"প্রেমের আবার স্বকীয়া পরকীয়া কীসের হে?" পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল। তাকিয়ে দেখি যা ভেবেছি তাই। এ আর কেউ না, স্বয়ং মুকুন্দ। আরে সেই মুকুন্দ যে কিনা শুধু গীতাঞ্জলিটা লিখে উঠতে পারল না বলে নোবেলটা পেল না! আরে বাবা সেই - যে কিনা সন্ধ্যাবাজারের দোকানে দোকানে বালতি করে জল এনে দেয় আর ক্লাবের রিডিং টেবিলে বসে সেদিনকার সবকটা খবরের কাগজ মুখস্থ করে। মায় এমনকি ইংলিশ স্টেটসম্যান পর্যন্ত সোজাভাবে ধরে সঠিক উচ্চারণ করে গড়গড়িয়ে পড়ে ফেলতে পারে সেই মুকুন্দ। ও যে ঠিক স্বাভাবিক না সেটা বুঝতে গেলে একটু পরিশ্রম আপনাকে করতেই হবে। মুকুন্দ যখন এই শীতেও ওর রঙচটা (কোনওদিনও কি আদৌ রঙ ছিল?) ফুলপ্যান্টের কোমরের নারকেল দড়ির বেল্ট টাইট করতে করতে আপনার দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্তভাবে বলে উঠবে, “বলতো সব নদী সুমুদ্দুরে গিয়ে মেশে কেন?" আপনি কী উত্তর দেবেন সবে ভাবছেন, সে সময় ও নিশ্চিত আপনাকে বলে উঠবে, “আরে বাবা, এটাতে এত ভাবনার কী আছে? বৃষ্টির জল সোজা এসে নিচে পড়ে বলে!" তখন আপনি নিশ্চিতভাবেই বুঝে গেছেন যে মানুষটার মাথার স্ক্রুগুলো অবশ্যই বেশ কিছুটা -- ঘটনাটা আর কিছুই না। আজ সকালে ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়ায় গৌতমের চায়ের দোকানের ঠেকের আড্ডাটাতে এ বারেরটা নিয়ে পাঁচ রাউন্ড চায়ের সঙ্গে পরকীয়া চর্চাটাও বেশ জমে উঠেছে। বিষয়টার সূত্রপাত হয়েছিল কিশোরী কন্যাদের ইদানিং ধূমপানের আসক্তি নিয়ে। পাড়ার কলেজের সুবাদে দীঘির ধারের বাঁধানো বেঞ্চগুলো আর ফাঁকা পড়ে থাকে না। সকাল থেকেই সেগুলো ভরে যায় যুবক যুবতীদের কল কাকলিতে। আর ব্যস, তাদের সুন্দর সুন্দর আঙুলগুলোকে অলংকৃত করতে উঠে আসে গোল্ড ফ্লেক আর নেভিকাটের ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ার গোড়ায় ধোঁয়া দিতে দিতে উঠে এসেছে পরকীয়া। আর পরকীয়ার মতো একটা মিষ্টি বিষয় যদি একবার প্রাতঃ ভ্রমণকারীদের প্লেটে পড়ে, ব্যস, তাহলে যেটা হবার সেটাই হচ্ছে। পরকীয়াবাদ থেকে শুরু করে পাড়ার কোন বৌটা কোন ভাড়াটের সঙ্গে, কোন ভদ্রলোক অফিস যাওয়ার নাম করে মেট্রোর কোনও সহযাত্রিনীকে নিয়ে সপ্তাহে পাঁচদিন মিলেনিয়াম পার্কে সময় কাটান সে সব নিয়ে নরক গুলজার হচ্ছে, এমনি সময় হঠাৎ মুকুন্দের আবির্ভাব। "আরে বাবা প্রেম জিনিসটা কী? এটা কি খায় না মাতায় দেয় এ্যাঁ! আরে বাবা, জিরেন কাঠের রসে জ্বাল দেওয়া পাটালি গুড়কে, কালো গাইয়ের দুধে জ্বাল দে ঘন কইরতে হবে। যকন বেশ মাখো মাখো, আঁটালো আঁটালো হয়ে এসেচে সে সুময় দুমুঠো বিন্নি ধানের চাল ওই দুধে ফেইলে দে বসে থাকো!, উঃ,! কি হবে বলো দিকি? পরমান্ন গো পরমান্ন। তোমরা বাঙালিরা যাকে পায়েস বলগো। তার থিকে এক চামচেও ভাগ দিতি ইচ্চে কইরবে? বলো দেকি? এমনকি পাত্তরের তলা পয্যন্তি চামচ দে কুর্যে কুর্যে না খেলি শান্তি নেই। ওই যে গো তোমরা যারে চাচিমুছি বলো গো! এবারে বলো দেকি, সেটাকে পায়েসই বলো কি পরমান্নই বলো সেটার স্বাদ কি আর ভেন্ন হয়ে যাবে? বলো দেকি, প্রেমও তাই গো। অন্তরের মধ্যে যদি মৌমাছি এসে বাসা বাঁদে, যদি মৌভান্ড বাইনে তোলে অন্তরের মাঝে তো তুমি কি কইরবে? সে তো আর তোমার নিজ হস্তে নি গো। কারে দেকে কখন যে মন মজে, সে ভাই বোনের কতাই বলো কি শ্বশুর বৌমা। কতায় বলে প্রেমে যেথা মজে মন, কিবা ভাই কিবা বোন! কী গো, বলে না! ওই দেকো, ওই দেকো, মিত্তির মশাইয়ের কান্ড দেকো!" সবাই মিলে শিব মন্দিরের দিকে চাইলাম। মন্দিরের দেওয়ালের মাথায় একটা ক্যারি ব্যাগ রাখা। সেটার থেকে বেরিয়ে আছে দুটো মাছের লেজ। মন্দিরের জানালায় দাঁড়িয়ে শোভন মিত্তির একবার করে শিব ঠাকুরকে প্রণাম করছেন আর একবার করে মাছের ঠোঙাটার দিকে চাইছেন। আর দেওয়ালের দিকে গুটিশুটি পায়ে এগিয়ে আসছে একটা সাদা কালো বেড়াল। "ওই দেকো পরকীয়া আর কাকে বলে? বাবা শিবের ওপর মিত্তিরবাবু আর ওর মাছের দিকে বেড়াল কেমন গুটিশুটি পায়ে --- হা হা হা --- যে জন প্রেমের ভাব জানেনা -- তার সঙ্গে নাই লেনাদেনা ---" শীতের কুয়াশার ভেতর একটা শতচ্ছিন্ন চেক শার্টের ওপর পেঁচিয়ে রাখা বর্ণহীন একটা তুষের চাদর মিলিয়ে গেলো। সুদীপ বসু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল, "গৌতম আর এক রাউন্ড দে -- এবারে সবকটাই চিনি দিয়েই দিস!” পরকীয়ার চিনি!