শেষ চিঠি

সিঙ্গুর, হুগলি


বুঝলে মিনতি, আমার তোমার গল্পটা কিন্তু চাইলে আমরা তৈরি করতে পারতাম। প্রথমে ভুলটা আমার ছিল, বাবার সুযোগ্য সন্তান হিসেবে নতুন বিয়ে করা বৌ, যে কী না বাইরের মেয়ে, তার সব কথাগুলো নিজের বাবাকে বলে দিতাম। হয়তো সেদিন থেকেই তোমার অবিশ্বাসের শুরু আমার ওপর। এরপর যখন বুঝলাম একটা বয়সের পর স্ত্রী বন্ধুর মতো আপন হয়, তুমি অনেকটা দূরে চলে গেছ, আঁকড়ে ধরেছ তোমার খোকাকে। কিন্তু এই ভুলটা আমার ভুলের থেকেও বড় হয়ে গেল তোমার জীবনে। 
মিনতি, বাবা মার কাজ হয়তো সন্তানকে মানুষ করা, খুঁটে খেতে শেখানো। এটা যেমন আমার বাবা বোঝেনি, তুমিও বোঝোনি। তাই খোকার বিয়ের পর ওর বদলগুলো মানতে পারলে না। খোকা শুধু জায়গা বদল করেছিল। তোমার অতিরিক্ত স্নেহ, আঁকড়ে ধরে থাকা ওর মেরুদণ্ডটাই তৈরি হতে দেয়নি। সেটা ধীরে ধীরে প্রমান হতে থাকল ওর বিয়ের পর থেকে। আমার অপছন্দের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলে ছেলের জেদ মেনে। হয়তো সেরা মা হতে চেয়েছিলে। কিন্তু সেদিন আমার কথা শুনলে ভালো করতে। আমি আসলে প্রকাশ করতে পারিনি, কিন্তু সারাজীবন আমি তোমার ভালোই চেয়েছি।
ভুল চলতেই থাকল। যে ছেলে তোমায় দশমীর প্রণাম জানায়নি, তাকে কেন জন্মদিনের আশীর্বাদ জানাতে ফোন করতে গেলে বলো? তুমি জানতে না সে তোমায় অপমান করবে? আমায় ভুল বুঝে বারবার দোষারোপ করে কী লাভ বলতো? তুমি কেন বোঝ না, তোমার খোকার মনে ভুলের যে পাহাড় জমেছে তাতে আমার কোনো হাত নেই! কেন আমি অহেতুক এই বয়সে এসে ভালো হতে চেয়ে অশান্তি বাড়াব। আমি কখনও চাইতে পারি, যে ছেলেকে ঘিরে তুমি এত বছর বেঁচেছ, আজ সে তোমায় কথায় কথায় অপমান করুক! এতটাও নীচ নই আমি। আমি ওর ভুল ভাঙাতে  গেলে ও যে আমাকেও ছুঁড়ে ফেলে দেবে, তোমার মতোই আমার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখবে না। তাই আমি কিছুই বলি না, শুধু শুনি। সপ্তাহে একবার ওর গলাটা শুনতে ফোন করি। নাতির গলা তো চাইলেও শুনতে পাই না। তাই এক মাত্র ছেলের গলা শুনতে লুকিয়ে ফোন করি, যতদিন বেঁচে আছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। অশান্তি যেন দিনদিন আমার আয়ুক্ষয় করে দিচ্ছে।
মিনতি চলো না এই শেষ বয়সে এসে আমরা আবার নতুন করে শুরু করি। একে অপরকে বিশ্বাস করে শুরু করি। চলো না নিজেদের মতো বাঁচি। শেষ অধ্যায়ে দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে পথটা হাঁটি। হাঁটবে মিনতি, ভরসা করবে আমায়?
ইতি তোমার স্বামী।

বৈশাখী ২০২৪