জল-আতঙ্ক

দাশনগর, হাওড়া

রমা অনবরত চিমটি কেটে চলেছে। আমি মটকা মেরে পড়ে রয়েছি বিছানায়। কোথায় সকালবেলা বউয়ের নরম হাতের স্পর্শে ঘুম ভাঙবে, আমি আড়মোড়া ভেঙে আলগা আদরে তাকে জড়িয়ে নেব, তা নয় চিমটির জ্বালা-ধরানো স্পর্শ। এভাবেই আমার বউ উসকে দেয় আমার ভয়কে। 
আমি সজল মজুমদার। বনদপ্তরের কর্মী। সদ্য বিবাহিত, চাকরিপ্রাপ্ত। হিমাচলপ্রদেশের একটি পাহাড় ঘেরা জঙ্গলে আমার পোস্টিং। কর্মে বন-জঙ্গল থাকলেও বন্য হওয়ার ব্যাপারে আমার একেবারেই সুনাম নেই। আর হবেই বা কী করে, সারাক্ষণই তো একটা ভীতি লাল-পিঁপড়ের মত কুটকুট করে কামড়ায়। ব্যাপারটা খুলেই বলি। দু'মাসের বিবাহিত জীবনে একটি জিনিস আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। ভয়। উঁহু! বউকে আমি মোটেই ভয় পাই না। তবে একটি বিষয়ে তার তীক্ষ্ণ নির্দেশকে রীতিমত সমঝে চলি। সেই বিষয়ে নির্দেশ যখন আসে তখনই ভয়ে আমার পেট গুড় গুড় করে। এই ভয় আমার ছেলেবেলা থেকেই ছিল, তবে তার সঙ্গে এমন বিভীষিকাময় দিন-যাপনের গল্পটা শুরু থেকেই বলি। বিয়ে করেই সদ্য পোস্টিং পেয়ে এখানে এসেছি। শীতকালে বিয়ে করা বাঙালির প্যাশন। আমিও ২৮টি বসন্ত একা পার করে বনদপ্তরের চাকরিটি বাগিয়েই জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর কাজটি করে ফেললাম। রমার সঙ্গে বিয়ের পর নিজের চাকরিক্ষেত্রের পোস্টিংটাও জুটে গেল তাড়াতাড়ি। জায়গার নাম দেখেই রমা তো তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছিল। এদিকে আমার ভেতরে তখনই ভয়-পোকার কামড় শুরু হয়েছে। প্রাকৃতিক নৈসর্গের দিক থেকে হিমাচলপ্রদেশের তুলনা নেই। কিন্তু প্রায় সারা বছরই শীত এখানে অহংকারের সঙ্গে রাজত্ব করে। এখানেই ভয়! নতুন বিয়ে করা বউ, ঠাণ্ডার জায়গা, নরম তুলতুলে লেপের মধ্যে বউয়ের উষ্ণ পরশের বাসনা যে আমারও ছিল না তা নয়, তবে সঙ্গে ছিল একটি ভীতি। যার নাম জল-আতঙ্ক। 
আজ্ঞে না, কোন চারপেয়ের কামড়ের ভয় নয়, হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় স্নানের ভয়!
 এ ভয় আমার ছেলেবেলা থেকে সঙ্গী। মায়ের বকুনি, বাবার খেদানি সব আমি বিরসবদনে উপেক্ষা করে গেছি, কিন্তু শীতকালে সপ্তাহে তিন থেকে চার দিনের বেশি স্নান করিনি। কলকাতায় এখন শীতকালের উপস্থিতি আর শহরের রকে চু-কিতকিত খেলার অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। তাই কোনো মতে ওই কয়েকটা মাস কাটিয়ে দিতে পারলেই ল্যাটা চুকে যেত। তবে ওই কয়েকটা মাস বাড়িতে পারফিউম ছাড়াও নানান গন্ধ উড়ে বেড়াত। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। পাড়ার ভোঁদার দোকানের সুগন্ধিদের গতি হতো আমাদের বাড়ি। নিজের পোস্টিংয়ের অর্ডার কপিটি দেখার পর এই জল-আতঙ্ক বা স্নানভীতিটি কুরে কুরে খাচ্ছে। বউকে কিছুই বলিনি! বউটি আমার ডাকাবুকো, কোনো বিষয়েই ভয়ের লেশমাত্র নেই , তাই ভয়ের মাথা, হাত, কান, পা সব খেয়েও কিছুতেই বলতে পারিনি জল-আতঙ্কের কথা।

হিমাচলে আসার পর দিন থেকেই এই ভীতি বেশ জোরের সঙ্গে আমার উপর চেপে বসেছে। এদিকে অফিসের বস আমায় দিয়েছেন লম্বা ছুটি। পাহাড়ি জঙ্গল, আকাশ দেখতে দেখতে বউয়ের সৌন্দর্যে বিগলিত হব আমি এই নাকি অফিসের তরফ থেকে আমায় দেওয়া উপহার। এদিকে গলা টলা তো দূরের কথা, বউ পারলে আমার গলা টিপে দেয়, কারণ! স্নান! 

এখানে আসার পরের দিনই ঘটনাটা ঘটল।

সকাল সাতটা বাজলেই আমার মন আবার চা-চা করে ডেকে ওঠে। বৌ না-চার দলে। বউয়ের হাতের পরশ চায়ে মিলবে না জেনেই, ঘুম থেকে উঠে নিজের হাতেই কাজটি করতাম। মানে চা তৈরি। তা সে চা গলাধঃকরণ করতে করতেই শুরু হয় চাপ। চায়ের সঙ্গে আমার চাপের সম্পর্ক সমানুপাতিক। কীসের চাপ? ওই যে চাপ সময়মত না এলে আমরা মাথা খুঁটে মরি! একদিকে গরম চা আমার গলায় সুড়সুড় করে নামে, অন্যদিকে পাকস্থলী ছাড়িয়ে চাপ এগোতে থাকে। চায়ের কাপ রেখে পড়ি-কি-মরি করে আমি দৌড়েছিলাম সেদিন বাথরুমে। আমার বউ বোধহয় তখন সবে আড়মোড়া ভাঙছে। আমি বাথরুম থেকে বের হতেই চোখাচোখি। এখানেই হয়তো আপনাদের মনে স্বামী-স্ত্রীর আদ্যোপান্ত একটি প্রেমময় মুহূর্তের চিত্রকল্প ভেসে উঠবে। নতুন বউ, সকালের প্রথম দেখায় পূর্ব রাতের সোহাগের অভিব্যক্তি ফুটে উঠবে দুজনের চোখে। এমনটা শুধু আপনি নয়, আমিও ভেবেছিলাম। আর ঠিক এইখানেই মারাত্মক ভুল করেছিলাম। আমার মনে একদিকে স্নানের ভয়, অন্যদিকে মনোরম সকালে নতুন বউকে কাছে পাবার বাসনা কিলবিল করছে। শুধু ও প্রান্তের একটু ইশারার অপেক্ষা!

কিন্তু কী হলো তারপর? প্রাতঃকৃত্য সেরে বেরিয়ে প্রথম চার চোখের মিলন হওয়ার পরেই নজরে পড়ল বউয়ের তীক্ষ্ণ তর্জনী যা পুনরায় একটি দিক নির্দেশ করছে। আবার বাথরুমের দিকে যাওয়ার আদেশ দিচ্ছে। তবে কি সকালের কর্মের কোন নিদর্শন কোথাও তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে! ইশ! নতুন বউয়ের কাছে মান-ইজ্জত থাকবে না আর! নিজেকে আপাদমস্তক পরীক্ষা করছি, এমন সময় গুরুগম্ভীর গলায় সে বলে উঠল,  ''একি স্নান না করেই বেরিয়ে এলে যে! সকালের কাজ সারার পর স্নান না করে ঘরে ঢুকে পড়বে! এ যে ভারী বেনিয়ম!"
''ইয়ে... মানে, এত সকালে, আর গতকালই তো বাড়ি থেকে স্নান করেই...আর আজ এমন হাড় কাঁপানো ঠান্ডায়...''
ভয়ে আমার দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। আমি আমতা আমতা করছি। কিন্তু সব কথা শেষ করতে পারিনি। বউয়ের কাজল কালো চোখ মুহূর্তের মধ্যে রক্তাভ আকার ধারণ করল!
"কী! স্নান করবে না! স্নান না করে খাবার ঘর, রান্নাঘরে ঢুকবে, তারপর রাত্রিবেলা ওই অবস্থায় আমায় জড়িয়ে...."
আমি আর শুনতে পারছিলাম না, এমন অজস্র কাজের কথা বউ বলে যাচ্ছিল স্নান না করে যা করা গর্হিত অপরাধ। এখানেই সে থামল না, বিদ্যুতের গতিতে গিজারের সুইচটা দিয়ে দিল। ততক্ষণে গিজারটাও অন হয়ে সবুজ রঙের দাঁত বের করে আমায় ভ্যাঙচাতে শুরু করেছে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। ভয়ে নাকি ঠান্ডায় বুঝতে পারছি না। আমার পা স্থির! সবেমাত্র বাথরুম নামের এই ভয়-গহ্বর থেকে বেরিয়েছি, সেখানেও জলের সঙ্গে ভালোই সম্বন্ধ করতে হয়েছে, আবার স্নান! তাও এখনই! বাইরে মেঘলা আকাশ, স্নান সেরে যে সূয্যিমামার কোলে রোদ নিয়ে একটু লুটোপুটি খেলব, সেই উপায় নেই। রাস্তা জুড়ে বরফ, আর আমার মন জুড়ে বারি-ভয়! এদিকে না এগিয়েও উপায় নেই! পেছন থেকে বউয়ের ক্রমাগত তাগাদা! 

নেহাত নিরুপায় হয়ে ভয়ে ভয়ে ঢুকলাম সেই গহ্বরে। হঠাৎ একটা বুদ্ধি বিদ্যুতের মত উদয় হলো, আচ্ছা বাথরুমের বন্ধ দরজার আড়ালে স্নান করছি কি না কে জানতে পারছে! মন অমনি ফুরফুরে, ভয়হীন। দরজাটা বন্ধ করে, খানিক জলের আওয়াজ করে গামছাটা নাড়ানাড়ি করলেই বেশ একটা স্নানের অভিনয় করা যাবে। আর বাকিটা সামলাতে সুগন্ধি তো রয়েছেই। স্নানভীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যেই না বাথরুমের দরজা বন্ধ করার জন্য হাত বাড়িয়েছি, ঝমঝম করে ঝরে পড়লেন তিনি। নাহ, গিজারের আনুকূল্যে পাওয়া গরম জল নয়। এক বালতি ঠান্ডা জল কাঁটার মতো শরীরে এসে বিঁধল। আমার হিজিবিজি ভাবনার ফাঁকে বউ যে কখন পেছনে এসে এই কর্মটি করেছে টেরটিও পাইনি। 
''বিয়ের আগেই তোমার মা বলেছিল, শীতকালে তোমার স্নান-ভয়ের কথা, কী ভাগ্য! সেই পোস্টিং হলো হিমাচলে, তখনই আন্দাজ করেছিলাম নিশ্চয়ই তুমি এখানে গোলমাল পাকাবে এই নিয়ে। বুদ্ধিটা তখনই ভেবে রেখেছিলাম। তোমার ভয় কাটাব। আর কোনদিন যদি স্নান না করার বাহানা করেছ...!''

বউ খলবল করে কত কী বলে যাচ্ছে! আমার মাথা, চোখ, মুখ দিয়ে শীতল বারিধারা দাঁত বের করে হেসে চলেছে, শুধু জলের স্বাদটা কেন নোনতা লাগছে কে জানে! আমার স্নানভীতি আর বউয়ের চিমটি এভাবেই আমার ভেতরে নোনতা জল বইয়ে দেয় রোজ।

1 Response

  1. কল্যানী says:

    অসাধারণ। হাসলাম আবার কাঁদলাম ও

বৈশাখী ২০২৪