চেয়ারটা ফাঁকা হয়ে যায়

সোনারপুর, কলকাতা


একটা চেয়ার, যেখানে বসে জানলার বাইরের অনেকটা দুনিয়া চোখে পড়ে। সেইখানে বসত সে। 
রেললাইনের পাশে খেলনাবাটি সংসার পাতা পাগলিকে ওখান থেকেই প্রথম দেখা যায়। 
পাগলি একা একা নাচগানের জলসা করত, ঝোপঝাড়ে কল্পিত বহু দর্শকের দিকে জোড়হাত করে “নমস্কার” বলে শুরু করত গান গেয়ে নাচ। 'চলরে চল সবে ভারত সন্তান', 'আয় তবে সহচরী', 'ধনধান্য পুষ্প ভরা!' কথা সুরে অজস্র ভুল হলেও, আন্তরিক আবেগে ত্রুটি ছিল না। পাগলিটার সংসারে কিছু জামাকাপড়, কিছু বাসন, অল্প চালডাল, চা, চিনির সঙ্গে মাটির ভাঁড়ে ভাঁড়ে কিছু গাছ ছিল, ও সেগুলিকে সারাদিন ধরে, গুছিয়ে রাখত। ওর কি নিজের বাড়ি ছিল, বা বাড়ির ইচ্ছে! একটা সুন্দর সাজানো সংসার! হয়তো মনের মতো একজন মানুষকে না পেয়েই এমন হয়েছে। ও চেয়েছিল, সাজানো কিচেনে কৌটোয় কৌটোয় ভর্তি খাবার, নিজের একটা ড্রেসিং টেবিলে সাজানো কসমেটিকস; যা ভেবেই হয়ত থালার পেছনকে আয়না ভেবে মিছিমিছি খালি হাত মুখে বুলিয়ে ক্রিম মাখে, কাজল পরে, লিপস্টিক দেয়। চিরুনি দিয়ে চুল বাঁধে, কখনো খোঁপা, কখনো বিনুনি। ওর একটা সাজানো ব্যালকনির শখ ছিল, যেখানে লাইন করে গাছের টব সাজাবে। কদিন পর আর দেখা যায় না ওকে। বাড়ির লোক হয়ত নিয়ে গেছে। 
যে মাঝবয়সী গোলুমোলু মহিলা এখন হলুদ বাড়িটার ছাদে, জামাকাপড় মেলছে, একদিন ওর বৌভাতের সকালের সাজে ছাদে এসে ছবি তুলছিল, তখন ছিপছিপে তরুণী। সতের বছরে সেও অনেকটা বদলেছে। 
একদিন রেললাইনের ওপারে ওই ঝোপের পাশে দুটো বিশাল দাঁড়াস সাপের শঙ্খলাগা দেখেছিল এই চেয়ারে বসেই। বাকিদের সে-ই ডেকে দেখিয়েছিল। শঙ্খলাগা শেষ হলে কীভাবে দুটো সরীসৃপ দুদিকে আছড়ে পড়েই দ্রুত চলে যায় দুদিকে, দেখেছিল।
একটা বয়েজ কাট, ছেলেদের মতো সাজগোজ করা মেয়ে, ছেলেদের মতো করে সাইকেল নিয়ে রোজ দাঁড়াত রেল লাইনের পাশে, যখন মেয়েদের স্কুল ছুটির সময়। একটা দুইবিনুনি এদিক ওদিক দেখে লাইন পেরিয়েই ব্যাগটা হাতে দিত বয়েজকাটের। দুজনের মুখেই হাসি, তারপর সাইকেলের সামনে বিনুনিকে বসিয়ে বয়েজকাট চলে যেত। বছর দুয়েক, এমনটা রোজ দেখেছে । 
কাজের ফাঁকে ফাঁকে জানলার বাইরের জীবন দেখতে, ভাবতে এবং বলতে খুব ভালোবাসত সে। যেটুকু চোখে পড়ে তা যেন তার কাছে আরেকটা গ্রহের চেনা জীবন। এমনকী যে কটি কুকুর বিড়াল ওই পথে যায় আসে, রেলের মেথর কোয়ার্টারের উঠোনে বসে, খেলে, তারাও তার চেনা। একটা বিড়ালের নাম সোনিয়া, একটা কুকুরের নাম হাম্বু। ওরা বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছিল, তাই নাম দিতে হল। দূর থেকে ওদের সঙ্গে মাঝে মাঝে কথাও বলত সে। 
রেললাইন, তার ওপাশে সারি ঝোপ, ঝোপের পিছনে লাইন দিয়ে দালান বাড়ি। ঝোপের আগে ডানদিকের কোনায় রেলের মেথর কোয়ার্টার। তিনতলার জানলা দিয়ে বাড়িগুলোর পিছনে বড়বড় গাছ আর তার ওপর থেকে অনেকটা  আকাশ চোখে পড়ে। মেঘ করে এলে, নীল আর কালোয় মেশামেশি আকাশ কতবার ক্যামেরাবন্দি করেছে। গুনগুন করেছে, 'ছায়া ঘনাইছে বনে বনে!'
 এই চেয়ার ছেড়ে উঠে গেছে সে। অন্য কেউ বসবে। সে কি দেখবে, পাতা শূন্য সজনে গাছ হালকা সবুজ ছোট পাতায় ভর্তি হয় কীভাবে, কদিনে পাতাগুলোর রং গাঢ় হয়ে যায় হালকা থেকে! আবারও পাতা ঝরার দিন এসে শূন্য করে দেবে ডাল। আবারও সবুজে সবুজে গাছ তুমুল হবে।

বৈশাখী ২০২৪