টান

​পায়ের কাঁচা আলতা শুকোনোর আগেই গোবর নিকোনো তকতকে উঠোনে মল্লিকা কয়েক পা ঘুরে নিল। লাল ছোট্ট ছোট্ট পায়ের ছাপ পড়ল সাদাটে উঠোনে, চালগুঁড়িতে আঁকা লক্ষ্মীপায়ের আল্পনার মতো।  

 উঠোন পেরিয়ে মল্লিকা এখন ওপাশের দাওয়ায় হেঁসেলের দরজায় দাঁড়িয়ে। শাশুড়ি একমনে রুটি বেলছে। মাটির উনুনে গনগনে লাল আঁচ। মল্লিকা জানে রুটিগুলো একটু মোটা হবে। মল্লিকার স্বামী নরেন আজ সপ্তার শেষে বাড়ি ফিরবে। রাতে পেতলের থালায় রুটি ছিঁড়ে পাতলা খেঁজুর গুড়ে ডুবিয়ে গালে ফেলে বলবে, "ইস, কী শক্ত!"

শাশুড়ি নাকি সুরে ফুঁপিয়ে বলবে, "তবু তো করিচি। কপাল! কোতায় এই বয়সে বেটার বৌয়ের সেবা পাব, তা নয়, খেটে মরতিচি।"

মল্লিকা দরজা থেকে সরে এসে দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে। আকাশে কড়ে আঙ্গুলের নখের মত একফালি প্রতিপদের চাঁদ। ওই মনে হয় ইস্টিশনে ট্রেন ঢুকল। 

মল্লিকার মনে আনন্দ পিঁড়ি পেতে বসছে। 

 ও বেলা বৃষ্টি হয়েছে খানিক।
 ...ছপ...ছপ...
এগিয়ে আসছে পায়ের শব্দ। মল্লিকার বুকে মাদল।

"মা-আ-আ", দরজা ঝনাৎ করে খোলে। 

"আসছি-ই-ই", নরেনের মা তড়িঘড়ি হ্যারিকেন নিয়ে দরজায়।

 মায়ের সঙ্গে  কথা বলতে বলতে উঠোনে এগিয়ে আসতে গিয়ে নরেন হঠাৎ থমকায়।

"মা...ওই দেখো। আবার।"

চমকে উঠে মা উঠোনের দিকে তাকিয়ে কাঠ। হ্যারিকেনের লালচে আলোয় এখন সেখানে স্পষ্ট আলতা পরা পায়ের ছাপ। ঘর থেকে সোজা হেঁসেলের দিকে।

মল্লিকা দাওয়ার অন্ধকারে নিজেকে মেখে নিয়ে জিভ কাটে, "ইস!"

''জলে ডুবে মরা। অপঘাত মৃত্যু। সে আমার সতী নক্কী বউ ছেল। তোর মায়া সে কাটাতে পারে?"

মল্লিকার কষ্ট হচ্ছে খুব। কেন সেদিন যে গিয়েছিল ওই পুকুরের মাঝখানের পানিফল তুলতে! কী যেন জড়িয়ে ধরল পায়ে...

"এবার গয়ায় পিণ্ডি দে বাবা।"

নরেনের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। একেবারে মুছে দেবে মল্লিকাকে? 

মল্লিকার বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। না আর ভুল নয়! আলতার ছাপ রেখে আর  উঠোনে নাচবে না। শুধু তো একটু চোখের দেখা। সেটুকু বন্ধ হলে...


"ওই দরজার পাশে দাঁড়াত আমার অপেক্ষায়, এখনো কি?" নরেনের চোখ শূন্য দাওয়ার দিকে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে অজান্তেই।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাসের হাহাকার নিয়ে বাড়ির পেছনের ঘোড়ানিম গাছের মিঠে হাওয়া অন্ধকার উঠোনে বয়ে যায়।

2 Responses

  1. Teesta Chakraborty says:

    মায়াজড়ানো লেখা। ভাল লাগল খুব।

  2. অরিজিৎ says:

    অসাধারণ। বেশ ভালো লাগলো।

বৈশাখী ২০২৪