মোক্ষদার তখন গতর ছিল। চৌধুরী গিন্নির হাড়ের ব্যামোর কথা সবাই জানত। মোক্ষদা ছিল তার খাস চাকরানি। বচ্ছরভর ব্যামোর জ্বালায় কাতরাত চৌধুরী গিন্নি, তবে শীতে বাড়ত সে ব্যামো। মোক্ষদা জড়িবুটি নিয়ে আসত গড়পাড়ের সাধুবাবার কাছ থেকে। তেলে মিশিয়ে মালিশ করত। মেজাজ ছিল খুব চৌধুরী গিন্নির। পান থেকে চুন খসলেই দূর দূর করে তাড়া করত মোক্ষদাকে। জ্বালায় জ্বলে খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল গিন্নি। ছেলে বউরাও কাছে ঘেঁষতো না। আর স্বামী! সে তো গঞ্জের কোন মেয়েছেলের কাছে বাঁধা পড়েছিল অনেক আগেই। সেই নিয়েই নাকি গিন্নির এত রোগ জ্বালা। লোকে বলে এসব! মোক্ষদারও ইচ্ছে করত ধুত্তোর বলে কাজ ছেড়ে দেয়, কে শুনবে এত মুখ ঝামটা! কিন্তু লোভ তাকে আটকে রেখেছিল! চৌধুরী গিন্নি বলেছিল, "সেবা কর মন দিয়ে। আমি মরে গেলে এই নকশি কাঁথাখানা তোকেই দিয়ে যাব।" শীত পড়লেই গিন্নির কাঠের আলমারি থেকে বেরত নকশিকাঁথা। মোক্ষদা কাঁথা কাঁধে ছাদে যেত রোদে দিতে। সবুজ লতাপাতা আর লাল থোকা থোকা ফুল আঁকা কাঁথাটাকে বুকের কাছে টেনে গন্ধ নিত সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়। তার শরীরের সব শীত উবে যেত এক নিমেষে। কাজের ফাঁকে দশবার গিয়ে রোদ খাইয়ে আসত কাঁথাকে। তারপর তো সে কাঁথা আসত চৌধুরী গিন্নির পালঙ্কে! টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ আর গা ভর্তি সোনার গয়না থাকলে কী হবে, হাড় জিরজিরে চৌধুরী গিন্নির গায়ে সে কাঁথা দেখাত বেমানান! মোক্ষদার মত অমন ডাগর গতর কই তার! খুব শীতে মোক্ষদার মাটির ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে রাত কাটে স্বপ্ন দেখে! একদিন তার ঘরে আসবে চৌধুরী গিন্নির সেই নকশিকাঁথা! সে কাঁথা গায়ে দিয়ে মোক্ষদাকে রানির মত দেখতে হবে। কাঁথার আতপে সে ঘুমিয়ে থাকবে রাতভর। বালবিধবা মোক্ষদার জীবনের সব পাওয়া না পাওয়া পুষিয়ে দেবে সে কাঁথা। শীত ছুঁতে পারবে না তাকে! সকাল থেকে খুব শীত পড়েছে আজ। খাটিয়ার ঠিক মাঝখানটাতে শুয়ে আছে মোক্ষদা। চোখের বন্ধ পাতার ওপর তুলসিপাতা! সাদা কাপড়ে মুড়ে খাটিয়ায় তুলে মোক্ষদাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় চলছে। মিনতি ছুটে গিয়ে মোক্ষদার টিনের বাক্স থেকে বের করে আনল কাঁথাটা। শেষ জীবনে মোক্ষদার ভাইপো বউ মিনতিই দুবেলা দুমুঠো ভাত দিত তাকে। বুড়ি মিনতিকে দেখিয়েছিল গিন্নিমার দেওয়া কাঁথাখানা। প্রতি শীতে সে কাঁথা বুড়ি যত্ন করে বেড়ার গায়ে রোদে দিত আর বলত, "এখন তোলা থাক, বেশি শীত এলে গায়ে দোব।" কাঁথাটা নিয়ে মিনতি মোক্ষদার গায়ের ওপর ঢাকা দিল। মোক্ষদা শেষযাত্রায় চলল আজ রানি সেজে!