কবিবর ধোয়ী আজ নতুন পদ শোনাবেন গতকালই বলে গেছেন। মহারাজ লক্ষ্মণসেন যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছেন রাজসভায়। অন্যান্য সভাসদবর্গও। আজ বিশেষ আলোচনাও আছে, পূর্ববার্তা ছিল। কিন্তু কবির দেখা নেই। এমন তো হয় না কখনও! মহারাজ স্বভাবতই বিরক্ত হয়েও স্তিমিত, যেহেতু অপরাধীর নাম কবীন্দ্র ধোয়ী। তিনি ঠিক করেছিলেন আজ কবির সৃষ্টির আলোচনা দিয়েই শুরু হবে দৈনন্দিন রাজকার্য। সময়ের অপচয় কিংবা অন্যথা তিনি যে একেবারেই সহ্য করতে পারেন না, রাজপরিষদ সদস্যরা তো বটেই, গোটা রাজ্যই জানে। কবিন্দ্র ধোয়ীরও তো এ তথ্য অজানা থাকার কথা নয়। তাহলে! মহারাজ সবেমাত্র রাজসভার ঘোষকের প্রতি নির্দেশ দিতে যাবেন, পরবর্তী প্রসঙ্গের অবতারণার আহ্বান জানানোর জন্য, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে কবি প্রবেশ করলেন। তাঁর ঘর্মাক্ত শরীর, পরনের বসন, এমনকি উত্তরীয়টি পর্যন্ত ঘামে ভিজে গিয়েছে। তিনি শিরোস্ত্রাণ খুলে হাতে নিয়ে এসেছিলেন। তাড়াহুড়োয় পড়তে গিয়ে তা মস্তকে সঠিকভাবে স্থিত হল না। ক'গাছা অলক বেরিয়ে এল শিরোস্ত্রাণের নীচ দিয়ে। হাস্যকর দেখাচ্ছে কবিকে। কিন্তু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মহারাজের কঠিন দৃষ্টি বুঝিয়ে দিচ্ছিল এ মুহূর্ত হাসি-মস্করার নয়। “বিলম্বের জন্য আমি আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থী, মহারাজ। মার্জনা করবেন।” কবি ধোয়ী মাথা নীচু করে অভিবাদন জানানোর ভঙ্গীতে বললেন। তাঁর গলার স্বরে এক অপরাধ বোধের প্রতিফলন স্পষ্ট। হাঁফাচ্ছেন। সামান্য কম্পিতও কি! মহারাজ যে তার আগেই ইশারায় পাখাধরাকে বলেছেন কবির উদ্দেশ্যে বাতাসের জোর বাড়িয়ে দিতে, রাজকবি খেয়ালও করেননি। উপস্থিত সকলেই লক্ষ করলেন, কবিবর কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছেন। “আপনার শারীরিক স্থিতি কুশল তো?” মহারাজের জিজ্ঞাসায় কবি যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। দায়সারাভাবে বললেন, “কুশল থাকার জন্য শুধু শরীরই কি একমাত্র উদ্দেশ্য, মহারাজ? বিধেয়ও যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কখনও কখনও।” “কোনও গুরুতর সমস্যা উপস্থিত হয়েছে কি?” ধোয়ী মহারাজের জিজ্ঞাসার উত্তরে চুপ করে আছেন। মহারাজ বললেন, “আপনি প্রথমে নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করুন।” ধোয়ী কোনও উক্তি না করে আদেশ পালন করলেন। তারপর কাপড়ের পুঁটলির ভাঁজ খুলে স্তরীভূত ভূর্জপত্রগুলি সযত্নে বের করতে থাকলেন আপনমনে। “নতুন পদ রচনা সম্পন্ন হয়েছে?” মহারাজের এই প্রশ্নের উত্তরে নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন কবি। সমগ্র সভায় পিন পতনের নৈঃশব্দ্য। বেশ কিছু পল অতিবাহিত হয়ে শোনা গেল কবির সুললিত স্বরালাপ - সর্বে ভবতু সুস্থিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ। সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু মা কশ্চিত্ দুঃখভাগ্ ভবেত্।। সাধু! সাধু! মহারাজ লক্ষ্মণসেন বিহ্বল হয়ে বলে উঠলেন। সমগ্র রাজসভাসদগণও তাঁর সুরে সুর মেলালেন। এই পদের অর্থ মহতী আলোর মত উদ্ভাসিত করে তুলল রাজসভাকক্ষের চারপাশ। সকলের সুখের জন্য, ভালো থাকার জন্য এই মঙ্গলকামনার আর্তি যেন এক পবিত্র সুরে রণিত হয়ে উঠল। শুভেচ্ছাবিন্দুটি থেকে সুবাসিত আতরের মত নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়তে থাকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের সর্বত্রগামী বাষ্প। কবি চুপ করে রয়েছেন। সভায় উপস্থিত কবি জয়দেব, কবি শরণ প্রমুখ সাহিত্য নক্ষত্রগণ এই পদের অর্থের বিস্তার নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠলেন। মহারাজও যোগদান করলেন সেই মেধাবী প্রতর্কে। “মহারাজ, একটি নিবেদন আছে।” কবি ধোয়ীর এই উক্তিতে আবার রাজসভা ক্ষণকাল স্তব্ধ হল। “বলুন কবি।” স্মিতহাস্যে মহারাজ বললেন। বিলম্বে পৌঁছনোর জন্য কবির ওপর তাঁর আর কোন অসন্তোষের লেশমাত্র নেই। “একজন অশ্ববিক্রেতা…” ধোয়ীর অসম্পূর্ণ বাক্য বিস্মিত ও কৌতূহলী দুইই করে তুলল মহারাজ লক্ষ্মণসেনকে। তিনি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন প্রিয় কবির দিকে। “অনুমান হয়, তাঁর কোন নিগূঢ় কুটিল উদ্দেশ্য আছে।” মহারাজ এবার ধৈর্য ধরতে না পেরে বলেই ফেললেন, “আপনার বক্তব্য অস্পষ্টতার কারণে বোধগম্য হল না, কবিবর। কোন অশ্ববিক্রেতার কথা বলছেন?” “মহারাজ, আজ রাজসভার অভিমুখে আসছিলাম প্রতিদিনের মত। প্রভাতে জাগরণে কিঞ্চিৎ বিলম্বের কারণে প্রস্তুত হয়ে গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে রাজসভা পর্যন্ত রোজকার পথ যেন দীর্ঘতর হয়ে উঠেছিল। এত দ্রুত পদব্রজে আসার ধকল এড়াতে বোধ হল অশ্বযান নেওয়া যাক। উক্ত স্থানে গিয়ে চেনা অশ্বযান চালককে পেয়ে স্বস্তি পেলাম। যানে আরোহী হয়েছি, এমন সময় চালক অনুরোধ করল, ‘পণ্ডিত মশাই, সামান্য সময় অপেক্ষা করুন, আমি অশ্বের জন্য এই সম্মুখের বিপণী থেকে কিছুটা ছোলা নিয়ে সত্বর আসছি!’ এমন সময় একজন দীর্ঘদেহী পাঠান পুরুষকে উক্ত স্থলে দেখা গেল, যাঁর ক্রূর দৃষ্টি, সুযোগসন্ধানী হাবভাব, চতুর হাসি এবং সন্দেহভাজন শরীরী ভাষায়, কারণ বলতে পারব না, যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলাম। মনে হতে লাগল, এই গৌড়ের মাটিতে এই অনাহুত কোন হিতৈষী নয়, হতে পারে না।” মহারাজ লক্ষ্মণসেন মস্করার ভঙ্গীতেই স্মিতহাস্যে কবিকে বললেন, “শুধু দর্শনই যদি একমাত্র বিবেচ্য হত, কবিবর, তাহলে ইহজগতে অধিকাংশ মানুষই সন্দেহভাজন!” রাজসভায় আলতো একটা হাসির ঢেউ খেলে গেল। ধোয়ী যথেষ্ট অপ্রস্তুত বোধ করছেন। ভাবছেন এ প্রসঙ্গের অবতারণা করা তাঁর উচিত হয়নি। কবির অপ্রস্তুত দশা উপলব্ধি করে কবি জয়দেব মহারাজকে বললেন, “দোষ নেবেন না মহারাজ। কবিবর ধোয়ীর মত বিচক্ষণ মানুষের সন্দেহ বা সংশয় উপস্থিত হয়েছে যখন, সে বিষয় কি এতটাই উপেক্ষণীয় হতে পারে? একবার সুলুকসন্ধান করে দেখে নিলে ক্ষতি হত কি? সবচেয়ে বড় কথা আপনার বিক্রম পার্শ্বস্থ সকল রাজা ও নবাবদের ঈর্ষার কারণ, এ তো অস্বীকার করা যায় না। কেউ গুপ্তচর পাঠিয়ে আসন্ন কোন সংঘাতের প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে না তো?” মহারাজ তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলেন। কবি ধোয়ী এই বিতর্কের মাঝে বলে উঠতে পারলেন না যে তিনি স্বয়ং শুনেছেন সেই অচেনা মানুষটিকে বলতে, “ইয়ে মুল্ক এক্দিন মেরে তল্বার কী আগে ঝুকেগা, ইনশাল্লা!” তাঁর কি শুনতে এতটাই ভুল হয়েছিল! মন্ত্রী হলায়ুধ বললেন, “মহারাজের আজ্ঞা হলে একবার সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টা কি করে দেখা যেতে পারে?” রাজসভায় উপস্থিত মান্যগণ্য ব্যক্তিরা অনেকেই যখন একই রায় দিলেন, মহারাজ লক্ষণসেন মাথা নেড়ে সায় দিলেন এই প্রস্তাবে। এরপর ঘোষক জানাল যে আজকের জরুরি আলোচনা পর্ব শুরু হতে চলেছে। এই পর্বে যে সকল সভাসদবর্গের উপস্থিত থাকার প্রয়োজন নেই, তাঁরা নিষ্ক্রমণের জন্য আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। “কবিবর ধোয়ী, আপনি থাকবেন।” মহারাজের আদেশে কবি ধোয়ী পুনরায় আসনে উপবিষ্ট হলেন। “স্পষ্ট করে বলুন তো কবিবর, একজন অচেনা অশ্ববিক্রেতা হঠাৎ করে আপনার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠল কেন?” লক্ষ্মণসেন সরাসরি ধোয়ীকে প্রশ্ন করলেন। “মহারাজ…মহারাজ আমি তাকে এই গৌড়বঙ্গ একদিন ধ্বংস করার শপথ নিতে শুনে ফেলেছি। আমি ভুল শুনিনি। আর তার বলার মধ্যে এমন এক ধ্বংসকামী ইচ্ছের প্রতিফলন ছিল যে…” মহারাজের দুই ভ্রু কুঁচকে গেল। রাজসভায় কোন শব্দ নেই। শুধু পাখা নাড়ানোর আওয়াজ। এরপর আলোচনায় ঠিক হল যে আজ রাতেই গুপ্তচরবর্গ বেরোবে এবং আগামীকাল সভায় এই বিষয়ে বিশদ তথ্য পেশ করবে। বৃদ্ধ বয়সে ফেলে আসা দিনের কথা বড় বেশি মনে পড়তে থাকে। স্মৃতির পৃষ্ঠারা উড়ে যায়…একটার পর একটা স্মৃতিছাপ বিমূর্ত হয়ে উঠতে থাকে। অশীতিপর বৃদ্ধ মহারাজ লক্ষ্মণসেনের মনে পড়ে যাচ্ছিল কবিবর ধোয়ীর সেই আশঙ্কার কথা প্রকাশ এবং স্বয়ং মহারাজসহ উপস্থিত সভাসদবর্গের কারও সে কথাকে প্রাথমিকভাবে গুরুত্ব না দেওয়ার ধৃষ্টতার কথা। গুপ্তচররাও কাজে ফাঁকি দিয়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে প্রশাসনের ঢিলেঢালা ভাবেও কোনও পরিবর্তন আসেনি। কবীন্দ্র ধোয়ী আপাতভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছিলেন। মহারাজ তাঁর শাসিত চৌহদ্দির রাজধানী স্থাপন করেছিলেন নদীয়ায়। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে সুরক্ষিততম নদীয়ায় বহিঃশত্রুর আক্রমণের সম্ভাবনা নেই। একপাশে রয়েছে ঝাড়খন্ডের শ্বাপদসঙ্কুল বিস্তৃত অরণ্য অঞ্চল, যা পার হয়ে বহিরাগত কারও পক্ষে রাজধানীতে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব। আর আভ্যন্তরীণ স্বরাষ্ট্রনীতি এতটাই পোক্তভাবে নির্মিত ছিল যাতে যে কোনও আক্রমণকে প্রতিহত করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করার জন্য মহারাজ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু বখতিয়ার খিলজি যে দীর্ঘদিন ধরে ছদ্মবেশে সমগ্র গৌড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন, এখানকার মানুষ, প্রকৃতি, উৎসব পালন, সমাজজীবন ইত্যাদি সম্পর্কে নিঁখুত তথ্য সংগ্রহ করে চিহ্নিত করেছেন রাজ্যের দুর্বলতা, ঔদাসীন্য ইত্যাদি, এ কারও ধারণারও অতীত ছিল। বহিরাগত শত্রু যে এমন ধুন্ধুমার সৃষ্টি করতে পারে, এ সম্পর্কে সম্যক ধারণাও ছিল না কারও। কারণ যুদ্ধবিগ্রহ এযাবৎকালে যা হয়েছে, সবই অন্তর্দেশীয় সংঘাত এবং ভৌগোলিক সীমারেখা বাড়িয়ে নেওয়াই ছিল যার মূল উদ্দেশ্য। পিতামহ বিজয়সেন এবং পিতা বল্লালসেনের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেব গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেন বাংলায় যে রাজ্যবিস্তার করেছিলেন, তা পূর্ববর্তী সীমারেখা অপেক্ষাও ছিল আরও বৃহদাকায়, পশ্চিমে উৎকল, পূর্বে কামরূপ পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু রাজ্যের সীমারেখা বিস্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সমানুপাতে মহারাজের বয়সও বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন তিনি বিচক্ষণ, অভিজ্ঞ, স্থিতধী ঠিকই কিন্তু জরা-কবলিত। এই সময় সকল প্রকার কার্য, দায়িত্ব ইত্যাদি থেকে অবসরগ্রহণ করে পৌত্র-পৌত্রীর সংসর্গে থাকা বা সাহিত্যপ্রীতির শখ প্রতিপালন করার মত ইচ্ছাই যেন ভেতর থেকে তীব্র হয়ে ওঠে। তাছাড়া মাধব, বিশ্বরূপ, কেশব তিনজনই যথেষ্ট সুযোগ্য হিসেবে সাবালক হয়ে উঠেছে। ওদের হাতে রাজভার ছেড়ে দেওয়াই যায়। যদিও সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বদলে গেছে অনেকটাই। রাজ্যের ভেতরে সক্রিয় গুপ্তঘাতকরা বখতিয়ার খিলজিকে বহু গোপন তথ্য সরবরাহ করে সমৃদ্ধ করেছিল। না হলে মাত্র সতেরো জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে দুর্ধর্ষ বখতিয়ার ঝাড়খন্ডের জঙ্গল পেরিয়েই এসেছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে, ভাবা যায়! যুদ্ধ-রাজনীতির প্রাথমিক সৌজন্যটুকুও না দেখিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকেই সরাসরি রাজভবনের প্রবেশদ্বারের সামনে চলে এসেছিল উন্মুক্ত তরোয়াল হাতে আগ্রাসী আঠেরজন অশ্বারোহী! অপ্রস্তুত দ্বাররক্ষীদের নির্মম আঘাতে নিহত করে সরাসরি প্রাসাদের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। সে এক তুলকালাম কাণ্ড! মহারাজ তখন সবেমাত্র দ্বিপ্রাহরিক আহারে বসেছেন। বিচলিত হয়ে উঠে অস্ত্রধারণ করার ক্ষত্রিয়নীতি ভুলে কীভাবে যে ত্বরিতগতিতে প্রাসাদ ছেড়ে অন্তর্হিত হওয়ার পরিকল্পনাতেই সায় দিলেন! মাধব ও বিশ্বরূপ বৃদ্ধ পিতাকে প্রাসাদের পেছনদিকের প্রস্থানপথ দিয়ে বের করে নিয়ে গিয়েছিল, সোজা বসিয়েছিল সাধারণ একটি নৌকোয়, সে খেয়া পাড়ি দিয়েছিল বিক্রমপুর, ঢাকার অভিমুখে। সেন বংশের শেষ পরাক্রমী হিন্দু রাজা তাঁর সাধের বাংলা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন কাপুরুষের মত। শারীরিক ক্ষমতা ও সাধ্য যে বড় বালাই। যে মাঝি কখনও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি গৌড়পতি তার নৌকার সওয়ারী হতে পারেন, তার ওপরেই বাংলার রাজসম্মান রক্ষার গুরুদায়িত্ব এসে পড়েছিল আচম্বিতে। সময়ের কী আশ্চর্য প্রহেলিকা! আজ যেন মহারাজের স্মৃতিসরণীতে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করছে অবিরাম। তন্দ্রাকে কখনও সেভাবে সময় দিয়ে উঠতে পারেননি। নৌকো যখন বাংলার তটভূমি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তন্দ্রাও পাশে উপবিষ্ট, কিছুটা স্তম্ভিতও। গৌড়ের রোদ্দুর একটু একটু করে দূরে চলে যাওয়ার সময়ে এক আবছায়া এসে ঘিরে ধরতে চাইছে যেন অশীতিপর বৃদ্ধকে। শিরায় প্রবাহিত রাজপুত রক্ত, চালুক্য মাতুলকুলের বীরত্বের উদ্ভাস…সবকিছু পড়ে রইল, নদীর স্রোতে ভেসে যেতে থাকলেন নৃপতিশ্রেষ্ঠ লক্ষ্মণসেন। “আমাকে ওরা কেন এত যত্ন করে বাঁচাল, বলতে পারো তন্দ্রা? এভাবে বেঁচে গিয়ে আমার প্রাপ্তির ভাঁড়ার যে শূন্য হয়ে গেল!” “আপনি মহারাজ লক্ষ্মণসেন, সেজন্য নয়, আপনি ওদের পিতা। পুত্র হিসেবে পিতামাতার প্রতি এটুকু কর্তব্যপালনে তো ওদের বাধা দেওয়া যায় না, মহারাজ!” তন্দ্রা রাজনৈতিক ছলচাতুরি বোঝেন না, তাই সরাসরি সত্য প্রকাশ করতেও কোন রাখঢাক করেননি। আর এই নিখাদ সত্যিই যেন নিদারুণ মুষলাঘাতে পিষে ফেলে গৌড়রাজকে। বেঁচে থাকাকালীনই তিনি রাজত্ব খুইয়ে ফেলছেন নিছক একজন বৃদ্ধ হিসেবে! এ তো বংশানুক্রমিক প্রথাবিরোধী! এযাবৎ যাবতীয় পরাক্রম যে ভূলুন্ঠিত হয়ে গেল! এই গোপন দহন কাউকে বোঝানো যায় না। এমনকি তন্দ্রাকেও নয়। সিংহাসন থেকে নেমে আসার পরবর্তী জীবনে যে এত বিস্বাদ, এত অর্থহীনতা, এত শূন্যতা - পূর্বে কখনও উপলব্ধিই করতে পারেননি। হে নৃসিংহদেব, এও সইবার ছিল! মনে পড়ে যাচ্ছে প্রথম সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়ার দিন। পিতার কাছ থেকে শেখা রাজ্যপরিচালনার নীতি, রাষ্ট্রনীতি, অস্ত্রচালনার সব পাঠ প্রয়োগের একক মালিকানা তাঁকে যেন এক কাঙ্খিত জগতের অধীশ্বর করেছিল। এই আনন্দ উদযাপনের অভিজ্ঞান হিসেবে তিনি পিতার অসমাপ্ত ‘অদ্ভুতসাগর’ শেষ করায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁর রাজসভা তখন গমগম করছে কবি জয়দেব, শরণ, ধোয়ী, হলায়ুধ প্রমুখ ব্যক্তিত্বে, যাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজস্ব ক্ষেত্রে একেকজন দিকপাল। গৌড়, প্রিয় গৌড় ছেড়ে চলে যাওয়ার এই নতুন ললাটলিখন কোন তাৎপর্য বহন করছে - তিনি জানেন না। তাঁর মাথা নিচু হয়ে এল। পিঠে তখন তন্দ্রার পরম প্রেমমিশ্রিত স্পর্শ। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। ছপাট ছপ…ছপাট ছপ… সুবর্ণকঙ্কণার কথা মনে পড়ে গেল। দিগ্বিজয়ের উদগ্র বাসনাকে ইচ্ছে করেই কখনও লাগাম পরাতে ইচ্ছে হয়নি। সে যতদূর যেতে চায়, যাক। আমি তাকে ছোটাই, সেও আমাকে নিস্তার দেয় কই! যে সকল অমাত্য, সামন্ত, বণিক ও সম্ভ্রান্ত নাগরিকবৃন্দ পিতা ও আমার রাজ্যকালের মধ্যে তুলনা করার মত অবান্তর কর্মে রত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের অন্তরে সূচ্যগ্র যে ধারণা বিদ্ধ করে দেওয়া গিয়েছিল, তার ফলশ্রুতি নেহাৎ মন্দ নয়। রাজসিংহাসনে আসীন ব্যক্তিকে মেনে নেওয়াই দস্তুর, একাজে যিনি অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, তিনি তো কিঞ্চিৎ সঙ্কটে আকীর্ণ হতেই পারেন। মহারাজ লক্ষ্মণসেন তাঁর রাজ্যশাসন নীতি নিয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিজেই নেবেন, এই স্পষ্টতা প্রোথিত করে দিয়েছিলেন, এমনকি ঘোর অবিশ্বাসীদের মনেও। সেই প্রতিপাদ্য মোতাবেকই তাঁর দুরন্ত বিজয়রথ ছুটে গিয়েছিল এ ভূখণ্ডের অবিশ্বাস্য সুদূর পর্যন্ত। অন্যায়কে যেমন প্রশ্রয় দেবেন না, তেমনই কারও অতিরেক যদি অন্তরায় হয়ে ওঠে, তাহলে তো… কান্যকুব্জ অধিকার বহুদিনের সাধ। এমন কোন ইঙ্গিতও ছিল না যে কান্যকুব্জের তরফে কোনরূপ বিপদ ধেয়ে আসতে পারে। তবে কেন অহেতুক রাজ্যসীমা বর্ধিত করতে চাওয়ার এই মোহ! যদিও সবকিছু উপেক্ষা করেই কান্যকুব্জকে নিজের অস্ত্রের সামনে বশ্যতা স্বীকার করালেন তিনি। রাজার একমাত্র কন্যা সুবর্ণকঙ্কণার রূপমুগ্ধ লক্ষ্মণসেন ঘোষণা করলেন, কান্যকুব্জের রাজকুমারী যদি সেন রাজ্যের মহারানি হতে রাজি থাকেন, তাহলে রাজ্য প্রত্যার্পিত হবে। কিন্তু বাংলার মাটিতে এসে ঘাঁটি গেড়ে বসলেও লক্ষ্মণসেনের বহিরাগত তকমা যে ক্ষীণ হওয়ার নয়। কর্ণাটপ্রদেশ থেকে বাংলায় আগত এই রাজাকে রাজকুমারী সুবর্ণকঙ্কণা ফিরিয়ে দিলেন। নিজের বিনিময়ে একজন বিদেশির হাতে মাতৃভূমিকে অর্পণ করার মত হঠকারিতা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠল না। রাজা জয়চন্দ্রের কাছে রাজকুমারীর পাণিগ্রহণের প্রস্তাব উপস্থিত হলে, রাজা তাঁর কন্যাকে স্পষ্ট বলে দিলেন, “তোমার ব্যক্তিগত ইচ্ছেকে মূল্য দিয়েই তোমাকে সর্বগুণান্বিতা করে তুলেছি। অতএব তোমার মতামতের ওপর আমি কোনরূপ বলপ্রয়োগ করব না।” যে দূত কান্যকুব্জ থেকে অপমানকর নঞর্থক বার্তা নিয়ে পৌঁছেছিল সেন রাজ্যে, তার কর্তিত মুণ্ডসমেত স্পর্ধিত বার্তা পৌঁছেছিল রাজা জয়চন্দ্রের কাছে, ‘নিজের দুঃসময়ের জন্য প্রস্তুত হও!’ না, রাজা জয়চন্দ্রকে নিহত করা হয়নি, পরিবারসহ উৎখাত করা হয়েছিল রাজ্য থেকে। সমগ্র রাজ্যবাসী চোখের জলে নিঃশব্দে বিদায় জানিয়েছিল রাজপরিবারকে। সুবর্ণকঙ্কণা দৃপ্তভঙ্গীতে পিতামাতার সঙ্গে পথে এসে দাঁড়িয়েছিল। একজন লোভীর কাছে সমর্পিত না হওয়ার গর্ব যেন উদ্ভাসিত করে তুলেছিল তাকে। লক্ষ্মণসেন শেষ চেষ্টা করেছিলেন কান্যকুব্জের রাজকুমারীকে অর্জন করার। কিন্তু বলাই বাহুল্য তাঁর এ প্রয়াস সফল হয়নি। সমগ্র কান্যকুব্জের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রাপ্তির ভাঁড়ার। মদমত্ত রাজা বুঝতেই পারেননি। এভাবে প্রতিটি ভূখণ্ড বিজয়ের সঙ্গেই কোন না কোন হেরে যাওয়ার কাহিনি সংশ্লিষ্ট থাকে, যা আপাত অদৃশ্য থেকে যায়! রাজকাহিনির প্রতিটি অধ্যায়ে যত অস্ত্রের ঝংকার, পরাজিতের হাহাকার, নিহতের স্বজনের শোক, তার তুলনায় যেন জয়ন্তীও ফিকে হয়ে আসে। রাজা লক্ষ্মণসেন কি এই গূঢ় সত্য অনুভব করতে পারেননি, না চাননি? তাঁর রাজত্বে রাজ-অত্যাচার ততটা প্রকট না হলেও প্রজাদের মনের ভেতর কোথাও যেন এক হতাশার আকর ছিলই। অতিবৃদ্ধরা পাল যুগের সমৃদ্ধির সঙ্গে তুলনা করতেন রাজ্যের সাম্প্রতিক অবস্থাকে। এই ছদ্মসমৃদ্ধি যেন ওৎ পেতে ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। তিন তিনটি পুত্রসন্তানের জনক হয়েও এক ভরাট রাজ্যকে রাখা গেল না! কেন! কোথায় ছিল ধ্বংসের বীজ! কোন অতর্কিতে প্রবেশ করেছিল সংহাররূপী অনিবার্যতা – এসব ভাবতে বসে বৃদ্ধ রাজা যেন খেই হারিয়ে ফেলেন। রানি তন্দ্রা অনুভব করতে পারেন এক তুমুল উথালপাতাল চলছে মানুষটার মনের ভেতর। রাতটা কোনক্রমে পেরোতে হবে শুধু। ভোরবেলায় মুন্সিগঞ্জের ঘাটে ভিড়বে নৌকা। রাজ্যের প্রবৃদ্ধ অংশটুকুতে তিনি খর্বরাজত্ব চালাবেন। এমনই পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু নিজের সবকিছু বিপদের মুখে ফেলে রেখে তাঁর এই পলায়নীপ্রবৃত্তিতে কি আদৌ কোন সুরাহা হল! “মহারাজ, এবার একটু বিশ্রাম করুন। এত দুশ্চিন্তা করবেন না দয়া করে। মাধব, কেশব, বিশ্বরূপ তো রইলই আপনার ভার লাঘব করার জন্য!” “কী ভাবে তোমাকে বোঝাব রানী, আমার তিন পুত্র যে কোনও সময়ে সিংহাসন লাভের জন্য নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে উঠতে পারে। রাজা বল্লালসেনের সঙ্গেও তাঁর পুত্রের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল একবার, ইতিহাসে সুবিদিত। সে তো রাজ্যশাসনের লোভে নয়। নিজ স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্য মহিলার প্রতি পিতার অবৈধ আসক্তিকে সন্তান মেনে নিতে পারেনি। পারার কথাও নয় যদিও। সেন বংশের এই অন্ধকার দিক তন্দ্রা জানেন না। জানলেও কোনদিনও তাঁর স্বামীর কাছে এই সম্পর্কে জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি। সময়ের স্রোতে পিতা পুত্রের সেই ক্ষণস্থায়ী দূরত্ব মুছে গিয়েছিল। বল্লালসেন তাঁর পুত্রের অভিমানকে মান্যতা দিয়েছিলেন। ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’ অসমাপ্ত রেখে চলে যাওয়া পিতার কাজ সম্পূর্ণ করেছিলেন পুত্রই। পিতার জিনবাহিত সাহিত্যপ্রীতি যেমন পুত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল, তেমনই কি নারীপ্রীতিও! মহারাজ লক্ষণসেন নিজেকেই মনে মনে ধিক্কার দেন। তন্দ্রা উপলব্ধিই করতে পারেন না মানুষটাকে আজ এসে দাঁড়াতে হয়েছে তাঁর নিজেরই প্রতিকৃতির সামনে। অতিমানবীয় সেই প্রতিকৃতি আজ তাঁর নিজেরই ততটা প্রিয় মনে হচ্ছে না। এই সংকট, এই তীব্র দ্বন্দ্ব যে কী ভীষণ টানাপোড়েনে তাঁকে জেরবার করে তুলছে, তিনি তা প্রকাশ করতে না পেরে গভীর মর্মজ্বালায় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছেন। সেই ছাই কুড়িয়ে জড়ো করে রাখছেন নিজেই। “রাত আন্দাজ কত হল, মাঝি?” নির্ঘুম মহারাজ প্রশ্ন করলেন। “সাত প্রহর শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ, মহারাজ।” বাংলার মহারাজ যে তার জলযানে সওয়ারি হবেন কোনদিন, এ ছিল মাঝির স্বপ্নেরও অতীত। অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসে দাঁড় টানায় কিঞ্চিৎ মন্থর টান। সেই দুপুর থেকে একটানা চলতে চলতে ক্লান্তি আসার কথা, কিন্তু মাঝিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে না বললে কোথাও না থামতে। অর্ধভুক্ত মহারাজের দ্বিপ্রাহরিক আহারের ব্যবস্থা করার জন্য মাঝি একবার উপযাচক হয়েই আজ্ঞা চেয়েছিল। কিন্তু তাকে বিফল মনোরথ হতে হয়েছে। স্মৃতিকাতর বৃদ্ধ তাঁর পরমপ্রিয় কবিবর্গ, মন্ত্রী, অমাত্য এবং সর্বোপরি প্রিয় পুত্র মাধবকে অনিশ্চয়তায় নিক্ষেপ করে এভাবে চলে যাওয়ার জন্য যে বিপুল অপরাধবোধ ও অনুতাপে দগ্ধ হয়ে পড়েছেন, তার কাছে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলিও যেন ফিকে হয়ে গিয়েছে। রাজ অন্তঃপুর থেকে কখনও বাইরের পৃথিবীতে এসে দাঁড়াননি তন্দ্রা, আজ এভাবে স্বামীর সহযাত্রী হয়ে তাঁরও মনের ভেতর এক চরম উথালপাতাল চলছে। সেই ধকলেই হয়ত তাঁর চোখ লেগে এসেছে। দূরে গঞ্জের আবছা আভাস চাঁদের আলোর নীচে জেগে আছে। রাজধানী থেকে যে রাজাকে পালিয়ে যেতে হয় নিজস্ব সীমানারই কোন দূরতম প্রান্তে, সে যদি কৌশল হয়, তাহলে তা কৃতিত্ব, আর সে যদি হয় অসহায় সমর্পণের সামিল, তাহলে রাজার ক্ষাত্রধর্ম নিয়েই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। রাজা হয়েও যে মানুষ আদতে একজন কবি, তিনি যে এই সংকটে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবেন না, এর মধ্যে বাহুল্য নেই। একদিন যে জনপদ অধিকার করতে ছুটে গিয়েছিল তাঁর সৈন্যবাহিনী, সীমানাভুক্ত হয়েছিল জিগীষার নজির হিসেবে, এতদিন যা শাসিত হয়েছে রাজধানী থেকে, মহারাজ কালেভদ্রে কখনও এসেছেন বিশাল বাহিনী নিয়ে, সেখানে আজ প্রাণের দায়ে আশ্রয় নিতে এলেন…এই অপদস্থ হওয়ার বোধ তাঁকে কুরে কুরে খেয়ে চলেছে। তবু রাজধর্ম পিছন ছাড়ে না। মুন্সিগঞ্জ তাঁকে নাগালে পেয়ে যতটা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, অশীতিপর মহারাজ তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না। কেশব ও বিশ্বরূপ প্রজাদের বুঝিয়েছে, পিতার শরীর ভালো নেই। দিন কাটতে থাকে। গুপ্তচর মারফত সংবাদ আসতে থাকে, বখতিয়ার খিলজির আগ্রাসী বাহিনী গৌড় থেকে ক্রমশঃ মুছে ফেলছে হিন্দুত্বের নজিরগুলি। কেমন আছে প্রিয় ও বিশ্বস্ত সুহৃদ, সভাসদ, প্রশাসন সহযোগীরা? ওরা কি রাজা লক্ষ্মণসেনকে ক্ষমা করতে পারবে কখনও? হলায়ুধের বিশেষজ্ঞ পরামর্শের অভাব বোধ করেও মহারাজ লক্ষ্মণসেনের ভিতর থেকে অকস্মাৎ জেগে ওঠে পুনরায় গৌড় অধিকারের স্পৃহা। একদিন কেশব ও বিশ্বরূপকে নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসে ঠিক হল আবার নতুন করে সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। পারদর্শী, বলিষ্ঠ, যুবাদের সন্ধান করে সুচারু শিক্ষাদানের মাধ্যমে নির্মাণ করতে হবে এক ভরসাযোগ্য গোষ্ঠী, ঠিক যেমন ছিল অতীতে রাজ্যবিস্তারের সময়। বাংলার সেন রাজার ত্রাসে সদা তটস্থ সংলগ্ন রাজ্যের অধিপতিরা যেভাবে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বা যুদ্ধহীন সমর্পণে স্ব স্ব রাজ্য সঁপে দিয়েছিলেন বাংলার নৃপতিকে, সেই সম্ভ্রম পুনরায় জাগিয়ে তুলে তুর্কি নবাবকে বুঝিয়ে দিতে হবে বাংলা সহজলভ্য নয়। মাধবকেও এই গুপ্ত সংবাদ প্রেরিত হল। অতি সংগোপনে প্রস্তুতি চলতে থাকল। রাজা পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠলেন। রানী তন্দ্রা যদিও চিকিৎসকের নিষেধাজ্ঞার দোহাই দিতে চাইলেন। কিন্তু পিছিয়ে আসার মানসিকতা থেকে বহু দূরে এগিয়ে গিয়েছে পরিস্থিতি। এভাবে কেটে গেল প্রায় সতেরো মাস। একদিন মুন্সিগঞ্জ থেকে মরিয়া বাহিনী রওয়ানা হল গৌড়ের অভিমুখে। বিক্রমপুরের কর্মকারদের খ্যাতি চতুর্দিকে। তাদের নির্মিত তুখোড় অস্ত্রে সজ্জিত এই বাহিনী আয়তনে ছোট হতে পারে, কিন্তু সাঙ্ঘাতিক কার্যকরী। মাধবও নিজের দক্ষতার সার্থক প্রমাণ দিল নিখুঁত ব্যবস্থাপনায়। যেভাবে বখতিয়ার খিলজির অপ্রত্যাশিত আক্রমণ সেন সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল, ঠিক একই কৌশলে ঝটিকা আক্রমণের পরিকল্পনা করা হল। অতি চালাক মানুষের অবচেতনেও ভুলের বীজ প্রোথিত থেকে যায়। বখতিয়ার খিলজিও গৌড় অধিগ্রহণের পর থেকে আত্মসন্তুষ্টির শীর্ষে আরোহণ ও অধিষ্ঠান করতে শুরু করে। মহারাজ লক্ষ্মণসেনের পুত্র মাধব সেনকে উপেক্ষা করেছিল তুর্কি নবাব ও তার গোষ্ঠী। ভুলটা হয়েছিল সেখানেই। গৌড়ের জনগণের হৃদয়ে তাদের প্রিয় মহারাজ ও তাঁর পরিবারের জন্য সমীহে সামান্য বিচ্যুতিও আসেনি। সহোদর ভ্রাতা কেশব ও বিশ্বরূপের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলা মাধব পিতৃ আজ্ঞা পালনে তার ক্ষমতার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটিয়েছিল। মহারাজ লক্ষ্মণসেনকে বিতাড়িত করার পর সেন রাজ্যের বিপুল সংখ্যক সৈন্যবাহিনীর কিয়দংশ তুর্কি নবাবের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হলেও বাকী অংশ রাজা মাধবসেনের হয়ে গোপনে সক্রিয় ছিল। মাধবসেনের কৃতিত্ব বলতে এটাই যে রাজত্ব খুইয়েও সেন রাজবংশের চিহ্ন সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে দেয়নি বহিরাগত দুর্বৃত্তকে। মহারাজ লক্ষ্মণসেন যখন মাধবের এই বিশেষ পারদর্শীতার কথা শুনতেন, যখন কেশব ও বিশ্বরূপের মেধাবী রাজ্যপরিচালনা প্রত্যক্ষ করতেন, রানী তন্দ্রার উদ্দেশ্যে তিনি বলতেন, “বুঝেছ রানী, আমার তিন পুত্রই যথেষ্ট কুশলী ও দক্ষ হয়ে উঠেছে। আমার এই বিশাল সাম্রাজ্য কতটা রেখে যেতে পারব জানি না, কিন্তু দুশ্চিন্তা নিয়ে যাব না, এ নিশ্চিত।” মহারাজের মুখে মৃত্যুসংক্রান্ত প্রসঙ্গে রানী তন্দ্রা একজন স্ত্রী হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। কারণ বৃদ্ধ মহারাজ যে বয়সে এসে পৌঁছেছেন, সেখানে এই অবধারিত যেন যে কোনও সময়ে সত্যি হয়ে উঠতেই পারে। এই টান অবহেলা করার সামর্থ্যটুকুও যেন ক্রমশঃ নিভে আসতে চায়। রানীর মন ভারী হয়ে আসে। “সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন, মহারাজ।” রানী তন্দ্রার কাতর মিনতি, কেশব ও বিশ্বরূপের পরাজিত সেনানীর মত অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা – কোনও কিছুই মহারাজ লক্ষ্মণসেনকে গৌড় আগ্রাসনে যাওয়ার ক্ষেত্রে রুখতে পারল না। তিনি বদ্ধপরিকর, যাবেনই। আর তাঁর মনে এক গোপন জিঘাংসা ঘনিয়ে উঠেছে – বখতিয়ারকে স্বহস্তে নিধন করবেন। সেনারা যখন শুনতে পেল মহারাজ লক্ষ্মণসেন নিজে এই যুদ্ধে সেনাপতিত্ব করবেন, তাদের মধ্যে এক ব্যপ্ত উচ্ছ্বাসের তরঙ্গ বয়ে গেল। মন্দ চাঁদের রাত। সমগ্র গৌড় ঘুমের দরিয়ায় ভেসে গেছে। ঘাটের অদূরে এক অনুর্বর ভূমিখণ্ডে জমায়েত হয়েছে অযুত অশ্ব। ঘাটে এসে প্রায় নিঃশব্দে ভিড়ল বিপুলাকার নৌকা। তার থেকে বেরিয়ে এল পঞ্চাশ জন সেনা, এমনকি মাঝির ছদ্মবেশেও একজন। এভাবে দুই শত নৌকায় ছেয়ে গেল সম্মুখ জলপৃষ্ঠ। এক তীব্র উন্মাদনা আচ্ছাদিত কী প্রকট ও সতর্ক নৈঃশব্দ্যে! উপস্থিত সৈন্যদের জন্য অশ্বের বন্দোবস্ত করার দায়িত্বে যে গুপ্তচরেরা, তারাও আশ্চর্য শান্ত, সমাহিত। বেশ কয়েকটি প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে শাণিত তরবারি-উদ্যত সৈন্যরা সোজা ছুটে যেতে লাগল রাজপ্রাসাদের দিকে। গৌড়ের মিঠে জলবায়ু এবং নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ তুর্কি সেনাদের কিছুটা শ্লথ ও অলস করে তুলেছিল শুধু তাই নয়, সমগ্র রাজশক্তি কার্যত কোনরূপ বিপদ সম্পর্কে সন্দিহান থাকার প্রয়োজনই মনে করেনি। আর এই অবমূল্যায়নকেই অবলম্বন করে আগ্রাসী হয়ে ওঠার নেপথ্যে যে ধুরন্ধর মস্তিষ্কের পরিচালনা রয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল নিঁখুত পরিকল্পনার নকশায়। বিন্দুমাত্র উত্তেজনা প্রকাশ না করে, সামান্য কলরব সৃষ্টি ছাড়াই অতি সংগোপনে মোক্ষম নাকাবন্দির কৌশলে অস্ত্রাগার, সৈন্যশালা, রাজঅশ্বযূথের আস্তাবল, প্রধান প্রশাসনিক দপ্তর, গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিকগণের বাসস্থল, সংবাদ আদানপ্রদান কক্ষ, এমনকি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথও এমন আঁটোসাটোভাবে অধিগ্রহণ করে ফেলা হল যে কোনও পন্থা অবলম্বন করেই রাজপ্রাসাদ ও তৎসংলগ্ন ভবনগুলির অধিবাসীবৃন্দ পলায়ন করতে পারল না। কিন্তু তুর্কিরা যুদ্ধবাজ জাত, জান থাকতে হার স্বীকার করাও তাদের ইমান-বিরোধী। তারা প্রতিরোধে অবতীর্ণ হল, কিন্তু ন্যূনতম পরাক্রমের সম্ভাবনাও অকুতোভয় সেন সেনানী ছারখার করে দিল। অশীতিপর মহারাজ লক্ষ্মণসেনের প্রতিশোধস্পৃহায় শাণ দেওয়া অস্ত্র যখন প্রোথিত হয়ে যাচ্ছে নবাব বখতিয়ার খিলজীর বুকে, তখন রাত্রি উল্লেখ্য হয়ে উঠছে। আলোর কোন সাম্প্রদায়িক রং হয় না, গৌড় নির্বিবাদে ইসলাম রঙের আলো থেকে হিন্দু আলোয় বদলে গেল। সমগ্র রাজধানী জুড়ে ‘জয় মহারাজ লক্ষ্মণসেনের জয়!’, ‘জয় নৃসিংহদেবের জয়!’, ‘জয় গৌড়, জয় বাংলা!’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল আকাশবাতাস। এই মধুর কোলাহলের মধ্যেই সীমিত সংখ্যক বেঁচে থাকা তুর্কি সেনাদের গৌড় থেকে পালিয়ে যাওয়া অশ্বক্ষুরের শব্দ অবদমিত হয়ে পড়ল। সেই রাত আনন্দপালনের রাত, কারণ রাজ অনুগ্রহে সে রাতে সকল সেনানীকে খাদ্য পানীয়ের মহারাজভোজ উপহার দেওয়া হবে, পারিতোষিক আসবে পরে বেতনের সঙ্গে। মাধব, কেশব ও বিশ্বরূপ নিজেরা তদারকি করে সমগ্র বিষয়টি সম্পন্ন করছে। আজীবন যত যুদ্ধ জিতেছেন, সে সবের চেয়েও এই বিজয়ের স্বাদ বহুগুণে বেশি, এই উপলব্ধি মহারাজ লক্ষ্মণসেনকে পূর্ণ করে তুলেছে। আজ রাতের মেহফিলে তাঁরও যোগদান করতে ইচ্ছে করছে বীর সেনানীদের সঙ্গে। কিন্তু রানী তন্দ্রা চিকিৎসকের নিষেধাজ্ঞার দোহাই দিয়ে সর্বদা মহারাজকে চোখে চোখে রেখেছেন। মহারাজ অনুভব করতে লাগলেন শরীরে যেন এক গভীর অবসাদের ভার চেপে বসছে। তিনি রাজবেশ খুলে রেখে ঘরোয়া পরিধানে শায়িত হয়েছেন। বাইরে শোনা যাচ্ছে উল্লাসধ্বনির আতিশয্য। রাতের অন্ধকারের সৌম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে মদগর্বী মশালের উগ্রশিখা, তালবাদ্যের দ্রুতলয় ধ্বনি। আবহাওয়ায় তাপ কমে এসেছে, অথচ তিনি ঘর্মাক্ত হয়ে পড়ছেন কেন! অস্বস্তির এক গুরুভার যেন তাঁকে আঁকড়ে ধরছে। সংলগ্ন কক্ষে রয়েছেন তন্দ্রা। মহারাজ চেষ্টা করেও উচ্চকিত স্বরে ডাকতে পারছেন না তাঁর সর্বক্ষণের দেহরক্ষীকে, নিদেনপক্ষে স্ত্রীকেও। শুধু কোনওক্রমে এক তুমুল ঝাঁকুনিতে তিনি ফেলে দিতে সক্ষম হলেন শয্যার পাশে রাখা ধাতব পানপাত্রটি। এই অপ্রীতিকর শব্দে ছুটে এলেন রানী ও তাঁর দাসীরা। এর কিছুক্ষণ পর তিন পুত্রও চলে এল। সৈন্যদের উল্লাস স্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। হাকিম এসে পৌঁছতে পৌঁছতেই সব শেষ। আনন্দ ও বিষাদের সমান্তরাল স্রোত দুটি সংশ্লিষ্ট প্রবাহে ভেসে যেতে যেতে বিষাদই প্রবল শক্তিশালী হয়ে উঠল সর্বনাশের ধ্বজা উড়িয়ে। প্রকৃত নিদ্রা নয়, এক মদির আচ্ছন্নতায় মহারাজ অনুভব করতে পারছেন এমন এক প্রিয় স্বপ্নের তীব্র দংশন সহনের ক্ষমতাও তাঁর আজ বিলুপ্তপ্রায়। তাঁর কম্পমান হাতে ধরা দুর্বল তরবারি যে দামাল বখতিয়ারকে নিধনের জন্য যে যথেষ্ট নয়, এই লজ্জা একান্তভাবেই তো তাঁর। এই আত্মমন্থন নিশ্চিত অবরোহে পতনের অভিমুখ নির্দেশ করে দিল। তন্দ্রাকে শেষ মুহূর্তে জড়িয়ে যাওয়া মৃদুস্বরে মহারাজ শুধু বলে যেতে পারলেন “কাঁদছ কেন, তন্দ্রা? প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের হাতে রাজ্যভার দিয়ে যেতে পারছি, আমি এক গর্বিত পিতা।” বৈষ্ণব রীতিতে মহারাজের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে গেল। বাংলার নিয়তিরূপ আকাশ থেকে দুর্যোগের মেঘ মুক্ত হল না। ঘটনাপ্রবাহের ভিড়ে ইতিহাস নিজের চলার পথ স্থির করে নিল।