ভয় নেই

কাঁচরাপাড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা

স্কুলের শেষ ঘন্টাটা ঢং ঢং করে বেজে উঠতেই আজকাল আমার বুকের মধ্যে যেন ঢেঁকির পাড় শুরু হয়... কোথায় জানি না একটা কিছু গুঁড়ো গুঁড়ো হতে হতে এই এতটুকু হয়ে আমূল বিঁধে যায় বুকের একেবারে মাঝখানটাতে! 
কী যে একটা অবশ করা অনুভূতি আমাকে ধীরে ধীরে পেয়ে বসে, সাইকেলে চেপে রণিতা, রিমা আর অণিমার সঙ্গে বাড়ির দিকে যত এগোতে থাকি ততই মনে হয় আমি যাব না! কিছুতেই যাব না! মনে হয় সাইকেলটা ফেলে পালাই... অনেক দূরে... অনেক অনেক দূরে! 
মোড় ঘুরে দুলিরঘাটের পোলের দিকে রিমা আর অণিমার এগিয়ে যাওয়া, রণিতার সোজা বাঁশতলা পেরিয়ে বাড়ির দিকে চলে যাওয়া আমি এক মনে দেখতে থাকি... দেখতেই থাকি! যতক্ষণ না ওরা পুরোটা মিলিয়ে যায়...  

বাড়ি ঢুকেই আমাদের বাগানের পুরোনো রংচটা টিনের দরজাটা ঠেলে দিয়েই বাঁ-পাশের ঘাস জমির ওপর স্ট্যান্ড করে রাখা লাল রঙের বাইকটা আছে কিনা দেখে নিই একঝলক, ওটা যেদিন না থাকে মনে কেমন একটা ফুরফুরে স্বাধীন ভাব এসে যায়! ঝমঝম করে সাইকেল রেখেই একছুটে চলে যাই মোটা কালো কাঁচ ঘেরা আমাদের বিরাট বারান্দার দিকে, অভ্যস্ত কায়দায় খুলে ফেলি বারান্দার হাঁসকল তারপর পরম নিশ্চিন্তে ডাকতে থাকি, “টুসি! টুসি!” 

 স্কুল থেকে ফিরে রোজই মাকে দেখতে পাই রান্নাঘরের পাশের ছোট্ট বসার ঘরটায় একমনে বসে বসে ছুঁচের কাজ করছে, একটু একটু করে নানান রঙে সেজে উঠেছে মস্ত একটা কার্পেট। খানিকক্ষণ তন্ময় হয়ে মায়ের হাতের কাজ দেখতে দেখতেই আমার ঠিক পাশটাতে ঘন হয়ে দাঁড়ায়...টুসি, আমার পুঁচকি ছোটো বোন। 

টুসির আদুরে ডাকে সাড়া দিতেই মায়ের চটকা ভেঙে যায়, “মাম্পি! কখন এলি মা? খেয়াল-ই করিনি সাড়ে চারটে বেজে গেছে। আয় আয় তোকে খেতে দিই!”  

আমার মা এমনই, খানিকটা অগোছালো। সময় টময়ের ধার না ধারা হ্যাত ক্যাত হীন একটা মানুষ! কেমন যেন অন্যমনস্ক, কখনো সাজগোজ করে না। ভালো শাড়ি পরতে তো মাকে আমি কস্মিনকালেও দেখিনি। ঐ সেলাই আর সংসার! রান্নাবান্না আর কাজকর্ম নিয়েই মায়ের সকাল থেকে সন্ধে কীভাবে যেন কেটে যায়। 
  
আমি মাম্পি, ভালো নাম বন্দিতা, ক্লাস টেনে পড়ি। আমার বোন সঙ্গিতা- টুসি, সবে চার বছরের। আমাদের বাড়ির মোট সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। আমি বোন মা ঠাকুমা আর... বাবা! এই অবধি সব ঠিকঠাক। তারপরেই কেমন যেন শিউরে উঠি! 

মায়ের বেড়ে দেওয়া ভাত, কাতলা মাছের ঝোল আর ফুলকপির তরকারি খেতে গিয়ে ওক করে খানিকটা বমি উঠে আসে! ভাতের থালায় একঝলক থকথকে ঝোল মাখা ভাতের দলা ছিটকে পড়ে। বেসিনে দৌড়ে গিয়ে গদ গদ করে উগরে দিই ভাত, মাছ, ফুলকপি। মা, হাঁ হাঁ করে ছুটে আসে। পিঠে মাথায় হাত বোলাতে থাকে, আমি হঠাৎ বমির দমকে হাঁপাতে থাকি। নাল ঝোল মাখা মুখে জলের ঝাপটা দিতে থাকে মা। টুসি ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয়। তখনই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে ঠাকুমা, “আবার কী হল রে বনি?” 
তারপর শাড়ির আঁচলে মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, কী হল তোর? ইস্কুলে আজ নিশ্চয়ই ঐ পচা আলু কাবলি আর টক আচার খেয়েছিস? 
আমি মাথা নেড়ে না বলতেই ঠাকুমা আদর করে জড়িয়ে নেয় আমাকে। মাকে বলে, “শর্মি আজ আর ওর ভাত খেয়ে কাজ নেই আমার কাছে একটু শুয়ে থাকুক, সন্ধেবেলায় খোকা ফিরলে তুমি যখন চা জলখাবার করবে তখন বরং ওকে খেতে দিও।”

ওপরে ঠাকুমার এই একটেরে লাল মেঝের ঘরটা আমার খুব ভালো লাগে, মস্ত খাটের মধ্যিখানে বালিশ নিয়ে চুপ করে  শুয়ে পড়ি ঠাকুমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আহ! কী শান্তি! চোখে একটা পাতলা সরের মতো ঘুম ভেসে বেড়াতে থাকে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না! একটা মিষ্টি গন্ধে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যায়। টুসির নরম হাতটা আমার পিঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে টের পাই, খপ্ করে ধরব বলে হাত বাড়াতেই একটা লোমশ ভারি হাত আঁকড়ে ধরে আমায়... ছট্ ফট্ করে উঠি আমি। মুহূর্তে একটা চিৎকার গলা অবধি উঠে এসেই থেমে যায়। ভারী থাবাটা শরীরের যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় অবাধে, আমি কিছুতেই বাধা দিতে পারি না! শুধু, আমার দুচোখ বেয়ে নেমে আসে গরম স্রোত,  ঠিক কতটা সময় পরে জানি না একটা সময় আমাকে ছেড়ে দিয়ে একরাশ অন্ধকার ধুপধাপ শব্দে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়...  

  তখুনি, ঠিক তখনই, এক হাতে ধূপ অন্য হাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে মা এ ঘরের পাশ দিয়ে ঠাকুর ঘরে যেতে যেতে বলে যায়, “মাম্পি! আর কত ঘুমোবি? ভর সন্ধ্যে বেলায় এরকম পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস দেখে তোর বাবা কী রাগ করছেন জানিস?” 
টুসি এতক্ষণ আমার পাশে শুয়ে সবটুকু দেখছিল। এবারে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “বাবা খুব পাজি! তোকে ব্যথা দেয় দিদি!”
আমি কাঁদতে থাকি। হু হু করে কান্না আমার বুক ঠেলে উঠে আসে। টুসির ছোট্ট মুঠোয় ঘামতে থাকে আমার হাত!

মা আর ঠাকুমার পাশে বসে দুধ রুটি খাচ্ছি, ঘড়িতে বোধহয় সওয়া দশটা বাজে। টুসি তো কোনকালেই ঘুমিয়ে পড়েছে, একটা কর্কশ চিৎকার কানে এসে লাগে, “রাত এগারোটা বাজতে চলল এখন ও খাওয়া দাওয়া শেষ হল না? এরপর আর কখন অঙ্ক নিয়ে বসবি? সামনে না তোর টেস্ট পরীক্ষা!”
একটা উন্মত্ত জানোয়ার যেন খিদের জ্বালায় চেঁচিয়ে ওঠে। আমার হাতে ধরা দুধের বাটি থেকে দুধ চলকে যায়! ঘামতে থাকি আমি, ঠাকুমা এবার গলা তোলে, “কী যে তোর খোকা রাত দুপুরে অঙ্ক করানো! সেই সক্কালে ওঠে মেয়েটা আজও স্কুল থেকে ফিরে কী বমিটাই না করল! আজ থাক অঙ্ক মঙ্ক!”
মা, কেমন ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে থাকে আমার মুখের দিকে। আমি মুখ নিচু করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকি। 

 এখন অনেক রাত, নোংরা ছবিগুলো দেখতে দেখতে কেমন যেন শরীর পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছিল, চোখ দুটো জ্বলে যাচ্ছে। অথচ আমার পাশে-ই কেমন আরামে একটা ভয়ংকর রাক্ষস  আমাকে পিষে দলে নোংরা করে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। আর আমি তিল তিল করে মরে যাচ্ছি! সত্যি মরে যাচ্ছি আমি! সারা শরীরে কী অসহ্য যন্ত্রণা! ঠিক করে হাঁটতেও কষ্ট হয়। তবু, কাউকে কাউকে বলতে পারি না আমি! কে বিশ্বাস করবে আমায়? কাকে বলব আমি? রণিতাকে ? রিমাকে? নাকি আসমাকে? সিক্তাম্যামকে বলব? যূথিকাম্যাম বিশ্বাস করবেন আমার কথা? আমি জানি কেউ শুনবে না! কেউ না! মা-ই যখন শুনল না! সেই প্রথমদিন-ই  তো মাকে বলেছিলাম, দেখিয়েছিলাম বুকের পেটের কালশিটেগুলো... মা শুধু বুকে জড়িয়ে কেঁদেছিল আর ফিসফিস করে বলেছিল, “কাউকে বলিস না মাম্পি! চুপ একদম চুপ!” 

আজ একুশে নভেম্বর, মাধ্যমিকের টেষ্ট পরীক্ষার শেষ দিন। কী পরীক্ষা যে দিয়েছি এবার  নিজেই জানি না! রণিতার পরীক্ষা ভীষণ ভালো হচ্ছে টের পাচ্ছি। প্রতিবার আমার আর রণিতার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম লড়াই থাকে, অথচ এবার আর কিচ্ছু নেই! কী করে থাকবে? আমি যে তলিয়ে গেছি অতল জলের ভেতর। 

অঙ্ক প্রশ্নটা হাতে পেয়েই কেমন যেন মাথাটা ঘুরে গেল। সারি সারি সংখ্যার জায়গায়... অসংখ্য নোংরা ছবি, চুলের মুঠিতে টান, ভারী একটা শরীরের নিচে পিষে যেতে যেতে উরু সন্ধিতে অসম্ভব ব্যথা নিয়ে বিরাট একটা নাগরদোলায় উঠছি আর নামছি, নামছি আর উঠছি... 
হঠাৎ দুটো লোমশ থাবা আমাকে ঠেলে ফেলে দিল। অনেক অনেক নিচে পড়ে যাচ্ছি আমি... 

মা কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, ঠাকুমার কোলে টুসি। বড়দি মাকে কী যেন সব বলছে। অপরাধীর মত মা মাথা নিচু করে বসে আছে। বড্ড গম্ভীর আমার ঠাকুমার  মুখ, টুসির ভিতু অসহায় দৃষ্টি কেমন যেন এলোমেলো হাওয়ায় উড়ে উড়ে পাক খাচ্ছে আমার চারপাশে... কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না আমি, শুধু গভীর  ঘুমে চোখের পাতা দুটো যেন বুজে আসতে চাইছে আমার! 
দীপালিদি আমার পিঠে হাত রেখেছেন, শিবানীদি, অন্তরাদি , মিতা ম্যাম, অনসূয়া ম্যাম সকলে অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে  বুঝতে পারছি। সবাই কি তাহলে সবটুকু জেনে ফেলেছে? সব কিছু? কী হবে এবার? আমি যে নোংরা একটা মেয়ে... ভীষণ ভীষণ নোংরা মেয়ে! দিদিরা কি আমাকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবেন? তবে কি আমার আর মাধ্যমিক দেওয়া হবে না? 

উফ! মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে! আর যে পারছি না আমি! মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট চিৎকার বেরিয়ে এল, “মাগো!” চেয়ার থেকে বোধহয় পড়েই যেতাম, বুকে জড়িয়ে নিলো কে যেন আমাকে! কে? ঠাকুমা? ঠাকুমার বুকে মাথা গুঁজে দিয়েছি আমি... আহ! কী শান্তি! কী আরাম! 
 আমার মাথায় হাত বুলোচ্ছে ঠাকুমা, বলছে, “ওঠ বনি, পুলিশের কাছে যাব আমরা! এখুনি থানায় যাব! ঐ নরপশুটাকে কি সহজে ছেড়ে দেব ভেবেছিস? চল্! ওঠ!”

 ঠাকুমাকে শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে ধরেছি আমি, শিরা ওঠা খরখরে শুকনো হাতটা ধরে কেমন একটা জোর পাচ্ছি যেন! ভাবছি, আগে কেন বলিনি ঠাকুমাকে? কেন বলিনি দিদিদের? কীসের ভয় ছিল আমার? কীসের? 

স্কুলের বাইরে বেরিয়ে এসেছি আমরা, ভিড় করে দেখছে আমাকে সকলে। স্কুলের সিঁড়ি, করিডোর,ক্লাস রুমের বাইরে অসংখ্য মেয়ে... সকলে একদৃষ্টিতে দেখছে আমাকে! কই আমার তো আর একটুও লজ্জা করছে না! একটুও না! শুধু মনে হচ্ছে আমার সঙ্গে সবাই আছে! সব্বাই। আমার ভয় কীসের? কোনো ভয় নেই! কোনো লজ্জা নেই!

বৈশাখী ২০২৪