চায়ের দোকান এবং আপেলিয় আক্ষেপ

রানাঘাট, নদিয়া


আড়মোড়া ভেঙে সূর্যের গড়ানো শুরু। এখনও টিকে আছে বাংলার সনাতনী চায়ের দোকান। কাঠের বেঞ্চি পাতা। যদি হয় সুজন তাহলে তিনজন। গিয়ে বসি একটি সুজন। পাশের মানুষটি অপরিচিত। লুঙি পরা। মুর্শিদাবাদি। ভাঙাচোরা লোহালক্কড় ফেরি করে কিনে নেয়। এখানে কাগজ মানে হাতে নিয়ে ভাঁজ করে পড়ে ফেলা খবর কাগজ। এই তো আমার ভোর! হাতে অমোঘ চায়ের সংযোগ। কাঁচের বয়ামে বিস্কুট, বাপুজি কেক, কুশল বিড়ির প্যাকেট। চায়ের গেলাস হাতে দেখি এই সকাল ধীরেসুস্থে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে। যেভাবে ভিডিও ফুটেজে ধরা থাকে সময় সেভাবেই ধরা থাকে এ সকাল শূন্যতার কণায় কণায়। কেউ কেউ নিশ্চয়ই দেখে -- আমার ঝুলন্ত চায়ের চারপাশে  ওঠে নামে আরও পাঁচটি চা। চায়ের পঞ্চম মাত্রা ভাবার চেষ্টা করি। পাশে গাঢ় ভোলা কুকুর ও তার সঙ্গীসাথী। কেটলি গোমুখ থেকে ক্রমে ক্রমে চা এসে পৌঁছে যায় বিষ্ণুপ্রয়াগের পর অলকানন্দা হয়ে, নন্দপ্রয়াগ, কর্ণ প্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ ও শেষে দেব প্রয়াগ হয়ে একেবারে নিচে গহন সাগরে। ফ্লায়িং শাটলের মতো এপাশ ওপাশ করে চলা। এই টুকটুক স্পন্দনে জীবনের যাবতীয় রং। কখন চায়ের পাশে এসেছেন সক্রেটিস। কোমরে গামছা বাঁধা সক্রেটিস। চল্লিশ মিলি চায়ের বরাদ্দ তাঁর কুড়িটি মিনিট। প্রশ্ন রাখেন তিনি “হঠাৎ বাড়ল কেন লংকার দাম? সবজির সিন্ডিকেট চালাচ্ছে কারা?” ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে দেখে নিই সক্রেটিসের মুখ। এরপর ধোঁয়াহীন বায়ুর টানেল দিয়ে ফের দেখি তাঁর মুখ । দুজন সক্রেটিস জায়গা বদলে নেয় ধোঁয়া আর ধোঁয়াহীনতায়। প্রশ্নরা ঘুরতে থাকে ধোঁয়ার ভিতর, চায়ের কেটলিতে, বিস্কুটে, কেকে, গামছায়, কুশল বিড়ির প্যাকেটে, প্রতিবেশী চা সেবীর খোঁচা খোঁচা ভেলক্রো দাড়িতে। প্রশ্নরা চামচে করে ঘেঁটে দেয় চিনি। প্রশ্নরা ঘেঁটে দেয় শিশুদের মাথা। প্রশ্নরা আগুন জ্বালে শাসকের ত্বকে। ফিটফাট জামাপ্যান্ট শচীন তেন্ডুলকারও মাঝে মাঝে পৌঁছে যান আমাদের চায়ে। ক্রিকেট বলের সব সেলাইয়ের দাগে নাকি লেখা থাকে আউট অথবা ছয়, চার কিংবা খুচরো সব রান। সিম -- রান, সিমরান, জি লে তেরি জিন্দেগি। সিমরান ছুটে যায় জিন্দেগির পানে। হঠাৎ একাকী হয়ে যাই। চায়ের আবেগ নিয়ে বসে থাকি। চারপাশে ঝড়, বৃষ্টি, রোদ, জ্যোৎস্নারা একসঙ্গে। আমরা দেয়াল গড়ি। ভেঙে ফেলি দেয়ালের কিউব রুট। ছিদ্র করি শোঁ শোঁ শোঁ শোঁ ইলেকট্রিক ড্রিল। একজন রাজমিস্ত্রি এসেছেন দেরি করে। ব্যস্ত তিনি খুব। তাজমহলের কাজ শেষ করে ঘরমুখো তিনি। শাহজাহান ছুটি দেয়নি কিছুতেই তাকে। পালিয়ে এসেছেন বাড়ি। পিছে পিছে সম্রাটের চর। ঘন ঘন জ্বর হয় মিস্ত্রির। তাজমহলের সব পাথর কাটতে গিয়ে কত কত তরতাজা যুবক... এটুকু বলেই তিনি থেমে যান। সময় ফুরিয়ে আসে তার। সামান্য সময় মেলে চায়ের দোকানে। চায়ের স্তম্ভে আমি দেখতে পাই বাইজির নাচ। দেখতে পাই শ্রীহরিকোটা থেকে চন্দ্রযান ৩ উড়ে যাচ্ছে চাঁদে। ব্যাগভর্তি কাঁচা লংকা নিয়ে বাজারের এক কোনে বসেছেন নীরব মোদি। আর খদ্দের সেজে এসেছেন ইডি অফিসার। তাকে কাঁচা বাদামের গান শোনাচ্ছেন ভুবন বাদ্যকার। এইসব অঘাত সমীকরণে ফুরিয়ে যায় চা। হাতের গেলাস পরশুরামের কুঠারের মতো লেগে থাকে। গৌড়ামামা চাওয়ালা রাস্তায় ঢেলে দেয় এক বালতি জল। মুহূর্তে ভেনিসে আমরা। মুর্শিদাবাদি সেই ভাঙড়ি কারবারি ভাটিয়ালি গান ধরতেই আরও আরও নৌকোরা ঘনীভূত হল। আমরা সবাই দেখছি নীল জলে ভেসে আসছে নৌকোয় যুবরানী ডায়না, মাদার টেরেসা, বিল ক্লিনটন, ম্যাডোনা, মারাদোনা, মাইকেল জ্যাকসন। পরিরা উড়ছে চারপাশে। তাদের পাশে হিসহিস করছে শয়তানের জিভ। আমরা একটুও ভীত নই। সে এনেছে আপেল সংবাদ। তার ঘাড়ে স্টিভ জোবস। অথচ আমাদের চায়ের বেঞ্চে আপেল সংবাদ পৌঁছতে পারে না কিছুতেই। 

বৈশাখী ২০২৪