বামী, ভাশুর বা শ্বশুরের নাম উচ্চারণ করতেন না। এক গৃহিণী সকালবেলায় রাধুনীদিদিকে নির্দেশ দিচ্ছেন, “ছোটখোকার পাউরুটি সেঁকে মেজঠাকুর মাখিয়ে দাও ভালো করে। দুকুরের মাছের ঝোলে নম্বা নম্বা করে বড়ঠাকুরকে কেটে দিও আর নারকেলগুলো কুড়িয়ে রেকো। বিকেলে খোকার বাবা বানাতে হবে।“ বলাবাহুল্য মেজঠাকুর অর্থাৎ মেজ ভাশুর হলেন ‘মাখনলাল’, বড়ঠাকুর ‘পটললাল’ এবং খোকার বাবা নাড়ুগোপাল। আদালতে জনৈক ব্যক্তি জজসাহেবকে এভাবে পরিচয় দিচ্ছেন, “মি লর্ড, মাইসেল্ফ জ্যাকেল ঘাষু।“ বিরক্ত হয়ে জজসাহেব বললেন, “এক্সপ্লেইন।” তিনি বললেন, “জয়কালি ঘোষ।“ জজসাহেব আবার বললেন, “জয়কালি জ্যাকেল নাহয় বুঝলাম কিন্তু ঘাষু এক্সপ্লেইন করুন।” তিনি বললেন, “মি লর্ড, বোস যদি বাসু হয় তবে ঘোষ কেন ঘাষু নয়?” অকাট্য যুক্তি। শিশির ভাদুড়ির নাম নিয়ে শিবরাম চক্রবর্তী লিখেছিলেন, "শিশি-র ভাদুড়ি নহ/ বোতলের তুমি"। এই ঘটনার একটা পশ্চাৎপট রয়েছে অবশ্য। শরৎচন্দ্রের দেনাপাওনা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শিবরাম, ‘ষোড়শী’ নামে। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী সে নাটক মঞ্চস্থ করলেন। প্রায় প্রতিদিনই হাউসফুল। অথচ শিবরাম লভ্যাংশ কিছুই পান না। এদিকে তখন চরম অর্থকষ্ট, দেনার দায়ে জর্জরিত তিনি। একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেললেন, “শিশিরবাবু, কিছু টাকার প্রয়োজন। নাটকে আমার লভ্যাংশ থেকে যদি কিছু দিতেন।” কথা ছিল নাটকের বেনিফিট শোয়ের দিন শিবরামকে কিছু টাকা দেবেন। কিন্তু সেই দিন যা কিছু টাকা ছিল, শরৎচন্দ্র নিয়ে চলে যান। শরৎচন্দ্র নাকি বলেছেন, “শিবরাম বিয়ে-থা করেনি, ওর আবার টাকার কী দরকার!” এই অপমান ভোলেননি শিবরাম, এর প্রতিশোধ নিলেন এভাবে। তিনিই আবার বন্ধু কাজী নজরুল সম্পর্কে বলতেন 'কাজী knows rule'। স্মৃতি থেকে একটি মজার বিষয় লিখছি। তখন ইংরেজ আমল। এক গ্রামের চার সমাজপ্রধান ব্রাহ্মণ বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় ও গঙ্গোপাধ্যায়কে গ্রামের লোকেরা কোনো বিষয়ে আবেদন করবার জন্য পাঠাল এক সাহেবের কাছে। তো তারা সাহেবের কাছে গিয়ে সময় চাইলে তিনি বিশেষ কোনো একটা সময়ের উল্লেখ করলেন। এদিকে গঙ্গোপাধ্যায় শৌখিন মানুষ। শিকারের দিকে তার বিশেষ ঝোঁক। সারাদিন বনে জঙ্গলে বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যথাসময়ে সকলে সাহেবের কাছে রওয়ানা হল কিন্তু গঙ্গোপাধ্যায়ের খোঁজ পাওয়া গেল না। সে কোন জঙ্গলে সেঁধিয়ে পড়েছে, তার হদিস করা গেল না। অগত্যা তিনজন সাহেবসকাশে উপস্থিত হল তাদের আবেদন নিয়ে। সাহেবের বাংলোর লনে তাদের বসানো হল। সাহেব এলেন, বসলেন। অতঃপর বললেন, “বোলো বাবু টোমাডের খি আর্জি আছে? কিনটু টোমরা টো সেডিন চারজন আসিয়াছিলে, আর একজন আসে নাই খেনো ? উহাকে ডাকিয়া আনো।” তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে উত্তর দিল, “হুজুর সে তো কোথায় কোথায় গুলি, বন্দুক নিয়ে শিকার করে বেড়াচ্ছে, তার খোঁজ পেলাম না।” “বন্ডুক? ইউ মিন গান?” “হ্যাঁ হুজুর।” তারপর সাহেব তাদের আবেদন শুনলেন এবং আশ্বাস দিলেন। বললেন, “ইহার পর কোনো ডরকার পড়িলে একডম সোজা আমার কাছে চলিয়া আসিবে, কোনো ডিধা খরিবে না। ওয়েল বাবু, টোমার নাম কি আছে, ব্যান... ব্যানডো... না বাবু ইহা কঠিন আছে। আমি টোমার আর্জি শুনিলাম, তাই টোমার নাম হইবে ব্যান-আর্জি, টোমার নাম চ্যাট... চ্যাট্টা... না বাবু, ইহাও কঠিন, টোমার নাম চ্যাট-আর্জি, আর টুমি মুখ...মুখা... পাঢ্ঢায়...ইহাও চলিবে না। টোমার নাম হইবে মুখ-আর্জি।” “হুজুর, কিন্তু গঙ্গোপাধ্যায়ের কী হবে? ওতো গুলি বন্দুক নিয়ে...” “লেট হিম বি উইথ হিজ গ্যান অ্যাণ্ড অ্যাণ্ড খি বলিলে, ইয়েস, গুলি। উহাকে আমি গ্যান-গুলি বলিব। উহার আর্জি আমি শুনিব না।” নামচরিতমানস আপাতত এখানেই শেষ।