"ভারী অসভ্য তো?" "এতে অসভ্যতামির কী দেখলে! এতক্ষণ তো তোমার দখলে ছিল।" "তা বলে এভাবে?" "শোন, একদম বাজে বকবে না। মেরে তোমার মাথা ফাটিয়ে দেব...বুঝলে..." "মাথা ফাটিয়ে দেবে? কী সাহস, তা অবশ্য তুমি পারো বটে!" "অফিস থেকে ছুটির পর বাড়ি ফিরে কোথায় একটু বাইরে আড্ডা মারবে, গল্পগুজব করবে তা না, খালি টিভির সামনে পড়ে থাকা!" ঝগড়া করতে করতে দুজনেই একটু থামল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পরে আবার শুরু হল ভালবাসার আতর মেশানো বাকযুদ্ধ..... “আমি একা টিভি দেখি? তুমি দেখ না?” “অ্যাই শোন, আস্তে কথা বল। তোমার গলার আওয়াজে কিছুই শোনা যাচ্ছে না!" “এই হয়েছে আর এক চ্যানেল, স্টার জলসা আর জি বাংলা! যত রাজ্যের অবাস্তব, অখাদ্য সংসার ভাঙার গল্প!" "উফফফ...! থামবে, না আমি মাকে ডাকব..." "সারাক্ষণ শুধু সিরিয়াল, সিরিয়াল, আর সিরিয়াল...! দু’চোখের যেন ক্লান্তি নেই...! এক কাপ চা চেয়েও..... " "প্লিজ...! শেষ হলেই বানাচ্ছি...।" অনির মনটা বেশ কিছুমাস ধরে ভাল নেই। অফিসে একটার পর একটা কাজের চাপ। ভোটার লিস্টে নাম তোলা থেকে শুরু করে, মিটিং, ভিসি, হোয়াটস্ আপ, ট্রেনিং! কাজের শেষ নেই। এখন আবার জুটেছে "দুয়ারে সরকার!" সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। জ্বলিয়ে মারছে। এদিকে ডি.এ. দেবার বেলায় নেই। শুধুই পালায় পালায়! অফিস থেকে এসেই জাপান-জার্মানির খেলাটা খুলেছে, অমনি হোম মিনিষ্টারের গর্জন শুরু হল। ওঁর "আলতা ফড়িং," "গাঁটছড়া," "মাধবীলতা" আর দেখা হচ্ছে না। কদিন ধরে। জাপান ভালোই খেলছে। মনে হচ্ছে ম্যাচটা জিতবে। এশিয়ান দেশগুলো অন্য দেশের তুলনায় কমপ্যারাটিভলি বেশ ভালোই খেলছে! গতকাল আর্জেন্টিনার সৌদির কাছে হারের পর থেকে মনটা আরও ভারাক্রান্ত। "মেসি ম্যানিয়া" যে গ্রাস করছে তা আর বলার অপেক্ষা...! আজ আবার বেলজিয়াম, স্পেনের খেলাও আছে। দুটো দলই ভাল খেলছে। বেলজিয়াম তো গত বছর অনেক দূর এগিয়েও আর যেতে পারল না। ওদের স্টার প্লেয়ারটা কী যেন নাম.....? কালো পেটানো চেহারা,.লুকাকু...! হাফটাইম হতেই দোলু রিমোটটা ছোঁ মেরে কেড়েই সোজা ঘুরিয়ে আবার স্টার জলসা। বাপরে বাপ! পারেও বটে...! অনি আর কথা না বাড়িয়ে সোজা বারান্দাতে গেল ফুঁকতে। ভেবেছিল দু চারটে গোলে শট, ভাল ফ্রি কিক হাফ টাইমে আর একবার দেখে সুখ মেটাবে। তা হল না। দোলুর ছেলেমানুষি ভরা দস্যিপনার কাছে হার মানতে হল। দোলুর এই গুণটাও তারিফ করতে ছাড়ে না পুজোর পরে গতমাসে বাড়িতে চোর এসেছিল। দোলু আওয়াজ পাওয়া মাত্রই তেড়ে গেছে ধরতে। ভাগ্যিস চোর বাবাজীবন পালিয়েছে। ধরতে পারলে পেঁদিয়ে গোলপোস্টের বাইরে....।এই বয়সেও এত ক্ষিপ্রতা..।! ফুটবল খেললে পারত। আসলে সারাদিন একা একা থাকে। হয় গল্পের বই, না হলে টিভি। কোথাও বেড়াতে যেতেও মন চায় না। আর একা একা যাবেই বা কোথায়..? বাইরে বেরোলেই একরাশ সমালোচনা..., পিএনপিসি তো আছেই! ভাই, ভাইয়ের বৌ, ওদের পুচকে দুটো নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। আলাদা সংসার। দুলদুলির অফিস। বৌদিকে দেবার মতন সময় নেই। তাছাড়া বাবাকে দেখতে হচ্ছে। ওষুধ দেওয়া থেকে শুরু করে, খাওয়ানো, বাথরুম! মাও প্রয়োজন ছাড়া বিশেষ কথাবার্তা বলে না। তার কারণ তো একটাই.... জাপান-জার্মানির খেলা শেষ হল। বহু কাঙ্খিত চা এসে গেছে। দোলু "এক্কা দোক্কা"তে বুঁদ হয়ে আছে। জাপান টেরিফিক খেলেছে। একটু পরেই "স্প্যানিশ আর্মাডা" নামবে। যতদূর জানে দোলুর ফুটবলে কোন ইন্টারেস্ট নেই... এমনকি ক্রিকেটেও.... চা খেয়ে অনি সিগারেটের সাদা সাদা রিং ছাড়তে ছাড়তে আকাশ পাতাল ভাবছে। সত্যিই তো...? আজন্ম অসুখী, বাবা মা মরা দোলুকে সঙ্গ দেবার কেই বা আছে...? বিষয়টা নিয়ে কোনদিন ভাবার অবকাশ পর্যন্ত হয়নি। দশ বছরের টানা সংসার। বন্ধুরা কেউ কেউ সিঙ্গল, কেউ ডাবল, কেউ বা গোলের হ্যাট্রিক করেছে। ওরা দুজনে এখনো অবধি একটাও গোল দিতে পারেনি। চেষ্টা যে কম করেনি তা নয়....। দু একবার পেনাল্টি বক্সের গভীরে ঢুকেও গোল নষ্ট হয়েছে...। মা তাই একটু দোলুর উপরে...! বাস্তবটা বড়ই কর্কশ। সে ফুটবলের ময়দানই হোক বা সংসারের ঘেরাটোপ! স্পেন শুরুতেই গোল দিয়েছে। দুরন্ত খেলছে। ওদের খেলাতে একটা ছন্দ আছে। একটু পরেই অনির অফিস থেকে ফোন আসতেই মনটা ভার.....। ওকে দুদিন পরেই হিঙ্গলগঞ্জের সামসেরনগরে ছুটতে হতে পারে। ওখানে মুখ্যমন্ত্রী আসছেন। বিশাল কর্মযজ্ঞ। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে সাহেবের টেন্সড্ ভয়েস শোনা যাচ্ছে...... "শুনুন না, আপনাকে কদিনের জন্যে একটু সামসেরনগর যেতে হবে..." "স্যার, কবে...?" "আপনি প্রস্তুতি নিয়ে তো রাখুন...!" "স্যার..." "ওখানে সব রকম ব্যবস্থায় থাকবে। কোন টেনশনের কারণ নেই। আর আমি তো আছিই..." সামসেরগঞ্জ যাওয়া মানেই দু তিনদিনের ব্যাপার। সন্ধ্যের খেলাগুলো মিস করতে হবে...! আজীবন ফুটবল পাগল অনির মাথায় যেন বাজ পড়ল। “একটা রাতের তো ব্যাপার..." "আসলে আপনারা শুধু শুধু আমার জন্যে...!" "…শুনুন, এত রাতে মেসে ফিরে লাভ নেই। তার চেয়ে...." "ওকে, যখন বলছেন......" কলিগ রক্ষিত সাহেব, হর্ষবাবুকে সঙ্গে করে সামসেরনগর থেকে যোগেশগঞ্জ হয়ে ভেসেলঘাটে আসতে অনেকটাই সময় লাগল। গাড়িতে আসতে যেতে সিএম ম্যামের ডিএমকে ধমকানি, বনবিবি, বাংলাদেশ বর্ডার, বাঘ, শীতবস্ত্র বিতরণ, বকেয়া ডিএ না পাবার খেদ বিশ্বকাপ এই নিয়েই তিনঘন্টা কেটে গেল। হর্ষবাবু বেশ রসিক মানুষ। লেখালিখি করেন। বেশ মিশুকে আর আমুদে লোক। পরোপকরা করা যেন উনার একটা অভ্যাস। "আমার জীবনের ধ্রুবতারা" নামে একটা উপন্যাস বহুদিন আগে শুরু করেও শেষ করতে পারেন নি। কেন পারেন নি, কারণ কিছু একটা আছেই.....। ইন্সপেক্টর বিসিডব্লিউ রক্ষিত সাহেবকে বসিরহাটে নামিয়েই অনি হর্ষবাবুকে নিয়ে সোজা উলুবেড়িয়ার বাসাতে। গাড়িতে আসতেই দুলদুলির ফোন..... "বৌমণির বমি, হালকা মাথা ঝিমঝিম করছিল........." "হঠাৎ......." "দুদিন ধরে রাত জেগে খেলা দেখেছে কিন্তু এখন শরীর ফিট..." "বিশ্বকাপ...! স্ট্রেঞ্জ.....!" অনি শুনে আকাশ থেকে পড়ল। ভাবতেই পারছেনা দোলু ফুটবল খেলা দেখেছে এ কদিন ধরে....। এক সপ্তাহ কেটেছে...... রবিবারের দুপুরবেলা। দুলদুলি অঘ্রাণের মোলায়েম রোদে ভিজে পুচকেটার জন্যে সোয়েটার বানাচ্ছে। এই শীতে না হলেও সামনের শীতে অবশ্যই। বৌদিমণি মা হতে চলেছে.....। বাড়ির আনাচে কানাচেতে খুশির মেঠো সোনামুগ রোদ্দুর ঝলসে উঠছে। গতকাল মেসিও গোল দিয়েছে। দশ নম্বর জার্সির ছোকরা এখন ভাল ফর্মে আছে। মনে হচ্ছে বিশ্বকাপটা এবার নীল-সাদায় পাবে। ওরা দুজনে গোল দেওয়াতে মা খুশিতে মন্দিরে পুজো দিতে গেছে। দাদা-বৌদির ভেজানো ঘর থেকে শব্দ ভেসে আসছে...... "ছেলে হলে ডাকনাম রাখব 'রোনাল্ডো'...... "আর মেয়ে হলে?" "মেসি!" "বল কী!" "হ্যাঁ গো, 'মেসি' নামের মধ্যে একটা মেয়ে মেয়ে গন্ধ লুকিয়ে আছে। ওর খেলা আমার ভীষণই ভাল লাগছে...!" অনির চোখে "সিত্রাং"য়ের নিম্নচাপ। ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে ঝরছে.....। সেদিন সকালে হর্ষবাবুকে চা দিতেই দোলনা থমকে যায়। আশা করেনি এইভাবে আবার দুজনের এত বছর পরে দেখা হবে! ওঁর দুচোখেও সেদিন রায়মঙ্গলের নোনা জোয়ার দেখেছিল। অনৃত লক্ষ করেনি। হর্ষবাবুর নামটা দোলু বেশ কবার শুনেছে অনির কাছে। ভাবতে পারেনি ইনি সেই হর্ষবাবু। যিনি বহুদিন আগে...... হর্ষবাবু উপন্যাসটা এবার শেষ করবেন বলে মনে হচ্ছে.....। বহুবছর আগে দোলনার সঙ্গেই এই হর্ষবাবুর বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয়েছিল। উনি তখন সবে রেলের চাকরিতে ঢুকেছেন। দোলনার পিসিমণি আর পিসেমশাই অনেক কষ্টে সম্বন্ধটা এনেছিলেন। পাত্র উনিদের পরিচিত। কিন্তু শেষমেশ সম্বন্ধটা ছাদনাতলা অবধি গড়ায়নি। ছেলের সব দিক ভাল হলেও দূরে বাইরে পোস্টিং। তাছাড়া রেলের চাকরি। ছুটিও কম। তাই কনের পরিবার আর এগোয়নি। দোলনারও তেমন মত ছিল না। এ বিয়েতে....। সাতচল্লিশের হর্ষবাবুর প্রথম সম্বন্ধ রিজেক্টেড হওয়াতে আর কোনদিন বিয়েই করবেন না বলে স্থির করে ফেলেন। এখন অবধি সেই ইচ্ছায় বহাল আছে। বন্ধুরা, কলিগরা জোরাজুরি করলেও কোন পজিটিভ রেসপন্স পাওয়া যায় নি। তবু বুকের অলিন্দে আজও 'দোলনা' দোলে পেণ্ডুলামের মতন। উনিই যে স্বামীর অফিস কলিগ দোলনা জানত না। মোবাইলের গ্যালারিতে বা ছবিতেও কোনদিন দেখেনি। আর উনি যে অবিবাহিত সেটাও অজানাই ছিল.....। সেদিনই দ্বিতীয়বার দেখল। আর দেখেই লজ্জাবতী লতার মতন...! তবে 'হর্ষ' নামটা বেশ কবার শুনলেও দোলুর মনে কোনো কৌতূহলও জাগেনি...! সন্ধে নেমেছে। দুজনেই ছাদে। তারায় ভরা আকাশ দেখে অনি হাতের আঙুল উঁচিয়ে ...... "ঐ দেখ, ধ্রবতারা। কেমন জ্বলজ্বল করছে...!" "তোমার-আমার জীবনের ধ্রুবতারা পরম আদরে যত্নে বেড়ে উঠছে একটু একটু করে” দুজনের দুচোখে আবার মাতলার মাতাল জোয়ার। কালো অন্ধকারের বোরখা একটু একটু করে হামাগুড়ি দিতেই খুবই হালকা কুয়াশাতে চারদিক ভরে গেল। অনি দোলনার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। আলতো করে মুখটা তুলে ওর ফাটা ঠোঁটে ভালবাসার চিহ্ন এঁকে দিল। সামনেই পূর্ণিমা। রুপোর চাকতি থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি রুপোর অহংকার ঝরে পড়ছে ওদের দুজনের উপর। কিছুক্ষণ পরেই ফ্রান্স-পোল্যাণ্ডের খেলা হবে। লিওনডক্সি, জিরার্ড, গ্রিজম্যান, এমবাপেরা কাতারের সবুজের মখমলে ধ্রুবতারার মতন ঝলসে উঠবে। একটু পরেই 'রেফারি' শাশুড়ি মায়ের বাঁশি বেজে উঠল... "বৌমা, অনি তোমরা দুজনেই নেমে এসো। বাতাস বইছে। তোমার, পুচুসোনার দুজনের ঠাণ্ডা লেগে যাবে!" দুলদুলি চাওমিন বানাচ্ছিল। হাসিতে ফেটে পড়ল। হাসির টুকরো টুকরো অণু-পরমাণু ছোট ছোট ঢেউ তুলে ড্রিবলিং করতে করতে কাতারের জনস্রোতে যেন ডুবে গেল।