রুহু আর কুহু

মাহেশ, হুগলি


কুহু আর রুহু দুই বন্ধু। যেমন তেমন বন্ধু নয়, এক্কেবারে প্রাণের বন্ধু যাকে বলে! ওরা দুজনে একটা ছোট্ট বাড়িতে থাকে! সেটা কোথায় জানো? সেএএই যে…না না, কোন অজ পাড়াগাঁয়ে না। খাস কলকাতার বুকেই। দেখতে পাওনি তো? তা দেখবে কী করে? ওদের দিকে কী আর চোখ যায়?
 
আচ্ছা, মা ফ্লাইওভার দিয়ে সাঁইসাঁই করে ছুটন্ত গাড়িগুলোর আশপাশ দিয়ে গজিয়ে ওঠা উঁচু উঁচু অহঙ্কারী বহুতলগুলোকে দেখেছো? খুঁজলে পরে দেখতে সেই অট্টালিকাগুলোর মধ্যেই এক কোণে বেশ ছোট ছোট দুঃখী দুঃখী মুখের তিন চারটে বাড়ির বাস। তা বাড়িগুলো অমন দুঃখী দুঃখী মুখের হলে কী হবে, ওখানকার লোকগুলো কিন্তু ভারী আমুদে! ওরা যেন কেমনধারা! চালচুলো নেই, টাকাপয়সাও বোধহয় নেই বিশেষ; তবু সারাদিন সবাই মিলে হুল্লোড় করে! রাত হলে একসঙ্গে খায় আর তারপর একে অপরের চাতালেই আড্ডা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়ে। এমনই একটা বাড়িতে থাকে রুহু আর কুহু।
 
মজার কথা হল, কুহু যে থাকে সেটা সবাই জানে! কিন্তু রুহু ছাড়া তাকে কেউ কখনো চোখেই দেখেনি। দেখবে কী করে? কুহু তো একটা ছোট্ট ভূতু। এই রুহুরই সমবয়সি হবে! সে এখানে এল কী করে? সে অনেককাল আগের কথা! তখনো কলকাতা ঠিক উন্নত শহর হয়ে ওঠেনি। একবার তাদের এলাকায় ওলাউঠো হয়ে গোটা এলাকা উজাড় হয়ে গেল। তা মরে গেলে সগগে যেতেই হয়, কুহুও যাচ্ছিল! কিন্তু গোল বাধল চিত্রগুপ্তের দরবারে। কুহু বেচারি কিছুতেই সেই ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতে পারে না! সবাই অবাক। এমন হবার তো কথা নয়! ভূত তো এমনিই দরজা টপকে ঢুকে যাবে, এ পারে না কেন?
 
অনেক জাবদা খাতা টাতা ঘেঁটে বেরোল যে কুহুর জন্মটাই হয়েছে ভুল। কোন এক বেয়াড়া দেবদূত অন্য বাচ্চার বদলে দিয়েছে কুহুর আত্মাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে! দেখেছো কী কেলেঙ্কারি কান্ড? কিরকম আখাম্বা জায়গা বলো দিকি, কাজের কোন একটা ছিরিছাঁদ নেই? এদিকে কুহুর বাড়ীর লোক সব সগগে চলল, আর কুহু পারল না! সে কত কাঁদল, অনুনয় করল! কিন্তু ওই নীরস বুড়ো চিত্রগুপ্তের মাথায় ঢুকলে তো! সে বেমালুম টাক চুলকে, কানে পেন্সিল গুঁজে, ভুঁড়ি বাজিয়ে জানিয়ে দিল আরো দুশো বছর কুহুকে এই পৃথিবীতেই থাকতে হবে, তারপর তার সগগের টিকিট জুটবে! অগত্যা আর কি করা! অনাথ শিশুটা রয়ে গেল নিজের বাসভিটেতেই। কালে কালে কত লোক এল গেল, সমবয়সি ছেলে বা মেয়ে পেলে ভাব করার চেষ্টা করত। কিন্তু সবাই ভয়ে পালাত। ভূতকে কে না ভয় পায়? শেষমেশ একদিন এই মেয়েটা এল।
“এই, তুই কে রে? আমদের বাড়িতে কী করছিস?” লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল কুহুর দিকে। কুহু এত অবাক হয়েছিল যে পাক্কা এক মিনিট কোন কথাই বেরোয়নি!
“তু…তু…তুমি আমায় দেখতে পাচ্ছো?”
“হ্যাঁ, দেখতে কেন পাব না? কিন্তু তুই আমাদের বাড়িতে কী করছিস?”
“আ…আ…আমি…মানে”
“চুরি করতে এসেছিস? চোখটা সরু হয়ে ওঠে কিশোরীর, “দাঁড়া, মা’কে ডাকবো?”  তারপরই নজর পড়েছে কুহুর মলিন পোষাকের দিকে। “তোর বুঝি খিদে পেয়েছে? এই নে, পেয়ারা খাবি? আমার নাম রুহু, তোর নাম কী? অনর্গল বকে যেতে থাকে মেয়েটা। এবার হেসে ফেলে কুহু।
“আমার নাম কুহু! পেয়ারা খেতে তো ভালই লাগে, কিন্তু খাই কী করে? আমার তো ক্ষিদে পায় না!” 
“ক্ষিদে পায় না? এ আবার কেমনধারা কথা?”
“পাবে কী করে? আমি তো ভূত!”
রুহুর চোখটা গোল হতে হতে ছানাবড়ার মত হয়ে গেল! তারপরই খিলখিল করে হেসে উঠল!
“ভূত? হি হি হি! ওইজন্য বুঝি সবাইকে টপকে ঘরে ঢুকেছিস?”
“টপকে ঢুকবো কেন? আমি তো এখানেই থাকি! তোমরাই তো হঠাৎ…এই তোমার ভয় লাগছে না?”
“ভয়? না, ভয় লাগবে কেন?”
“ওমা, জলজ্যান্ত একটা ভূত দেখে তোমার ভয় লাগছে না?”
“হিহিহি, না! আমি আগেও তেনাদের দেখেছি। ও আমি ঠিক বুঝতে পারি কে ভাল আর কে খারাপ! আচ্ছা কুহুভূত, তুই আমার বন্ধু হবি?”
তো এই করেই রুহু আর কুহুর বন্ধুত্বের শুরু। বেশ খুশিতেই ছিল সবাই মিলে, কিন্তু ইদানিং যেন গোল বেধেছে! সব লোকগুলোর মুখ ভার, যেন দুনিয়ার বোঝা বইতে হচ্ছে তাদের। রুহুও আর আগের মত হাসে না।
“কী হয়েছে? বল না রে!” বারবার অনুনয় করে কুহু, রুহু কিছুই বলে না। ছলছল চোখে বসে থাকে।
“আমরা এখান থেকে চলে যাবো রে!” অনেকক্ষণ পর বলে ওঠে বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে।
“চলে যাবি? সে কী? কেন? কোথায়?” কুহু বুঝে উঠতে পারে না। তার বন্ধু তাকে ছেড়ে যাবে কেন?
“গ্রামে ফিরে যাব। এই যে কঠিন রোগটা হয়েছে পৃথিবীতে তারপর থেকে তো বাবাদের কাজগুলো আর নেই। এখানে ঠিকমতো খাওয়া জোটে কই? তাছাড়া বাবা বলেছে এটা যার জমি সে কোন ব্যবসায়ীকে বেচে দিয়েছে! আমাদের ঘর খালি করে দিতে হবে! নাহলে তার গুন্ডারা এসে তাড়িয়ে দেবে!”
“এহ, তাড়িয়ে দিলেই হল নাকি? আমি কিছুতেই তোকে যেতে দেব না!”
“তুই কী করবি? তোকে তো কেউ দেখতেই পায় না!” 
“তাতে কী? আমি ভূত না? আসুক না গুন্ডা, আমি ওদের এমন ভয় দেখাব!” দাঁত কিড়মিড়িয়ে রুহুকে জড়িয়ে ধরে থাকে কুহু।
 
যেমন কথা তেমনি কাজ। পরের দিন যথা সময়ে ব্যবসায়ীর গুন্ডারা এল। তার আগেই কুহু সেজেগুজে তৈরি! কিন্তু সমস্যা হল, সে তো ছোট্ট একটা ভূতু। জীবনে কাউকে ভয় দেখায়নি। এখন একটা গুন্ডাকে কাবু করবে কী করে! সে যাই করে কিছুতেই কিছু হয়না। টিভি সিনেমায় দেখা যা যা কারসাজি সে জানে সবই চেষ্টা করল! কখনো একটা বল নিয়ে তাদের সামনে নাচায়, তো কখনো একটা মোমবাতি হাওয়ায় উড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু দিনের আলোয় মোমবাতি উড়িয়ে কি কেউ ভয় পায়? উলটে সেসব দেখে গুন্ডাদের কী হাসি! কেউ খি খি করে হাসল, কেউ হাসলো হ্যা হ্যা করে! দুজন তো হেসে গড়িয়েই পড়ল। তাদের সর্দারটা আবার ভাবল এসব বাড়ির বাচ্চাদের কারসাজি! তাই রুহুকে সামনে পেয়ে তার কানটাই দিল আচ্ছা করে মুচড়ে! এই না দেখে কুহুর তো বিষম রাগ উঠেছে। আর রাগের চোটে সে কেঁদেই ফেলেছে! ব্যাস, যেই না কাঁদা, ওমনি টপাং করে গুন্ডাদের সর্দার, “ওরে বাবারে, গেলুম রে, মেরে ফেলল রে” বলে বসে পড়েছে! তারপর উঠেই দেখে তার পিছনে অ্যাব্বড় একটা ন্যাজ। তাই তো? কি করে হল? মানুষের ন্যাজ গজালো কী করে?  
 
আসলে হয়েছে কী, ঠিক সেই সময়ে বহুদিন পর পরিদের রানি হীরামণি বন্ধু রণিলকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন নিজের গাজরক্ষেতের তদারকিতে। হঠাৎ আকাশ থেকে কুহুর কান্না শুনতে পেলেন। ভূতুবাচ্চারা আবার পরিরানির হেবি পেয়ারের কিনা, তাই তাদের কান্না তিনি মোটে সইতে পারেন না। 
“কই রে, দূরবীনটা দেখি তো আমার!” রণিলের থেকে দূরবীনটা নিয়ে ভাল করে পরখ করেন তিনি। তখনই গুন্ডাগুলোর দিকে নজর পড়েছে!
“তবে রে! দুধের শিশুকে কাঁদানো!” বলে যেই না নিজের জাদুদন্ডটা পৃথিবীর দিকে তাক করেছেন, অমনি তো সব গুন্ডাদের হাল খারাপ! সর্দারের ন্যাজ গজাল, তার ডান হাত কালুয়ার নাকটা হয়ে গেছে খরগোশের মত। পাঁচু মস্তান দেখে গাধার মত দুটো কান গজিয়েছে তার। কোত্থেকে যে কী হল কিছুই বুঝতে পারল না কেউ, খালি গুন্ডাগুলো “ভূউউউত…ভূউউত…” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল!
তারপর?
তাপ্পর আবার কী? রুহু আর কুহু তাদের পরিবার সমেত নিজেদের বাড়িতে আনন্দে থাকতে লাগল।
আমার কথাটি ফুরল,
নটেগাছটি মুড়োল!

বৈশাখী ২০২৪