নতুনধানের আতপ চাল আর গুড়ের গন্ধমাখা শীত মরশুম শেষ, সজনে ফুল ছড়ানো কুলের চাটনি সহযোগে বসন্তের অরন্ধন পর্বও শেষ হয়েছে। এবার আসছে আমপোড়া, বেলপানা প্রস্তুতের দিন। তবু যেন পিঠে-পার্বণের দিন ফুরোতে চায় না, মাকে দেখতাম এইসময় বছরভরের খেজুরগুড় সংগ্রহ করে রাখতেন পরম যত্নে, খবরের কাগজ মুড়ে। প্রবাসে সবসময় না মেলে ভালো গুড় না সরেস নারকেল। পেলেও কোরাবে কে?!! অগত্যা পায়েস-ফিরনিই ভরসা। নারকেলের কথায় মনে পড়ল আমার দেশের বাড়ির জেঠিমা খুব ভালো নারকেল কোরাতেন। লম্বা, ছিপছিপে চেহারা, ডাগর চোখ, চওড়া কপাল জুড়ে মস্ত সিঁদুরের টিপ। শ্যামলা মুখে লাবণ্য থাকলেও জেঠিমাকে ঠিক সুশ্রী বলা চলতো না। তাতে শাশুড়ি মায়ের ছিল ভারি রকমের আপত্তি। সকলে আড়ালে আবডালে বলতো বৌয়ের কেমন যেন ছিরিছাঁদ নেই। সংসারে সব আছে বাঁধন নেই, ভাঁড়ার ভর্তি আনাজ আছে তবু শুক্তোনিতে লবণ নেই, ঠাকুর ঘরে মা লক্ষী আছেন তবু তুলসীতলায় প্রদীপ নেই। আসলে তার সবটুকু শ্রী ছিল কুটনো কোটায় আর বাটনা বাটায়, রান্নাবান্নায় নয়। জেঠিমাকে দেখতাম পানের বোঁটায় চুন মাখিয়ে গালে পুড়ে পিতলের ছোট্ট জাঁতি দিয়ে বাড়ির গাছের সুপুরি কাটতেন, খুব সরু সরু করে, তারপর সাজিয়ে রাখতেন শাশুড়ির পানের ডাবরে। কখনো দেখতাম সারা দুপুর ধরে করে কুচোচ্ছেন বচ্ছরকার আমলকী, জারানোর দায়িত্ব অবশ্য থাকত আমার মায়ের। কিংবা ঝিরিঝিরি করে কুচোতেন সেরখানেক ওজনের বাঁধাকপি। কখনো ঠাকুরঘরের সামনে বসতেন বঁটি পেতে।মুহুর্তে কাঠের বারকোষ ভরে উঠত দুধসাদা নারকেলের পরতে। সেই নারকেল, চালের গুঁড়ো মেখে হতো ছোট ছোট গোল গোল বড়া, কখনো গড়া হতো গঙ্গাজলি নাড়ু, একটু কর্পূর মিশিয়ে। পেতলের কড়ায় গুড় সহযোগে নারকেলের পাক দিতেন শাশুড়ি মা স্বয়ং। সংসারে চিরকালই রাঁধুনির নাম হয়, জোগাড়ের নাম হয় না। তবে আমাদের জেঠিমারা জানতেন ডালে-ভাতে-ঝালে-ঝোলে-মিষ্টিতে-অম্বলে সংসারের পঞ্চব্যঞ্জনের স্বাদে তরিবৎ হয়, একটুও কমতি হলে স্বাদ খোলে না। এভাবেই সুখে-দুঃখে, মানে-অপমানে, যাপনে-স্মৃতিতে তারা ছিলেন সংসারের সহজ পথের সওয়ারী। সরল বিশ্বাসে, অনাড়ম্বর প্রয়াসে তারা পাড় করেছেন সংসারের আপাত জটিল বৈতরণী। কোন কিশোরী বয়সে বাবা মায়ের হাত ধরে ওপাড় থেকে চলে আসেন জেঠিমা। সেই স্মৃতিটুকু ধরা ছিলো বাঙাল ভাষায় আর কাঁচা মরিচের ঝালে। উঠোনের এক কোণায় নিজে হাতে যত্ন করে কাঁচালঙ্কার বাগান করেছিলেন। আমরা মাঝেমধ্যে দেশে গেলে বলতেন “তুমরা আসছো দেইখ্যা বেশি ঝাল দিই নাই, শুদু পাস-সয়’খান মরিচ ফালা দিসি”, শুনে আমদের খাবার আগেই জিভদিয়ে পানি ঝরতো আর কি! দেশের বাড়ির হারিয়ে যাওয়া হেঁশেলের এক কোণায় ছিল নারকেলের দঁড়ি দিয়ে বাঁধা মস্ত এক শিকে। এতে চারপেয়ে মার্জারকুল এবং দু’পেয়ে দস্যুদলের রত্নাকরবৃত্তি দিব্য আটকানো চলত। অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে ঘন জ্বাল দেওয়া সর তোলা দুধ, মাটির হাঁড়িতে শুকনো মিষ্টি, কখনো বা মিহিদানা শিকেয় তোলা থাকত। জেঠিমা খুব ভালো মিহিদানা বানাতেন। ওমন মিহিদানার স্বাদ দেশের বাড়িতে কাটানো গ্রীষ্মের ছুটির মতোই জীবন আর ফিরে পাইনি। প্রথমেই দেখতাম লোহার হামানদিস্তায় জায়ফল গুঁড়িয়ে গরম শিরায় মিশিয়ে রাখতেন। তারপর লুচি ছাঁকবার ঝাঁঝরি হাতা দিয়ে বেসনের গোলা ফুটন্ত তেলে শিশিরের মতো টুপটাপ করে পড়ত, কয়েক সেকেন্ড ভেজেই তুলে দিতেন সেই ঈষদুষ্ণ শিরায় ,ঘন্টা দুই পর রসে ভরপুর ছোট্ট ছোট্ট মুক্তোর মতো মিহিদানা তৈরি হয়ে যেতো। ছোটবেলার সেই জীবন্ত জলছবিই এই রেসিপির উপকরণ। মাপমতো না হলে মিহিদানা বানানো বেশ ঝক্কির।তাই মাপজোপ রইল। মিহিদানার উপকরণ: বেসন-২ কাপ জল-পৌনে ২ কাপ শিরা: চিনি-২ কাপ জল-১ কাপ লেবুর টুকরো-১ টা গোলাপজল-১ চামচ ফুড কালার- এক চিমটে পায়েস: দুধ-১ লিটার দুধকে ঘন করে ৫০০মিলি. কাজু গুঁড়ো-৩/৪ বড় চামচ ঘি-ছোট চামচের ১ চামচ এলাচ-২ টো চিনি- বড় চামচের ৪ চামচ (স্বাদ অনুযায়ী) পদ্ধতি:মিহিদানা বানাতে মাপ অনুযায়ী বেসনের গোলা বানিয়ে নিন। লুচি বানাবার ছান্তায় গোলাটা দিয়ে একটু একটু করে ঝাঁকাতে থাকুন। ছোট ছোট দানার মতো মিহিদানা পড়বে গরম তেলে।৩০ সেকেন্ড থেকে ১মিনিট ভাজলেই হবে।বেশি ভেজে মুচমুচে হলে চলবে না। এবার উষ্ণ শিরায় সরাসরি দিয়ে দিন। শিরা বানাতে পরিমাণ মতো চিনি আর জল মিশিয়ে ফোটাবার সময় তাতে দিন একটুকরো লেবু,এতে শিরাতে চিনির খ্রিস্টাল তৈরি হবে না।চিনি গলে গিয়ে শিরা ফুটে উঠলে দিন এক চামচ গোলাপজল আর এক চিমটে রং। তাতে মিহিদানায় সুন্দর হলুদ রং হবে। শিরাটা কিন্তু একটু চটচটে হতে হবে। মিহিদানা শিরায় দেবার পর মিনিট দশ খুব ঢিমে আঁচে ফোটাবেন। তারপর গ্যাস বন্ধ করে ঢেকে রাখুন ঘন্টা দুই। তাহলেই মিহিদানা তৈরি। পায়েস বানাতে ঘন করা দুধ গ্যাসে চড়িয়ে তাতে দিন দুটো এলাচ আর একটু ঘি। নেড়ে মিশিয়ে দিন কাজুগুঁড়ো আর চিনি। নাড়তে থাকুন ক্রমাগত। আস্তে আস্তে ঘন হয়ে এলে নামিয়ে ফেলতে হবে।পায়েস একটু ঠান্ডা করে তাতে মেশান মিহিদানা এবং পরিবেশন করুন, কাজু কিংবা কিশমিশ দিয়ে।