শৈত্য


গরম জল আর ঠান্ডা জলের হিসেবি মিশ্রণে শীতটা বেশ উপভোগ্য লাগে দিয়ার।
আগে এরকম লাগত না। সকালে বাথরুমে গিয়ে স্কাই লাইট বেয়ে এসে পড়া আলো দেখে মনে হত ক্যামেরায় ছবি তুলতে হবে। তারপর মনে হত এই ছবিটার বিষয় হল, "রে অফ হোপ।" তারপর বাথরুমে গিয়ে ধোঁয়া বের করত নিঃশ্বাসে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী হলুদ বাল্বের আলোয় নিজের মত আকার নিত। বাইরে থেকে বাবা ডাকত, "তোর হল দিয়া? কলেজে যাবি তো। আমাকেও তো বেরোতে হবে।"
দিয়া টাওয়েল জড়িয়ে বেরিয়ে আসত। বাবা ওরকমটাই দেখতে চাইত। ভিজে পিঠে হাত বোলাত। হাতের চেটোটা কী গরম! ভিজে চামড়ার ওপর বলেই হয়ত বেশি গরম লাগত। দিয়ার খারাপ লাগত তা নয়। পনেরো বছর বয়সে মা যখন লোকটাকে বিয়ে করেছিল, তখনই কী ভালো লাগত। 
"কিশন, ইউ আর সো হ্যান্ডসাম!", দিয়া বলেছিল। নাম ধরে ডাকতে ভালোই লাগত। লোকটা দিয়ার চেয়ে তেরো বছরের বড়, আর মায়ের চেয়ে এগারো বছরের ছোট। তবুও লোকটা বলত, "দিয়া, বাবা বলো, সাউন্ডস গুড।"
তাই সই।

রোমশ গালে ক্ষুর চালানোর পর কী যেন একটা আফটার সেভ লাগাত। হিমহিম ঠান্ডা গাল। দিয়া গালে গাল ঘষত। মা দেখত, কিছু তো বুঝত। কিন্তু বলত না কিছুই। কলেজে পড়ানো, কী করে বাকিদের টপকে ডিপার্টমেন্টের হেড হবে, তারপর ডিন অফ ফ্যাকাল্টি হবে, সেসব নিয়ে আর পলিটিক্স নিয়েই জেরবার ছিল। সেই যেবার ওরা দীঘায় গেল। দিয়াই বলেছিল, "বাবা, তুমি হোটেলে থেকো। মাকে সমুদ্রের ধারে এনগেজ করে আমি আসব।"

মা কেনাকাটায় ব্যস্ত। সেটাও শীতকাল। দিয়া একটা হলুদ রঙের হুডি পরেছিল। খুলতেই কী শীত। হোটেলের ঘরে এসে পরতে পরতে সবটুকু খোলার পর কাঁপুনি লাগছিল। বাবা নামক মানুষটাকে জড়িয়ে গা থেকে ওম শুষে নিচ্ছিল দিয়া। এমন সময়ে দরজায় মা। 
একটা বিচ্ছিরি ঠান্ডা সেঁধিয়ে গেছিল দিয়া আর মায়ের মধ্যে। সেদিন থেকে সেই শেষ দিন পর্যন্ত যখন মায়ের ঠান্ডা কপালে ওই কীসব লাগাতে বলল শ্মশানের পুরুত মশাই। দিয়া নিচু হয়ে লাগাচ্ছিল, পুরুত লোকটা জামার ওপর দিয়ে উথলে ওঠা বুকের মাংসল ভাঁজ দেখছে। দিয়া খেয়াল করেছিল। স্বাভাবিক মা মরা মেয়ের মত আছাড়ি পিছড়ি কাঁদতে না দেখেও পুরুতটা অবাক হয়েছিল। পাশে ওই বাবা নামের লোকটা। দিয়ার পড়ে যাওয়া ওড়নাটা গায়ে তুলে বলে, "দিয়া, আমি আছি।"
মায়ের গা'টা তখন কী ঠান্ডা! কে বলবে হাসপাতালে শেষ অবধি অজানা জ্বরেই মানুষটা মরেছে। চোখদুটো বন্ধ, নাহলে দিয়া জানে মায়ের দৃষ্টিটা কতটা ঠান্ডা ছিল। পাইথন যেমন করে তাকিয়ে থাকে শিকারের দিকে সেরকম ঘিনঘিনে স্যাঁতসেঁতে পাথুরে দৃষ্টি।  

তবে এটাও ঠিক, মা আসলে লোকটার ওপর ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলেছিল। বাবা নামক লোকটা এমনিও থাকত । খাওয়া পরার এমন তোফা সুযোগ, কে ছাড়ে! উপরি হল দিয়া উল্টে পাল্টে আদর করতে দিত। লোকটার অনাথ ছোটবেলা, নিজের চেষ্টায় গান শেখা, স্ট্রাগলের গল্প শুনত। ওর মাথাটা নিজের আদুড় বুকে টেনে নিত। গান! দূর, দায় পড়েছে দিয়ার মোটিভেট করতে। মাও তো করেনি। ঝোঁকের মাথায় অথবা রূপ দেখে ফ্ল্যাটে আশ্রয় দিয়েছিল। শুধু  আশ্রয় নয়, কোন একটা প্রোগ্রামে আলাপ। তারপর মেলামেশা, বিয়ে পর্যন্ত। দিয়ার মায়ের মত কোয়ালিফায়েড লেডি। দিয়ার তিন মাস বয়স থেকে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে একা থাকা, একাধিক পুরুষসঙ্গ করা দিয়ার মা এরকম একটা ন্যালাখ্যাপা, শুধু দেখনসর্বস্ব পুরুষকে বিয়ে করতে পারে, কেই বা ভেবেছিল! তবে এটা ঠিক, ছোট্ট ছোট্ট কারণে ঠাস ঠাস করে চড় মেরে নিজের স্ট্রেস রিলিফ করতে ভদ্রমহিলার সমান মাপের পুরুষ দিত নাকি! দিয়ার মায়ের সঙ্গে যে কলিগের সম্পর্ক নিয়ে কানাকানি হত, সেই উল্টে ভদ্রমহিলার ওপর মেজাজ নিত। রাজ্যের টেনশন আর বিরক্তি আছড়ে ফেলার জন্য বিয়ে করা নিরীহ বাছুরটাই ঠিক। এমনকি দিয়ার সঙ্গে জোরে কথা বললে দিয়াও ঘুরিয়ে দিত ভালো করে। মা লোকটাকে মারত, একটা সরি অবধি বলত না পরে। দিয়া অন্তত দেখেনি। দিয়া বরং লোকটার গালে লালচে পাঁচ আঙুলের দাগের ওপর হাত বুলিয়ে দিত, নোনতা জল ওর আঙ্গুল বেয়ে নামত। ও ভিজে যেত আমূল। পুরুষ বা নারী, কান্না দেখতে দিয়ার এত কেন ভালো লাগে, নিজের কাছে বেশ অবাক লাগে।

'বাবা' শব্দটা আর দিয়ার সঙ্গে কিশনচাঁদ শর্মার সম্পর্কের রসায়নটা যায় না। কিন্তু ওই সম্বোধনেই ডাকটাই রয়ে গিয়েছিল। লোকটা দিয়াকে গান শোনাত। রোজ ভোরে রেওয়াজ করত। মা মারা যাবার পরে দিয়াকে খুশি করার জন্য যা যা করার সব করত। কিন্তু ততদিনে সেই গান ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। স্ক্রিনে নায়িকা দিয়া। নায়ক, পলাশ। দিয়ার সঙ্গেই কাজ করে ভিন্টেজ কোম্পানিতে। ইউ এস বেসড। ওরা বিয়ে করে অনসাইটে বিদেশে সংসার পাতবে। তারপর কোম্পানি চেঞ্জ করবে, কত প্ল্যান ততদিনে।

তবুও বাবার নুন মরিচ গালে গাল ঘষত। যখন ফর্সা একহারা চেহারা, আর দারচিনি রঙের মণি দিয়াকে আকর্ষণ করত, দিয়া টেনে নিত এক ঝটকায়। মা মারা যাবার পরে কীরকম ভিখিরির মত হয়ে গিয়েছিল লোকটা। পোষা কুকুরের মত দিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে লেজ নাড়ত। হয়ত ভাবত, দিয়াকে খুশি করেই থাকতে পারবে ফ্ল্যাটে। এই লোকটা নাকি বোহেমিয়ান ছিল । ছ্যা। মাথার ওপর ছাদ, আর বসে বসে খেলে বোহেমিয়ান হবার ভূত অনেকের মাথা ছেড়ে হিমালয়ে হাঁটা দেয়। দিয়ার ক্রমশ ঘৃণা হত। রক্ত মাংসের গা গুলোনি গন্ধ লাগত লোকটার শরীরে।
পলাশকে বাড়িতে আনতে দিয়ার লজ্জা করত। বাবা নামক লোকটার জন্য নয়। কিন্তু সোফার ওপর ডাই করা ছেড়ে রাখা জামা, আন্ডারগার্মেন্টস। টেবিলের ওপর টুকরো টুকরো পেঁয়াজ, খোলা লিকারের বোতল। পলাশ খুব ফিট ফাট। দেখলে নাক সিঁটকে বলবে, "দিয়া, ওয়াশ ইট। তারপর আমি আসব।"

বাবা নামক লোকটা বসে থাকে রোজ, শীতের রোদে পা দিয়ে। কিস্যু কাজ নেই। দিয়া একদিন খেঁকিয়ে বলে, "বাবা, পরিষ্কার করে রাখতে পারো না ঘরটা? সকাল থেকে গিটারে টুং টাং করলে হয়?"
লোকটা ভীতু বেড়ালের মত তাকায়। সেদিন দিয়া ফিরে এসে দেখে, ঘর মোটামুটি গোছানো। অন্তত সোফাটা পরিষ্কার। আনন্দ হবার আগেই বিরক্তি এসে জমা হয়। জামাকাপড় একটাও ভাঁজ করেনি। দলা করে গুঁজে দিয়েছে আলমারিতে। মায়ের মত রাগ হচ্ছে। ছুটে গিয়ে এলোপাথাড়ি চড় মেরেও শান্তি হয় না দিয়ার। বিছানার পাশে রবারের ঝাঁটার মত আছে, রাতে চাদর ঝাড়ার। সেটা তুলে নিয়ে এলোমেলো মারতে থাকে দিয়া। বলতে থাকে, "ইউ আর আ হোপ্লেস। গো টু হেল।"
নাহ, হবে না। অনেকদিন হল। সেদিন মার খেয়ে নাক দিয়ে রক্ত বেরোল। বেসিনে সেই রক্ত লেগে। এত নিষ্কর্মা মানুষ হয়!
"শোনো, এবার তুমি চলে যাও। এই ফ্ল্যাট মায়ের নামে ছিল। আমি জয়েন্ট ওনার ছিলাম। এখন এটা আমার। আমি চাই না, তুমি থাকো।" এটা বলা ছাড়া কোনই উপায় ছিল না দিয়ার। একটা দামড়া লোক ঘাড়ে বসে খেলে কাঁহাতক সহ্য করা যায়! পলাশও চায় না। 
"কোথায় যাব?", ইচ্ছে করেই করুণ করেছিল গলাটা। 
"যেখানে খুশি। রেল স্টেশনে, ফুটপাথে। তবে এখানে আর নয়।"
"তোমার মায়ের পেনশনটা কিন্তু আমি ক্লেম করতে পারি।" কেটে কেটে বলেছিল লোকটা।
"হোয়াট?" দিয়া নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি। কেন্নো ফণা তুলতে কবে শিখল! তবে তখনই মাথায় খেলে গিয়েছিল, অন্য হিসেব। হ্যাঁ, ফণাটা নামিয়ে ফেলার কার্বলিক অ্যাসিডের যোগান তো আছেই।  
"শোনো, মায়ের পেনশন তুমি কী করে পাও, আমিও দেখে নেব। ভালোয় ভালোয় কেটে পড়, না হলে কিন্তু তোমাকে চোর আর মলেস্টার বানিয়ে বাকি জীবনটা এমন কেস দেব, জীবনে বেরোতে পারবে না।" দিয়ার চোখেও পাইথনের দৃষ্টি।

লোকটা একেবারে মরে যাবে, দিয়া চায়নি। বাসের তলায় থেঁতলে একটা রক্তের পুকুর হয়েছিল, তাতে সাঁতার কাটছিল পকেট থেকে ছিটকে যাওয়া কতগুলো সাদা কন্ডোম। সুইসাইড নয়, খুনও নয়। অ্যাক্সিডেন্টই। একটা বাস আরেকটা বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে ফুটপাথে উঠে গিয়েছিল। কিন্তু ওই রক্তের পুকুরে একটি ভাঙা পারফিউমের বোতল মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল। কন্ডোমগুলো দিয়ার জন্য নয়। প্রায় এক বছরের ওপর দিয়া আর উষ্ণতা খুঁজত না কিশনচাঁদের শরীরে। বরং দিয়ার পয়সায় ওই কন্ডোমগুলো কেনা। দিয়ার অগোচরে। কিন্তু পারফিউমটা? ল্যাভেন্ডার। একটা বিশেষ দোকানের বিশেষ কোম্পানির। ওটা কার জন্য? দিয়াকে খুশি করার শেষ চেষ্টা হিসাবে? দিয়া তো ওতে খুশি হত না। ঘাড় ধরে বের করেই দিত। তবুও দাঁত ভেঙে যাওয়া, চোখ ঠিকরে বেরোনো শরীরটায় একবার কেন হাত রাখতে ইচ্ছে করছিল! না রাখেনি হিয়া। পরমুহূর্তে নাকে রুমাল দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। 

পলাশ আর দিয়া এখন থাকে ওই ফ্ল্যাটেই। সেদিন ঘর গোছাতে গিয়ে গিটারটা নিয়ে কী করব বুঝতে পারছিল না দিয়া। পলাশই বুদ্ধি দেয়, "সুন্দর করে পালিশ মেরে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখো। ভালো লাগবে।"
তারপর নতুন কেনা গ্লাসটপ বার্নারে দিয়ার জন্য কফি বানাতে এগিয়ে যায়। কফির গরম ধোঁয়া আর গায়ের হালকা উষ্ণতা দিয়া কপালের ধারে চেপে ধরে চুমুক দেবার আগে। ছোটবেলাকার অভ্যাস। ওর সাইনুসাইটিস ছিল ছোটবেলায়। এখন নেই। অভ্যাসটা রয়ে গেছে। 
কফিটা আসবে। তার আগে দিয়া গিটারের তারে আঙ্গুল ছোঁয়ায়। যার জিনিস তার হাত শেষ পড়েছে ছ'মাস আগে। বড্ড বেশি ঠান্ডা না তারগুলো!  
অত ভাববে না ও। আপাতত গরম কফিতে চুমুক দেবে। শীতের সন্ধেটা গরম করার কফি ছাড়া আর যে উপায় আছে, পলাশের চোখে তার আভাস। দিয়া এগিয়ে গিয়ে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে। পলাশ একটু শিউরে ওঠে। তারপর বলে, "দিয়া কী ঠান্ডা তোমার হাতগুলো!"

তবে কি ওই গিটারের তারে লেগে থাকা ঠান্ডাটাই ওর আঙুলে! পলাশের মধ্যে এই ঠান্ডাটা বুনে দিলে দিয়াও কি ওই লোকটার মত একটা রক্তের পুকুর হয়ে যাবে!
"কী হল বেবি, কাম অন।" পলাশ দিয়ার কানের লতিতে কামড় দিচ্ছে।
"আমার খুব শীত করছে পলাশ, প্লিজ এখন থাক।" দিয়া সরিয়ে দেয়। সরে আসে। 
দিয়াকে আগে উষ্ণ হতে হবে। তারপর।

বৈশাখী ২০২৪