সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর ক্যাম্পাস থেকেই "বিশাল এন্ড বিশাল" গ্রুপের চাকরিটা পেয়ে কপালটা যে খুব ভালো সেটা নিয়ে সুভাষ নিশ্চিত হয়েছিল। হদ্দ গ্রামের স্কুলে পড়ে সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে জায়গা পাওয়া আর সেখান থেকে এই ভারতজোড়া নামি কোম্পানিতে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি একটা স্বপ্নের মতো, যেটা প্রায় প্রত্যেক মধ্যবিত্ত বাপ-মা দেখেন সন্তানের জন্য। সেই থেকে এই বিগত দু’বছর বিভিন্ন শহরে বেশ কয়েকটা প্রজেক্টে কাজ করেছে সুভাষ। পরিশ্রমী, মেধাবী, ভদ্র বলে সুনামও হয়েছে যথেষ্ট। বড়কর্তারা আশা দিয়েছেন এইভাবে চললে আগামী বছর তাকে আমেরিকা পাঠাবেন কোনও প্রজেক্টের ভার দিয়ে। সাফল্যেও একটা নেশা আছে। সেই নেশায় ভরপুর সুভাষ হুগলির এই প্রাচীন বর্ধিষ্ণু গ্রামটাতে এসে পৌঁছেছে ক’দিন আগে। একদম হুগলি নদীর পাশেই গ্রামটা, বাস করে প্রায় হাজারের কাছাকাছি লোক। পুরোনো রাজবাড়ি, নীলকুঠি, দুর্গা দালান, প্রাচীন পুকুর ও সংলগ্ন কালীবাড়ি যেখানে এককালে নাকি নরবলি হত; সব নিয়ে একটা এক বা দুদিনের ভ্রমণ স্থান হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হবার সম্ভাবনা জায়গাটার। এখানকারই একটা পুরোনো বড়লোকের বাড়ি প্রায় জলের দরে কিনেছে । একটা রিসর্ট তৈরি হবে বাড়িটা কিছুটা সারিয়েসুরিয়ে আর = অদলবদল করে। প্রজেক্টটার দায়িত্বে আছে সঞ্জয়। মারাঠি ছেলে। সুভাষের চেয়ে কিছুটা বড়। অসুরের মতো খাটতে পারে আর ততোধিক প্রাণশক্তি। গোটা টিমে আরও দু’জন ইঞ্জিনিয়ার, দু’জন ড্রাফটম্যান, গোটা পঞ্চাশ জোগাড়ে আর মিস্ত্রি। গত দু’দিন গেছে গুছিয়ে বসতে। আজ বাড়ি খালি করা শুরু হল। ফাঁকা বাড়ি হলেও এখনও বেশ কিছু পুরোনো জিনিসপত্র আছে। সঞ্জয় জোগাড়েদের দিয়ে বার করাচ্ছে সে সব। বাড়িটার সামনের দিকটা প্রায় ভাঙা। পেছনের দিকের কিছুটা ভালো অংশে একটি পরিবার থাকতেন। তাঁদের ছেলেটিও মালপত্র বার করা আর বাছাই কাজে সাহায্য করছে। অনেকগুলো পুরোন তোরঙ্গ এক জায়গায় একসঙ্গে পড়েছিল। নিছক কৌতূহলবশত সুভাষ তার একটার ডালা ধরে জোরে টান দিতেই লড়ঝড়ে তালা ভেঙ্গে তোরঙ্গের ঢাকনা খুলে গেল। ভেতরে একটা পুরোনো বন্দুক - রিভলবারের চেয়ে কিছুটা বড়, গোটা কতক টোটা, একটা লম্বা চেন যার সঙ্গে একটা ক্রশ জোড়া, গোটা কতক চিঠি, একটা চামড়া বাঁধানো খাতা। সব কটি জিনিসেই সময় তার হাতের ছাপ দিয়ে গেছে। চিঠিগুলো হাতে ধরতেই প্রায় গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ল। বন্দুকটাতে মরচে ধরে গেছে। টোটার খোলগুলো নেড়েচেড়ে রেখে চামড়া বাঁধানো খাতাটা নিয়ে নিজের তাঁবুতে ফিরল সুভাষ। সামনের পাতাগুলো খুব ঝুরঝুরে, শেষেরগুলোও। মাঝখানের কিছু পাতা অক্ষত। প্রতিটি পাতার শেষে সই করা, W.C. Jhonson। সুস্পষ্ট ইংরেজিতে লেখা পাতাগুলো পড়তে পড়তে সুভাষের গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠছিল, রক্ত গরম হয়ে উঠছিল। খাতা পেন নিয়ে সে তর্জমা করতে থাকে সেই ডায়েরির। এই কাহিনি সবার জানা দরকার। 23rd October 1859 আজ খবর এল কুঠি থেকে মাইল পাঁচেক দূরের বগলা গ্রামের কয়েকজন চাষী নীলের দাদন নিতে অস্বীকার করেছে। কাল রাতে কুঠির মাইল দশেক দূরের জলায় হাঁস মারতে গেছিলাম। মোট সাতটা হাঁস মারা হয়েছিল। সকাল সকাল সামশের মিঞা রোস্ট করে দিল। আমরা তিনজনে, ডেভিড, হ্যারি আর আমি মিলে তার তিনভাগ সাঁটিয়ে দিলাম সঙ্গে রামের বোতলও ছিল। খেয়েদেয়ে দিল খুশ করে বেরলাম প্রজা ঢিট করতে। বেলা দুটো নাগাদ গ্রামে পৌঁছলাম। শালারা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি আমরা আসব। হাতেনাতে ধরা পড়ল সবকটা। গ্রামের লোকগুলো চরম ভিতু। আমাদের বাধা দেওয়া তো দূরে থাক স্রেফ পালিয়ে গেল। ভালো, ভালো। যত ভয় পাবে ততই ভালো। ততই পোক্ত হবে নীলের শাসন। শুয়োরের বাচ্চাগুলো হাতেপায়ে পড়ছিল জানে বাঁচার জন্য। কুত্তার দল। মরতে এত ভয় তো লড়তে এসেছিলি কেন? সব কটাকে ঝুলিয়ে দিয়ে এসেছি গাছের ডালে। নে, এবার দোল খা। গ্রামের থেকে দুটো ডবকা ছুকরি তুলে এনেছি। নতুন মদের পাইট খুলেছেন ক্যাপ্টেন। আজ রাতে ভরপুর মস্তি হবে। 24th October 1859 আজ সারাদিন শুয়ে বসেই কাটল। গতকাল ধকল তো কম হয়নি। দুটো ছুকরির একটা গতরাতেই টপকে গেছে। আজ রাতে বাকিটার পালা। 25th October 1859 খবর এসেছে ঐ গ্রামবাসীরা গ্রামে ফিরেছে। বিদ্রোহের সাজা ওদের পেতেই হবে। শুনছি কাল ডেভিডও যাবে। ডেভিডকে এই কুঠির বড় সাহেব বলে সবাই। ওই কুঠি শুরু করেছিল। 26th October 1859 আজ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা। গতরাতে ধরে আনা শেষ ছুকরিটা যখন আমার ভাগে যখন পড়ল তখন অনেক রাত। ডেভিড ঘর থেকে বেরিয়ে আমাকে ইশারা করল ঢোকার। ঢুকতেই বিছানায় পড়ে থাকা আধমরা ছুকরিটা অকথ্য গালাগালি শুরু করল। ভালো, ভালো। ত্যানানো রুটি আর ত্যানানো আওরৎ দুইই আমার না পসন্দ। ওর ওপর সওয়ার হতে তাই ভালোই লাগল। এত রক্ত ঝরেছে, মরবে তো নিশ্চিত তবুও ছুকরিটা আমাকে বাধা দিচ্ছিল। শালী!! আচ্ছাসে বুঝিয়েছি ব্রিটিশ পুরুষ কেমন হয়। এই কালো চামড়ার নোংরাগুলোকে মানুষ ভাবতে আমার ঘৃণা হয়। এগুলো মরলেই বা কী আর বাঁচলেই বা কী! বিছানা থেকে উঠে যখন জামাপ্যান্ট পরছি শালি কুত্তিটা থুঃ করে থুতু ছুঁড়ল আমার দিকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে এক গুলি ছুঁড়ে ছুকরির খুলি উড়িয়ে দিলাম। কিন্তু আমার হাতে বন্দুক দেখেও ছুকরি ভয় পায়নি। বরং যেন হাসি ফুটতে দেখলাম ওর মুখে। কে জানে আমার মনের ভুল না নেশার ঘোরে ভুল দেখলাম! বেলা বাড়তেই বেরোলাম ডেভিডের সঙ্গে আমরা দু’জন। সঙ্গে জনা পঞ্চাশ লেঠেল। গ্রামবাসীগুলো ভাবতেও পারেনি আমরা আসব। প্রথমেই গ্রামটাকে চারদিক দিয়ে ফেলা হল। তারপর ভয়ে এদিকে ওদিকে লুকোতে চেষ্টা করতে থাকা মেয়েগুলোর মধ্যে থেকে গোটা তিনেক ডবকা ছুকরিকে বেছে নিয়ে বাকি মেয়ে মদ্দদের ওপর বেশ এক রাউন্ড টার্গেট প্র্যাকটিস। সব শেষে বাকিগুলোকে ঘরে ভরে চালে আগুন লাগিয়ে রসিয়ে রসিয়ে শুনছিলাম ব্যাটাদের আর্তনাদ। সত্যি বলতে কী এই লোকগুলোকে আমার মানুষ বলেই মনে হয় না। সব নর্দমার কীটের দল! 27th October 1859 গতরাতে তোফা রান্না করেছিল সামশের মিঞা। সত্যি বলতে কী এই রান্না ছাড়া এদেশের আর কিছুই আমার পছন্দ নয়। যেমন গরম,তেমনি নোংরা,তেমনি ধুলো,তেমনি মশা- মাছি, তেমনি এদেশের অসভ্য বর্বর লোকজন। তবে হ্যাঁ মানতে হবে এখানে রান্না হয় জবরদস্ত। লোকগুলো নোংরা হলে কী হবে রাঁধে ভালো। কাল খাওয়া দাওয়ার পর তুলে আনা ছুকরিগুলোর মধ্যে একটাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। ভালোই কেটেছে রাতটা। 28th October 1859 আজ কোতোয়ালি থেকে লোক এসেছিল। গ্রামের গোটাকতক লোক কী করে যেন বেঁচে গিয়ে কোতোয়ালিতে খবর দিয়েছিল। তাই তদন্ত করতে এসেছেন দারোগা সাহেব। একটা গোটা খাসি কোথা থেকে যেন নিয়ে এনেছিল হ্যারি। সেটাই কাটা হল। সামশেরের রান্না করা মাংস রামের সঙ্গে দারুণ জমে। রাত আটটা নাগাদ দারোগা সাহেব যখন উঠলেন তার আগেই রিপোর্ট লেখা হয়ে সদর দপ্তরে চলে গেছে। রিপোর্টে পরিষ্কার ভাষায় লেখা আছে গ্রামবাসীদের নিজেদের মধ্যে বিবাদে নিজেরা একটি খড়ের গাদায় আগুন লাগায়। সেই আগুন সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েই এই ঘটনা ঘটেছে। ব্যস, এবার আর কারোর কিছু বলার থাকবে না। আশপাশের গ্রামগুলোও ঠান্ডা থাকবে। এরপর বেশ কিছু পাতা একেবারে নষ্ট। আবার পড়া যাচ্ছে ডিসেম্বর মাস থেকে। 10th December 1859 আজ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। আজ এখানকার জমিদার নবকৃষ্ণ স্যানাল তার বন্ধু রামরতন রায়কে নিয়ে এখানে আসেন। ডেভিডের সঙ্গে দেখা করার পর বগলা গ্রামের ঘটনাটার কথা তোলেন নবকৃষ্ণ। ডেভিড ঘটনার সঙ্গে কুঠির যোগাযোগ কোনও ভাবে স্বীকার না করলেও নবকৃষ্ণ আর তার বন্ধু আমাদের নানাভাবে প্রশ্ন করতে থাকেন। এই বন্ধু লোকটাকে আমার একেবারেই পছন্দ হয়নি। লোকটা বেশ আলাদা রকমের। এখানকার সাধারণ ভিতু লোকগুলোর মতো নয়। সাধারণত এখানকার জমিদাররা কুঠির সাহেবদের বেশ সমীহ করে চলে। হাজার হোক সাদা চামড়া বলে কথা। কিন্তু এই লোকটার ভাবসাব সে রকম নয়। বেশ সমানে সমানে কথা বলছিল। আমাদের প্রভুত্বকে ও গ্রাহ্য করে না। মন বলছে এই লোকটা বিপজ্জনক। 11th December 1859 আজ খবর এসেছে নবকৃষ্ণ তার বন্ধুকে নিয়ে মহালের গ্রামে গ্রামে ঘুরছে। নবকৃষ্ণের বন্ধুটির আবার চাষীদের ওপর প্রচণ্ড দরদ। নীলচাষ করতে গিয়ে চাষীরা নাকি সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে। শুনে এত হাসি পাচ্ছিল যে কী বলব। নায়েব করালীচরণ সামন্ত খবরগুলো দিচ্ছিল। চিন্তায় ওর মুখ বেগুনি হয়ে গেছে। এই কালা আদমিগুলো রাগলে বা দুশ্চিন্তা করলে বেগুনি হয়ে যায়। আমাদের মতো লাল হয় না। লোকটাকে একটা হনুমানের মতো লাগছিল। কুত্তির বাচ্চা একটা। এরপর দিন সাতেক কোনও লেখা নেই। বোধহয় কোনও ঘটনা ঘটেনি। 21st December 1859 আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম এই রামরতন রায় লোকটা সুবিধার নয়। আজ ডেভিডকে তার এক বন্ধু কুঠিয়াল নদীয়ার দোগাছা থেকে একটা পারসেল পাঠিয়েছে। তাতে সদ্য ইউরোপ থেকে আসা একটা বক্স স্কচ হুইস্কি, গোটা দশ প্যাকেট খুব ভালো টোটা আর একটা খবরের কাগজ ছিল। কাগজটার নাম ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট,’ চালায় হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নামে একটা লোক। আশ্চর্যের ব্যাপার হল কাগজটা ইংরেজিতে। এদেশের লোক কবে এত ইংরেজি শিখল যে খবরের বার করতে শুরু করল? গভর্নমেন্ট এদের এসব বার করার অনুমতি দেয় কেন? নরকের কীট কালা আদমিগুলো কিনা আমাদের কাজের বিচার করে! বগলা গ্রামের গোটা ঘটনটা বিশদে লেখা হয়েছে কাগজে। জানল কী করে এরা? ঐ রামরতন রায়ই খবর দিয়েছে নিশ্চয়ই। ওটাকে আর এই হরিশ মুখুজ্জেকে জেলে দেওয়া উচিত গভর্নমেন্টের। এদের বিরুদ্ধে "রাজদ্রোহ আইন" প্রয়োগ করা উচিৎ। 22nd December 1859 আজ করালী খবর এনেছে পাকুড়তলী গ্রামের দুজন চাষা দাদন নিতে অস্বীকার করেছে। ডেভিড ওদের কাল তুলে আনতে বলেছে। 23rd December 1859 আজ অবাধ্য চাষীদুটোকে নিজের হাতে শায়েস্তা করেছি। এত মার মেরেছি যে বাঁচবে বলে মনে হয় না। তবে আশ্চর্য লোকদুটো মার খেয়ে গেল কিন্তু ছেড়ে দেবার জন্য হাতে পায়ে ধরল না। জ্ঞান থাকা অবধি বলে গেল দাদন নেবে না। আশ্চর্য! এরা হঠাৎ করে এত সাহস পেল কার কাছ থেকে? কে এদের এত সাহস জোগাচ্ছে? ঐ হরিশ মুখুজ্জ্যে? 24th December 1859 কাল ক্রিসমাস। গোটা কুঠি চমৎকার করে সাজানো হয়েছে। অনেক বন্ধুবান্ধব নিমন্ত্রিত। আমি নিজে পাশের কুঠির ফ্রেডরিকের মেয়ে লারার জন্য অপেক্ষা করে আছি। সদ্য এসেছে ইংল্যান্ড থেকে। আমার মনে হচ্ছে ওকে আমার জীবনসঙ্গী করলে কেমন হয়। এসব আমি আগে ভাবিনি কোনও দিন। আজ মনটা একটু কেমন যেন আছে। কেমন একটা ভয় করছে। আসলে আজ সকালের ডাকে কলকাতা থেকে হিন্দু প্যাট্রিয়টের গত সপ্তাহের কয়েকটা কাগজ এসেছে। প্রত্যেকটার সম্পাদকীয়তে হরিশ মুখুজ্জ্যে বিশদে লিখেছে নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি। আমি স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি লোকটার সাহস দেখে। ওর কি ভয়ডর নেই! ও কি জানে না এই রকম লেখার ফলাফল কী হতে পারে? নিজের কাছে স্বীকার করতে বাধা নেই আমার কেমন যেন ভয় করছে। তাই বোধহয় মনটা গৃহস্থের নিরাপত্তা চাইছে। 5th January 1860 লারা, লারা, লারা। নাঃ ও আকাশের চাঁদ আমার জন্য নয়। ওর নজর আমার মতো নীলকুঠির ছোট সাহেবে আটকে নেই। অন্তত কোনও ব্রিটিশ আর্মি অফিসার বা সিভিল সার্ভিসের লোক ছাড়া ও মেয়ের মনে ধরবে না। দুত্তেরি! আজ সারাদিন হুইস্কি খাব। 10th January 1860 আজ এখানের পোস্ট অফিসে গেছিলাম। কুঠির কাজের কিছু চিঠিপত্র আসার ছিল। সেখানে নতুন আসা পোস্টমাস্টার টির সঙ্গে আলাপ হল। নাম দীনবন্ধু মিত্র। আমার অবশ্য তেমন কোনও আগ্রহ নেই এই সব কালা আদমিদের সঙ্গে ভাব করার। নেহাতই দায়ে পড়ে করতে হল। চারদিকের হালচাল ভালো নয়। চাষীরা আর আগের মত মুখ বুজে ভয়ে ভয়ে থাকছে না। অনেক জায়গাতেই চাষীরা দাদন নিতে চাইছে না। কোথাও কোথাও আবার দাদন নিয়েও নীলচাষ করছে না। এত সাহসী এরা হঠাৎ কবে হল? কোথা থেকে পাচ্ছে এত সাহস! এরা জানে না আমরা কী কী করতে পারি? আরে শালারা 1830 -র পঞ্চম কোম্পানি আইনে নীলচাষ না করার অপরাধে তোদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করতে পারি রে শালারা! আর তোদের তো কোনও অধিকারই নেই আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করার। ভাগ্যিস নেই! না হলে বোধহয় ওই হরিশ মুখুজ্জ্যে আর রামরতন রায় মিলে আমাদের নামে হাইকোর্টে মামলা করত। অবশ্য মামলা করে কিছুই হত না। ইউরোপিয়ানদের বিচার করার অধিকার একমাত্র ইউরোপিয়ান বিচারপতির। আর কোনও ইউরোপিয়ান কখনই কোনও কালা আদমির পক্ষে রায় দেবেন না। 11th January 1960 লারার সঙ্গে আজ দেখা হবার কথা ছিল হল না। ওর এখানে ভালো লাগছে না তাই কলকাতা চলে গেছে। 15th January 1960 দুটো নতুন নাম কানে আসছে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস আর দিগম্বর বিশ্বাস। এদের নেতৃত্বে নাকি চাষীরা জোট বাঁধছে। নীলচাষ আর করবে না। ভালো, ভালো। অনেকদিন বন্দুকগুলো ব্যবহার হয়নি। এবার হবে। লারা, প্রিয়তমা লারা, এবার তুমি দেখবে সামান্য কুঠিয়াল বলে যাকে তুমি অবহেলা করলে সে আসলে কতটা শক্তিশালী। এই কুত্তির বাচ্চাগুলোকে দেখিয়ে দেব আমি কী জিনিস! দেখিয়ে দেব সাদা চামড়ার লোককে সমীহ না করলে কী হয়! 20th January 1860 আজ করালীকে নিয়ে প্রজা শাসনে গেছিলাম। গোটা গ্রাম ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়ে এসেছি। দাদন নাকি নেবে না শালারা! নীল বুনবে না, ধান বুনবে! একটাই ছুকরিকে তুলে এনেছি। এটার বাবাই দলের পান্ডা। এটাকে দিয়েই সেই কুত্তির বাচ্চাকে বোঝাব সাহেবদের পেছনে লাগার ফল। 21st January 1860 যাঃ শালা!! সে শালী গর্ভবতী ছিল। আগে বুঝিনি। একটা লাথি পেটে মারতেই কাতরে কাতরে মরে গেল। আগে বুঝলে এটাকে তুলতাম না। গোটা মস্তিটাই মাটি হয়ে গেল উপরন্তু করালীর সঙ্গে ঝগড়া হল। সে আসলে চরম ভিতু। ভয় পাচ্ছে। বলছে ঘটনা জানাজানি হলে মুশকিল হবে। আরে গাধা, ব্রিটিশ রাজত্বে ব্রিটিশের মুশকিল হবে! কখনও হয়েছে? এরপর আবার কিছু নষ্ট পাতা পেরিয়ে ডায়েরি শুরু হয়েছে। 24th July 1860 ক্রমশঃ পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। কলকাতার সংবাদপত্রগুলোতে প্রায় রোজই নীলচাষীদের আন্দোলনের খবর বেরোচ্ছে। সবচাইতে বেশি লিখছে ঐ হরিশ মুখুজ্জ্যে। ব্যাটা আদা জল খেয়ে আমাদের পেছনে লেগেছে। এই দেশি কালা আদমিটার সাহস আর উদ্যম দেখে অবাক হতে হয়। শুনেছি ব্যাটা খুবই অসুস্থ তবুও লিখেই চলেছে, লিখেই চলেছে। এটার জন্য কোনও আইন নেই? এটাকে থামাচ্ছে না কেন? এই লোকটাতো একাই একশ’ হয়ে উঠছে। 25th July 1860 টমাসের চিঠি এল বিকেলের ডাকে। আমার ছোটবেলার বন্ধু। নদীয়াতে একটা কুঠি চালায় ও। লিখেছে ও কুঠি তুলে দেবে ভাবছে। ভয় পাচ্ছে ও। যদিও সব কিছু খুলে লেখেনি। আমি ওর সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করতে যাব ঠিক করেছি। 30th August 1860 গতকাল দুপুরের পর টমাসের কুঠিতে এসে পৌঁছেছি। টমাস বেশ ঘাবড়ে আছে। আজ সকালে দুজনে মিলে মহাল দেখতে বেরিয়ে ছিলাম। গ্রামের লোকেদের চোখ মুখের ভাষা বদলে গেছে। ওরা আর অত ভয় পাচ্ছে না। কে ওদের এত সাহস দিচ্ছে বার করতেই হবে। না হলে নীলচাষ উঠে যাবে বেঙ্গল থেকে। 31st August 1860 টমাসকে রোখা যাবে না। ও কুঠি বিক্রি করে ইংল্যান্ডেই ফিরে যাবে মনস্থির করে ফেলেছে। আমারও কি দেশে ফিরতে ইচ্ছে করে না? করে। কিন্তু যখনই মনে হয় ফিরে যাওয়া মানে আবার সেই গতানুগতিক জীবন তখনই ইচ্ছেটা উবে যায়। প্রায় বিনা পরিশ্রমে এত আরামদায়ক জীবন আর কোথায় পাব আমি? লেখাপড়াও তেমন শিখিনি। না হলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। কিন্তু অত পরিশ্রম আমার পোষাবে না। তার চেয়ে এখানে অনেক সুবিধা। আমি ফিরে যাব না। 14th September 1860 ডেভিডও ভয় পাচ্ছে। কী সমস্যা! 15th September 1860 এখানে আসার পর প্রথমবার ডেভিডের সঙ্গে আমার আর হ্যারির ঝগড়া হল। ডেভিডের বৌ বাচ্চা আছে ইংল্যান্ডে। সে সেখানে ফিরতে চাইছে। আমি আর হ্যারি যাব না। কেন যাব? কেউ নেই সেখানে আমার নিজের। আমি এখানেই থাকব। মরি তো মরব কিন্তু পালাব না। অনেকগুলো নষ্ট পাতা পেরিয়ে আবার লেখা পাওয়া গেল। 27th June 1861 মরেছে, মরেছে! মরেছে ঐ হরিশ মুখুজ্জ্যে! খবর পেয়েছি আজ। দেখি এবার ঐ কালা বাঁদরগুলোর পাশে কে দাঁড়ায়। 28th June 1861 আজ অনেক দিন পর মহালে গেলাম। আমি আর হ্যারি। ডেভিড কিছুতেই গেল না। কাপুরুষ কোথাকার! আচ্ছাসে বেত চালিয়েছি। ব্যাটাদের খানিকটা ভয় না পাওয়ালে বড্ড বেড়ে যাচ্ছে। দুটো ছুকরিকে তুলে এনেছি। দেখি ঠান্ডা হয় কিনা শালারা। 29th June 1861 আজ সকাল হতে না হতেই প্রায় জনা পঁচিশ লোক গ্রাম থেকে এসে হাজির হয়েছিল ছুকরি দুটোকে ছাড়াতে। ডেভিডের জন্য সব গোলমাল হয়ে গেল। হ্যারিই ঠিক বলেছিল। গুলি চালিয়ে সব কটার খুলি উড়িয়ে দিলেই ব্যাটারা ঠান্ডা মেরে যেত কিন্তু ডেভিডের সাহসে কুলোল না। আপোষ করতে গেল। হারামজাদারা বলে কিনা করালীকে ছাড়িয়ে দিতে হবে। এত বড় দাবি করার সাহস কোথা থেকে পেল এরা? ডেভিড অবশ্য তাতে রাজি হয়নি কিন্তু ছুকরি দুটোকে ছেড়ে দিতে হল। মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে গেল শালারা। আমি এসব সহ্য করব না। দেখে নেব তোরা কত বাড় বেড়েছিস! এরপর মাসখানেক কিছু লেখা নেই। 25th July 1861 চারদিকে প্রচুর শোরগোল পড়ে গেছে। সেই যে পোস্টমাস্টার, দীনবন্ধু মিত্র, সে নাকি একটা বই লিখেছে, নীলচাষীদের দুরবস্থা আর নীলকরদের অত্যাচার বর্ণনা করে। কিছুদিন আগে বেরিয়েছে বইটা। নাম "নীলদর্পণ।" সে লিখেছে লিখুক গে। আজকাল কালা আদমিগুলো দু পাতা ইংরেজি পড়তে শিখে নিজেদের ব্রিটিশের সমান ভাবতে শুরু করেছে। লাই দিয়ে কুকুরকে মাথায় তুললে যা হয় আর কী। কিন্তু সমস্যাটা সেখানে নয়। বইটা আবার ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে। ফাদার লঙ্ বইটা অনুবাদ আর পাবলিশ করেছেন। বোঝো কান্ড। ফাদারের মাথাটা বোধহয় এই গরমের দেশে থেকে থেকে খারাপ হয়ে গেছে। 30th July 1861 কলকাতা থেকে আমার এক বন্ধু ফ্রেডরিক বইটা পাঠিয়েছিল দুদিন আগে। বইটা পড়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই বই কেউ অনুবাদ বা পাবলিশ করে? ফাদারের মাথাটা সত্যিই গেছে। এটা তো একটা জ্বলন্ত দলিল আমাদের কাজকর্মের। প্রতিটা ঘটনা সত্যি। কী করে জানল ওই পোস্টমাস্টার! কোন আক্কেলে এই বই পাবলিশ করলেন ফাদার? যদি কোনওদিন বেঙ্গল থেকে নীলচাষ উঠে যায় তার পেছনে এই বই আর ঐ হরিশ মুখুজ্জ্যে সবচেয়ে বেশি দায়ী থাকবে। ফ্রেডরিক চিঠিতে লিখেছে ঐ বই পাবলিশের অপরাধে ফাদারের জেল হয়েছে। কিন্তু তাতে কি বিপদ এড়ানো যাবে? বইটা আগুনের কাজ করছে লোকের মনে জমা রাগে। ডেভিড আবার বলছিল ফাদার নন কে এক মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাকি বইটা অনুবাদ করেছে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। ফাদার বইটা পাবলিশ করে চরম ভুল করেছেন। আগুন ছড়াচ্ছে চারদিকে। কী ভাবে সামলানো যাবে সেটাই ভাবতে হবে। 12th August 1861 করালীও কি ভয় পেয়েছে? চারদিক থেকে নীলকুঠিতে হামলার নানা খবর আসছে। বেশিরভাগ নীলকর ভয় পেয়েছে। গোটা কতক নাম আবার খুব শুনছি, দিগম্বর বিশ্বাস, বিষ্ণুপদ বিশ্বাস আর রামরতন মল্লিক। এরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে চাষীদের একছত্র করছে। চাষীগুলোও এদের কথা শুনছে। এইসব বিদ্রোহকে একদম মাথায় উঠতে দেওয়া উচিত নয়। স্রেফ পেট টিপে পিঁপড়ের মত মেরে ফেলতে হবে এই কালা ভূতগুলোকে। জন্মের মত এদের বিদ্রোহের শখ না ঘুচিয়ে দিয়েছি তো আমার নাম জনসন নয়। 15th August 1861 ডেভিডকে বোধহয় রোখা যাবে না। টমাস কুঠি বেচে দিল ক্ল্যাডিয়াসকে। ডেভিডও ওর ভাগ বিক্রি করে টাকা পয়সা নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরতে চাইছে। ও নাকি নিজের দেশেই মরতে চায়। বিদেশ বিভুঁইয়ে মরার ওর ইচ্ছে নেই। সেই ভালো। পালা কাপুরুষ। ভিতুদের দিয়ে আর যাই হোক মহাল চালানো যায় না। আবার কিছু উইতে খাওয়া পাতা। তারপর আবার লেখা শুরু হচ্ছে। 16th October 1861 আজ ডেভিড ফিরে গেল ইংল্যান্ডে। আমার মনটা খুব খারাপ। ভীষণ মনে পড়ছে ছোটবেলার দিনগুলো। হার্টফোর্টশায়ারের সেই সবুজ মাঠ, ফুটবলের সেই উত্তেজনা, স্কুল ফেরত সাইকেল নিয়ে পাশের জঙ্গলে ঘোরা, বাবার সঙ্গে নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া আর ডরোথি। আমার ডরোথি। চিরকালইতো জেনে এসেছি ও আমার। শুধু বড় হয়ে ওঠার অপেক্ষা। তারপর ফাদার একদিন মন্ত্র পরে আমাদের চিরস্থায়ী বাঁধনে বেঁধে দেবেন। কিন্তু ঈশ্বর! ঈশ্বরের যে তা মঞ্জুর করলেন না। ডরোথি প্রেমে পড়ল পাশের গ্রামের কাউন্টের ছেলের। সাধারণ ব্যবসায়ীর ছেলে আমি। সাধ্য কি কাউন্টের ছেলের মোকাবেলা করি। তাই তো ভাগ্যের সন্ধানে এসেছিলাম এই ইন্ডিয়াতে। ফিরব কার কাছে? বাবাও তো আর নেই। তাই আমি এখানেই থাকব। মরতে পারি কিন্তু হারব না, ফিরবও না। 18th October 1861 নতুন নায়েব আজ থেকে কাজ শুরু করল। নাম শিবদাস। দেখা যাক কেমন কাজ করে। 22nd October 1861 আজ নায়েবকে নিয়ে মহালে বেরিয়েছিলাম। আচ্ছাসে দাবড়ে এসেছি। এখনও অবধি এখানকার পরিস্থিতি আয়ত্ত্বেই আছে। নিজের জায়গা ধরে রাখতে হলে ব্যটাদের চাপে রাখতে হবে। তবেই সব ঠিক থাকবে। 25th October 1861 পরিস্থিতি সত্যিই খারাপ হচ্ছে চারদিকে। এর আগে নদীয়া থেকে গোলমালের খবর আসছিল এখন বর্ধমান, হাওড়া, সুন্দরবন এলাকা প্রায় সব দিক থেকেই নীলকুঠিতে হামলা আর প্রজাবিদ্রোহের খবর আসছে। বহু নীলকুঠিতে আক্রমণ হয়েছে। বেশ কয়েকজন সাহেব মারাও গেছেন। বিদ্রোহীদের মধ্যে অবশ্য অনেকেই ধরা পড়ছে। সরকার এর আগে সিপাহিদের নিয়ে এত সমস্যায় ভুগেছে যে এবার আর অতটা দমননীতির আশ্রয় নিতে পারছে না। তবে এর মধ্যেও বেশ কয়েকটা বিদ্রোহী গুলিতে মরেছে। কিন্তু কী ভাবে যেন এদেশের এই ছোটলোকগুলো চরম সাহসী হয়ে উঠেছে। এরা আর আগের মতো ভয় পাচ্ছে না। আর এরা আমাদের ভয় না পেলেই বিপদ। নীলের শাসন কায়েম রাখা মুশকিল হবে। 27th October 1861 আজ কোতোয়ালি থেকে দারোগা সাহেব এসেছিলেন। সাবধানে থাকতে বলে গেছেন। এই কুঠির অত্যাচারের গল্প নাকি চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। সব সময় কুঠিতে লাঠিয়াল মজুত রাখতে বলে গেলেন। কখনই একা বা দুজন চার জন মিলে মহালে যেতে বারণ করলেন। সব সময় সঙ্গে টোটা ভর্তি বন্দুক রাখতে পরামর্শ দিলেন। হ্যারি অবশ্য সব ফুঃ দিয়ে উড়িয়ে দিল কিন্তু সাবধানের মার নেই। এদেশের কালা বাঁদরগুলোর বড্ড বাড় বেড়েছে দেখা যাচ্ছে। ওদের বোঝানো দরকার ব্রিটিশ সিংহ কী বস্তু! সাহেবদের গায়ে হাত পড়লে কী হতে পারে সেটা জানাতে হবে। চরম শিক্ষা দেব ব্যাটাদের! 28th October 1861 আজ সকালে একটা ভিখারি রাস্তা দিয়ে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল। "নীলবাঁদরে সোনার বাংলা করল রে ভাই ছারখার অসময়ে হরিশ ম’ল, লঙের হল কারাগার প্রজার প্রাণ বাঁচানো ভার।" মাথায় আগুন ধরে গেছিল শুনে। বন্দুক তুলে সোজা মাথায় গুলি করেছি হারামজাদার। যাঃ, নরকে গিয়ে গান গা শালা। এরপর ডায়েরির বেশ কিছু পাতা অক্ষত থাকলেও সেখানে কিছুই লেখা নেই। ডায়েরিতে আর কোনও কিছু লেখা হয়নি কোনওদিন বেশ বোঝা যাচ্ছে। কী হল তবে জনসনের? সামনের নদীর দিকে চেয়ে ভাবতে থাকে সুভাষ। পেছনে পায়ের শব্দে সচেতন হয়ে দেখে স্থানীয় ছেলেটি আসছে। ও সুভাষকে একা বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করে, “কি দাদা কাজ শেষ?” সুভাষ হাসে, "আচ্ছা বিনয়, এখানে কোনও জমিদার বাড়ি বা নীলকুঠি বা এরকম কিছু ছিল কোনওদিন?” “ছিল তো দাদা। ঐ নদীর ধারের বিশাল ঝোপঝাড়ঢাকা বাড়িটা দেখছেন, ওটা একটা নীলকুঠি ছিল। আমার বাবার ঠাকুর্দার বাবা ছিলেন কুঠির নায়েব। নামটা যেন কী ছিল? ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। করালীচরণ। তাঁরইতো করা এই বাড়ি, যেটা আপনারা কিনলেন।" "এমন হাল হল কী করে নীলকুঠির?" "সঠিকভাবে জানি না দাদা। দাঁড়ান আমার ঠাকুর্দার কাছে আপনাকে নিয়ে যাব বিকেলে। উনি অনেক কিছু জানেন পুরোনো দিনের।" বিকেলে রতনের ঠাকুর্দার কাছে গেল সুভাষ। নব্বই পেরোনো মানুষটির এখনও মস্তিষ্কও যথেষ্ট সচল। সব শুনে গুছিয়ে বসেন বৃদ্ধ। "শোনো বাবারা, কী ঘটেছিল নীলকুঠিতে। আমার বাবার মুখে শুনেছি। তিনি শুনেছিলেন তাঁর বাবার মুখে। একদিন নীলকুঠির এক সাহেব সকালে ঘুরতে বেরিয়ে এক বৈরাগীকে খামোখা গুলি করে মেরে ফেলে। গ্রামের লোকজন এমনিতেই ক্ষেপে ছিল সাহেবদের অত্যাচারে। এবার তারা রে রে করে তেড়ে গেল কুঠির দিকে। কুঠি ঘিরে ফেলল প্রায় একশ’ দু’শ লোকে। কুঠির লাঠিয়ালরা ভয়ে পালিয়ে গেছিল। দু চারজন যারা ছিল তারা গ্রামের লোকেদের হাতে মার খেয়ে মারা পড়ল। সাহেবরা কুঠির ভেতর থেকে গুলি চালাতে লাগল। কিন্তু দুজন সাহেব মিলে অত ক্ষ্যাপা লোককে আটকানো যায় নাকি? বেশ কয়েকজন গ্রামের লোক সাহেবদের গুলিতে মরল, কিছু জখম হল কিন্তু কেউ পালাল না। কুঠি ঘিরে কুঠিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল গ্রামবাসী। ভেতরে সাহেবরা যখন ভয়ে চিৎকার করছে তখনও কেউ তাদের ছাড়েনি। দুজন সাহেবই পুড়ে মারা যায়। কুঠি ধ্বংস হয়ে যায়। তোমাদের চুপিচুপি একটা কথা বলি। রাতের বেলা কুঠির দিকে যেও না কখনও। লোকে বলে ওখানে তেনারা এখনও আছেন। রাতে নাকি কুঠিতে আলো জ্বলে। লোকের চিৎকার শোনা যায়। ঘোড়ার খুরের শব্দ, ইংরেজিতে কথা বলা শোনা যায় গো বাবারা। কখনও যেও না ওদিকে রাতের বেলা। ওরে, ও বেচা বাবুদের চা দে। দাঁড়াও বাবারা ধান কটা উঠল কিনা দেখে আসি!” বৃদ্ধ চলে যান। এ বয়সেও সতেজ। লাঠি ছাড়াই হাঁটেন। ওঁর চলে যাবার দিকে চেয়ে সুভাষ মনে মনে আবৃত্তি করে ওঠে, “রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত আঁখি / শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি/ ওরা কাজ করে /দেশে দেশান্তরে/…/ শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে/ ওরা কাজ করে।"