নির্মাতা

"হ্যাঁ রে, খোলা মাঠের মাঝে লাইন পেতে রেল চলবে কেউ ভেবেছিল? হাওড়া থেকে শুরু। মা গঙ্গা আর কত পাপ সইবে লা!”
বৃদ্ধা আমোদনন্দিনী হাতের জপের মালাটা দুবার ঘুরিয়ে নিয়ে সামনে বসা ভাইপো বউ বিন্দুর মুখখানা লক্ষ করেন। বিন্দুবাসিনী উনিশ বছরের পরিণত গৃহিণী। মেয়ে বিনোদসুন্দরীর একরাশ চুলে ছাঁচি পেঁয়াজবাটা মাখাতে মাখাতে দুটি দাঁতের ফাঁকে চুল বাঁধার ফিতেটা চেপে ধরে সে বলে, "বাড়িট টামনে ডিয়ে রেল যাটঠে, কট ভালো বলো!"
বিন্দুবাসিনীর কথায় যে গর্ব ঝরে পড়ে সেটা আমোদের চোখ এড়ায় না। একটু যেন হিমসের চোরকাঁটা বুকে ফোটে। বাড়ির পাশে টেরেন গাড়ির লাইন বসে গব্বে মাটিতে পা পড়ছে না মাগির। মর মর! আজ না হয় হাওড়া থেকে চন্দননগর হয়ে টেরেন চলছে, একদিন আমোদনন্দিনীর নবদ্বীপের বাড়ির পাশেও ঠিক টেরেন যাবে। হুঁ! মনে মনে আরেকটু জ্বলে আমোদনন্দিনী হুল ফোটায়, "মেলেচ্চদের গাড়ি বাছা, ভালো মোটেও নয়। সব অসইরন!" 

বিন্দুবাসিনী কন্যার চুলে শক্ত করে ফিতের পাক মেরে ঝাঁজ দেখায়, "বলছি না, নড়বি না। আলবোট বিনুনি বাঁদার শক, আর খালি নড়ছে মেয়ে!" বাড়ির পাশে রেল চলছে, অথচ তার একবারটিও চড়া হয়নি। কত্তার মুখে গল্প শুনে খুবই রোমাঞ্চ হয়। রেল নাকি যখন চলে দুলুনিতে ঘুম এসে যায়। বিন্দুর সোয়ামি রোজ ব্যবসার কাজে হাওড়া যায়। এসে গল্প বলে। সেই গর্বের রেলকে হেলাছেদদা করছে তার পিসশাশুড়ি, বিন্দুর রাগ ধরে।
 
চুল বাঁধা হয়ে গেলে বিন্দুর মেয়ে বিনোদসুন্দরী ডুরে শাড়ি কোমরে জড়িয়ে দ্বিতল বাড়ির বিলিতি মাটি গুলে সদ্য বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে উঠোনে বয়স্যদের সঙ্গে খেলায় যোগ দেয়। অসাবধানে তার ছোট্ট পায়ের আঙুলের ছাপ কাঁচা মেঝেতে স্থায়ী দাগ হয়ে থেকে যায়।   

"মামাবাবু বকবে দেখিস।"
পিসতুতো ভাইয়ের কথা শুনে বিনোদ একটু ভয় পেয়ে যায়। বাবাকে বিনোদের বড় ভয়। এমনিতে বাবা আমুদে মানুষ। কিন্তু রেগে গেলে যখন "বিনোদ...এদিকে এসো!" বলে ডাক পাড়েন তখন বাড়ির কড়ি বরগাগুলোও ভয় পেয়ে ঠকঠক করে কেঁপে ওঠে। দাসদাসী থেকে শুরু করে পাইক বরকন্দাজ সক্কলে জমিদার খাঁ বাবুকে মা ভবতারিণীর খাঁড়ার মত গণ্য করে ভয়ে জুজু হয়ে থাকে। বাবা যদি একবার এসে দেখেন যে নতুন মেঝের ওপর পায়ের দাগ পড়ে গেছে, তাহলে হয়তো আর আস্ত রাখবেন না। ছোট্ট যে ভাইবোনগুলো উঠোনে খড়ির দাগ কেটে এক্কা দোক্কা খেলছে, তাদের নুকিয়ে ছাদ থেকে আচার এনে খাওয়াবে বিনোদ, শুধু টিপে দিতে হবে বাবাকে যেন না বলে। বিনোদ ভাইবোনদের ডেকে হেঁকে সে কথা বলতে যাবে এমন সময়ে তীব্র বাঁশির আওয়াজে সব কথা ঢাকা পড়ে যায়। 

ততক্ষণে ওপরে আমোদনন্দিনী আর জমিদার গিন্নী বিন্দুবাসিনীর মধ্যে ঠান্ডা গলায় কাজিয়া লেগেছে। আমোদ পানচিবুনি রাঙা দাঁত দিয়ে ঠোঁটের ওপরের শুকনো চাম একটানে তুলে বিষ গলায় বলে, "পণ্ডিত রাধালঙ্কার বাঁড়ুজ্জে সে কি কম বড় জ্যোতিষী? তা সে পাঁজি-পুঁথি বিচার করে ট্রেনে উঠেছিল। হুগলিতে নেমে মন্ত্রপাঠ করে তবে তার শুদ্ধি হল। শুধু তাই নয়, আগুনে গাড়িতে আয়ু কমে যাবে, এই অজুহাতে আর ট্রেনে ফেরেননিকো। সে কি ভুল বলেচে?"

 বিন্দুবাসিনী উপযুক্ত উত্তর খুঁজে না পেয়ে খানিক চুপ থেকে বলে, "কত্তা খপরের কাগজ পড়ে বললেন কোন এক সায়েব জোনস নাকি বলেছিল ঘোড়ার চেয়ে জোরে রেলগাড়ি চলতিই পারে না। জেদ করে সে ঘোড়া ছোটাল চন্নননগরের দিকে মুক করে। সে ঘোড়া মাঝপথে পটল তুলল। তবেই বোঝো রেলগাড়ির জোর। হাজার ঘোড়াও তার কাছে নস্যি।" 
ফোকলা গাল ফুলিয়ে দন্তহীন মাড়ি পাকলে আমোদসুন্দরী কী একটা বলতে শুরু করার আগেই দানবীয় যান্ত্রিক শব্দে ওদের কথা ঢাকা পড়ে যায়। 
সকলেই উদগ্রীব হয়ে ওঠে ট্রেন দেখার জন্য। অন্তঃপুরের মেয়েরা জানলার খড়খড়ি তুলে চোখ রাখে বাইরে। বাচ্চারা খেলা ফেলে এক ছুটে মাঠে গিয়ে দাঁড়ায়। 

চকচকে লোহার লাইনের ওপর দিয়ে দীর্ঘ অজগরের মতো মৃদু মন্দ গতিতে রেলগাড়ি এগিয়ে আসতে থাকে। আকাশে কয়লার ধোঁয়ার কালো নিঃশ্বাস ছেড়ে দীর্ঘ বাঁশি বাজিয়ে সে এগিয়ে আসে চন্দননগর থেকে ভদ্রেশ্বর স্টেশনের দিকে। সামনের ইঞ্জিনটা মস্ত একটা রাগী মুখের মত ফোঁস ফোঁস করছে। মাঠ বরাবর এগিয়ে এসে ঠিক খাঁ-দের জমিদার বাড়ির পাশে "হুশশ..." শব্দ করে রেলগাড়ি আচমকা থেমে যায়। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে হাপরের মত হাঁপাতে থাকে ইঞ্জিন। 

"এখেনে থামল কেন? এটা তো ইস্টিশন নয়!” আমোদের গলায় সন্দেহ।

"আহা দেখোই না,” বিন্দু উত্তর দেয়।

গাড়ি দাঁড়াতে অমনি লোকজন পিল পিল করে রেলগাড়ির দরজা দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট লাফ মেরে মাঠের ওপর নামতে থাকে। বড় বড় কাপড়ের বস্তা ফেলে তার ওপর কায়দা করে পা দিয়ে একজন নামে, তারপর হাঁক দেয়, "ভাই রে, বস্তা ফেল।" টপাটপ বস্তা পড়ে। মজুর কামিনরা মালপত্র নিয়ে নেমে যখন দূরের হাটের দিকে এগিয়ে যায়, তখন আমোদসুন্দরী ঘুলঘুলি থেকে চোখ সরিয়ে বৌমাকে আবার জিজ্ঞাসা করে, "হ্যাঁ লো বউ, এই মাঠের মধ্যিখানে তো ইস্টিশন নয়। তাহলে রেল দাঁড়াল কেন?"
 বিন্দুবাসিনী মাথায় কাপড় তুলে বলে, "সে সব আমাদের কত্তা জানে। তোমার ভাইপোকে জিগিয়ে নিও। ওই যে তিনিও নাফ মেরে রেল থেকে নেমে হেঁটে আসছেন।"

 খাঁ বাড়ির জৌলুষ নিয়ে মানকুণ্ডুতে অনেক জনশ্রুতি আছে। লোকে বলে মুঘল আমলে আকবরের সেনাপতি মানসিংহ এক মস্ত পুকুর খোঁড়েন। তা থেকেই জায়গাটার নাম মানকুণ্ড। সেই দীঘিটাই এলাকায় সবচেয়ে পুরোনো, এবং তার দৈবী মাহাত্ম্য অসীম। ওই দীঘির নিচেই নাকি অধিষ্ঠান ছিল অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তির। খাঁ বাড়ির পূর্বপুরুষকে তিনি স্বপ্ন দেন। সেখান থেকে দেবীকে তুলে প্রতিষ্ঠা করার পরেই খাঁয়েদের এত প্রতিপত্তি লাউডগার মত ফনফনিয়ে বেড়েছে। সেও প্রায় দু’শ বছর আগের গল্প। সেই কবেকার বিরাট পুকুর এখন ১৮৫৪ ইংরেজি সনে অনেকটা মজে গেছে। কিন্তু খাঁ বাড়ির বর্তমান কর্তা গৌর খাঁ প্রাসাদের মতো বাড়ি ঘিরে কেয়ারি করা বাগান, চকচকে প্রতিষ্ঠা করা দীঘি সবই গড়েছেন। কলকাতায় তাঁর নানারকম ব্যবসা, নুন, সার এরকম কতকিছুর। 

পূর্বপুরুষদের ধারা বজায় রেখে গৌর খাঁ রীতিমত পয়সা উপার্জন করে বড়মানুষ হয়ে উঠেছেন। বাড়িতে দুর্গামূর্তির সঙ্গে মহাদেবেরও নিত্য পুজো হয়। এই দুপুর গড়িয়ে যাওয়া লালচে বিকেলবেলাও ঠাকুর দালানে লোকজন পাত পেড়ে খেতে বসেছে। গৌর নিজে শিউলি রঙে ছোপানো ধুতি পরে তদারকি করছেন। এমন সময়ে বাইরে ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়ানোর আওয়াজ হয়। খবর আসে কোম্পানির লোক এসেছে। সাহেবদের খাতির করে ভেতরে আনা হল। সামনে স্বয়ং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার জন হজসন। এই সাহেবের বুদ্ধিতেই চন্দননগরের ফরাসিদের সঙ্গে একমত হয়ে রেলের জন্য জায়গা মিলেছে। নাহলে প্রথমে ফরাসিরা বেঁকে বসেছিল। ইংরেজদের সঙ্গে তাদের কাজিয়া আছে। শেষে দফায় দফায় বসে কথা বলে জট কেটেছে। তারপরেও বিপত্তি, রেলের বগি ইঞ্জিন বিলেত থেকে জাহাজে আসছিল। ভুল পথে চলে যায়। তারপরে এই সাহেবের বুদ্ধিতেই কলকাতার ঘোড়ার গাড়ি তৈরির কোম্পানি থেকে বগি বানিয়ে রেল চলেছে। পরে অবশ্য বিলেত থেকে বগি এসে পৌঁছেছিল। 

কোম্পানির সায়েবদের ভয়ে বাড়ির কত্তা নায়েব থেকে সকলে থরহরি কম্প। তারা মনিবের জাত। তবুও মেলেচ্চরা ঠাকুরের দালানে উঠেছে দেখে বাড়ির মহিলারা মনে মনে নাক শিঁটকে ঘোমটা দিয়ে সরে যান। 

গৌর খাঁ সামনে এসে দাঁড়ান। তখনও অঙ্গে পুজোর হলুদ কাপড়। গলায় গরুর দড়ির মত মোটা সোনার হার। টকটকে ফর্সা গায়ের রং ও দীর্ঘ আকৃতির দিকে সাহেবরা সপ্রশংস নয়নে তাকান। হজসন নিজের মনে একবার সিস দিয়ে বলে ওঠেন, "ভেরি গুড।"  
 
গৌর খাতির করে সাহেবদের নমস্কার করেন। পরিচারককে আদেশ দেন, "পাকা বেলের শরবত লাও, বরফ দিয়ে। আর কড়াপাকের সন্দেশ।" তারপর সাহেবদের দিকে ফিরে বলেন, "কী মনে করে স্যার?"

জনসন এই কদিনে বাড়িতে মাস্টার রেখে সামান্য বাংলা শিখেছেন। সেটুকুর ওপর ভরসা করে বলেন, "টুমার নামে রেলে কমপ্লেইন আছে। টুমাকে যেতে হইবে। বাড়ি জমি বিক্রি করিয়া টুমাকে ফাইন দিতে হইবে।"

গৌরের স্ত্রী বিন্দুবাসিনী ঘোমটার আড়াল থেকে বলে, "আ মরণ। মনিষ্যির ভালো করতে নেই।"

"বেশ চলুন।" গৌর খাঁয়ের অভিব্যক্তিতে ভয়ের লেশমাত্র চোখে পড়ে না। শুধু অদূরে একগলা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রী বিন্দুর দিকে মুখ তুলে তিনি বলেন, "ভয় পেও না গিন্নি। কিচ্ছুটি হবে না।" বিনা বাক্যব্যয়ে গৌর খাঁ সাহেবদের সঙ্গে বেরোতে উদ্যত হলেও দেখা যায় গাঁয়ের সাধারণ মানুষ খাঁ বাড়ির সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়েছেন। সায়েবদের আসতে দেখেই তাঁরা খানিক আন্দাজ করে নিয়েছেন কী হতে চলেছে। একযোগে সকলে বলে ওঠেন, "আমাদের খাঁ বাবু কোথাকেও যাবে নি। তানার তো কোনও অন্যায় নেই।'' সাহেবরা এ ওর মুখের দিকে তাকান। জমে ওঠা লোকজন আবার বলে, "খাঁ বাবুর অন্যায্য কাজ থাকতেই পারে না।" 
  
সাহেব রেগে বলেন, "আলবাত আছে। এই বাবু রোজ রেলের ফার্স্ট ক্লাস কামরার টিকিট কেটে ওর নায়েবকে রেলে তুলিয়া দেন চন্দননগর থেকে। চন্দননগর স্টেশনের পর ভদ্রেশ্বর স্টেশন। মাঝে এই মানকুণ্ডু তো স্টেশন নহে। বাট, বাবুর নায়েব মানকুণ্ডু আসিলেই গাড়ির চেইন টানে। গাড়ি থামাইয়া বাবু উঠিয়া পড়েন।"

"সাহেব, এর জন্য আমরা রোজ জরিমানা দিই", গৌর খাঁ একটুও ভয় না পেয়ে বলেন। 

"কিন্তু রেলের যাত্রায় ইহা সমস্যা করিতেছে বাবু।", সাহেব হাত নেড়ে বলেন।  

ততক্ষণে দ্বিপ্রাহরিক দেবসেবা শুরু হয়েছে। কাঁসর বাজিয়ে ব্রাহ্মণ পুজো শুরু করেছেন। গৌর খাঁ সেদিকে মুখ করে ভক্তিভরে প্রণাম করেন। সমবেত গরিব মানুষরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। একজন সাহস করে এগিয়ে এসে বলেন, "খাঁ বাবু আমাদের মা বাপ। মানকুণ্ডুতে ইস্টিশন নেই। হয় যেতি হয় চন্নননগর, নইলে ঠেঙিয়ে ভদ্দেশ্বর। কিন্তু মানকুণ্ডুতে জাগ্রত মহাকাল শিবের মন্দির আছে। মন্দিরের পাশে মেলা হয়, হাট বসে। এত মালপত্তর নে অদ্দুর উজিয়ে রেল ধরতে কষ্ট হয় না বুঝি? খাঁ বাবু রোজ রেল মধ্যিখানে থামায় বলেই না আমরা ওঠা নামা করতে পারি মানকুণ্ডু থেকে।"

"ইহা কুযুক্তি, বাবুকে যাইতে হইবে। উহার মোটা জরিমানা হইবে।", সাহেব একরোখা। 

"চলুন সায়েব। আমার মা দুগ্গা সহায়," বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে গৌর এগিয়ে চলেন। কিন্তু না, সমবেত জনগণ পথ রোধ করে ফেলেছেন ততক্ষণে। মশালের আলো হাতে হাতে ছড়িয়ে যাবার মতো প্রত্যেকের চোখে একটা অদ্ভুত সাহসের আলো। সমস্বরে সবাই বলে ওঠেন, "খাঁ বাবুকে নে যাওয়া চলবেনি। আমাদের সক্কলকে তাহলে নে যেতে হবে।" 

কোম্পানির সাহেব কর্মচারীরা প্রমাদ গোনেন। এই এতজনকে নিয়ে যাওয়া আদৌ কি সম্ভব! আলোচনা করে তাঁরা বলেন, "ওয়েল বাবু। তাহলে আপনি লিখিত দস্তখৎ দিন যে আপুনি আর চেইন টানিবেন না। যাত্রাপথে বিঘ্ন ঘটাইবেন না।" 
গৌর অকম্পিত স্বরে বলেন, "না সে কথা দিতে পারি না। হাটুরেদের সুবিধার জন্য একশো বার চেন টেনে মানকুণ্ডুতে রেল দাঁড় করাব।" 

তর্ক চলতে থাকে। গৌর খাঁয়ের পক্ষে এলাকার সব সাধারণ জনগণ। সাহেবদের জেদ ক্রমশ তেল কমে নিভু নিভু হয়ে দাঁড়ায়। শেষে গৌর শর্ত রাখেন, "তোমরা ওপর মহলে কতা বলে দেখো সাহেব। যদি মানকুণ্ডুতে ইস্টিশন করা যায়।"
"ইস্টিশন? ফানি। ল্যান্ড কোথায়?"
"আমি দেব জমি। মায়ের কৃপায় ওতে আমার সম্পদ কমবে না।", গৌর সর্বসমক্ষে ঠাকুরের দালানে দাঁড়িয়ে কথা দেন।
"বেশ তাহলে ইস্টিশন হইবে। আমি কথা বলিব।", সাহেব জোর গলায় বলেন।

"জয় গৌর খাঁ। জয় মা জগজ্জননী।"
প্রজাদের জয়ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে মানকুণ্ডু।

মানকুণ্ডু স্টেশন এই ভোরের বেলা ব্যস্ত সমস্ত। বড় বড় মাছ বরফের গদিতে শুয়ে আছে। রেলের মালপত্রের কামরায় তুলে শহরে যাবে। মানকুণ্ডু স্টেশন পুরোপুরি তৈরি হতে বছর দুই লেগেছে। তারপরে বিশ বছর কেটে গেছে। প্রচুর নতুন ব্যবসায়ী বাড়িঘর করেছেন। স্টেশন ঘিরে গমগম করা এই মানকুণ্ডুকে দেখে বোঝার উপায় নেই দশ বছর আগে এখানে ধু ধু মাঠ ছিল।   

দুজন পাট ব্যবসায়ী রেলের জন্য অপেক্ষা করছেন। তামাক খেতে খেতে দিন কালের খবর, বিলেতের খবর, শহরে জিনিসপত্রের দাম দস্তুর নিয়ে আলোচনায় তাঁরা মত্ত। কথা বলতে বলতে সামনে তাকিয়ে দুজন অবাক হন। একজন বৃদ্ধ তাঁদের কথা শুনছেন, গায়ে শতছিন্ন পাঞ্জাবি। এ ভিখারি না যাত্রী দুই ব্যবসায়ী ভেবে পান না। শেষে ভিখারি অনুমান করে একটা তামার ফুটো পয়সা বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে দেন। বৃদ্ধ সেটা স্পর্শ না করে আগুনঝরা চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। তামার পয়সার ওপর রোদ ঠিকরে পড়ে। ক্রমশ বৃদ্ধের দৃষ্টি নরম হয়। মৃদু হেসে সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে সামনে এগিয়ে এসে বলেন, "মানকুণ্ডু ইস্টিশনটা কেমন বলো দিকি?"

"বেশ ভালো।", ব্যবসায়ীরা আমোদ পেয়ে উত্তর দেন। 

"আমি এই ইস্টিশন তারপর রেল লাইন সব খুলিয়েছিলুম জানো?", বৃদ্ধ গর্বের সঙ্গে বলেন।

"কী?" 

"হ্যাঁ। সায়েবরা ইস্টিশন তো করল। সকলে ধন্যি ধন্যি করল। ঠিক তারপর আমাদের মেয়ের বে লাগল। আমাদের ছোটমেয়ে। বিনোদসুন্দরী। ওই আমাদের শেষ কাজ।"

"আচ্ছা। তারপর?" ব্যবসায়ীরা তামাক টেনে প্রশ্ন করেন। 

"নতুন জামাই আসবে বের দিন। সে কি রেল লাইন পের হয়ে আসতে পারে? মাথা নিচু করে তারতুর বাঁচিয়ে কেন সে ঢুকবে? খাঁ বাড়ির জামাই! আমিও কি কম! বললুম সায়েবদের, ‘শোনো বাপু, আমার জমি, তাতে তোমাদের ইস্টিশন। আমার জামাই মাতাখান নামিয়ে আসবে? চলবে না। লাইন খোলো। একটা দিনের ব্যাপার!”’

উপস্থিত সব যাত্রীই গল্প শুনছেন। অবাক হয়ে তাঁরা জানতে চান, "সায়েবরা রাজি হল?" 

"হবে না? কত টাকা দিলুম যে। একদিনের তরে লাইন খোলা হল। খাঁ বাড়ির মেয়ের বে। সে কত আয়োজন। ভিয়েন বসল দশদিন ধরে..." বৃদ্ধ মনের সুখে গল্প বলে যেতে থাকেন অতীতের। সে বিয়ে যখন হয় তখন খাঁ-দের পড়তি দশা। তবুও সেই বিয়েবাড়িতে জৌলুষ কম হয়নি। আজও মুখে মুখে ফেরে। কলকাতা থেকে ব্যান্ড পার্টি এনে বরকে বরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। রেল লাইন খোলানো হয়েছিল জামাইয়ের যাত্রাপথ সুগম করতে। বৃদ্ধের মুখে গর্ব আর আনন্দ খেলা করে। দূরে খাঁয়েদের প্রাসাদোপম বাড়ি সংস্কারের অভাবে ম্লান ভগ্নদশায়। 

বৃদ্ধ অতীত গৌরবের গল্প শেষ করে দূরের সবুজ প্রান্তরের দিকে এগিয়ে যান। পেছন থেকে অচেনা পাটোয়ার যাত্রীরা আলোচনা করেন, "মানুষ মাতা খারাপ হলে কত মিথ্যে বলে। ছেঁড়া জামা। গল্প দিচ্ছিল রাজার ঐশয্যর। দূর দূর।"

এলাকার পুরোনো মানুষেরা ধমকে ওঠেন, "কে বলল মিছে কতা! উনি কে জানো? গৌর খাঁ। খাঁ বাড়ি জায়গা দিছিল বলে ইস্টিশন হল। এই সব ওর জমি জিরেত ছিল এককালে।"

"তবে অমন দশা যে?" 

"নোকের জন্য দান ধ্যান করে গো। ঘোর কলি। ভালো কাজে যে ভগমান সব সময়ে ভালো ফল দেন, তা নয়কো। অবিশ্যি বেশি বিলাসিতাও ছিল।"

"তাই?"

"হ্যাঁ। না হলে ভেবে দেখো, জামাই আসবে বলে কেউ কখনও রেল লাইন খোলাতে চায়? তাও নিজের খরচে? হবে না দেউলে? সাধে বলে, সাবধানে খরচ করতে। নইলে গৌর খাঁ হতে হয়।"

"অ। বুঝলাম। তা ছাড়ো দিকিন ওসব কথা। কবে কে কী করেছে। কবে মামা ঘি খেয়েছে, আঙুলে নাকি গন্ধ!" সকলে আবার তামাকে মন দেন। ব্যবসার লাভ ক্ষতির হিসাবে মশগুল হয়ে পড়েন।  

বৃদ্ধ ক্লান্তপায়ে এগিয়ে চলেন। মানকুণ্ডু স্টেশনের নৈমিত্তিক জনগণের কলরব শুনতে তাঁর বড় ভালো লাগে। যত তিনি এগিয়ে চলেন তত ক্রমশ মৃদু হতে থাকে কলরব। বৃদ্ধ এগিয়ে চলেন আরও সামনে। ওই যে অদূরে তাঁর প্রাসাদের  মতো বাড়িটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। জৌলুষ নেই। নোনা ধরতে শুরু করেছে। দেওয়ালে বটগাছ ঝুরি নামিয়ে দিয়েছে মাটি পর্যন্ত। পাশের বাগান পরিচর্যার অভাবে আগাছার জঙ্গলে ভর্তি। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায় গৌর খাঁর। আচ্ছা যদি এখনই বাড়িটা কোনও ভালো কাজে দিয়ে দেওয়া যায়! এই হাসপাতাল কী বড় পাঠশালার জন্য! বৃদ্ধ গৌর খাঁ মনে মনে কল্পনা করেন, লোকে শতমুখে নাম করছে গৌর খাঁর। অনেক অনেক দিন পরেও সকলে জয়ধ্বনি দিচ্ছে, বলছে, "গৌর খাঁকে আমরা কি ভুলতে পারি! বাংলার ইতিহাসে গৌর খাঁ ভোলার নন।" গৌর কল্পনা করেন, তিনি চলে আসার পরে এখনও নিশ্চয়ই স্টেশনে সবাই গৌর খাঁর সুনাম করছে। 

করছে না মানে! করবেই তো। 

বৈশাখী ২০২৪