লম্বা গোলাপি রঙের কাগজটা হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক হেমেন্দ্র সামনের করিডোরটায় এসে দাঁড়াল। তারপর মুখে ফুটে উঠল এক বিন্দু হাসি। খেয়াল হল না, তার এই অদ্ভুত অভিব্যক্তির দিকে চেয়ে ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুভেন্দু। বিকেলবেলার স্বপ্নটা দেখে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন সিদ্ধেশ্বরবাবু। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে বিছানার পাশ থেকে লাঠিটা টেনে নিলেন তিনি। বাথরুমের দরজার সামনে থেকে জলের আওয়াজ আসছে। রেবা বিকেলবেলা রোজ স্নানে যায়। বারান্দার চেয়ারটায় এসে বসলেন। পাঁচিল পেরলেই গঙ্গা, অথচ সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে কেনা, ছোট শালির বাড়ির কাছে শ্রীরামপুরের এই বাড়িটা তেমন করে ভোগ করতে পারলেন না। শরীর সুস্থ না থাকলে ভোগে আনন্দ নেই। চেয়ারটায় বসে গঙ্গার স্রোতের দিকে তাকিয়ে বুক ভর্তি শ্বাস নিলেন তিনি। একগুচ্ছ আগাছা জলের তোড়ে বনবন করে ঘুরছে, জোয়ার বোধহয়। লাঠিটা হেলান দিয়ে রেখে চেয়ারের হাতলের ওপর হাত রেখেছেন, হঠাৎ চেহারাটা চোখে পড়ল তার। গঙ্গার পাড় থেকে তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। তাহলে কি স্বপ্নটা ভাঙ্গেনি? তিনি কি এখনো ঘুমের মধ্যে? পারকিনসনস চোখের জ্যোতি কাড়েনি, এখনো রোজ সকালে খালি চোখে কাগজ পড়েন তিনি। কিন্তু একশো ফুট দূরের চেহারা এমন স্পষ্ট? শেষবার, সেও তো বছর পঁয়ত্রিশ হল যখন দেখেছিলেন, তখন ঠিক এইরকমই একটা জামা পরেছিল। মিলন হাসিমুখে এসে বারান্দাটার ঠিক নিচে দাঁড়াল। দোতলা বারান্দা থেকে নিচের তলাটা স্পষ্টই দেখা যায়। চেয়ার ছেড়ে উঠে রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন সিদ্ধেশ্বরবাবু। একটু ঝুঁকে কিছু বলতে গেলেন মিলনকে, হয়তো কুশল প্রশ্ন। কিন্তু পরক্ষণেই থমকে গেলেন। কী করে সম্ভব? কিছুক্ষণ যেন চোখদুটো অন্ধকার হয়ে গেল, পা দুটো টলে গেল একটু। মাথার ব্যথাটা ফিরে আসছে, তীব্রভাবে। কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে থাকলেন। বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল বোধহয় এমনি করে। তারপর নিজেকে সামলালেন আবার। চোখ খুললেন। ভাগ্যিস পড়ে যাননি? হঠাৎ পাশে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। এ কী? মিলন যে একেবারে তার পাশের চেয়ারে এসে বসেছে। মুখ জুড়ে সেই হাসিটা। কথা বলতে গিয়ে যেন গলাটা কেঁপে গেল, তবু বললেন, “মিলন, আমি তো কোন অন্যায় করিনি? তুই বল, করেছিলাম কি?” “অন্যায় করিসনি, অবিশ্বাস তো করেছিস?” স্মৃতির ঘর খালি করে ফিরে ফিরে আসছে যেন একটাই ছবি। সেই ঘটনাটা কত বছর হল মনেই পড়েনি। ধীরে ধীরে ধুলো জমতে জমতে কত স্মৃতি যে ঢাকা পড়ে যায়। তবে কি আজ সেটা মনে করাতেই এমন করে এসেছে মিলন? যত মনে পড়ছে, মাথাটা যেন অসহ্য যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট মনে পড়ছে দিনটা। কলকাতার রিচি রোডের পৈতৃক ভিটে তখন বিক্রি হয়নি। ঠিক এমনি একটা রেলিং দেওয়া বারান্দা ছিল সে বাড়িতেও। বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সিদ্ধেশ্বর, মুখে একরাশ চিন্তার রেখা। তাঁর দীর্ঘশ্বাস শুনে পাশে এসে হাতে হাত রাখলেন রেবা, “কী হয়েছে গো? কোন খারাপ খবর নাকি? কে ফোন করেছিল?” “মিলনকে মনে আছে তোমার?” “হ্যাঁ সেই তোমার কলেজের বন্ধু তো? এই তো কমাস আগে কিছু টাকা ধার চাইতে এসেছিল?” “কিছু টাকা নয়, অনেকগুলো টাকা। একটু আগে তার স্ত্রী ফোন করেছিল।” “কেন কি হয়েছে?” “মিলন মারা গেছে।” “হ্যাঁ, সে কী?” “একবছর ধরে নাকি ক্যান্সারে ভুগছিল। এখন বুঝলে চেহারাটার ওরকম অবস্থা কেন হয়েছিল? ” “ইশ, সত্যি খুব খারাপ খবর গো।” “হুম।” “শুধু হুম? এই দাঁড়াও দাঁড়াও, তোমার এতদিনের বন্ধুর এমন অকাল মৃত্যু। কিন্তু তোমার মুখে তো দুঃখ নয়, বরং চিন্তার ছাপ। কী ব্যাপার বল তো?” “ও কিছু না।” “কিছু তো একটা হয়েছেই। লেট মি গেস। ও, বুঝেছি। তুমি ভাবছ অতগুলো টাকা আর ফেরত পেলে না, ঠিক বলিনি?” “যদি ভেবে থাকি সেটা কি অন্যায়?” “অন্যায় নয়, কিন্তু একটা মানুষের জীবনের চেয়ে বড়ো কি?” “আহা, যদি তেমন আপন কেউ হত আলাদা ব্যাপার। কিন্তু পুরনো বন্ধু, সেই কলেজের পর পনেরো বছর আর দেখা সাক্ষাৎ নেই, দুম করে এসে টাকা ধার চাইতে চলে এল। ধীরে ধীরে তো দেখাশোনা না হতে হতে সম্পর্কগুলোও ঢিলে হয়ে যায়, হয় না?” “তবু তুমি এক কথায় টাকাটা দিয়ে দিলে যে?” “জানোই তো আমি না করতে পারিনা। আর তাছাড়া, কলেজে থাকতে নানান রকমের উপকার পেয়েছি। ও বেশ কয়েকবার আমায় টাকাও ধার দিয়েছে। তখন পকেট মানির যুগে সেটাই বা কজন দেয়? ওদের অবস্থা ক্রমাগত অবনতি হয়েছে, আমার উন্নতি। কিন্তু সেসব ছিল ছোটখাটো এমাউন্ট। এ যে অনেকগুলো টাকা!” “তোমার কাছে ওই টাকা কটা না থাকলে বিরাট ক্ষতি তো হবে না?” “নাই বা হল, টাকাটা তো আমার কষ্ট করে উপার্জন করা। কেউ বলতে পারে সারা জীবন আর্থিক অবস্থা একই থাকবে কিনা? কোন সময় দরকার পড়ে তাই বা কে বলতে পারে? আর তাছাড়া মিথ্যে বলে টাকাটা নিল যে?” “ও কথা কেন বলছ?” “ও কেন টাকাটা চেয়েছিল মনে আছে? ” “হ্যাঁ, ওর বউয়ের চিকিৎসার জন্য। ” “কিন্তু ওর ক্যান্সার হয়েছিল, ওর বউয়ের নয়। সেক্ষেত্রে ও জানত, ওর ক্যান্সার হয়েছে জানলে আমি যেহেতু বুঝতাম ওর মৃত্যু অবধারিত, তাই টাকা ফেরত না পাবার ভয়ে হয়তো টাকাটা দিতাম না। এটা কি একরকম চিটিং নয়? ” “আ হা, সদ্যমৃত একটা বন্ধুর সম্পর্কে এরকম কথা নাই বা বললে?” “তুমি জানতে চাইছই বা কেন? কথাগুলো অপ্রিয় হতে পারে, মিথ্যে তো নয়? এখন এই যে ওর স্ত্রী আসছে শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ করতে, সেটা করতেও তো টাকা লাগবে? এই ধরণের লোক দেখানো আতিথেয়তা না করে পাওনা টাকা শোধ করলেও তো হয়? ” “আমি তোমার কথাগুলোর শেষ মুহূর্তেও আশা করেছিলাম তুমি বলবে টাকাগুলো শ্রাদ্ধ পালন করে খরচ না করে নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেওয়া উচিত। যাক বললে না যখন কী আর করা যাবে? উনি কখন আসবেন?” “কে?” “মিলনবাবুর স্ত্রী?” “ও তখন তো বলেছিল ঘন্টাখানেক। ” “আচ্ছা, আমি কিছু জলখাবার রেডি করি। কিছু ফল মিষ্টি দেব, অশৌচের মধ্যে আবার খাবেন কিনা?” “হ্যাঁ কুসংস্কারের তো অভাব নেই এ সমাজে।” “কু-সংস্কার নাম দেওয়াটা ঠিক কিনা কি জানি? অন্তত যতক্ষণ তা দিয়ে কোন খারাপ হচ্ছে না। ইংরাজিতে যেমন সুপারস্টিশন বলে, বাংলাতেও অতিসংস্কার নামটা যেন ভালো হত। কুসংস্কারটা বড্ড জাজমেন্টাল।” কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেছিলেন রেবা। বারান্দায় তার পরেও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন সিদ্ধেশ্বর। কী করে রেবা বলছে এই শ্রাদ্ধের ব্যাপারটা কারো খারাপ করছে না? দুঃখপ্রকাশের অভিনয় করে একটা মৃত মানুষের বাড়িতে পাত পেড়ে খেয়ে ফুর্তি খারাপ নয়? অবশ্য এটাও সত্যি যে মিলনের মৃত্যু সংবাদ শুনে তাঁর নিজেরও কোন কষ্ট হচ্ছে না। কলিংবেলটা বেজেছিল সময়েই। যিনি দরজা দিয়ে ঢুকেছিলেন তাকে দেখে কিন্তু বেশ সমীহ করতে ইচ্ছে হয়। একটা ঘিয়ে রঙয়ের শাড়ি পরেছেন। সুন্দরী নন, তবে চোখে মুখে আভিজাত্যের ছাপ প্রকট। মুখ জুড়ে ক্লান্তি আছে, চোখের তলায় কালি আছে, তবু উপচে পড়া দুঃখ নেই, বরং মুখে হাল্কা হাসি আছে। আনন্দের হাসি নয়, সৌজন্যের। তাকে বসতে বলেছিলেন সিদ্ধেশ্বর। ভদ্রমহিলা নমস্কার জানিয়ে বলেছিলেন, “বসার সময় হবে না জানেন। আসলে বোঝেনই তো, আমি একটা অতি সাধারণ প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করি। একজন ক্যান্সার পেশেন্টের চিকিৎসা তো বিরাট ব্যাপার। কোন আশা নেই জেনেও অন্ধকারে হাতড়ে যাওয়া, সর্বস্বান্ত হওয়া এই আরকি। পাওনা টাকা পয়সার জন্য রোজই এখানে ওখানে যেতে হচ্ছে।” “হ্যাঁ খরচাপাতি তো আছেই। তার ওপর শ্রাদ্ধ শান্তির খরচ তো কম নয়!” বলেছিলেন রেবা। “না না, সেসব খুব ছোট করে যেটুকু না করলেই নয়। লোকজন খাওয়াব না। যেটুকু টাকাপয়সা আছে, সেটুকু তো ছোট ছেলেটার ভবিষ্যৎ ভেবে রাখতে হবে। ” থমকে গেছিলেন রেবা মিলনের স্ত্রীয়ের কথাগুলো শুনে। এই কথা তোলার জন্য যে রেবার অনুশোচনা হয়েছিল সেকথা সিদ্ধেশ্বরের দিকে ওঁর তাকানো দেখেই বুঝেছিলেন সিদ্ধেশ্বর। পরক্ষনেই ভদ্রমহিলা নিজের ব্যাগ হাতড়ে বলেছিলেন, “এসেছি একখানি বিশেষ কাজে। আমার স্বামীর ইন্সিউরেন্সের কাগজ ঘেঁটে দেখলাম, একটার বেশ খানিকটা অংশ আপনাকে নমিনি করা আছে। আগে এটার পুরো নমিনি আমিই ছিলাম, পরে চেঞ্জ করেছে মনে হয়। কোন কারণ থাকবে নিশ্চয়ই। তো আপনি কি কিছু ডকুমেন্ট নিয়ে আমার সঙ্গে একদিন ইন্সিউরেন্স অফিসে যেতে পারবেন?” কিছুক্ষণের জন্য সময় যেন থমকে গেল। এ ওর মুখ চাওয়াচায়ি। মাথাটা হঠাৎ করে অন্যখাতে চলতে থাকল সিদ্ধেশ্বরের। কে যেন তার গালে খুব জোড়ে একটা থাপ্পড় কষিয়েছে এইমাত্র। তিনি কিছুই বলতে চান না। তবু মুখ থেকে কী করে বেরিয়ে এল একগুচ্ছ শব্দ, “আমি যাব আপনার সঙ্গে, কিন্তু ওই টাকাগুলো তুলে আপনাকে দিয়ে দেব। ওগুলো আমি নিতে পারব না। ” “তা কি হয়? অনেক ভেবেই নিশ্চয়ই উনি এ কাজ করেছেন? যদিও আমাকে এ বিষয়ে কিছুই জানাননি।” “চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে বলছি কী হয়েছিল। ”এক থালা ফল মিষ্টি এনে টেবিলের ওপর রাখলেন রেবা। তারপর বললেন, “এগুলো খেয়ে নিন। কত ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। ” “আমি এত তো খেতে পারব না দিদি, তবে আপনি যখন হাতে করে এনেছেন একটা মিষ্টি তুলে নিচ্ছি। আমি বরং জলটা খাই। গরম তো, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।”-একথা বলে ঢকঢক করে এক গ্লাস জল গলাধঃকরণ করলেন ভদ্রমহিলা। এবার জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁ কী যেন বলবেন বলছিলেন?” “ও বলেছিল ওর চিকিৎসার জন্য বড্ড খরচ হয়েছিল। আমার কাছে দুঃখের কথা বলছিল। তবে টাকা ও চায়নি। আমিই দিয়েছিলাম। সে কারণেই হয়তো আমায় নমিনি করে গিয়েছে। ও টাকা...” সিদ্ধেশ্বরের কথা কেড়ে নিয়ে রেবা বলে উঠলেন, “ও টাকা শোধও করে গেছেন। এই তো দিন কয়েক আগে, একটা অচেনা ছেলে এসে বলল সিদ্ধেশ্বরবাবু পাঠিয়েছেন। তার হাতেই টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমার মনে হয় নমিনিটা তারপর চেঞ্জ করতে ভুলে গেছেন।” “অচেনা ছেলে? কী নাম বলুন তো?” “নাম তো ভুলে গেছি। এই তোমার মনে আছে?” সিদ্ধেশ্বরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন রেবা। অন্যমনস্ক সিদ্ধেশ্বর কিরকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে উঠেছিলেন, “আমারও মনে নেই, এই বছর ত্রিশেক বয়েস। ফরসা, লম্বা মতন।” “কী জানি অফিসের কেউ হবে হয়তো, ঠিক বুঝতে পারছি না। অফিস থেকে তো প্রায়ই লোকজন আসত দেখা করতে। শেষের দিকে আসলে চিকিৎসার ধকল শরীর আর নিতে পারছিলনা। সব ভুলে যেত, ফ্যাল ফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। একখানা চেয়ারে মুখ গুঁজে বসে থাকত শুধু। এ বড়ো খারাপ রোগ জানেন।” কী যেন মনে পড়ে চোখে জল এল তাঁর, আঁচল দিয়ে কাপড়টা একটু মুছে আবার বললেন, “মানুষটার বাঁচার কী ভীষণ ইচ্ছে ছিল বলুন তো? নিজের চিকিৎসার জন্য টাকা ধার করেছে। আমায় অবশ্য সত্যিটা সঙ্কোচে বলতে পারেনি। বলেছিল পুরনো কোন বন্ধুর থেকে আমার চিকিৎসার জন্য টাকা ধার করেছে, নামটা বলেনি। সেবার আমারও তো যায় যায় অবস্থা। থাক সে কথা। নমিনেশনে আপনার নাম দেখে ওর একটা ফোন নম্বর লেখা ডায়েরি খুঁজে আপনার ফোন নম্বর পেলাম।” মিলনের স্ত্রীর কথা শুনে আবার সিদ্ধেশ্বর আর রেবা মুখ চাওয়াচায়ি করলেন। সবার মুখ থমথমে। বেরিয়ে গেলেন তিনি। আর কত যেন প্রশ্ন রেখে গেলেন চিরদিনের জন্য। রেবা শুধু ভদ্রমহিলা চলে যাবার পর কঠিন চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল, “ফোন করেছেন দেখেই ধরে নিলে শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ করতে আসছেন?” কিছু বলবেন বলে মুখ খুলেছিলেন সিদ্ধেশ্বর। কিন্তু রেবা সে উত্তরের অপেক্ষা না করে উধাও হয়েছিলেন। পঁয়ত্রিশ বছর পেরিয়ে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন সিদ্ধেশ্বর। ডাকলেন, “মিলন, অনুশোচনা বড়ো বেয়াড়া জিনিস। সে ভাবায়, রাত জাগায়, হঠাৎ হঠাৎ নিজের ওপর ঘেন্না অবধি ধরায়। সেদিন টাকাটুকু না নিয়ে ভেবেছিলাম সব সমস্যার সমাধান করব, হল না। যার কাছে ক্ষমা চাইবার ছিল, তাকে এই পঁয়ত্রিশ বছরে প্রথমবার কাছে পেলাম। ক্ষমা করবি ভাই সেই একসময়ের প্রিয় বন্ধুকে?” সিদ্ধেশ্বর চাইছেন পুরোনো বন্ধুকে বুকে টেনে নিতে। কিন্তু তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না কেন? তাঁর বারান্দায় তিনি বসে নেই? সামনে যেন খুব অন্ধকার, একটা টানেল। আলোর শুধু একটাই বিন্দু, বহুদূরে। তিনি দৌড়াচ্ছেন টানেল ধরে আর ডেকেই চলেছেন, “ক্ষমা করবি মিলন?” টানেলের শেষে সেই এক বিন্দু আলোর নিচে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে তাকে দুহাত তুলে ডাকছে মিলন। অথচ তিনি যতই এগোচ্ছেন, দূরত্বটা কমাতে পারছেননা কিছুতেই। “পারলাম না, বুঝলে। একেই রোগটা মস্তিষ্কের, তার ওপর ওরকম একটা চোট, একেবারে ব্রহ্মতালুতে। স্ত্রী বাথরুমে ছিলেন, একা একা বারান্দায় গিয়ে বিপত্তি ঘটিয়েছেন। পড়ে গেছেন পিছন দিকে। মাথাটা বিচ্ছিরিভাবে দেওয়ালে বা মেঝেতে ঠুকে গেছে, সঙ্গে মাথার পেছনটাও ফেটে গিয়েছে।” পিছন ফিরে শুভেন্দুকে দেখতে পেয়ে ই-ই-জি রিপোর্টটা দেখিয়ে জুনিয়র ডাক্তার শুভেন্দুকে কথাগুলো বলল নিউরোলজিস্ট হেমেন্দ্র বেড়া। হাতে থাকা লম্বা কাগজটার ওপর কতগুলো তরঙ্গ। সেটার একটা কোণা বাঁহাতে ধরে অন্যদিকটা ডানহাতে সোজা করতে করতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন, “এমন ধোঁয়াশা যার জট কেউ কোনদিন খুলতে পারবে না।” “কি আছে স্যার ইইজি রিপোর্টে?” প্রশ্ন করল শুভেন্দু। “গামা ওয়েভ, মৃত্যুর আগে মস্তিষ্ক গামা ওয়েভ তৈরি করেছে।” “এর মানে কী?” “সঠিক মানে তো জানা কোনদিনই সম্ভব নয়। তবে গামা ওয়েভ খুব দ্রুত কোন প্রসেসিংয়ের ফলে হয়। আঁধার শেষে আলোর সন্ধান যার কাছে, তাকে যে জিজ্ঞাসা করবার কোন উপায় নেই? তবে সম্ভাবনা খতিয়ে দেখলে মনে হচ্ছে, মৃত্যুর আগে পুরনো স্মৃতিগুলোই কেবল পাক খাচ্ছিল মস্তিষ্ক জুড়ে। যাক মৃত্যুর আগের সময়টা অতটা খারাপ নয় কি বলো? মিঠে স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই অচেনা পথ হাঁটা যাবে না হয়?” একটু থেমে আবার বলল, “ও হ্যাঁ, আমার রিপোর্টগুলো হাতে পেলাম আজ বুঝলে? ম্যালিগন্যানসি আছে। ছুটিতে যাব শিগগিরি, অনির্দিষ্ট কাল।”