জাদুকরী

বালিগঞ্জ গার্ডেন্স, কলকাতা

অনেকদিন আগে পালকদের উত্তর কলকাতার মামাবাড়িতে খুব যাওয়া আসা হত। সে বড়ো হই হট্টগোলের বাড়ি রে বাবা। সেখানে ইয়া ইয়া পিলার দেওয়া রোয়াক, তির্পূরণীর মাঠের মতো গাড়ি বারান্দা, সিঁড়ি দেওয়া খাট। সে সব ভারী গেরেম্ভরী ব্যাপার স্যাপার কিনা। ছুটি পেলেই তাই মা মাসিরা বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে সেখানে হাজির। থাকবেন, খাবেন, মাখবেন মাস ভর, তারই ঢালাই ব্যবস্থা করে রাখতেন পালকের দাদু-মেজদাদু-ছোড়দাদুরা। তিন মহলা বাড়িটাতে কত যে ঘর, বারান্দা, রোয়াক, দালান ছিল তা যদি গুনে শেষ করা যায়। 
পান্তো ঝি বলত, "ও মা গো, সকালে যতগুলো দরজা জানালা বন্ধ করি এ বাড়িতে, বিকেলে সে সব বেড়ে গিয়ে দ্বিগুণ হয় কী করে বল দিনি। এ বাড়ির জানালা দরজা গুনতে গুনতে আর বন্ধ করতে করতে আমার হাতের পায়ের নড়া ছিঁড়ে গেলো যে গা।" 
বইয়ের ঘর, গানের ঘর, ঘুঁটের ঘর, ভাঁড়ার ঘর, দক্ষিণের ঘর এ সব থাকা সত্ত্বেও পালককে ভারী টানে এই বাড়ির চিলেকোঠার ঘরখানা। সেই যে বাড়ির সবচেয়ে উঁচু মগডালে, সেই একটুকরো, একচিলতে ঘরখানা, যেখানে মায়ের আদুরী পিসি আর তার হরিমতি বেড়ালনী বাস করে। আদুরী পিসি পালককে আর তার মামাতো মাসতুতো ভাইবোনদের যে খুব আদরের চোখে দেখেন, তা নয়। বরং ওরা এলে পিসির একটু অসুবিধেই হয়। ওরা মানে চিংড়ি, ভোলা, বুলেট, পায়েস, লক্ষ্মী, পালকরা মিলে বড্ডো দাপাদাপি করে ওই ছাদের ওপরে। পিসির ঘুম চটে যায়, হরিমতীর এমন সাধের দিবানিদ্রা ভেঙে গেলে সে রাগে গোঁ গোঁ করতে থাকে। কিন্তু ছেলেপেলেরা কি আর তার জন্য খেলাধুলা, হট্টিচাল্লি, দুরন্তপনা বন্ধ করে?  
 
তা সেদিনও অমন ছাদে উঠেছে সব ক'টা মিলে। এখানে এক বাড়ির ছাদের সঙ্গে  পাশের বাড়ির ছাদ পরপর জোড়া। তাই ইচ্ছে করলেই এই ছাদ থেকে ওই ছাদে ছুটে চলে যাওয়া যায়। এমন করে প্রায় সাত আটটা বাড়ি পর পর। পালকদের হয় মজা। ধরাধরি খেলতে খেলতে এই ছাদ থেকে ওই ছাদে লম্বা দৌড় দেয় ওরা। তা সেদিন হল কী, এক নতুন খেলুড়ে এল ওদের দলে। বেশ গাল ভরা নাম মেয়েটির - ব্ল্যাক জুয়েল। এমন নাম পালকরা কক্ষনো শোনেনি। তাই ওদের খুব আগ্রহ হল ওর সঙ্গে ভাব করার।   
 
ওদেরই বয়েসি বলে ভাব জমল আরো। ও সব শেষ বাড়িটাতে বেড়াতে এসেছে। ধরাধরি খেলা চলছে সাত আটটা বাড়ির ছাদ জুড়ে। এ ওকে তাড়া করে ফিরছে। একবার বুলেট চোর হল তো সবাইকে তাড়া করে ছুটল। তারপর পালকের পালা। এইভাবে প্রবল হুল্লোড় চলছে ছাদময়। পালক হঠাৎ দেখতে পেল চিলে কোঠার একরত্তি জানালায় আদুরী পিসি আর তার বেড়ালনী বসে গোমড়া মুখ করে ওদের খেলা দেখছে। পিসির চোখে প্রবল রাগ আর ভর্ৎসনা। কিন্তু মুখে যেন একটা কেমন কৌতুকমাখানো ছেঁড়া জালের মতো হাসি। আদুরী পিসির দিকে তাকিয়ে একটুও ভালো লাগল না পালকের। মনটা অন্যরকম হয়ে গেলো আর তখনই ঘটল এক অদ্ভুত কান্ড। চিংড়ি তাড়া করেছে ব্ল্যাক জুয়েলকে আর ছুটতে ছুটতে ওরা যাচ্ছে শেষ প্রান্তে। অমনি সবাই ছুটতে লাগল সেই শেষ ছাদের উদ্দেশ্যে। আরে এ কী করছে চিংড়ি, ব্ল্যাক জুয়েল তো পড়ে যাবে ছাদ থেকে! কিন্তু কী এক তাড়া করার নেশায় পেয়ে বসেছে চিংড়িকে এক্কেবারে শেষ প্রান্তে আসার আগেই পালক টেনে ধরে চিংড়ির জামা কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে ... ব্ল্যাক জুয়েল বোধহয় পড়েই গেল নিচে। কিন্তু নাহ, তার চিহ্নমাত্র নেই। আরে এমন আবার হয় নাকি? একেবারে কর্পূরের মতো উধাও হয়ে গেলো মেয়েটা! ওরা চিন্তিত, নিচে গিয়ে বড়োদের ব্যাপারটা বলা উচিত। একটা জলজ্যান্ত মেয়ে এইভাবে উবে যাবে নাকি। যখন ফিরে আসছে, ওরা দেখতে পেলো আদুরী পিসি জানালায়। 
“হাহাহাহাহা হিহিহিহিহি কেমন মজা? আর ধরাধরি খেলবি ছাদে? ও হোহোহোহোহোহো। বুড়ির হাসি থামে না। “ওরে ও কি আর সত্যি সত্যি মেয়ে রে বাবা। ও যে আমার বানানো মায়া…ওকে খুঁজে পাবি কোথায় তোরা - হা হা হা হা হা।”
মায়া? মানে ম্যাজিক? কী বলে রে পিসিটা!
 
যাইহোক, নিচে গিয়ে সেই কথা বলতেই, বড়োরা তেমন পাত্তা দেন না। 
শুধু পান্তো ঝি চোখ গোল গোল করে বলে, “ওরে তোদের কদ্দিন বলেছি কি না, ছাদে যাবি নি? ওই বুড়ি জাদুকরী। সে কি আজকের কথা গো। সে আজ কত যুগ যে হয়ে গেলো,” বলেই ফোঁস করে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পান্তো। মন্মথ বুড়ো এ বাড়িতে আছে অনেককাল। তার বয়সের গাছপাথর নেই বলা চলে, হাতে পায়ে শেওলা ধরে গেছে। "রাখ দিকিনি পান্তো, ছেলেপেলেগুলো ভয় পেয়ে যাবে না? ও সব আকথা কুকথা ক্যান রে?” পান্তোর আরো কিছু বলার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সে চুপ করে যায় অমনি। 
 
সে রাতে দিম্মির বড়ো পালঙ্কে বিছানা হয়েছে বেশ। সব ভাই বোনেরা শুয়ে আছে পা গুটিয়ে, পাছে কেউ পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে যায়। এ সব ছোটোখাটো ভয়, ছোটরা বিশেষ করে পেতে খুব আমোদ পায়। এখন তো ঘরের নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপে, দিম্মির নরমসরম বিছানায়, সব ভাইবোনদের মধ্যে শুয়ে পড়া। ভয় সেঁধোবে কোদ্দিয়ে? তবু ওই ঐটুকু ভয়ের আশ্বাস যেন ভয়ের পাবার নেশাটাকে সাংঘাতিক বাড়িয়ে দিয়ে ঘুমের গভীর আবেশ এনে ফেলে। তখন দিম্মির পান জর্দা খাওয়া মুখ থেকে ভুরভুরে গন্ধ পেতে পেতে, স্বপ্নে ভাসতে ভাসতে পালক আর তার ভাইবোনেরা আদরের ঘুম যায় । 
 
এ সব তো গেলো ছোটো দের কথা। পালকের মধু মামীর কিছুদিন হলো ভারী এক অন্যরকমের অসুখ করেছে। রাতেরবেলাতে ঘুম তো আসেনা আর যদি বা একটু এল, অমনি কোনো কোনো বিশেষ রাতে, কিছুক্ষণ পরে ঘুম ভেঙে হাঁটতে শুরু করেন মধু মামী। মামা ঘুমোচ্ছেন সারাদিনের অনেক খাটাখাটনির পর, তাই কেউ খবর জানেই না। দুপুর রাতে কেউ ডাকে মামীর নাম ধরে, “মধু, ও মধুময়ী, বলি, রাত যে বয়ে যায়। এই বেলা আয়, আয়  রে, পহর যে বয়ে যায়।” মধু মামীর চোখ বোজা, কিন্তু সে হাঁটতে শুরু করে, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে সেই ডাক লক্ষ্য করে। এইভাবে মধু মামী গিয়ে পৌঁছয় ছাদে। আজ পূর্ণিমা। ভরভরন্ত চাঁদের বুক থেকে আলো এসে ভাসিয়ে দিয়েছে পৃথিবীকে। সারা ছাদ আলোময় আর সেই ছাদে কত পরির মেলা। সে যে কী অপরূপ দৃশ্য। মধুমামীর চোখ খোলা এখন। সেই পরিদের মাঝে ঐতো! আদুরী পিসিও রয়েছে। তারা সকলে মিলে মধুময়ীকে ঘিরে ঘিরে নাচতে থাকে। তাদের সাদা ডানা থেকে মুক্তোর মতো চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। তাদের নগ্ন শরীরের বিভঙ্গে চাঁদের আলো পড়ে তাদের কোনো আদিম দেবীর রূপদান করেছে। মেঘের আবেশ আর তারার সঙ্গীতে সে এক অন্যরকমের রাত। এমন রাত সচরাচর আসে না। মধুমামী নাচতে নাচতে আবেশে ঢলে পড়েছে যখন, তখন ভোর হয় হয়। 
 
পান্তো রাতে ঘুমোয় না এ বাড়িতে। মন্মথ ঝগড়া হলে ওকে বলে যক্ষী বুড়ি। 
"তুই এ বাড়িতে থেকে যাবি পান্তো। এ বাড়ি তোকে কব্জা করেছে, বেরোতে দেবে নে। মরেও ওই নিচের এঁদো কুঠুরিতে পচে মরবি তুই, দেখে নিস্।" তাতে কী? পান্তোর তো গতরাতেও ঘুম আসেনি। মধু মামী যেই হাঁটতে শুরু করেছে ছাদের দিকে, অমনি পান্তো উঠে গেছে, সিঁড়ি বেয়ে, মামীর পিছু পিছু। তখন গভীর রাত। বৈঠকখানা বড়ো ঘড়িতে ঠিক দুটো বেজেছে - ঢং ঢং। পান্তো ঠিক জানে, আজই সেই রাত। কোথায় সিঁড়িতে ঘাপটি মেরে বসে ছিল সে। সিঁড়ির জানালার সার্সি দিয়ে ফুটন্ত জ্যোৎস্না এসে পড়েছিল। আর ওপর থেকে ভেসে আসছিলো আদুরী পিসির ইনিয়ে বিনিয়ে ডাকা, “ওরে আয়, আয়  রে, কে কোথায় আছিস, পহর বয়ে যায়, এমন রাত বুঝি বয়ে যায় রে, ও মধুময়ী আয় আয় আয় .. । ” সত্যি অন্য কেউ হলে ভয় পেত, ঘরে গিয়ে দোর দিত। পান্তো সে কোন আদ্যিকাল থেকে এই বাড়িতে আছে কিনা তাই ওর ভয়ডর নেই। এ বাড়ির অন্ধিসন্ধি আগাপাশতলা ওর মুখস্থ। ও কেন ভয় পেতে যাবে। বরং এই সব ভয় ও তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করে। আর যে সব রাতে এ সব হয় না, সেই সব রাতে ভিতেও শুয়ে শুয়ে এই রাতের কথা ভেবে ভেবে ভয় পেতেই ভালোবাসে আর তখন ওই ভয়ের আবেশে ওর ঘুম এসে যায়। ঠিক যেমন ছেলেবেলায় দিদিমার কাছে জাদুটোনার গপ্পো শুনতে শুনতে ঘুম যেত পান্তো বুড়ি । 
 
তাই গতরাতে যখন মধু মামী ছাদের 'পরে ঘুমিয়ে পড়লেন, আর বুড়ি আদুরী তার মায়াজাল গুটিয়েশুটিয়ে চিলেকোঠাঘরে উঠতে যাবেন, তখনি খপ করে গিয়ে তার হাত ধরে ফেলে, পান্তো। 
"বলি, ও বুড়ি, এত্তদিন গেলো তোমার নেশা কাটলো নি? হাঁ গো? ছেলেপেলেদের ভয় দেখালে, বৌটাকে এমন করে ডেকে নিয়ে আসো - কেন গা? তোমার কি কাজ নেই?"
এবারে চমকে গেলো আদুরী পিসি, "আহ পান্তো, কী করিস, হাত ধরিস কেন? মরণ আমার। যাহ পালা, বৌটাকে নিয়ে যা নিচে, ও ডাকলেই উঠবে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গিয়ে শোবে 'খনে নিজের ঘরে আবারও। যা যা জ্বালাসনে বলছি আমায় আর।" 
পান্তোও কম যায় না। সেও যাবে না কিছুতেই। বললো, "বলো আর জাদুটোনা হারিকিরি করবে না? এ তোমার নেশা গো। এমন করে বিপদ ঘনাবে একদিন দেখো।" 
আদুরী তখনকার মতো কথা দিলো বটে। বললো, "আচ্ছা যা তো, সে হবে 'খনে । "
পরের দিন বিকেলে পালকরা যখন খেলতে গেল, ওরা দেখলো একটা ছোট্ট কাঠবেড়ালী পুটপুট করে তাকাচ্ছে ওদের দিকে। তার চোখদুটি অনেকটা ব্ল্যাক জুয়েলের চোখের মত। হবি তো হ, মধুমামীকেও হঠাৎ পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ খোঁজ। কোথায় যাবে? ওর তিনকুলে কেউ ছিল না। থানা পুলিশ। খোঁজ জারী আছে। পান্তো গলা খাটো করে মা মাসিদের কাছে বললো, বাড়িতে নাকি একটা নতুন গোলা পায়রার আগমন হয়েছে। পান্তোর বিশ্বাস সেইই নাকি মধুমামী। পরে গলা উঁচু করে বলল, “এ সব কার কারসাজি, পান্তো জানে গো । " 
"কার? কার?" সকলের প্রশ্ন সমস্বরে। 
"জাদুকরীর।" বলে ওঠে পান্তো হিলহিলে গলায় ।

বৈশাখী ২০২৪