আলোর পথিক

মধ্যমগ্রাম, কলকাতা

নবম শতাব্দীর বাংলা। কয়েক বছর আগে নতুন একটি বিহার গড়ে উঠেছে বাংলার বুকে। তা নিয়ে চারিদিকে ধন্য ধন্য রব উঠেছে। লোকমুখে পল্লবিত হয়ে বহু উপকথা ও কাহিনি শোনা যাচ্ছে বিহারটিকে নিয়ে। বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্মের স্বর্ণযুগ এসেছে। যেন এসেছে এক নবজোয়ার ও চেতনার বিপ্লব। মিশ্র ভাষায় লেখা হচ্ছে অসংখ্য বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন নিয়ে গ্রন্থ। ভাস্কর গড়ে তুলছেন বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের অপরূপ সব করুণাঘন মূর্তি। ছোটো ও বড় নিত্য নতুন শত শত বিহার, স্তূপ ও চৈত্য গড়ে উঠছে দিকে দিকে। যহোর (যশোর) দেশের পাহাড়পুরের বিখ্যাত সোমপুরী বিহারের চেয়েও নাকি এই নতুন বিহারটি আরও অনেক বেশি সুন্দর। এমন স্থাপত্য আর কারুকার্য শোভিত বিহার নাকি সম্পূর্ণ জম্বুদ্বীপে আর দ্বিতীয়টি নেই। এই খবরটা রাজা দেবপালও শুনেছেন বহুকাল আগেই। তাঁর রাজ্যে কাউকে ধর্মাচারণে কখনও কোনও বাধা দেওয়া হয় না। বরং যথাবিহিত সাহায্যই করা হয়। বাংলায় মিলেমিশে বাস করেন জৈন, তীর্থিক উপাসক, বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্তরা। অথচ এই বিহার নির্মাণের ব্যয়ভার চেয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো আবেদন তাঁর কাছে এসে পৌঁছায়নি। সেই বিষয়টিই রাজাকে সবচেয়ে আশ্চর্য করেছে। বিহারটির নাম উড়ন্তপুর বা উড়ন্তপুরী বিহার। এর নির্মাতা ভিক্ষু সুসীমবাহু নাকি অদ্ভুত অলৌকিক শক্তির অধিকারী। তিনিই বিহার নির্মাণের সুবিশাল খরচ একাই বহন করেছেন। অথচ ভিক্ষু হওয়ার আগে তিনি ছিলেন এক হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান! তাহলে এত বিপুল অর্থ পেলেন কোথা থেকে? তবে কি কোনো গোপন রত্নভাণ্ডারের হদিশ জানেন তিনি? 
দেবপালের রাজসভা। রাজার হাতে এখন একটি আমন্ত্রণলিপি। রাজার দুপাশে দুজন সশস্ত্র প্রতিহারী দাঁড়িয়ে আছেন। রাজাকে পালকের পাখা হাতে ব্যজন করছেন দুজন দাসী। উড়ন্তপুরী বিহার থেকে এই লিপিতে ভিক্ষুসংঘ প্রার্থনা করেছেন রাজার আশীর্বাদ। আমন্ত্রণলিপিটি নিয়ে এসেছেন দুজন তরুণ ভিক্ষু। উড়ন্তপুর বিহারটি বজ্রাসন বিহার (বোধিবৃক্ষ সংলগ্ন বিহার) নলেন্দ্র বিহার (নালন্দা বিহার) এবং বিক্রমশীল বিহারের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। নলেন্দ্র থেকে এই বিহারের দূরত্ব মাত্র তিন মাইল। পত্রে লেখা আছে আগামী বৈশাখী পূর্ণিমাতে প্রবারণা উৎসবে রাজার উপস্থিতি কামনা করছে উড়ন্তপুর বিহারবাসীগণ। রাজা দেবপাল স্মিত হেসে ভিক্ষুদের তাঁর সম্মতি জানালেন। 
এরপরেই দ্বিপ্রাহরিক বিরতির কাড়া নাকাড়া বেজে উঠল। একই সঙ্গে রাজসভা সমাপ্তির জয়ধ্বনিও সূচিত হল। দ্বার প্রতিহারী হাঁকলেন, “মহামহীম শ্রীল শ্রী শ্রী পালবংশ তিলক মহাপরাক্রমী মহারাজাধিরাজ ধর্মপালপুত্র, পরম সুগত মহারাজ দেবপালের জয়!” 
দেবপাল সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। শালপ্রাংশু দেহটি তাঁর। নির্মেদ বলিষ্ঠ দুই পুরোবাহুতে এবং কপালে চন্দন চর্চিত। চন্দন ছাড়াও কপালে আছে দধি, চাল ও কুমকুমের মঙ্গলচিহ্ন, রাজার মাথায় সোনার মুকুটে মরকত মণি। 
উপস্থিত প্রজারা সবাই স্বতস্ফূর্ত হয়ে রাজার জয়গান করলেন। রাজা দেবপালের মতো প্রজাবৎসল ও ধর্মপরায়ণ ছিলেন তাঁর পিতা ধর্মপালও। দেবপাল যোগ্য পিতার যোগ্য উত্তরসূরী তাতে কারও মনে এতটুকু সংশয় নেই। রাজা অতিথি ভিক্ষুদের নিয়ে অন্তঃপুরের দিকে চললেন। আগত ভিক্ষুদের তিনি নিজের হাতে অন্ন পরিবেশন করবেন।  
বাংলার মানুষ সকলেই জানেন বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর বৌদ্ধ সংঘে ধীরে ধীরে বিভেদ দেখা দেয় এবং দেখতে দেখতে বুদ্ধের ধর্মের আঠেরোটা শাখা সৃষ্টি হয়। তার মধ্যে মহাযানের সমর্থক মহাসাংঘিক, সর্বাস্তিবাদী আর হীনযান বা স্থবিরবাদীরাই হল বাংলার প্রধান শাখা। নানা ছোট ছোট আঞ্চলিক শাখাগুলি মথুরা, বারাণসী, কাশ্মীর এবং বৈশালিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া আর একটি বিভাগও আছে বাংলায়। তার নাম হল সম্মতীয়। এই চারটি বিভাগের ভিক্ষু বা শ্রাবকেরাই বাংলার বিহারগুলিতে মিলিয়ে মিশিয়ে সকলে বাস করেন। তবে মহাযানপন্থীরাই সংখ্যাগুরু। বিহারে এঁদের প্রত্যেকের মন্দির আলাদা। মহাযানের মহাসাংঘিকেরা পুজো করতেন অবলোকিতেশ্বরের। সর্বাস্তিবাদীরা পুজো করতেন মঞ্জুশ্রী, অবলোকিতেশ্বর আর তারাদেবীর। স্থবিরবাদীরা বুদ্ধের মূর্তিকেই পুজো করতেন। সম্মতীয়রা পঞ্চধ্যানিবুদ্ধের পুজো করতেন। পঞ্চ তত্ত্বরূপী পাঁচটি রংয়ের পাঁচজন ধ্যানীবুদ্ধ ছিল তাঁদের উপাস্য। এঁদের সবার জন্য মন্দিরও ছিল আলাদা। বিহারগুলিতে ছোট ছোট আলাদা কক্ষ বিশিষ্ট বিভিন্ন দেবতার মূর্তি ছিল। সর্বত্র ছিল কঠোর নিয়ম ও শৃঙ্খলা। নিয়ম বহির্ভূত যে কোনো আচরণের শাস্তি ছিল নির্বাসন। বিক্রমশীল বিহারটি কঠোরভাবে শীলপালনের জন্য বাংলায় সুবিখ্যাত ছিল। এছাড়া দেশ বিদেশের ভিক্ষুরা যে বিহারটিতে এসে শিক্ষালাভ করতেন তার নাম ছিল নলেন্দ্র। যেটি পরে নালন্দা নামে জগতে পরিচিতি পেয়েছিল। দেবপালের রাজত্বে তখন সেখানেই ছাত্র এবং শিক্ষকের সংখ্যা ছিল সবথেকে বেশি। 
রাজা দেবপাল প্রতিটি বিহারেরই পৃষ্ঠপোষক। তাঁর দানেই বিহারগুলি পরিপুষ্ট। 
প্রবারণার দিন রাজা উড়ন্তপুর বিহারে প্রবেশ করলেন সোনার কারুকার্যে শোভিত রথে আরোহণ করে। তাঁর পরনে সাদা চিনাংশুক। গলায় ফুল এবং মুক্তোর মালা। কর্ণে কুণ্ডল। উন্মুক্ত বাহুতে সোনার মানতাশা ঝলমল করছে। রাজা বিহার দেখে মুগ্ধ হলেন। বিহারের চারদিকে চারটি তোরণ এবং চারটি মন্দির। সেখানে চার সম্প্রদায়ের জন্য চারটি অপূর্ব সুন্দর পৃথক মন্দির। বিহারের উপর ও নীচের তলা নিয়ে অসংখ্য কক্ষ। জলের কূপ, জলাশয়, সুসজ্জিত উদ্যান, প্রতিটি দিকই সুষমামণ্ডিত। প্রতিটি কাজ কেবল অপরূপ নয়, স্বয়ংসম্পূর্ণও বটে। রাজা বিস্মিত হয়ে বললেন “এর নির্মাতা কে? আমি তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে চাই।” 
রাজার কথা শুনে ভিক্ষুসংঘের প্রধান ভিক্ষু এগিয়ে এলেন। তাঁর নাম রত্নাকরশান্তি। বয়সের ভারে শরীর ন্যুব্জ হলেও কন্ঠস্বরে এখনও আছে দৃঢ়তা। চোখ ও মুখে খেলা করছে কাঠিন্য আর এক ভাব গম্ভীর তন্ময়তা। রাজা ভিক্ষুর দিকে চেয়ে ভাবলেন নিশ্চয়ই ইনি মহামুদ্রাসিদ্ধি অর্জন করেছেন! না হলে মুখমণ্ডল এমন আলোকিত হবে না কিছুতেই। তিনি সংঘপ্রধানকে যথাবিহিত বন্দনা করলেন। রাজার কর্মীরা এগিয়ে এসে সংঘপ্রধানকে দানবস্ত্র ও খাদ্য উৎসর্গ করলেন। পৃথক একটি রথ থেকে নামানো হল সংঘের সকলের জন্য চীবর-বস্ত্র, পঞ্চবিধ ওষুধ। যেমন ঘি, ননী, ঝোলা গুড়, শুকনো পশুচর্বি, ঘোল ইত্যাদি। এছাড়া রাজা এনেছেন বাছাই করা অসংখ্য সুপক্ক ক্ষীরমল্লিকা আম। দান গ্রহণ করে ভিক্ষু সংঘ রাজার সুস্থতা ও উন্নতি কামনা করার পর রত্নাকরশান্তি রাজাকে বললেন, “মহারাজ একজনের বিশেষ অনুরোধে আপনাকে এই বিহারে আমরা আমন্ত্রণ করেছি। তিনি ভিক্ষু সুসীমবাহু। তিনিই এই বিহারটির প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে তিনি মৃত্যুশয্যায়। তিনি তাঁর কক্ষে আপনার সঙ্গে গোপনে একটিবার কথা বলতে চেয়েছেন।”
রাজা বললেন, “অতি উত্তম। আমি নিজেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে আগ্রহী। এত সুন্দর যাঁর শিল্পবোধ, তাঁর সঙ্গে দেখা না করলে এই বিহার দর্শন আমার অসম্পূর্ণ হবে।” 
এরপর রাজা সংঘপ্রধানের সঙ্গে বিহারের ভেতর প্রবেশ করলেন। দুটি ফাঁপা দেওয়ালের মাঝখানে খুব নিচু প্রবেশমুখ। সেখানে চকমকি ঠুকে আগুন জ্বেলে রাজাকে আলো দেখানো হল। রাজা ভেতরে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করে দেখলেন সেখানে একটি শয়নমঞ্চে শুয়ে আছেন একজন তরুণ ভিক্ষু। তবে রোগে শরীরের স্বাভাবিক লাবণ্য হারিয়ে গেছে। রাজাকে  দেখে তরুণের মুখটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, “মহারাজ আমি ভিক্ষু সুসীমবাহু। বর্তমানে আমি কঠিন বিসর্প রোগাক্রান্ত। বৈদ্য আয়ুষ্কাল নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। মৃত্যুর আগে এই বিহারের ভার আপনাকে অর্পণ করে যেতে চাই। আমি যতদিন বেঁচে থাকব এই বিহারের ভার বহন করা সম্ভব। আমার মৃত্যুর পর তা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অথচ আমি চাই এই অপরূপ বিহারটি দীর্ঘকাল ধর্মের সঠিক পথ দেখিয়ে মানুষের মঙ্গলসাধন করে চলুক।”
রাজা অবাক হয়ে বললেন, “আমাকে আপনি সব খুলে বলুন। এই বিপুল অর্থ আপনি কোথা থেকে পেয়েছেন?”
সেই অন্ধকার কক্ষে প্রদীপের নিভু নিভু মৃদু আলোই ছিল একমাত্র সাক্ষী। ভিক্ষু দেওয়ালের দিকে চেয়ে কম্পিত স্বরে বললেন, “মহারাজ আমার কথাগুলি আপনি অবিশ্বাস করবেন না। আমি মৃত্যুপথযাত্রী। আমি আপনাকে মিথ্যা কখনও বলব না। জন্মগতভাবে আমি মগধরাজ্যের অধিবাসী ছিলাম। বজ্রাসন বিহারে আমি যখন ভিক্ষু হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম তখন আমার মাত্র ষোলো বছর বয়স। পরিবারে তীব্র অনটন। ক্ষুধার জ্বালা আমার ভেতর বৈরাগ্য জাগিয়ে তুলল। চোখের সামনে কঠিন রোগে মারা গেলেন নিকট আত্মীয়রা। আমি একাকী জীবনে বেছে নিলাম ত্যাগের পথ। 
“বজ্রাসন বিহারে বৌদ্ধ উপাসকেরা যেমন আসতেন তেমন তীর্থিক উপাসকেরাও আসা যাওয়া করতেন। তীর্থিকেরা মাঝে মাঝে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে বিতর্ক বিবাদ করতেন। সেই সময় একদিন সন্ধেবেলায় নরদ নামের একজন বৃদ্ধ তীর্থিক উপাসক আমাকে বিহারের বাইরে ডাকলেন। ভাবলাম তিনি হয়তো ধর্মের কোনো গূঢ় বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন। আমি তাঁর সঙ্গে বিহারের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। নরদ বললেন, ‘আমার তোমার সাহায্য প্রয়োজন। আমি বৃদ্ধ হয়েছি। একটি বিশেষ তান্ত্রিকক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এ আমার একার দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। আমার একজন শক্তিশালী, নিরহঙ্কারী এবং পবিত্র চরিত্রের তরুণকে প্রয়োজন। আমি সংসারী মানুষ, তায় আবার বৃদ্ধ, তাই এই ক্রিয়া আমার দ্বারা কিছুতেই হবে না। তীর্থিক আচার্যদের কাছ থেকে আমি এই পদ্ধতি শিখেছি নিখুঁত এবং সঠিকভাবে। তোমার সাহায্য পেলে পাঁচ বছরের মধ্যেই আমার সিদ্ধিলাভ সম্ভব হবে। তুমি রাজি হলে তুমিও বিপুল অর্থের অধিকারী হবে। এত অর্থ রাজা মহারাজদেরও থাকে না!’ 
“আমি ভাবলাম বিহারে অর্থের এখন খুবই অভাব। বহুকাল হয়েছে ভিক্ষারও আকাল শুরু হয়েছে। মানুষ এখন ধর্মের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠছেন। এই সময় অর্থ থাকলে আরও নতুন বিহার নির্মাণ করা যাবে। যা দিয়ে ধর্মের আরও ব্যাপক প্রচার সম্ভব হবে। আমি নরদের কথায় রাজি হয়ে গেলাম। মহাযান মতের প্রচারই ছিল আমার এই কাজে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য। 
“আমরা সেদিন রাতেই বজ্রাসন বিহার ত্যাগ করে চলে গেলাম। তন্ত্রের ক্রিয়ার জন্য বাংলা সুবিখ্যাত। আমরা নদীনালার দেশ বাংলার চন্দ্রদ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। তিনদিন তিনরাত্রি অনবরত হেঁটে নৌকায় বহু নদী পেরিয়ে অবশেষে চন্দ্রদ্বীপের একটি নির্জন বনে এসে পৌঁছলাম। নরদ জঙ্গল থেকে দরকারী ঔষধি গাছপালা সংগ্রহ করে আনলেন। আমি কাঠ কেটে এনে যজ্ঞের আগুন জ্বালালাম। তবে প্রথম থেকেই নানা অসুবিধার সৃষ্টি হতে লাগল। বারবার ক্রিয়া ও আচারে ভুল হতে লাগল। একদিন স্বপ্নে পরপর পদ্ধতিগুলো কে যেন এসে আমাকে বলে গেলেন। সেই পথেই এবার এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। এভাবে দুটি বছর কেটে গেল। অবশেষে তিন বছরের মাথায় একরাতে আমাদের আচার সুষ্ঠভাবে শেষ হল। যে পিশাচটিকে আমরা কয়েকদিন ধরে জাগ্রত করার চেষ্টা করছিলাম সেটি হঠাৎ জেগে উঠে বসল। নরদ বললেন, ‘শবটি জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ওর জিভটি কেটে নিতে হবে। তিনবারের চেষ্টায় তা যদি না করতে পারো পিশাচ আমাদের দুজনকেই হত্যা করবে।’
আমি দুবার চেষ্টা করে বিফল হলাম। জিভ বাইরে থেকে হাত দিয়ে সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য দেখে আমি পিশাচটির মুখের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে দাঁত দিয়ে তাঁর জিভটি কেটে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে পিশাচের দেহটি জড়বৎ মাটিতে পড়ে গেল। তাঁর জিভটি হয়ে গেল একটি তরবারি এবং পিশাচের সম্পূর্ণ দেহটি সোনায় রূপান্তরিত হল। আমি সেই মুহূর্তেই খেচড়ি সিদ্ধিলাভ করলাম। সেই তরবারিটি হাতে নিতেই আমার শরীর পালকের মতো হালকা হয়ে গেল। আমি আকাশে উড়ে বেড়াতে লাগলাম ইচ্ছেমতো। এবার উত্তরদ্বীপ, দক্ষিণদ্বীপ সপ্তসাগর পেরিয়ে চলে গেলাম বহুদূরে। এবং এই সমস্ত জায়গা আমি ঘুরে ফিরে এলাম নিমেষের মধ্যে। নরদ সোনার পিশাচ দেহটি আমাকে দিলেন। আর নিজে তরবারিটি হাতে নিতেই পলকের মধ্যে তীব্র বেগে আকাশে উড়ে গেলেন। পরবর্তীতে তাঁকে আর কখনও দেখতে পাইনি। হয়তো তিনি অনন্ত স্বর্গবাস কামনা করেছিলেন। যাইহোক পিশাচের দেহটির একটি অংশ কেটে নিলে পরদিন সেটি আবার তৈরি হয়ে যেত। ফলে সোনার অভাব কখনও হত না। এই সোনার বিনিময়েই আমি এই উড়ন্তপুর বিহারটি নির্মাণ করেছি। জগৎ ঘুরে আমি যা শ্রেষ্ঠবস্তু দেখেছিলাম তেমন কৌশল সমূহ সমস্ত আমি এই বিহার নির্মাণে ব্যবহার করেছি। পিশাচের দেহটি আমি একটি গোপন স্থানে রেখে দিয়েছি। আশা করি কোনো সুকৃতীশালী সাধক সেটি কখনও আবিষ্কার করবেন। এবার থেকে এই বিহারের ব্যয়ভার আপনি যদি অনুগ্রহ করে বহন করেন, আমি একটা কঠিন দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তিলাভ করতে পারব।”
রাজা বললেন, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, এখন থেকে নলেন্দ্র, বজ্রাসন ও বিক্রমশীলের মতো সমান গুরুত্বসহ ওদন্তপুর বিহারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি গ্রহণ করলাম।” 
রাজা ভুল বশতঃ উড়ন্তপুর বিহারকে ওদন্তপুর বলায় সেই থেকে বিহারটির নাম হল ওদন্তপুর। 
সুসীমবাহু এবার রাজাকে বললেন, “পিশাচ জাগ্রত হয়ে আমাকে বলেছিল বড় অদ্ভুত কয়েকটি কথা। সে বলেছিল, ‘এরপর বঙ্গদেশ থেকে একজন ভিক্ষু নলেন্দ্র বিহারে শিষ্য হয়ে আসবে। যাঁর নিন্দা করবে সেখানকার সবাই। কিন্তু মনে রেখো, সেই প্রকৃতপক্ষে সবার থেকে শ্রেষ্ঠ। বুদ্ধের ধর্মকে একমাত্র সে-ই করতে পারবে ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত। কিন্তু তাঁকে নলেন্দ্র কিছুতেই ধরে রাখতে পারবে না। জম্বুদ্বীপও সেই রত্নকে চিরকালের জন্য হারাবে!’ মহারাজ! আপনি কি তেমন কাউকে সেখানে চেনেন? যিনি নলেন্দ্রতে সবার কাছে নিন্দিত? যদি তাঁর খোঁজ পান, অবশ্যই তাঁকে আপনার গোচরে রাখবেন। মনে রাখবেন, তিনিই এই ধর্মের ভবিষ্যৎ রক্ষক। নলেন্দ্রতে যদি তাঁর প্রতি অবিচার হয়, আপনি তাঁকে অবশ্যই রক্ষা করবেন এবং সুরক্ষা দেবেন। এই আমার আপনার কাছে শেষ অনুরোধ। তিনি কে তা আমি জানি না। তবে পিশাচের কথা মিথ্যা হবে না। নিশ্চয়ই এমন কেউ এখন নলেন্দ্র বিহারে বর্তমানে বাস করছেন!”
দেবপাল অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। তক্ষুণি রাজার একজনের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর নাম ভুসুকুপাদ। নলেন্দ্র বিহারে সকলেই তাঁকে নিয়ে দিবারাত্রি হাসাহাসি করে। দেবপাল নিজেই তাঁর নাম রেখেছিলেন ভুসুকু। এর অর্থ হল অলস বা কর্মহীন। এবং পাদ হল একটি সম্মানজ্ঞাপক ভূষণ। যা ভিক্ষুদের নামের শেষে ব্যবহার করা হয়। এই ভিক্ষু পূর্বাশ্রমে একটি ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন। নলেন্দ্রতে এসে ভিক্ষু হয়েও তাঁর এতটুকু স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি। দিবারাত্রি খাওয়া ও ঘুম নিয়েই তিনি ব্যস্ত থাকেন। তিনি অত্যধিক পরিমাণে খেয়ে থাকেন। একাই পাঁচ দ্রোণ ভাত খেয়ে নেন। ভাতের সঙ্গে নুন হলেই তিনি সন্তুষ্ট। কিছু না থাকলে ভাতে জল ঢেলেই তা খেয়ে নেন। তবে কি সে-ই এই মূল্যবান গুপ্তসাধক? যিনি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন সবার অলক্ষ্যে? রাজা ভাবলেন এখনই তিনি একবার নলেন্দ্রতে যাবেন। এই বিষয়ে তিনি খোঁজ খবর করার জন্য বিশেষভাবে উদ্দীপিত হলেন।

                                                    ২
যহোর দেশের সামন্তরাজার ছেলে শান্তরক্ষিত। ছোটবেলা থেকেই তাঁর সংসারে মন নেই। তাঁদের রাজ্যের সোমপুরী বিহারে তাঁর নিত্য যাতায়াত। কিছুদিনের মধ্যেই শান্তরক্ষিতের পিতা পুত্রের রাজ্যাভিষেক করতে চাইলেন। এবার থেকে পিতার স্থানে রাজপদ প্রাপ্ত হবেন পুত্র। শান্তরক্ষিত এতে কোনো উৎসাহই দেখালেন না। রাজ্যবাসীর দায়িত্ব নিতে হবে মনে করে খানিকটা চিন্তিত হলেন মাত্র। তবে পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও কথাই বললেন না। রাতে শুয়ে তিনি বিরস মনে ভাবতে লাগলেন আগামী দিন থেকে এই রাজপদ তাঁর জীবনের সমস্ত সুখ শান্তি কেড়ে নেবে। ঘুমিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখলেন মঞ্জুশ্রী রাজ সিংহাসনে বসে আছেন এবং তিনি সেই সিংহাসনে মঞ্জুশ্রীকে সরিয়ে নিজে উঠে পড়তে চাইছেন। একসময় জোর করে সেখানে তিনি বসে পড়লেন। তা দেখে মঞ্জুশ্রী তাঁকে বললেন, “পুত্র যেখানে আমি বসেছি সেখানে তোমার বসা কি শোভা পায়?” 
লজ্জায় সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন শান্তরক্ষিত। দেখলেন তারাদেবী একটি ফুটন্ত জলের পাত্র থেকে ভীষণ গরম জল নিয়ে নিজের মাথায় ঢালছেন এবং তাঁর সুন্দর দেহটি জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। তা দেখে শান্তরক্ষিত বললেন, “মা! আপনি কেন এমন করে নিজের মাথায় গরম জল ঢালছেন? কেন যন্ত্রণা দিচ্ছেন নিজেকে?” তারাদেবী বললেন, ‘পুত্র রাজপদ গ্রহণ করলে এমন অসহ্য যন্ত্রণা তোমাকে ভোগ করতে হবে। তাই আমি তোমাকে সাবধান করতে এসেছি।’
ঘুম ভেঙে গেল শান্তরক্ষিতের। এই স্বপ্নের অর্থ তাঁর কাছে পরিষ্কার। তিনি কিছুতেই রাজা হতে পারবেন না। ভোররাতে ঘর ছেড়ে তিনি পালিয়ে গেলেন। ধরা পড়ার ভয়ে দ্রুত পেরিয়ে গেলেন তাঁদের রাজ্যের সীমা। পথে এল এক গভীর জঙ্গল। শান্তরক্ষিত এবার পথ হারিয়ে ফেললেন। যেদিকে চাইছেন বড় বড় মহীরুহ। কোনওদিকে পথ নেই। খিদে এবং তৃষ্ণায় তিনি পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এমন সময় একটি বিরাট পাহাড়ের পাশে একটি ঝরনা দেখতে পেলেন। শান্তরক্ষিত সেখানে জল খেলেন। এমন মিষ্টি জল তিনি কখনও খাননি। ঝরনার পাশে একটি অপরূপ সুন্দর নারী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর মুখটি স্বপ্নে দেখা অবিকল তারাদেবীর মতো। তিনি শান্তরক্ষিতকে বললেন, “এই জলের চেয়েও মিষ্টি জল আমি তোমাকে খাওয়াতে পারি। আমার সঙ্গে এসো।”
শান্তরক্ষিত সন্মোহিতের মতো দেবীর পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে একটি গুহার ভেতর প্রবেশ করলেন। তিনি গুহার ভেতরে দেখলেন একজন দেবপুরুষ বসে আছেন। অবিকল তাঁর স্বপ্নে দেখা বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীর মূর্তি। শান্তরক্ষিত আভূমি প্রণত হলেন। সারাদিনের অনাহারের পর এই অলৌকিক দৃশ্য তিনি সহ্য করতে পারলেন না। সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। জ্ঞান ফেরার পর তিনি দেখলেন সেই গুহায় একপাশে তাঁর জন্য নানা রকম সুস্বাদু ফল ও খাবার জল রাখা আছে। কোথাও আর কেউ নেই। সেগুলি খাওয়ার পর তিনি গভীর ধ্যানে ডুবে গেলেন। ঘনবনের ভেতর সেই গুহার পরিবেশে এমন কিছু ছিল যা তাঁর মনকে গভীর ধ্যানে নিয়োজিত করল। ধ্যানেই তিনি সিদ্ধ মন্ত্রলাভ করলেন। সেটি জপ করতে করতে আবারও তিনি বাহ্যচেতনা হারিয়ে ফেললেন। সাধনার পথে এভাবে তিনি নিজের চেষ্টায় অনেক এগিয়ে গেলেন। কিন্তু প্রথাগত শিক্ষা এবং গুরুর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তিনি ঠিক করলেন নলেন্দ্র বিহারে যাবেন। সেইমতো তিনি নলেন্দ্র বিহারে উপস্থিত হলেন এবং সেখানে সংঘপ্রধান জয়দেবের কাছে দীক্ষাপ্রাপ্ত হলেন। 
নলেন্দ্রতে থাকার সময় থেকেই মন্ত্রজপ এবং গ্রন্থরচনাকে জীবনের একমাত্র আরাধ্য বলে ঠিক করলেন শান্তরক্ষিত। তিনি  গাছের বাকলে তাঁর দর্শন ও উপলব্ধিগুলি লিখে রাখতে লাগলেন সবার অগোচরে। দিনেরবেলা সবাই যখন পঠন পাঠনে ব্যস্ত থাকেন, তখন তিনি ঘুমিয়ে থাকেন। এবং দ্বিপ্রহরে উঠে অন্ন গ্রহণ করতেন, এরপর আবার নিদ্রার ভান করে গভীর   ধ্যানে ডুবে থাকতেন। প্রচণ্ড গরমের দিনেও তিনি তাই মাথা ঢেকে কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে থাকতেন। ধীরে ধীরে তাঁর আচরণের কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। এমনকী রাজার কানেও কথাটা গিয়ে পৌঁছালো। ঠাট্টা করে রাজা তাঁর নাম দিলেন ভুসুকুপাদ। শান্তরক্ষিত আনন্দিত মনে তা গ্রহণ করলেন। কিছুতেই তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সহপাঠীরা তাঁকে নিয়ে উপহাস করে দেখেও দেখেন না শান্তরক্ষিত। নলেন্দ্রতে তাঁর দীক্ষার পর নাম হয়েছিল শান্তিপাদ। সেই নামে তাঁকে কেউ ডাকে না। সবাই তাঁকে উপহাস করে ডাকে ভুসুকু। ধর্মব্যাখ্যার আসরে ভুসুকু কখনও উপস্থিত থাকে না, এইজন্য ভুসুকুর সহপাঠীরা ঠিক করল রাজার কাছে তাঁরা ভুসুকুর বিরুদ্ধে নালিশ জানাবেন। ভুসুকু এই সুবিখ্যাত বিহারের মানহানি করছে। তাকে বহিষ্কার করতেই হবে। 
মেঘ না চাইতেই তাদের কাছে হঠাৎ জল এসে উপস্থিত হল। রাজা স্বয়ং উপস্থিত হলেন নলেন্দ্র বিহারে। দিনটি হল প্রবারণার দিন। রাজা কারও অভিযোগ শোনেননি অথচ তিনি নিজে থেকেই সংঘপ্রধানের কাছে অনুরোধ করলেন, আজ তিনি ভুসুকুপাদের কাছে ধর্মকথা শুনবেন। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আনন্দে ও উল্লাসে ফেটে পড়ল শান্তরক্ষিতের সহপাঠীরা। এবার জব্দ হবে ব্যাটা ভুসুকু! এইবার তার বহিষ্কারের আর বেশি দেরি নেই! তাঁরা আনন্দিত হয়ে কলরব করতে করতে ভুসুকুর কক্ষে গিয়ে উপস্থিত হল। ভুসুকু তখন ধ্যানের চতুর্থ সোপান উত্তীর্ণ হয়েছেন। বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবতা বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী এসেছেন তাঁর শিয়রে। মঞ্জুশ্রী বলছেন, “বৎস! ধ্যান থেকে উঠে পড়ো। তোমার সত্যধর্ম প্রতিষ্ঠার সময় হয়েছে। যাও কাজে লেগে পড়ো।”  
ভুসুকুর সহপাঠীরা দেখল তীব্র গরমের দিনে সর্বাঙ্গে কম্বল জড়িয়ে ভুসুকু নিদ্রিত। তাঁরা ভুসুকুকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে বলল, “চলো মহারাজ দেবপাল তোমাকে ডেকেছেন। আজ তোমাকে তাঁর সামনে ধর্মভাষণ দিতে হবে।”
ভুসুকু এক মুহূর্তও দেরি না করে এগিয়ে গেলেন। প্রবারণার দিন বিহারের প্রাঙ্গণে মণ্ডপ গড়া হয়। সেখানে উঁচু বেদীর উপর উঠে আসনে বসলেন শান্তরক্ষিত। তাঁর সামনে দর্শকের আসনে বসে আছেন মহারাজ দেবপাল। এছাড়া তাঁর সহপাঠী ভিক্ষুরাও সকলে উপস্থিত আছেন, উপস্থিত হয়েছেন তাঁর গুরুদেব জয়দেবও। তাঁর মুখ ম্লান হয়ে আছে। তবে তাঁর সহপাঠীদের মুখ দেখে শান্তরক্ষিত বুঝলেন, এরা সবাই তাঁর বহিষ্কার আকাঙ্খা করছে। তবে মঞ্জুশ্রী তাঁকে ধর্মদেশনা করতে বলেছেন, শুধু এই জন্যই তিনি আজ এখানে এসেছেন। সংঘ যদি তাঁকে বহিষ্কার করে তাতে তাঁর কিছুই যায় আসে না। কারণ তিনি কোনও কিছুতেই সম্পৃক্ত নন। তিনি সভার দিকে তাকিয়ে দেবপালের উদ্দেশ্যে বললেন, “আমি কি সূত্র বলব? না স্বরচিত নতুন কিছু বলব?”
রাজা ভুসুকুপাদকে যাচাই করার জন্য বললেন, “আপনি নতুন কিছুই বলুন। আমি শুনতে বিশেষ আগ্রহী।” ভুসুকুর সহপাঠীরা এতে আরও আনন্দিত হল। তারা মজা দেখার জন্য উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলেন।  
শান্তরক্ষিত তখন ‘বোধিসত্ত্ব-চর্যা-অবতার’ আবৃত্তি করতে লাগলেন। যখন তিনি শূন্যতা বিষয়ে বললেন যে সেখানে চিন্তনে অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব কিছুই বর্তমান থাকে না। তখন তিনি কিছুক্ষণের জন্য শূন্যে বিলীন হয়ে গেলেন এবং অন্তরীক্ষ থেকে তখন তাঁর কন্ঠস্বর শোনা গেল। রাজা এবং উপস্থিত সকলে বিস্ময়াভূত হয়ে এই ধর্মদেশনা শুনলেন। এই পুঁথিটি তৎক্ষণাৎ সেই মুহূর্তে রচিত হয়েছিল তাই তখন এর কোনো লিখিতরূপ ছিল না। পণ্ডিত ভিক্ষুরা তাঁদের স্মৃতিতে ধরে রেখেছিলেন এই অসামান্য চিন্তন সমৃদ্ধ পুথিটি।
অনেকক্ষণ পরে নিজের সম্বিত ফিরে পেলেন শান্তরক্ষিত। তুমুল সাধুবাদের মধ্যে দিয়ে তিনি মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলেন। সকলে ভেবেছিলেন তিনি হয়তো তাঁর কক্ষে ফিরে গেছেন। কিন্তু তিনি তখন নলেন্দ্র চিরকালের জন্য ত্যাগ করে চলে গেছেন। যাবার আগে তিনি তাঁর গুরুদেবের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে একটি চিঠি লিখে গেলেন। চিঠিতে লিখলেন,
‘আমার আরও দুটি গ্রন্থ আছে। যদি সেগুলিকে কারও প্রয়োজন হয়, তাই এখানে লিখে যাচ্ছি তাদের নাম। একটি শিক্ষা-সমুচ্চয় এবং অন্যটি সূত্র-সমুচ্চয়। দুটি গ্রন্থই গাছের বাকলে পণ্ডিত লিপিতে লেখা হয়েছে। সেগুলি আমার কক্ষের জানালার গোবরাটে রাখা আছে। তবে চর্যাবতার পণ্ডিতদের স্মৃতিতে যা আছে তাই গ্রহণ করতে হবে। অনেকের আনন্দের কারণ হতে এই সংঘ থেকে আজ চিরবিদায় নিলাম। আমি হয়তো এই সংঘের সুযোগ্য ছাত্র হতে কখনও পারিনি। তবে শৃঙ্খলাভঙ্গও আমি করিনি। আমাকে আপনি মার্জনা করবেন।’  
নলেন্দ্র ত্যাগ করার পর এক রাজার দেহরক্ষী রূপে দাক্ষিণাত্যে থাকতে লাগলেন শান্তরক্ষিত। মঞ্জুশ্রী তাঁকে একটা কাঠের তরবারি দিয়েছিলেন। এই তরবারিটি নলেন্দ্র থেকে ফেরার সময় সেই পুরনো গুহাতেই তিনি পেয়েছিলেন এবং মনে করেছিলেন সেটি তাঁর প্রাণের দেবতা মঞ্জুশ্রীই তাঁকে দিয়েছেন। শান্তরক্ষিত সব সময় সেই তরবারিটি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতেন। একবার পুজোর সময় রাজার অন্যান্য দেহরক্ষীরা যখন তরবারি পরিষ্কার করছিলেন, তখন শান্তরক্ষিতের তরবারিটি কাঠের তা সবাই জানতে পেরে গেল। সকলেই তখন রাজাকে গিয়ে নালিশ জানাল শান্তরক্ষিতের নামে। শান্তরক্ষিত অনুভব করলেন এখানেও কেউ চায় না যে তিনি থাকেন। মানুষের কদর্য হিংসা তাঁকে বিস্মিত করল। রাজা এই ঘটনা জানতে পেরে শান্তরক্ষিতকে ডেকে পাঠালেন। রাজা তাঁকে বললেন তাঁর তরবারিটিকে উন্মুক্ত করে দেখাতে। শান্তরক্ষিত বললেন, “এটি দেবতাদত্ত তরবারি। এখানে উপস্থিত আমার শত্রুভাবাপন্ন মনের সকলের চোখ এই তরবারি অন্ধ করে দেবে। তাই এটি এখন খোলা যাবে না। রাজা উপহাসের ছলে বললেন, “ বেশ তাই হোক। তবুও তুমি তরবারি উন্মুক্ত করে দেখাও। এটি কি সত্যিই কাঠের তরবারি?”
“এই তরবারি মোটেই কোনো সামান্য কাঠের তরবারি নয়, মহারাজ! আমাকে অবিশ্বাস করলেও দয়া করে অন্তত একটি চোখ বন্ধ করে রাখুন।”
উপস্থিত সকলের সামনে এইবার শান্তরক্ষিত তাঁর তরবারিটি উন্মুক্ত করলেন। নিমেষের মধ্যে বজ্রপাতের মতো আলোর তীব্র ঝলকে সকলের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। এবং সবাই তাদের একটি করে চোখে আর কিছুই দেখতে পেলেন না। রাজা ছুটে এসে শান্তরক্ষিতের পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলেন। রাজার কথায় শান্তরক্ষিত সকলের চোখে তাঁর থুতু লাগিয়ে দিলেন এবং তখন সকলেই তাদের দৃষ্টি ফিরে পেলেন। 
এই ঘটনার পর শান্তরক্ষিত সেই রাজ্য ছেড়ে আরও দক্ষিণদিকে চলে গেলেন। রাজা দেবপালের গুপ্তচরের দল বহুকাল ধরে তাঁকে জম্বুদ্বীপের চারদিকে তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে জানতে পেরে শান্তরক্ষিত অচ্ছুতের বেশে নোংরা ও আবর্জনাপূর্ণ পোশাকে দাক্ষিণাত্য পরিব্রাজন করতে লাগলেন। তাঁর শরীর তখন এমন ক্লেদ পূর্ণ হয়েছিল যে তাঁকে অতি পরিচিতরাও দেখে চিনতে পারত না। 

                                                   ৩
শান্তরক্ষিতের অলৌকিক শক্তির গল্প তখন ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার সর্বত্র। বোধিচর্যাবতার হয়ে উঠেছে যোগাচারীদের মূল প্রতিপাদ্য গ্রন্থ। ধন্য ধন্য করছেন দেশ বিদেশের পণ্ডিতেরা। দেবপাল নিজের আচরণের জন্য লজ্জিত হয়েছেন। শান্তরক্ষিতের কাছে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করতে চান। কিন্তু কোথায় তিনি? খুঁজে খুঁজে গুপ্তচরেরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এদিকে তিব্বতের পণ্ডিতেরাও ঠিক করেছেন একটিবার শান্তরক্ষিতকে তাঁদের দেশে নিয়ে যাবেন। পোন ধর্মের কুসংস্কারে দেশ রসাতলে যাচ্ছে। যুক্তিপূর্ণ দর্শন এই সময়ে তিব্বতের জনমানসের জন্য ভীষণ প্রয়োজন। তিব্বতরাজ ঠিস্রোং দেচানের মন্ত্রী সালনাং বা জ্ঞানেন্দ্র ছিলেন নলেন্দ্রর শিক্ষার্থী। সেই সময় ভারতীয় শাস্ত্র ও ধর্ম বিষয়ে জ্ঞানলাভের জন্য নলেন্দ্র বিহারে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন। সালনাংয়ের নলেন্দ্রর নাম ছিল জ্ঞানেন্দ্র। তিনি শান্তরক্ষিতের বোধিচর্যাবতার সূত্র ভাষণ নিজের কানে শুনেছিলেন। শান্তরক্ষিত নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে সালনাং খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন শান্তরক্ষিতকে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শান্তরক্ষিতের কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়া।
বহুকাল তীর্থে তীর্থে ঘুরে শান্তরক্ষিত এবার পৌঁছালেন শ্রী পর্বত অঞ্চলে। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখলেন বৌদ্ধ ও তীর্থিকদের মধ্যে বিতর্ক হচ্ছে। বিতর্কে উভয়পক্ষকে তাঁদের অলৌকিক শক্তির প্রদর্শন করতে বলা হল। বৌদ্ধরা পরাজিত হচ্ছে দেখে সেখানে উপস্থিত হলেন শান্তরক্ষিত। তীর্থিকেরা তাঁর নোংরা পোশাক দেখে শান্তরক্ষিতের শরীরে উচ্ছিষ্টজল ও আবর্জনা ছুঁড়ে দিলেন। উচ্ছিষ্ট সেই জল শান্তরক্ষিতের শরীর স্পর্শ করা মাত্রই টগবগ করে ফুটতে লাগল। বৌদ্ধরা বুঝলেন শান্তরক্ষিতের মধ্যে অলৌকিক শক্তি আছে। তাঁরা তাঁর শরণ নিলেন। তখন শান্তরক্ষিত সেখানে প্রবল ঝড় ও বিস্ফোরণের সৃষ্টি করলেন। তীর্থিকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেলে বৌদ্ধদের জয় ঘোষিত হল। 
এই কথাও পল্লবিত হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। এবার সালনাং ছুটে এলেন দাক্ষিণাত্যে। তিনি শান্তরক্ষিতকে বললেন তাঁর গুরু বোধিসত্ত্ব। বাংলার এই আলোক বর্তিকাকে তিনি তিব্বতের মাংয়ুলে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলেন। শান্তরক্ষিতই হলেন সেই বাঙালি আলোর পথিক, যিনি প্রথম তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ভিত সুদৃঢ় করেছিলেন। শান্তরক্ষিত সেখানে গড়ে তুললেন বৌদ্ধধর্মচর্চার প্রধান একটি কেন্দ্র। সামিয়ে বিহার। এটির নকশা শান্তরক্ষিত করেছিলেন ওদন্তপুরী বিহারের অনুকরণে। এই বিহারের সম্পূর্ণ নাম সামিয়ে মিনজুর লহুনগি ডুবপেই চুগলগখাং বা অচিন্ত্য নিরাভোগ সিদ্ধবিহার। এটি লাসার তিরিশ মাইল দক্ষিণ পূর্বে চাংপো নদীর ধারে অবস্থিত। 
তিব্বতে শান্তরক্ষিত পরিচিত হলেন শান্তিজীব নামে। বহু বাধা পেরিয়ে শান্তরক্ষিত প্রথম দশজন তিব্বতি ভিক্ষুদের সংস্কৃত শিখিয়ে সেখানে শুরু করলেন জ্ঞানচর্চার প্রথম পদক্ষেপ, অনুবাদ। ধর্মগ্রন্থাদির অনুবাদের মাধ্যমে ধীরে ধীরে কুসংস্কারের অন্ধকার কেটে যেতে লাগল। শুরু হল আবার বিরুদ্ধবাদীদের ষড়যন্ত্র। আলোর পথিক শান্তরক্ষিতকে ঘিরে চলতে লাগল পোন ধর্মের বিরুদ্ধবাদীদের অভিযান। একসময় তাঁদের চক্রান্তে হতোদ্যম হয়ে তিব্বত ছেড়ে চলে গেলেন শান্তরক্ষিত। তিব্বত দেশে দেখা দিল মারক রোগ, বজ্রপাত। দলে দলে মানুষ রোগাক্রান্ত হতে লাগল। বিরুদ্ধবাদীরা বললেন, বিধর্মীদের গ্রন্থপাঠ এবং অনুবাদের জন্যই এই বিপদ দেখা দিয়েছে। তাঁদের কথায় বিব্রত ও ভীত হলেন রাজাও। অবশেষে তিনিই বাধ্য হয়ে শান্তরক্ষিতকে তিব্বত থেকে চলে যেতে বললেন।
শান্তরক্ষিত বিদায় নিতে হতাশায় ভেঙে পড়লেন তিব্বতের মন্ত্রী সালনাং এবং রাজা ঠিস্রোং দেচান। শান্তরক্ষিত ছাড়া এই তমিস্রা থেকে উদ্ধারের তাঁদের আর কোনো পথ নেই।

   ৪
আবার দেশে ফিরে এসেছেন শান্তরক্ষিত। আবার সেই বাংলার সজীব সবুজ ছায়াপথ। এবার আর লোকালয় নয়, শান্তরক্ষিত আশ্রয় নিলেন গভীর বনের ভেতর পার্বত্য চট্টগ্রামের এক অরণ্য বিহারে। সারাদিন নিজের কক্ষে ধ্যানে ডুবে থাকেন তিনি। সেখানেও আবার বিহারের অধিবাসী ভিক্ষুরা তাঁর বিরোধিতা করতে শুরু করলেন। খবর গেল সেখানকার সামন্তরাজার কাছে। শান্তরক্ষিত নাকি ব্যাভিচারী। তিনি অরণ্যের হরিণের মাংস খান! একজন অহিংস শ্রমণের নামে এ অতি ভয়ানক অভিযোগ। রাজা শান্তরক্ষিতের কাছে ছুটে এলেন। 
“ভদন্ত আপনি এখানে হরিণ হত্যা করছেন?”
হা হা করে হাসলেন শান্তরক্ষিত। আমি কোনো প্রাণী হত্যা করি না। তারপর তিনি মায়ার মাধ্যমে শত শত হরিণ দেখালেন রাজাকে। তারপর আবার তাদের অদৃশ্য করে দিলেন। শান্তরক্ষিত বললেন, “এই বিশ্বের দৃশ্যমান জগতে সব কিছুই মায়ায় আবৃত। তার চেয়ে মহারাজ অনুভব করুন যা কিছু দৃশ্যমান তার সবই অসার, সব কিছুই অলীক! এই যে আপনি আমাকে অলস ভুসুকু হিসেবে দেখছেন, আসলে এ-ও আমি নই। দৃশ্যমান জগতের বাইরেও আরও একটা জগত আছে। অন্তর্জগত! এই জগতের মোহবন্ধন আপনার নাশ হোক। সবার মঙ্গল হোক! মহান শূন্যতার অনুভূতিতে সমস্ত জগতের সবার মিথ্যাদৃষ্টির নাশ হোক।”

এবার তাঁকে আবার পথ চলা শুরু করতে হবে। নতুন করে চলতে হবে আবার। অন্ধকার বরফাবৃত শীতলদেশ তিব্বতে তাঁকে আবারও ফিরে যেতেই হবে। সেখানে যে আলোর শিখা ভালো করে জ্বলেনি এখনও। রাজার ঠিস্রোংয়ের দূত ছুটে এসেছেন শান্তরক্ষিতকে তিব্বতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। তাঁকে তিনি নিরাশ করবেন না। নিজেকে নিয়ে তাঁর ভাবনা নেই। দেশ ও কালের সীমানা অতিক্রম করে মুমুক্ষু মানুষকে ধর্মের পথ দেখানো আর জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রাখাই একমাত্র কাজ তাঁর। 

বৈশাখী ২০২৪