যে পরিমাণ ভাপ উঠছে এই ঘরটিতে, কারো পক্ষে বোঝার উপায় নেই যে বাইরে বেরুলেই শালের অভয়ারণ্যে ঢুকতে হবে, দেহমাথা ঢেকে দিলেই যথেষ্ট হবে না, মুখও বন্দি করে নিতে হবে। সময়টি এমন, নারীদের সঙ্গে পুরুষগুলিকেও বোরখাওয়ালি বানিয়ে ছাড়ে। “উডা, উডা … খাঁজ খালি কর…পুইড়া যাইতেছে বেবাক… পুলাডায় কী কইবোনে মুখে দিয়া!” বলতে বলতে রাসিদা বানুর কোঁচকানো মুখটা যখন আরো কুঁচকে গেল, চুলোর আগুন তখন মাটির খাঁজকে ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আগুনের লেলিহান দাপটে রাসিদা যেন কিছুটা কেঁপে উঠলেন। তারপর যখন শূন্য খাঁজগুলো আবার চালের গুঁড়োজলে ভরে উঠতে লাগল, আর ছন্নছাড়া শিখারা গনগন করতে করতে ফের খাঁজের তলে চাপা পড়ল, হাঁফ ছাড়তে ছাড়তে তাঁর নকশা-কাঠিটার দিকে হাত বাড়ালেন। সকাল থেকেই তাঁর মেজাজ বিগড়ে আছে। বড় ছেলে প্রবাস থেকে বহুদিন পর ফিরছে, তার জন্য কত কী ভেবে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু ছোট ছেলে জামালকে যেভাবে বলে দিয়েছিলেন, তার কোনটাই সে ঠিকমত করেনি। দুই মণ রস দরকার ছিল, বাড়ি আর ভিটের রস দিয়ে টেনেটুনে যে হত না, তা নয়। কিন্তু জামালকে বলেছিলেন মোড়লবাড়ির কথা; বদখত দেখতে হলে কী হবে, এত সুমিষ্ট রস তাদের এলাকার আর কোন গাছে পাওয়া যায় না! মাটির গুণেই, না কি, গাছগুলির আছে আলাদা কোন জাতধর্ম, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়েই কয়েকবার বীজ এনে লাগিয়েছেন নিজেদের ভিটেয়, কিন্তু গ্রামের অন্য লোকেদের মত একই অভিজ্ঞতা হয়েছে রাসিদা বানুর - চারা গজিয়েছে, কিন্তু তারপর আর বাড়েনি। হয় মাটি, না হয় গাছ, কেউ না কেউ বিদ্রোহ করেছে! জামাল ভ্যানগাড়ি করে রসের বিশাল হাঁড়ি পাঠিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এক নজর দেখেই বুঝেছেন রাসিদা বানু, এ আসল জিনিস নয়। তাছাড়া শয়তানটার দেখা নেই সেই সকাল থেকেই। কলেজে কী না কী টুর্নামেন্ট চলছে, আজ তার ফাইনাল ম্যাচ! ঘন ঘন নিঃশ্বাস বেরোতে থাকে রাসিদা বানুর বাতে তোবড়ানো শরীরটা থেকে, কিন্তু দ্রুতই মিলিয়ে যায় গরম ভাপের সঙ্গে বাইরের কুয়াশায়, সবার অলক্ষ্যে। ছেলেটা খেলা খেলা করেই গেল! কিভাবে সংসারটা চলছে, সেদিকে একটুও হুঁশ নেই! বড় ভাইটা মরুভূমির দেশে কী কষ্ট করেই না টাকা কামাই করে! কখনো চিন্তা করে দেখেছে বাদাইমাডা? বড় ছেলের কথা মাথায় আসতেই বুকের মধ্যে ঢেউ উঠে রাসিদা বানুর, চোখ ছাপিয়ে বাষ্প বের হতে চায়। কামালের মাথা বরাবরই ভাল ছিল, লুৎফর মাস্টার তো দেখলেই বলতেন, “অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে… খেয়াল রাইখেন, ভাবি… পড়ালেখাডা বন্ধ করতে দিয়েন না!” কামাল নাকি কঠিন কঠিন অঙ্ক মুখেই করে ফেলত। ব্ল্যাকবোর্ডে স্যার অঙ্কের প্রথমভাগটা নিজে করে দিয়ে বাকিটার জন্য ছাত্রদের ডাকলে, আর কোন হাত না উঠলেও কামালেরটা উঠত। তবে এসব কাহিনি মাস্টারদের কাছেই শোনা; রাসিদা বানু তো অংকের আগামাথা কিছুই বোঝেন না। কিন্তু যখন কামালের বাবা স্টক লটের ব্যবসায় সব হারাল, আর কামাল গোঁ ধরল বিদেশ যাওয়ার জন্য, তখন রাসিদা বানু ঠিকই বুঝলেন, ছেলে সংসারের জন্যই নিজের ভবিষ্যতের গলা টিপে ধরতে চাইছে! কামাল তখন কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে, মেট্রিকের মত ইন্টারেও তাক লাগানো রেজাল্ট আশা করছে তার শিক্ষকেরা। কামাল দিনরাত টিউশানি করত বটে, কিন্তু তা থেকে বাঁচিয়ে মায়ের হাতে আর কী-ই বা গুঁজে দিতে পারত? তাই সেই অল্পবয়সে সেই যে গালফ এয়ারওয়েজের প্লেনে চড়ে বসল কামাল, তারপর তো এক যুগ হয়ে পার গেল প্রায়, প্রবাসে প্রবাসেই কাটিয়ে দিল; দেশে আর থিতু হল না। পাঁচ বছর আগে ছুটিতে এলে অনেকটা জোর করেই তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন রাসিদা। সোনার ছেলে তাঁর, লেখাপড়াটা নষ্ট করার জন্য স্বামীর পাশাপাশি নিজেকেও দোষ দেন তিনি; সেজন্যই কিনা, রাসিদা বানু পাগলের মত মেয়ে খুঁজতে লাগলেন কামালের জন্য - এমন বউ ঘরে আনতে হবে যেন সংসার জীবনটা নষ্ট না হয় বাছার! বাছাবাছি চলতে লাগল গ্রাম-শহর উজাড় করে, দূরদেশের সীমা ছাড়িয়ে। একদিন রাসিদার ননদ নিয়ে এলেন এক পাত্রীর খোঁজ; সুন্দরী মেয়ে তো আরও অনেক পেয়েছিলেন, কিন্তু এই মেয়েটার চোখ-মুখে কী যেন একটা দেখলেন তিনি, কোন এক অলৌকিক শিহরণ স্রোতের মত বয়ে চলল তার মস্তিষ্কের সব ক’টা কোঠা দিয়ে! সে কী মায়া, না রূপ – বোঝা গেল না, তবে মন বলল, কামালের জন্য বউ খোঁজাখুজির পালা শেষ হয়েছে! রাসিদার অনুমান মিথ্যে হয়নি। রেশমা তাঁর কল্পনাকেও হার মানিয়েছে, এতটুকুন মেয়ে, অথচ অল্প কদিনেই পুরো বাড়ির দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে! এখনও পর্যন্ত কেউ একটা টুঁ শব্দও করতে পারেনি তার বিরুদ্ধে। বরং খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। গ্রামের ছেলে-বুড়ো অনেককেই দেখা যায় রেশমার কাছে ধরনা দিতে। রেশমা যেন দুনিয়ার তামাম বিষয়েরই খোঁজ রাখে, সব দিকেই তার জানাশোনা, তার সঙ্গে বিনাপয়সার শলা-পরামর্শ করতে ঢল নামে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের। রাসিদা বানু মাঝে মাঝে ভাবেন, রেশমার যেন জন্মই হয়েছে তাঁর বড় ছেলেটার জন্য - কামালের মত সব দিকে তার খেয়াল, সবার জন্যই মহব্বত। তার ছোট ছেলে জামালকে তো মাথায় তুলে রাখে রেশমা, ছেলেও ভাবিকে পেয়ে মাকে ভুলতে বসেছে। “আরে আরে ছাই হইয়া গেল তো! খাঁজ উডা, খাঁজ উঠা। কোন ধ্যানে আছস্, ক দেহি,” ধমক লাগান বউকে। চুলোটা থেকে সামান্য দূরে একটা মোড়ায় বসে ফুলকলি পিঠের নকশা করছেন। ছেলের জন্য এই পিঠেটা নিজের হাতে বানাচ্ছেন - এতদিন পর আসছে, খাবার টেবিলে এক পদের পিঠে দিলে তো আর হয় না! অন্যান্য পিঠার ভার রেশমার উপর ছেড়ে দিলেও গাইড তিনিই করছেন। তাঁদের এলাকার এই রসচিতোই শীত এলেই ঘরে ঘরে বুদবুদ ছড়িয়ে দেয়, মনকাড়া এক সুবাসে আকাশবাতাস ঘন হয়ে উঠে, রসের বাষ্পে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে ছেলে-বুড়ো-জায়া-জননী সকলে! রসচিতোই অন্য জায়গাতেও হয়, কিন্তু এই এলাকার এই পিঠেটা গুণেমানে সেরা। সেই সকালে কলসভর্তি রস একটা বড় হাঁড়িতে ঢেলে চাপানো হবে জ্বলন্ত উনুনের উপর। তারপর সারাদিন ধরে সেই রস আগুনে পুড়ে সোনা রঙ ধরলে সন্ধেয় প্রায় সমপরিমাণ দুধ মিশিয়ে ফের জ্বাল দেওয়া। পরে বলগ উঠতে শুরু করলে উনুনের আঁচ একদম কমিয়ে খাঁজের পর খাঁজ গরম চিতোই পড়তে থাকে রসের হাঁড়িতে। হাঁড়িটা শুরুতে গমগমে আর টলটলে থাকে, কিন্তু রাত যত গড়াতে থাকে, তীব্র শীতের মধ্যে চলে পিঠেগুলোর সঙ্গে রসের ধুকধুকানি, গায়ে গায়ে লেগে চলে নীরব মিথস্ক্রিয়া। এরপর ভোরে যখন পাতে দেয়া হয়, তখন মাখনের মত নরম হয়ে গেছে চিতোইয়ের শরীর, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রসে ঢলঢল, মুখে দিলে মনে হবে অমৃত, ঠোঁটের কানাগলি দিয়ে উপচে পড়বে রসের সুধা। মুলির বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দিয়ে হু হু করে হিম ঢুকছিল রান্নাঘরে। কিন্তু দু’টো প্রমাণ সাইজের জ্বলন্ত চুলো থেকে বেরিয়ে আসা লকলকে আগুন একটুও ফুরসুত দিচ্ছিল না সেই হিমকণাদের ঘাঁটি গাড়ার, কাছে এলেই ধাওয়া করছিল। আর রান্নাঘরটির অন্য বাসিন্দারা সেই সুযোগে নানান গল্পে মেতেছিল, তাদের কথারা হাঁড়ির রসের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন ক্রমে ঘন হয়ে উঠছিল! রেশমা ছিল এই আসরের মধ্যমণি। তবে বড় উনুনটার একদম মুখে বসেও কেমন যেন শীত শীত লাগছিল তার! স্বামীর পাঠানো একটা শাল গায়ে চুলোর সামনে বসে সেই শাল সামলে একের পর এক খাঁজ মুন্ডে ভরে দিচ্ছিল। খাঁজের গহবরগুলি ঠিক ঠিক ভরাট হচ্ছিল, কোথাও এতটুকু এতটুকু লেপ্টে-চেপ্টে যাচ্ছিল না। কিন্তু খাঁজ নামাতে গিয়েই গোলমাল লেগে যাচ্ছিল, হিসেবের গরমিল হচ্ছিল বারবার। সত্যি বলতে কি, পিঠেগুলোর মতিগতি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না রেশমা! কতটুকু উত্তাপ তাদের দরকার, কী পরিমাণ আগুন হলে পরে তাদের জলের শরীরটা জমাট বাঁধতে পারে, তার অংক যেন আজ তাকে সমানে ফাঁকি দিয়ে চলছিল। একটা সময় শাশুড়ির মতো তারও রাগ ধরে যায় জামালের উপর। একটা কার্ডিগ্যান বানাতে দিয়েছিল উপজেলা কমপ্লেক্সের বড় টেইলার্সটাতে। আজ তার ডেলিভারি হওয়ার কথা, সকালেই বলে দিয়েছিল জামালকে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত দেখা নেই উড়নচন্ডিটার! নিশ্চিত খেলা-পরবর্তী আনন্দে মজে আছে। হঠাৎ বিকট একটা আওয়াজ, যেন বিস্ফোরণ ঘটল ক্ষুদে রান্নাঘরটাতে; বুকটা ছলাৎ করে উঠলো রেশমার! প্লেনটা মাথার উপর মাত্র কয়েক সেকেন্ড ছিল, কিন্তু তার বেশ কিছুক্ষণ পরেও ঠক্ঠক্ করে কাঁপছিল রেশমা। তাদের গ্রামটা এয়ারপোর্টের কাছেই ছিল, তাই প্লেনের শব্দ শুনে শুনেই বড় হওয়া! তাছাড়া তার স্বামীর প্লেন তো এসে পৌঁছুবে ভোর ছটায়। কিন্তু কেন জানি, প্লেনের শব্দটা আজ তার কাছে ভীষণ অচেনা লাগল! তার মাথার মধ্যে সে এমন চক্কর দিতে শুরু করল যে চোখের সামনের সব কিছু ধূসর হয়ে যেতে লাগল, মনে হল এক অনন্ত কুয়াশারাজ্যে পথ হারিয়েছে সে! জামালকে তার থেকে বড় দেখায়, কিন্তু সত্যি সত্যিই সে বড় কিনা, তা জিজ্ঞাসা করেনি কখনো রেশমা, আর সেটা সমীচীনও হত না। রেশমা জামালের বড় ভাইয়ের বউ, তাই জামালকে তার ছোটই হতে হবে, বয়স যাই হোক, এটাই রীতি এই সমাজের। তারপরও যখন জামালের উপর ভার পড়েছিল তাকে বাপের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার, তখন রেশমা কিছুটা শিউরে উঠেছিল ঠিকই। কিন্তু জামাল ছোট থেকেই টেটনা, পুরো পথ জুড়ে সে তামাশার ঝড় বইয়ে দিল নয়া ভাবির উপর। রেশমার লজ্জা আর শংকা – দুটোতে মিলে যেন পাল্লা দিল কে কাকে আগে কাটিয়ে দিতে পারে। জামাল সারাটা দিনই ক্ষেপিয়ে যেত তার ভাবিকে, আর রেশমাও দেওরের কানটা মোচড়ানোর জন্য রুদ্ধশ্বাস দৌড় লাগাত। বেশিরভাগ সময়ই অবশ্য নাগাল পেত না রেশমা, কিন্তু কখনো সখনো যদি ধরতে পারত, তো জামালের পিঠের উপর এমন দুমদাম বসিয়ে দিত যে শাশুড়ি তার নামাজের ঘর থেকেও টের পেত, আর তসবিহ গোনায় ভুল করে ফেলত। জামাল একটা সময় রেশমাকে রাসু বলে ডাকতে শুরু করল। চেতানোর ছলে, না কি আল্লাদের ঢলে, তার অনুসন্ধানে না গিয়ে রেশমা রেগে আগুন হয়ে যেত আর শাশুড়ির আদালতে নালিশ ঠুকত। কিন্তু জামাল থোড়াই কেয়ার করত মায়ের বকুনি! উল্টো নিত্যনতুন ফন্দি বার করত তার প্রায় সমবয়সি ভাবিটাকে জব্দ করতে। সব থেকে বড় বাঁদরামিটা সে করত তার ভাইয়ের চিঠিটা পৌঁছে দেয়ার সময়। শেষবার যে চিঠি লিখেছিল স্বামীকে, তার উত্তর কী এসেছে, তা জানার জন্য উতলা থাকত রেশমার মন। আর তার পুরো সুযোগ নিত জামাল, বড় অংকের চাঁদার বিনিয়মে স্বামীর চিঠিখানা পড়ার সুযোগ মিলত রেশমার। কিন্তু দিন দিন চাঁদাবাজির নতুন নতুন আস্তানা খুঁড়ে চলল জামাল। মনে আছে, গেল ঈদে চিঠির সঙ্গে পে অর্ডার এল একটা বড়সড়। উপজেলার সব থেকে বড় ব্যাংকে পে অর্ডারটা ভাঙ্গিয়ে যখন সোজা মার্কেটে চলে গিয়েছিল রেশমা বাড়িসুদ্ধ লোকের জন্য জামাকাপড় কিনতে, তখন সঙ্গে জামালকেও রাখতে হয়েছিল, আর সে চেকের বড় অংশটা সুযোগমত খসিয়ে নিয়েছিল। বন্ধুদের চমকে দিতে সব থেকে দামি ব্র্যান্ডের প্যান্ট, জুতো, আর জামার পাশাপাশি একটা স্মার্টফোনও দরকার পড়েছিল তার। কিন্তু রেশমাও উসুল করে নেয়। তার যাবতীয় কাজ, দর্জিঘর থেকে ব্লাউজ, সলোয়ারটা, সাজদোকান থেকে মেহেদি, হলুদটা – সব খুঁটিনাটি কাজ জামালকেই সারতে হয়। তাছাড়া, কলেজ থেকে ফেরার সময় তিনরাস্তার মোড় থেকে বড়ই ভর্তা, আর জলপাইয়ের আচার সঙ্গে করে নিয়ে না এলে, শনি ঘনিয়ে আসে জামালের কপালে, সংঘাত অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। তবে মারুক-ধরুক আর যা-ই করুক, জামালের কলেজ থেকে ফেরার পথ চেয়ে রেশমাই বসে থাকে; অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো বটগাছটিতে যখন প্রহরের পর প্রহর বয়ে যেতে থাকে, আর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে শুরু করে ছায়ার দল, ভীষণ অস্থিরতায় পায়চারি করতে দেখা যায় রেশমাকে জানালার ধার ঘেঁষে। এইতো মাস তিনেক আগে জামালের গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল। সারা রাত পানি ঢালা আর জলপটি নিয়ে বসে রইল রেশমা, শাশুড়ি বার কয়েক এসেও একচুল নাড়াতে পারলেন না। পিঠে বানানো শেষের দিকে। পুরো রান্নাঘর বাদামি ধোঁয়ায় ভরে উঠছে। বাইরের কুয়াশার সঙ্গে মিলেমিশে জায়গাটিতে এক অদ্ভুত মেঘ তৈরি হয়েছে; না শীত, না গরম, কেমন যেন অস্বস্তি হতে থাকে রেশমার! ওদিকে শাশুড়ি হাতির শুঁড়ের মত বিশালদেহী উড়ুমটা রসের হাঁড়িতে নামিয়ে দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকেন পিঠেগুলো। রস যেই মানেরই হোক, পিঠাগুলো রসালো হয়েছে বলে মনে হয়; মাথা নেড়ে সন্তোষ প্রকাশ করতে করতে সাহায্য করতে আসা আশপাশের বউঝিদের আমন্ত্রণ জানান রাসিদা, মতটা যাচাই করে দেখে নিতে। বউঝিরা অবশ্য ইতিমধ্যেই রসে টইটুম্বুর হয়ে ছিল, নতুন করে আসল রস চেখে নেয়ার সাধ্য কমই ছিল। তাদের আঁচলে লুকোনো রসের ডিব্বায় ততক্ষণে কয়েকবার গোসল সম্পন্ন হয়েছে রেশমার! স্বামীকে সামনাসামনি দেখতে পাওয়া পাঁচ বছর আগের ঘটনা দেখা হলেও স্মার্টফোনে তো ফি সপ্তাহেই দেখা হয়। কত ধরণের যে কথা হয়! কামালের কাছ থেকে আসে হাজারো রকমের পরামর্শ, আদেশ, নিষেধ – নামাজ-রোজা, পর্দাপুশিনদা, মা বাবা ভাইয়ের দিকে খেয়াল রাখা। সব থেকে বেশি জামালের কথা। রেশমা সবসময়ই বিশ্বাস করে এসেছে, তার স্বামী আদর্শলিপিতে পড়া আদর্শমানবদের একজন। মাঝে মাঝে চিঠিও লেখে কামাল, কেন জানি, মনে হয়, লেখায় সে কথার চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। তখন তাকে আরো বেশি করে চেনা যায়। একদিন পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল রেশমা; মনে পড়ছে, কাঁদতে কাঁদতেই সে উত্তর লিখেছিল কাঁপা কাঁপা হাতে। “আর একটু সবুর কর্, রেশমা। আর কষ্ট হইব না। এই শীতটা তর অনেক আরামে কাটবো। আগুনের মাশলার মধ্যে বইয়া ওম পোহাইবি!” হাসতে হাসতে যখন কথাগুলি বলছিলেন পাশের বাড়ির সাথি ভাবি, তখন অদূরে বসে থাকা রাসিদা বানু আড়চোখে তাকিয়েছিলেন একটুখানি, আর তারপরেই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন সদ্যই পুকুর থেকে তুলে আনা মাছের ভান্ডটা নিয়ে, কালই এগুলো ভেজে ছেলের সামনে দিতে হবে। আরো কত যে পদ-ব্যঞ্জন গাঁথা হচ্ছে কামালের জন্য! গত কদিন ধরে ক্ষেত থেকে কলুই শাক, ধনে পাতা আর ফুল তোলা হয়েছে। কামালের ভর্তা ভারি পছন্দ, আট-দশ রকম ভর্তার প্লান ছিল তাদের বউ-শাশুড়ির। জামালের উপর ভার পড়েছিল সেসবের কাঁচামাল যোগাড়ের। কিন্তু কোথায় সে? এখনো পর্যন্ত কোন খবর নাই বেতমিজটার! অল্প সময়ের ব্যবধানে আরেকটা প্লেন যায় মাথার উপর দিয়ে, আর রেশমা ফের ধাক্কা খায়; ভাবনার অতলে ডুবে গিয়েছিল সে। কাল তো এই সময় বাড়িতেই থাকবে তার স্বামী। হয়ত বিশাল লাগেজটা নিয়ে বসে পড়বে মেঝের উপরেই, আর কার জন্য কী এনেছে, সব বের করে দেখাবে। বাসার সবাই গোল হয়ে ঘিরে থাকবে তাকে তখন। এতদিন পর আসছে, নিশ্চিত লাগেজ ভর্তি করে জিনিস আনবে সবার জন্য। তার জন্য যে জিনিসগুলি আনবে, তা কি সবার সামনে তুলে দিতে পারবে? নাহ্, সাহস হবে না, বরং ‘এইগুলো তোমার বউমার জন্য’ বলে তার শাশুড়ির হাতেই তুলে দেবে। রেশমাকে এতগুলো বছর পর দেখার পর কী করবে কামাল? নিশ্চিত তার চোখ-মুখের রঙ বদলে যাবে, আর আড়চোখেই দেখে যেতে থাকবে রেশমাকে! যা লাজুক! সারাদিন হয়ত কোন কথাই বলবে না রেশমার সঙ্গে! কিন্তু ঘরে যাওয়ার পর? মিটিমিটি হাসতে থাকবে শুধু মনে হয়। রেশমা স্তব্ধতা ভাঙ্গার জন্য অনেক কথা জিজ্ঞেস করবে তখন। চিঠিতে যা জেনেছে, তা-ই আবার জিজ্ঞেস করবে, “এক লগে কয়জন থাকতা? খাওয়াদাওয়ায় খুব সমস্যা হইত, না?” এমন নয় যে উত্তরগুলো চলে আসবে সঙ্গে সঙ্গে। কামাল গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকবে, হয়ত মাঝে মধ্যে আঙুল টিপে দেবে, এর বেশি কিছু করবে না! বাইরের শোরগোল, বাসার লোকের সাড়াশব্দ একদম থেমে না যাওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষাতেই থাকবে নিশ্চিত। এটাই রীতি এ বাড়ির, কেউ তাদের রুমে ঢুকবে না; এরপর বাতি নিভানোর অপেক্ষাতেই থাকবে কামাল! আবার একটা প্লেনের বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিয়ে যায় রান্নাঘরটিকে, আর হাড়শুদ্ধ যেন নড়ে উঠে রেশমার! শাশুড়ির চিৎকার কানে আসে, ছোট ছেলেকে সমানে গাল পাড়ছেন, শাপ-শাপান্ত করে যাচ্ছেন, “অহনো ছেমড়ার দেহা নাই, আন্দার থাকতেই রওনা হইয়া যাওনের কথা ভাইরে আনতে… গায়ে-গতরে খবিশ হইতেছে একটা দিন দিন! ভাইয়ের পাতে খাইতেছে, তাই টের ….. !” অনেক দূর থেকে আগত অবোধ্য ধ্বনির মত শোনাল কথাগুলো রেশমার কাছে। শরীরটায় সে বল পাচ্ছে না কদিন ধরেই। কী যেন হয়েছে তার, গত কদিন যাই মুখে দিয়েছে, তেতো লেগেছে। স্বামীর পাঠানো শালটা আরেকটু টেনেটুনে ধরে সে বুকের কাছে। কিন্তু শীত যাচ্ছে না। শরীরটা যেন বরফ হয়ে গেছে। প্রচন্ড কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে চাইছে মনে হয়। কিছুটা হাত ঘষে উত্তাপ পাওয়ার চেষ্টা করল রেশমা। রাত যতই গভীর হচ্ছে, শীতের দাপটা বেড়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে রেশমা শেষ খাঁজটা ভাজতে থাকে, আর কিছুক্ষণ পরেই ঢুকে যাবে দিনের শেষ পিঠেগুলো রসের হাঁড়িতে। তার অনেকটা সময় লাগে গরম গরম চিতোইগুলো রসের হাঁড়িতে নামাতে গিয়ে, কারণ চিতোইগুলো উঠানোর পরে খালি খাঁজে যে ধোঁয়াটা তৈরি হয়, তা তাকে চুম্বকের মত টেনে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। তার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যেতে থাকে পেঁজা তুলোর মত রাশি রাশি কুয়াশা, সাদা ভেলার মত বয়ে যেতে থাকে সবকিছুকে অদৃশ্য করে দিয়ে। পুনশ্চঃ পরদিন সকালে জামালের পাতে বড় বড় রস চিতোই বেড়ে দিচ্ছিল রেশমা। জামাল আসলে টুর্নামেন্ট শেষে বাড়ি না ফিরে সরাসরি এয়ারপোর্টে চলে গিয়েছিল, বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ভোরে বাড়ি ফিরে সবাইকে চমকে দেয়ার ফন্দি এঁটেছিল সে। কিন্তু এয়ারপোর্টে বসেই একটা বার্তা পায় জামাল, তার ভাই কামাল লিখেছে, দুবাই এয়ারপোর্টের পথেই ছিল সে, আচমকাই একটা ফোন আসে এক আকামার কাছ থেকে, অনেকদিন ধরে লেগে ছিল, মাইনে দ্বিগুণ হয়ে যাবে, আর তাই …। ভাইয়ের টাইপ করা শব্দগুলো এলোমেলো ছিল; কোন কোন শব্দ তার ঘর পুরো করতে পারেনি, আর দাঁড়ি-কমা, সেসবেরও কোন বালাই ছিল না। ঠিক কী কারণে এই শ্রীহীন অবস্থা - সোনার হরিণকে নাগালে পাওয়ার উচ্ছ্বাস, না কী, শেষ মুহূর্তে ফ্লাইট বাতিলের সঙ্গে মিশে থাকা লজ্জা – তা নিয়ে ভেবে ভেবে রাতটা এয়ারপোর্টেই কাটিয়ে দেয় জামাল। ভোরে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের দেখা মিললে একটিতে উঠে পড়ে সে, আর ভাইকে ছাড়াই বাড়ি ফিরে আসে। হতাশার প্রবল বায়ু বয়ে যাচ্ছিল বাড়ি জুড়ে, রাসিদা বানু আহাজারি করে যাচ্ছিলেন তার কামালের নাম ধরে। এরই মাঝে সাংসারিক কর্তব্যে নেমে পড়ে রেশমা, অভুক্ত দেওরটাকে জোর করে বসিয়ে দেয় খাবার টেবিলে। ভাত শেষে পিঠে ধরার পর জামাল অবশ্য বেশিদূর এগুতে পারছিল না, এক পর্যায়ে সামলাতে না পেরে বলে উঠে সে, “একটুও ভাল হয় নাই, রাসু। পিঠা বানানি ভুইলা গেছ!” রেশমা আধেকটা পান মুখে দিয়েছিল ইত্যবসরে; তার রস চিপড়ে ফেলে মুখটা খাঁজের মত করে বলল, “যেমন রস আনছো, হেইরমই তো পিডা হইব!” চিতোইগুলো ততক্ষণে রসের জালে আটকে জমে গিয়েছিল পুরো। কঠিন সব গা হিম করা শিলায় পরিণত হয়ে তারা হাঁড়ির শরীরটাকে জাপটে ধরছিল আচ্ছা করে।
2 Responses
অদ্ভুত ভালো! যেমন গল্পের বুনোট তেমনই ভাষার স্বচ্ছন্দ সাবলীল আল্পনা। দারুণ লাগলো।
অসাধারণ লেখা,পড়তে পড়তে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম।
লেখক অসামান্য মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।