রুক্ষতার পথ ধরে

চক গড়িয়া, কলকাতা


হাওয়ায় একটু একটু শীতের ছোঁয়া লেগেছে। ভোরের দিকে আর বিকেলের পরে শিরশিরে অনুভূতি হয়। চামড়ায় টান অনুভব হয় দুপুরের দিকে। রোমিতা যেন মনেও  আজকাল এক শিরশিরে টান অনুভব করে। কিসের যে এই টান... কে জানে? সাজানো বাড়ি, ঝকঝকে গাড়ি, ঝিকমিকে গয়না - কিছুরই তো কোনো অভাব নেই। সাত্যকি তাকে চোখে হারায়। অন্ততঃ সবাই তো তাই বলে। কোনো কিছুরই তো অভাব রাখেনি তার।  শ্বশুরবাড়ির মানেটাও তার কাছে একদম অন্যরকম। শাশুড়ি সত্যিই তার কাছের মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন। কতটা পেরেছেন, সে কথা অবশ্য… তবু চেষ্টাটুকু আন্তরিকই ছিল। সাত্যকির দিদির  বিয়ে হয়ে গেছে।  সে তার নিজের চাকরি, নিজের জীবন সবকিছু নিয়ে বড্ডো ব্যস্ত। মাঝেমধ্যে তার বৌমণিকে সে ফোন করে বটে, তবে তা নেহাতই কেজো ফোন। এই বাড়িতে আসার তার সময়ই হয় না। সুতরাং একার রাজত্বে নিজের রাজ্যপাট নিয়ে রোমিতা ভালোই আছে বলা যায়। শুধু দুপুরের দিকটা বড় একলা লাগে তার। সাত্যকি অফিসে, শাশুড়ি স্কুলে, শ্বশুরমশাই  নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে ঘুমোন। কিংবা হয়তো জেগেই থাকেন। এই একটি মানুষের সঙ্গে বাড়ির সবার যেন কেমন আলগা আলগা সম্পর্ক। সাত্যকিকে এই নিয়ে রোমিতা কয়েকবার প্রশ্নও করেছে। কিন্তু প্রতিবারই একইরকম এড়িয়ে যাওয়া উত্তর পেয়েছে। শাশুড়ি আর শ্বশুরমশাইএর ঘরও আলাদা। মানুষটা যেন এই বাড়িতে দ্বীপের মতো থাকেন। রোমিতা কয়েকবার চেষ্টা করেছিল ওই দ্বীপের সঙ্গে সেতু তৈরি করার, কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। রাশভারী মানুষটা নিজেই পছন্দ করেননি, এই আত্মীয়তার আন্তরিকতাটুকু। তবু রোমিতার কেন যেন মনে হয় সম্পর্কের এই শীতার্ত অনুভূতিকে ও একদিন ঠিক পাল্টে দিতে পারবে। 

একটা বাড়ি আর চারজন মানুষ, সবাই সবার সুখে দুঃখে একসঙ্গে যাপন করবে না? এই বিশ্বাসটুকুই ওর মনে এক শিরশিরে অনুভূতির জন্ম দেয়। কোথাও যেন একটু আড়াল রয়েছে। আর সেই আড়ালের অন্ধকারই যেন এই বাড়ির সমস্ত সম্পর্কগুলোকে এক শীতার্ত  অনুভূতি দিয়ে ঢেকে রেখেছে। ভালোবাসা আছে কিন্তু উষ্ণতা নেই, আন্তরিকতা আছে কিন্তু তার মোলায়েম স্পর্শটুকু নেই। রোমিতা যে কী করে?  তার নিজের বাড়িতে সে কখনও এমনটা দেখেনি। তাই তার বড্ড অস্বস্তি হয়। বাবার  "মামণি"  বলে যে ডাকটা ছিল তার মধ্যে যেন পৃথিবীর সমস্ত সুধা মিশে থাকত। কিংবা মায়ের বকুনি, ভাইয়ের খুনসুটি সব মিলিয়ে এক স্বস্তিতে ভরে থাকত তার মন, তাদের সংসার। এখানে যেন এই স্বস্তিটারই অভাব। সব আছে। সুখ শান্তি ঐশ্বর্য। শুধু ওই স্বস্তিটুকু যদি থাকত… মা বলত, "সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো। " এই কথাটা এখন নিজের জীবনে রোমিতা খুব বেশি করে বুঝতে পারে। সে নিজেও কয়েকদিন পরে আবার কলেজ যাওয়া শুরু করবে। নিজের পড়াশুনো, ছাত্রছাত্রীদের নানান বায়নাক্কা সব মিলে সেও খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তবু দিনের শেষে যখন বাড়ি ফিরবে তখন যদি স্বস্তি না থাকে, তবে সারাদিনের যে টেনশন তার মুক্তি হবে কী করে? এ এমন এক সমস্যা যে এই নিয়ে কারুর সঙ্গে আলোচনাও করা যাচ্ছে না। কী বলবে? শ্বশুরমশাই খুব গম্ভীর? কিংবা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন? সবাই  তো এক কথায় উত্তর দিয়ে দেবে যে, তোমার তাতে কী অসুবিধা? তোমাকে তো আর কেউ বিরক্ত করছে না। সুতরাং… নাহ! এভাবে চলতে পারে না। জানতেই হবে রোমিতাকে সবকিছু। নাহলে এই সংসারে শীতের রুক্ষতা নিয়েই বাঁচতে হবে। শীতের  শেষে যে ফুল ফোটে, তার রঙে কোনোদিন রঙিন হয়ে উঠবে না রোমিতার রাজ্যপাট। এ যে তার বড় পরাজয়!  আর হারতে রোমিতা কক্ষনো ভালোবাসে না।

তাই এবার সাত্যকির দিদি পরীর সঙ্গে এই নিয়ে কথা শুরু করল রোমিতা। কিন্তু ঝিনুকের খোলস ভেঙে মুক্তোর সন্ধান কি এত সহজে মেলে! সেও ব্যাপারটা এড়িয়েই যেতে চাইল। কিন্তু রোমিতার যেন এবার প্রাণের দায়। সদ্য বিবাহিতা  রোমিতা মাত্র কয়েকদিন হলো সাত্যকির সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা সেরে ফিরেছে। এখনও ছুটির দিনে তাদের নিমন্ত্রণ থাকে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি।  তার সব ব্যাপারে এত কৌতূহল কিসের?  তবু বারবার আঘাতে তো পাথরেও ফাটল ধরে। একদিন পরী মুখ ফসকে হোক আর যেভাবেই হোক বলেই ফেলল, "আমার পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত তো সব ঠিকই ছিল। তারপর কী যে হল, সবকিছুই পাল্টে গেল। ভাইয়ের তো কিছু মনেই নেই, ও ছোট থেকেই এভাবেই অভ্যস্ত।" 

কিন্তু কী হয়েছিল, কী যে হয়েছিল দিদিভাইএর কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে, সেবারের শীতে তারা সবাই মিলে হিমাচল প্রদেশ বেড়াতে গিয়েছিল। প্রচুর বরফ দেখেছিল। সেখান থেকে ফিরে এসেই তাদের সংসারটাও যেন চিরকালের জন্য শীতঘুমে  চলে গেল। কোনো আনন্দ নেই, বেড়াতে যাওয়া নেই, সবাই মিলে হৈ হৈ নেই, সব কেমন পাল্টে গেল। বাবার শোওয়ার ঘর আলাদা হল। মা কোনোই আপত্তি করল না। পরী খুব কান্নাকাটি করেছিল। ভাই তখনও কিছু বোঝার মতো হয়নি। কিন্তু সবই জলাঞ্জলি গেল। কেউ শুনলই না তার কথা। কিংবা শুনতে চাইলই না। “ব্যস, আর কিছু জানিনা,” বলে পরী হাল ছেড়ে দিল। এবার সে বুকুন অর্থাৎ সাত্যকিকে নিয়ে পড়ল। সে বেচারা নতুন বিয়ের আনন্দে মশগুল। জন্মের পর বড় হওয়া অবধি সে মা বাবাকে এমনভাবেই দেখে আসছে। কাজেই এই নিয়ে তার মধ্যে কোনো প্রশ্নও কখনও জাগেনি। একেবারেই যে জাগেনি, এ কথা বললে ভুল বলা হবে। একটু বড় হওয়ার পরে, যখন মনে প্রথম বসন্তের ছোঁয়া লাগে, সবকিছু ধীরে ধীরে পাল্টে যায় চারদিকে, তখন তখনই একবার সে মা কে জিজ্ঞাসা করেছিল, "মা, তুমি কি বাবাকে ভালোবাসো?" মা খুব অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়েছিল। থতমত খেয়ে বুকুন বলেছিল, "না, মানে… তোমরা তো আলাদা ঘরে থাকো, কখনো একসঙ্গে কোথায় যাও না… তাই বলছিলাম… আমার অন্য সব বন্ধুর মা বাবারা তো ঠিক এমন নয়! তাই আর কী..."  মা সবটা মন দিয়ে শুনেছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে বুকুনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, "আরও একটু বড় হও, বুঝবে ভালোবাসা কখনো ছাঁচে ঢালা যায় না। রুক্ষতা, ধুসরতাও ভালোবাসারই রং।" ব্যস, বুকুন আর কিছু জানে না। তবে তার কত বন্ধুর চেনাজানা পরিজনের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে। কত তিক্ততা, বীভৎসতার গল্প শুনেছে সে। সেই তুলনায় তারা তো ভালোই আছে। বাবা মা কে সে কখনো ঝগড়া করতে দেখেনি। ভালোই তো! তবে মাকে সে কখনও মাঝেমধ্যে বিমর্ষভাবে... না ঠিক বিমর্ষ নয়, আনমনাভাবে বসে একটা গান গুনগুন করতে শুনেছে। "তোমার অভিসারে যাব অগমপারে… কাঁদালে তুমি মোরে, ভালোবাসারই ঘায়ে"... আজ এই বয়সেও মাকে তার তখন বড্ডো অচেনা লাগে, একটু যেন ভয় ভয় করে। আজও। তখন যেন মা কেমন দূরের মানুষ হয়ে যায়। 

ব্যস, এইটুকু পুঁজি সম্বল করে রোমিতা এক অসম যুদ্ধে নামল। কার বিরুদ্ধে, কিসের বিরুদ্ধে একদম পরিষ্কার নয়। তবে শীতের রুক্ষতার তীব্রতার বিরুদ্ধে রঙিন বসন্তের যে লড়াই, তার সঙ্গে এই লড়াই এর বড় মিল। প্রথমেই ঠিক শ্বশুরমশাই এর কাছে যাওয়ার সাহস হল না। কাছের মানুষের হাত ধরে লড়াইটা শুরু করাই বোধহয় একটু সহজ কাজ। সে সোজা তার শাশুড়ির কাছে গিয়ে তাঁকে ধরে পড়ল। 
"মণি, চলো না, আমরা সবাই মিলে একবার রাজস্থান যাই।" 
চমকে উঠতে গিয়েও চমকটাকে ঢেকে ফেললেন সুব্রতা। হেসে বললেন, "আমাদের বয়স হয়েছে রে, তোরা যা না, কলেজ শুরুর আগে আরেকবার কোথাও ঘুরে আয়।" 
"কেন? সবাই চল না, সবাই মিলে গেলে খুব আনন্দ হবে।"
"ওরে পাগলি, আমি ছুটি পাব না রে, তোরা যা।"  
"ঠিক পাবে, চেষ্টা কর। আমি বাবাইকে বলছি।" 
এবার সুব্রতা মিঠির মানে  রোমিতার হাত চেপে ধরলেন, "না, থাক। বাবাইকে বলার কোনো দরকার নেই। ছেড়ে দে।" 
"কেন, মণি? বাবাই কি অন্য গ্রহের? কী হবে বললে?" 
"তাই তো দেখলাম রে সারাজীবন ধরে… যে মানুষটা কখনও কিছু শুনতেই চাইল না, কী লাভ তাঁকে টানাটানি করে? ছেড়ে দে।" 
"না, বলবই। নিঃসীম সাদা শূন্যতাও তো ভালোবাসার রং হতে পারে মণি। শুধু রুক্ষ ধূসরতাই  কেন হবে?" 
"এত পাকা পাকা কথা শিখলে কোথায়? এইটুকু মেয়ে, বড়দের মতো করে সব শিখে ফেলেছ? কী মনে কর, মামণি?" অসীম স্নেহ নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন, শিবপ্রসাদ মিত্র। এই শীতের দেশের রাশভারী রাজা। রোমিতা সুব্রতার দিকে তাকিয়ে  দেখল, শীতের রুক্ষতাকে সবুজে ভরে দিতে দুচোখ বেয়ে নেমেছে উষ্ণ প্রস্রবণ। কত লক্ষ আলোকবর্ষ পেরিয়ে দুজন মানুষ পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়েছে। এ সময় বড় আপন সময়, বড্ড নিজের সময়। তৃতীয় জনের উপস্থিতি এখন বড্ড বেশি বাহুল্য।  রোমিতা তাই চলল রাজস্থানের টিকিট কাটতে। তার আগে অবশ্য সে দিদিভাইকে আর তার নিজের বাবা মাকে একবার ফোন করে নেবে। দুঃখকে একা বহন করতে হয়, আনন্দ কিন্তু সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হয়। এই বাড়ির চারটে টিকিট তো কনফার্ম হয়েই গেছে, বাকিগুলো তো জানতে হবে। 

টিকিট কাটতে বসলো রোমিতা। দূরে কোথায় রেডিওতে গান ভেসে আসছে মান্না দের কণ্ঠে " কে তুমি তন্দ্রাহরণী…." সুরের এই ধারা যেন রোমিতার রাজ্যপটকেও সুরের মায়ায় রঙে রঙে ভরিয়ে তুলছে।

রোমিতা আজ যেন নতুন করে বুঝতে পারলো,  শীত শুধু রুক্ষতাকেই বহন করে না, বসন্তের আগমন বার্তাও বয়ে আনে।

বৈশাখী ২০২৪