দূরদর্শন

	“তুমি নিশ্চিত এই লোকটাই?”
	“একদম নিশ্চিত!”
	“এমন নিঃসন্দেহ হওয়ার কারণ?”
	“ওর সঙ্গে গতকাল অনেকক্ষণ কথা বলেছি আমি।”
	“সেই সমস্ত কথা তো মিথ্যেও হতে পারে...”
	“আমার মনে হয় না!”
	“তোমার মনে হওয়া নিয়ে কিছু এসে যায় না। আমাকে আরও নিশ্চিত হতে হবে। এমন একটা লোককে চট করে গ্রেফতার করার আগে তলিয়ে দেখতে হবে।” 
	“তলিয়ে দেখার জন্য ওর পিছনে গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছি। নিশ্চিন্ত থাকো।” 
	“ভালো করে মিলিয়ে দেখেছ? এই লোকটার সম্বন্ধে সব তথ্য মিলছে?” 
	“তথ্য তো তেমন ছিল না। কিন্তু খুব ভাল করে ভাবো, লোকটা এই অঞ্চলে সম্পূর্ণ অপরিচিত, দুদিন ধরে সে শহরে ফিরিওয়ালার মতো ঘুরছে, অথচ কিচ্ছু ফিরি করায় তার আগ্রহ নেই। কেবল এদিক-সেদিক তাকায়, এধারে ওধারে ঘুরে বেড়ায়... মতলব বোঝার চেষ্টা করব না?”
	“তা ওর সঙ্গে কথা বলে কী বুঝলে?”
	“লোকটা কেমন এড়িয়ে যায়। ধরা দিতে চায় না। নাম বলল, ফয়জল। জিগ্যেস করলাম বাড়ি কোথায়। বললে, পূর্ণিয়া। অতদূর থেকে সে এখানে আসবে কেন? তখনই সন্দেহ হল। তারপর একথা সেকথা। কোনও কথার সঙ্গে কোনও কথার মিল নেই। উল্টোপাল্টা বকে। একবার বলে লোকজন সব গুনে দেখছি, একবার বলে চারপাশে শুধু ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ার শব্দ পাই, থেকে থেকে বলে, সব টুট জায়েগা... শুনলে বেশ বোঝা যায় সব সাজানো। পাগল নয়, আমি তোমাকে বলছি শোনো, ও ব্যাটা পাগল সাজার ভান করছে!” 
	“আমার কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে ফকির। এ কখনওই কোম্পানির চর নয়!” 
	“মনে হয় না। মাথায় পাগড়ি আর গায়ে জোব্বা থাকলেই সে ফকির হয় না। চিন্তা কোথায় জানো, মুর্শিদকুলী খাঁ মরলে কী হবে, ওর জামাই শুজাউদ্দীন তো চরম অপদার্থ। সে তো সব দায় ছেড়ে রেখেছে হাজী মহম্মদ, আলমচাঁদ আর জগৎ শেঠ ফতেচাঁদের ওপর। আর আমাদের হয়েছে যত জ্বালা... যে যখন গদিতে উঠবে তার হাজার বায়নাক্কা সামলাও।”
	“চুপ চুপ। হাওয়ারও কান আছে। যা নির্দেশ আছে, তাই করি চলো। আগে এই লোকটার মতলব বুঝতে হবে।”   

যাকে নিয়ে কথাবার্তা, সে বটতলায় বসে আছে চুপচাপ। একেবারে নিরুদ্বিগ্ন। পাশে এক ছোট ঝাঁকায় সামান্য পসরা। কী আছে বোঝার উপায় নেই। গামছা দিয়ে ঢাকা। উদাসীন চোখমুখ। গায়ে রঙ জ্বলে যাওয়া আলখাল্লা ধরনের পোশাক আর গালের দাড়ি দেখে আপাতদৃষ্টিতে মুসলমান বলে মনে হয়। আবার ভেকধারীও হতে পারে। আশেপাশে বৃদ্ধের জটলা। তাদের মধ্যে সে এক নিতান্ত যুবক, মাথায় ছেঁড়াখোঁড়া পাগড়ি, মন দিয়ে কারও গালগল্প শুনছে বলে মনে হয় না। তাকে যে অনতিদূর থেকে দু’জন নজর করে চলেছে সেদিকে তার হুঁশ নেই কোনও।      
গঙ্গার ঘাটে বৃদ্ধদের জটলাটি জমে উঠেছে। এসব জটলায় হামেশাই রাজা-উজির মরে। দু’জন নজরদার ধীরে ধীরে জটলার দিকে এগিয়ে আসে। 
“অ যুগীখুড়ো, শরীরগতিক কেমন?” 
“সে আছে একরকম। শোনো বাছা। শরীরের নাম মহাশয়, যত সওয়াবে, তত সয়।” 
বাকিরা ঘাড় নাড়ে।  
বৃদ্ধদের দলে যুগীখুড়ো, অর্থাৎ যোগীশ্বর সর্বাপেক্ষা প্রবীণ মানুষ। তিনি বাক্যবাগীশ, সামান্য আরবী ফার্সী পড়তে জানেন বলে তাঁর দরও আলাদা। তিনি রোজই আড্ডায় বসে শোনান ইংরেজরা কেমন করে চারধারে জঙ্গল কাটিয়ে সাফ করে ডোবা বুজিয়ে জলা পরিষ্কার করে রাস্তাঘাট বানিয়ে এই কলকাতা শহরের পত্তন করেছিল। চারদিকে ছিল এঁদো ডোবা, পানাপুকুর, খাল-বিল, তার মধ্যে কতকটা ধানের ক্ষেত, খানিকটা ফলমূলের বাগান, বাকি সবটাই হোগলার ঝোপ, বাঁশের ঝাড়। বড় রাস্তা বলতে একটাই, সরু গলির মতো এঁকেবেঁকে উত্তরে চিৎপুর গ্রাম থেকে দক্ষিণে কালীঘাট পর্যন্ত চলে গেছে। তার ওপর দিয়ে তীর্থযাত্রীরা দল বেঁধে দেবী-দর্শনে যেত। সমস্ত পথের দুধারে ঝোপঝাড়ে ঠ্যাঙাড়ে খুনে-ডাকাতের আড্ডা। একটু অসাবধান হলে ধনে-প্রাণে মারা পড়ার উপক্রম।  
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হাল ধরাতে বোম্বেটে ঠ্যাঙাড়েদের উপদ্রব অনেক কমেছে।  
যোগীশ্বর প্রথম যৌবনে ছিলেন ঢাকা শহরে, পরে কিছুদিন মুর্শিদাবাদে জমিদারের সেরেস্তায় কাজ করেন। যদিও কী কারণে তাঁর এই কলকাতায় আগমন, তার সঠিক কারণ তিনি নিজে খোলসা করে বলেননি কোনওদিন।
যোগীশ্বর শোনাচ্ছিলেন কালীঘাটের ভদ্রকালী কালিকাদেবীর মাহাত্ম্য।
“সে কি যে সে দেবতা ভায়া? সেখানে স্বয়ং নকুলেশ্বর মহাদেবের সঙ্গে বিরাজ করছেন তিনি। মা মা গো!” বলতে বলতে ভক্তিভরে দু’হাত ঠেকান কপালে। 
যোগীশ্বরের পাশে বসেন রামগতি। তাঁর বাস শাঁখারীটোলায়। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে এক কাল্পনিক দেবীমূর্তিকে প্রণাম করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “শুনিচি, খুবই জাগ্রত দেবী। তা সে আর দর্শন করতে যাওয়া হল কই।”
“মা না টানলে... সবই তাঁর কৃপা। না হলে ওই সে বিশাল জঙ্গলের মধ্যে এক বাতে-পঙ্গু খোঁড়া সাধু কেমন করে মাটির তলা থেকে ওই মূর্তি খুঁজে পান... চিন্তা করলেও শিউরে উঠি...”  
“আচ্ছা যোগীভায়া, শুনিচি দেবীর মন্দিরটি গড়ে দেছেন সাবর্ণ চৌধুরীরা, কিন্তু ওই জলে-জঙ্গলে পুজোর পুরুত কারা ছেলেন?”
যোগীশ্বর নিজের গুরুত্ব অনুভব করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন, “শোনো বাপু, সাবর্ণ-চৌধুরীরা তো দেবীর পূজারী হতে পারেন না, তাই হালদার-বংশীয় একঘর শ্রোত্রিয় বামুন আনিয়ে তাঁদের করে দেন মন্দিরের সেবায়েত। আরে ওই পরিবারেই তো আমার সম্বন্ধীর নিত্য যাতায়াত, নইলে আর এত জোর দিয়ে কই কী করে?” 
নিম্নবর্গীয় মানুষের ভিড়ের মধ্যে একটু সমীহ ছড়িয়ে পড়ে।   

অপরাহ্নের সূর্যের তেজ ক্রমশ স্তিমিতপ্রায়। গঙ্গার তীরবর্তী এই অঞ্চলে যতদূর চোখ যায় ডিঙি নৌকা, কিছু পালতোলা নৌকার ভিড়। জাহাজ এই পাড়ে বড় একটা ভেড়ে না। মানুষজন নিয়মিত পারাপার করে। পাড়ের মানুষ হাঁক পাড়ে, “কী কর্তা কোথা হইতে আসা হয়?” উত্তর মেলে ওধার থেকে। কেউ যাবে কলুটোলা, কেউ যাবে আহিরীটোলা। গঙ্গার পশ্চিম পাড় বারাণসী সমতুল, কিন্তু এই পূবপাড়ে অন্ত্যজ শ্রেণির বাস। জেলে, কসাই, পটুয়া, শুঁড়ি, শাঁখারি, কলু, কুমোর, কামার, কলু, তাঁতিদের জন্য নির্দিষ্ট এক-একটি পাড়া। অল্প কয়েকঘরের বাসস্থান। সব পেশার সমস্ত শ্রেণির মানুষের বাস এই অঞ্চলে।     
দুপুর গড়ালে সব পাড়া থেকেই দু’চারজন অল্পবিস্তর স্বচ্ছল ব্যক্তি এসে বসেন এই আড্ডায়। ঘরের খবর, পাড়ার খবর, দেশের খবর আদান-প্রদান হয়।   
যোগীশ্বরের মন্দির সংক্রান্ত আলোচনার একটি অন্য কারণ রয়েছে। মুর্গিহাটায় পর্তুগিজদের, খ্যাংরাপটিতে আরমানিদের দুটি নতুন পাকা গির্জেবাড়ি তৈরি হয়েছে সম্প্রতি। শোনা যাচ্ছে দরমা ঘেরা কাঠের গির্জেঘর ফেলে নতুন পাকা বাড়ির জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের একখণ্ড জমি দান করেছে। এদিকে কুমোরটুলিতে গঙ্গার ধারে মহাদেবের প্রকাণ্ড মন্দির তৈরি করছেন গোবিন্দ মিত্তির। তাঁর সেই নয়টি চূড়াওয়ালা নবরত্ন মন্দির ঘিরে কলকাতায় সাড়া পড়ে গিয়েছে। বেনিয়া ইংরেজরা পর্যন্ত বলছে, এটি হ’ল ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দরামের ব্ল্যাক প্যাগোডা। প্রতিদিন সায়াহ্নে বিভিন্ন মন্দিরের স্থাপত্য নিয়ে তুলনামূলক গালগল্প চলছে পুরোদমে। আজও আড্ডায় তার ব্যতিক্রম হল না। বসামাত্র বিভিন্ন অঞ্চলের মন্দিরের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে বক্তব্য আসতে শুরু করল।   
গোবিন্দরাম মিত্র এখন বাঙালিদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। কোম্পানির কাউন্সিলে কলকাতার হর্তাকর্তা হলওয়েল সাহেব। তিনি এসে ইস্তক উঠেপড়ে লেগেছিলেন গোবিন্দরামকে তাড়িয়ে ছাড়বেন। সাধারণ মানুষের কাছে রাজা আসে, রাজা যায়... কিন্তু কোম্পানির কাছে গোবিন্দ মিত্তির যে-সে মানুষ নন। স্বনামে বেনামে বহু ব্যবসা তাঁর। প্রচুর বাজারের ইজারা নিয়েছেন একের পর এক, সস্তায় নিজের আশ্রিতদের মধ্যে জমি বিলি করেছেন এন্তার। এমনকী দুর্জনে বলে, আদায়ি খাজনার টাকায় প্রচুর গড়বড় করেছেন তিনি। কাউন্সিলে তাঁর মুরুব্বির জোর রয়েছে। গোবিন্দপুর থেকে বাস তুলে এনে সুতানুটির কুমোরটুলিতে গুছিয়ে নিয়েছেন তাঁর সম্পত্তি, তৈরি করেছেন বিশাল বাড়ি। সর্বত্র তাঁর অবাধ গতিবিধি। দশদিকে দশজোড়া চোখ। কোথায় কে শহরে ঢুকছে, বেরোচ্ছে, সব তাঁর নখদর্পণে।  
গত ক’দিন ধরেই শহরে কানাঘুষো। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কাউন্সিলে নাকি ডাক পড়েছিল গোবিন্দ মিত্তিরের। সেখানে সাহেবদের নাকি একেবারে তুলো ধুনে দিয়ে এসেছেন মিত্তিরমশাই। এসব ভেতরমহলের খবর আদায় করে আনতে যুগীখুড়ো ওস্তাদ। সরকারি দফতরে তাঁর পিসতুতো মাসতুতো মামাতো খুড়তুতো স্বজনের শেষ নেই, আর সেই সব স্বজনের মুখ থেকে একেবারে হাঁড়ির টাটকা খবর এনে গরম গরম পরিবেশন করেন যোগীশ্বর।   
“গোবিন্দ মিত্তির সায়েবের মুকের ওপরেই পষ্ট জানিয়ে দেছেন শোনলাম। ঘটনাটা কী এট্টু ব্যাখ্যান দ্যান যুগীখুড়ো,” শ্রোতার প্রশ্নে আগ্রহী হয়ে হুঁকোতে টান দেন যোগীশ্বর, “আরে তারপর সে এক কাণ্ড। সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে মিত্তিরমশাই জানিয়েছেন কোম্পানি তাঁকে যা মাইনে দেয়, তাতে তাঁর কাপড়চোপড়ই হয় না, পেট ভরা তো দূরের কথা।” 
যদু তাঁতি অবস্থাপন্ন। সে পাশ থেকে বলে, “সে যাই বলেন খুড়ো, আমাদের মতো গরিবের ওপরে অত্যেচার সকলে করে। রামে মারলেও মরি, রাবণে মারলেও মরি। আমাদের পড়ে মার খাওয়া ছাড়া গতি নাই।” 
সায় দেয় রামগতি। “যা বলেচ ভায়া। গোবিন্দরামের ছড়ি ওই হলো সায়েবের জন্যি একরকম, আমাদের মতো নিখাউন্তে লোকের জন্যি আরেকরকম।”
“গোবিন্দ মিত্তির কিচু কম সম্পত্তি করেনি মাত্তর ক’দিনে। সব তো সে শুষেচে আমাদের। ওই কোম্পানির মাল তো নেয়নিকো।” 
“তার খাজনা আদায়ের কৌশল বড় ভয়ানক। সাধে মুকুন্দরামের ছড়ি নিয়ে কতা কয় লোকে...” 
তাঁতি পাড়া আর পটুয়া পাড়া গত ক’দিন মিত্তিরের লেঠেলদের খাজনার তাগাদায় বড় নাজেহাল ছিল। সুযোগ পেয়ে তারা মুখ খোলে বেশি।  
“এরা মানুষই অমনধারা। ওপরওলাদের মন জুগিয়ে চলবে, আর নীচের তলায় জুতো ছড়ি চাবুক চালাবে।”
“সরকারি কাজের নিয়মই অমন। কারও চোখের চামড়া নেইকো।”
“শুনিচি সে সায়েবদের সুমুখে দাঁইড়্যে কয়েচে তাঁর মতোন মানী লোকের মান বজায় রাখার জন্যিই তারে নাকি টাকা আমদানি করার অন্য পথ নিতি হয়।” 
“হুঁঃ, সে পথ মানে তো তোমার আমার রক্ত চোষা।”
“কপাল বটে, চুষে সব ছিবড়ে করি দেলো, তবু প্যাট ভরে না সুমুন্দির ব্যাটাদের।” 
যোগীশ্বর গলা খাঁকারি দেন একবার। তাঁর সেই ইশারাতেই বাকিরা সতর্ক হয় এবার। একটি অচেনা যুবক যে এতক্ষণ পাশে বসে তাদের সব কথা গলাধঃকরণ করে চলেছে, সেটাও খেয়াল করে সকলে। গোবিন্দরাম সরকারি লোক, তাঁর প্রবল প্রতিপত্তি। হাওয়া বেয়ে সব কথা পৌঁছে যায় তাঁর কানে। এমনি এমনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কুঠির তখনকার গভর্নর জব চার্নক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে তাঁকে চাকরি দেননি। ফার্সী বাংলা সংস্কৃত ভাষা জানা মানুষটি কাজ চালানোর মতো ইংরেজি বলতে পারেন। হিতাহিত জ্ঞান দূরদর্শিতা আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জোরে উচ্চ পদাধিকারীদের সুনজরে পড়তে তাঁর একটুও সময় লাগেনি। গোবিন্দপুরে ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ তৈরির কিছু আগে সপরিবারে চলে এসেছেন সুতানুটির কুমোরটুলিতে। এসে ইস্তক এখানে এই শিবের মন্দির গড়ছেন। খাজনা আদায়ের বিবিধ উপায় তাঁর আয়ত্তে।  
যোগীশ্বর বলে ওঠেন, “সে যাই বলো, এই মন্দিরখানি জেগে থাকবে চিরকাল। যতদিন এই শহর থাকবে, মন্দিরখানিও থাকবে অটল। একদিন এই শহরটিকে দূরের জাহাজ থেকে দিব্যি দেখা যাবে ওই মন্দিরের চূড়োগুলির জন্য।” 
“এসব কিচ্ছু থাকবে না,” হঠাৎ এই উক্তিটিতে চমকে তাকায় সকলে। কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখে, সেই যুবক। লম্বা এক জোব্বা পরনে। ধুলোয় মলিন। মুখে দাড়ি, মাথায় রঙিন পাগড়িটি শতচ্ছিন্ন। 
দৃঢ়কণ্ঠে বলে, “সব মিশে যাবে ধুলোয়। কিছুই থাকবে না আর। না ওই মন্দিরের চুড়ো, না ওই মন্দির, না এই লালমুখো সায়েবের দল।”
সকলে নড়েচড়ে বসে। নতুন খোরাক পাওয়া গেল একটা। খানিক সময় কাটবে।
“বললেই হল থাকবে না? কে বটে তুমি?” যোগীশ্বর হেঁকে ওঠেন।
“আমি? আমি কেউ না। আমি, আমরা, এই তোমরা সব নিমিত্ত, সব জাল, সব জঞ্জাল। শেষ কথা কইবে মহাকাল।”  
“অ। তা বাপু মহাকালের সমস্ত খবর কি তোমার নাগালে পৌঁছচ্ছে আজকাল? কে তুমি? গণৎকার না জ্যোতিষী?”
“ওই যে বললুম, আমি কেউ নই, এই তোমরাও কেউ নও। এই ঘাট, এই শহর... সব বদলে যাবে, কত কী মুছে যাবে। আগে ভাঙবে ওই মন্দিরের চুড়ো। তার আর বেশি বাকি নেই গো।”  
“আরে, এ ব্যাটার সাহস তো কম নয়! আস্পদ্দা দেখো। সবেমাত্র মন্দির তৈরি হল, এর মধ্যেই চুড়ো ভেঙে মিশিয়ে দিচ্ছে! আরে গোবিন্দ মিত্তিরের কানে গেলে কী হবে বলতে পারিস? জ্যান্ত পুঁতে দেবে ওই মন্দিরের মধ্যে।” যোগীশ্বর হাঁ হাঁ করে ওঠেন। বিচক্ষণ প্রবীণের ভয় ধরে, এই আড্ডায় তাঁর একাধিপত্য সম্পর্কে গোবিন্দ মিত্তির যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, তাঁর সম্পর্কে তির্যক আলোচনা তিনি ভালোভাবে নেবেন না। এখানে আর কেউ না জানুক, তিনি নিজে জানেন সস্তায় একখণ্ড বাসযোগ্য জমি তাঁকে গোবিন্দরাম নিজে পাইয়ে দিয়েছেন।  
“কে কাকে পুঁতে দেবে, সে তো তার নিয়তি খুড়ো। ছয়দিনের দিন বিধাতাপুরুষ কপালে যা লিখে দিয়েছেন, সে লেখা খণ্ডাবে কে? তুমি আমি আমরা সবাই একদিন টুপ করে তলিয়ে যাব ওই নিয়তির ঘূর্ণিতে, কেউ আগে, কেউ পরে” যুবকটি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকায়, “ভালো করে দেখো সকলে, ওই যে পশ্চিম আকাশে... দেখো দেখো... একটা বিরাট ঘন কালো ছায়া...”   
যুবকটির কথা শেষ হবার আগেই রামগতি বলে ওঠে, “আরে ও তো সন্ধে ঘনিয়ে আসার লক্ষণ, এ আর নতুন কী! রোজই তো দেকচি।” 
“রোজ যা দেখো তোমরা, তার আড়ালেও একটা ভীষণ সত্যি লুকিয়ে হাসচে গো মশাইরা, সে সত্যি তোমরা কেউ ঠাহর করতে পারনি, পারবেও না। শুদু চেয়ে থাকো, খুব শিগগির সব তোলপাড় হয়ে যাবে, সব।” 
“হেই এট্টু ঝেড়ে কও দিনি, কী এমন তোলপাড় হবে শুনি? ওই অত আখাম্বা উঁচু দেবতার মন্দিরের চুড়ো নিয়ে কী সব অসৈরণ কতা কইচ’, বলি হুঁশ আচে তোমার?” 
“হুঁশ? হ্যাঁ, তা কিছু আছে আজ্ঞে। মানও আচে, হুঁশও রেখে দিছি। এই লুটেরাদের দেখি আর ভাবি, এমনধারা লুঠপাট করে চলবে তো? তাদের জেবন, তাদের পরে তাদের ছেলেপুলে বালবাচ্চার জেবন... আগামী এই বিরাট পিত্থিমি আর জগতজোড়া এমনধারা নিয়মবাগেই চলবে তো? যদি চলে, তবে বুঝব প্রকৃতির ভাঙাগড়ার চক্করটা শুধু কথার কথা। তার মধ্যে সার নাই কিছু। সব মিছে, সব ফক্কিকারি...” 
কেমন নিস্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ। যুবকের গলার স্বরে কী যেন এক গম্ভীর সুর, অত অল্প নিচু স্বরে কথা কইছে সে, কিন্তু মনে হয় যেন কোন মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে আসে তার কণ্ঠস্বর। 
“সব ভেঙে যাবে? এই মন্দির? তা’ ক্যামনে হবে? তুমি কি সব দ্যাখতে প্যালে নাকি?” জেলেপাড়ার পঞ্চা এগিয়ে আসে, তার চোখেমুখে ভয় আর বিস্ময়।  
“কত কী দেখছি গো, এই যেমন এই জাহাজ বোট বজরা পানসি ডিঙি... সব খোলার মতো ডুবে যাচ্ছে ওই গঙ্গায়, ডিঙি উলটে পড়ে আছে পথেঘাটে, গঙ্গার জল ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাসিয়ে নে’ যাচ্ছে সমস্ত শহর... এক রাত্তিরে ওই দিশিপাড়ার মাটির বাড়ি আর একটিও আস্ত দাঁড়িয়ে রইল না, সায়েবদের পাকাবাড়ি শুয়ে পড়েছে মাটিতে, যেগুনো খাড়া তার কারও নেই জানলা, কোনওটার নেই দরজা। শুধু ঝড় আর ঝড়। আকাশভাঙা বিষ্টি, পাথরকাঁপানো বাজের ডাক। সে কী হাওয়ার তাণ্ডব। যেন এক হাঁ-করা রাক্ষস এসে তোলপাড় করে দিচ্ছে চারদিক...”
“ঝড়?”  
“হ্যাঁ। যে সে ঝড় নয় গো, প্রলয়ঙ্কর হাওয়ার মাতন। সে মাতন আসে একবার। শতেক বছরে একবার। আর সেই মাতনে সব ভেঙেচুরে পড়ে যায়। ওই দেখো,” বলে আঙুল নির্দেশ করে সেই যুবক, শান্ত মাঝনদীতে পালতোলা নৌকাটি দেখিয়ে সে বলতে থাকে, “ওই দেখো ভেসে যাচ্ছে গরু বাছুর ছাগল ভেড়া। সব মড়া। গাছপালা উপড়ে পড়েছে চারদিকে। বনের বাঘ, বুনো শুয়োর এদিকসেদিক মরে পড়ে আছে। কাক ভেসে যাচ্ছে গঙ্গায়, ওই দেখো শকুনের উল্লাস, শকুনের লাশের ওপরেই ভিড় করেছে আরও ক’টি জীবিত শকুন। বেঁচে থাকতে হবে যে! জাহাজের খোলে সরসর করে গিয়ে ঢুকল এক মানুষখেকো কুমির। দেখো তাকিয়ে... সকালের আলো ফুটচে যেই, একটা করে লোক মাল তুলতে নামছে ওই জাহাজের খোলের মধ্যে, আর বিশাল লম্বা কুমিরটা একের পর এক গিলে খাচ্ছে মানুষ... একজন দুজন তিনজন... আঃ! দেখতে পাচ্ছ তোমরা? দেখতে পাচ্ছ?” আর্তনাদের মতো শোনায় তার গলা।    
যোগীশ্বর বাকিদের চোখের ইশারা করেন, মাথায় বায়ু চড়েছে নির্ঘাত। এ ছোঁড়ার চিকিৎসা দরকার। 
জেলেপাড়ার পঞ্চা যুগীখুড়োর ইশারায় ভ্রুক্ষেপ করে না। সে এগিয়ে আসে, “বলি হ্যাঁ গো ভালমানুষের পো, কও দিকি এই মন্দিরটার দশাও কী অমনি হবে?”
যুবকটি মৃদু হাসে। 
“পাপের ভারা যখন পূর্ণ হয়, তখন আর কেউ টেঁকে না। কিচ্ছু থাকে না। ওই মন্দিরে অনেক দম্ভ পুরেছে গোবিন্দ মিত্তির, মন্দিরের চুড়ো ভাঙবে আগে। তারপর... তারপর এক আমবাগানের মধ্যে একটা বেলায় লুঠ হয়ে যাবে সবকিছু... তার আর বেশি দেরি নেই।”     
যোগীশ্বর দাবড়ে ওঠেন, “থামো তো হে। পাপ আর পাপ। বলি এই ঘোর কলিযুগে পুণ্যির বিচার হল না, পাপের বিচার করতে এয়েছেন।” 
যুবকটি আর কথা বলে না। দুই নজরদার পরস্পরের দিকে তাকায়। মোগলদের নয়, সুলতানেরও নয়, একে তো আদৌ গুপ্তচর বলেই মনে হচ্ছে না। এমনকি ইংরেজ সিপাইদের লোক হবার সম্ভাবনাও নেই। বরং যুগীখুড়োর অনুমানই সঠিক, এমন লোককে বায়ুগ্রস্ত বলেই মনে হয়।  
যোগীশ্বর হেঁকে ওঠেন, “কোম্পানির সায়েবরা ব্যবসা করতে এসেছে, সে কথা ঠিক, কিন্তু শহরটাকে গড়েপিটে সাজিয়ে নিচ্ছে দেখছ না? বেনিয়ারা গুছিয়ে নিয়ে বসেছে। তোমার ওই কোন ঝড়ে না কীসে তারা কি উড়ে পালাবে এই দেশ ছেড়ে? অতই সহজ? বাংলার নবাব কী দিল্লির বাদশা তাদের তাড়ালে অবিশ্যি আলাদা কথা।”  
যুবকটি উত্তর দেয় না। মৃদু হাসে। গঙ্গার ঘোলা জলে ডুবন্ত সূর্যের রাঙা আলো দেখতে দেখতে উঠে দাঁড়ায়। হাতে ঝাঁকা। আনমনে বলে, “কে কাকে তাড়ায়, নিজেরাই মিলিয়ে নিও কত্তা।”
কে যেন জিগ্যেস করে, “ওই ঝাঁকা করে কী বেচতে এনেচ শুনি?”
ফিরে তাকায় যুবক। তার হাতের ঝাঁকার গামছা সরিয়ে টান মেরে খুলে দেখায়, ক’টি কড়ি রয়েছে সেখানে। 
“বেচতে আসিনি গো, গুনতে এসিচি। দিন গুনচি। এক এক করে দিন গুনি। নবাবের দিন শেষ হবে, লালমুখোদের দিন ফুরোবে, ভাই ভাইয়ের বুকে ছুরি বসাবে... অনেক রক্ত বয়ে যাবে গঙ্গা দিয়ে। কেবল ওঠাপড়া দেখি আর গুনি।” 
“তুমি অ্যাতো কতা কইছ ক্যামনে? তুমি কি পীর না পয়গম্বর?”
“আমি? আমি দর্শক। আমি দেখতে পাই। অনেক দূর থেকে দেখতে পাই। আর যেদিন থেকে দেখতে পাচ্ছি, সেদিন থেকে ডেকে ডেকে বলছি সকলকে, ওগো সাবধান হও গো, সাবধান হও... বড় পাপ, বড় পাপ...”
যোগীশ্বর তাড়া দেন, “এই এবার ঘরের দিকে চলো সকলে। আর নয়। বেলা পড়ে গেছে অনেকক্ষণ। আন্ধারে ঠাহর করে চলতে হয়, কোন জন্তু কোন দিকে ওঁত পেতে বসে আছে...” 
যুবকটি রওনা দেয় সম্পূর্ণ উলটো দিকে। যে দিক নেমে গিয়েছে ঘাট পেরিয়ে নদীর জলে, সেই দিকে। 
হঠাৎ কে একজন হেঁকে বলে, “আরে ওই মানুষটার রকম দ্যাকো, সিধে পায়ে হেঁটে নামচে গে’ জলের মদ্যিখানে।”   
সকলে বিস্ফারিত চোখে দেখে যুবকটি নামছে নদীতে। উদাসীন পায়ে হেঁটে সে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে নদীর জলের মধ্যে। সন্ধ্যার অন্ধকারে হুগলী নদীর জল ঘোলাটে থেকে কালচে। দুই নজরদার তাকায় এ ওর মুখের দিকে। সে চোখে শুধু বিস্ময়। কোথাও আবার সামান্য স্বস্তি। গুপ্তচর পাহারা দেওয়ার গুরুদায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া গেল। যোগীশ্বর শিউরে ওঠেন একবার। চারপাশে গুঞ্জন। সকলকে হাঁক দেন, “এই চলো দিকি এবার ঘরের পানে, এইসব পাগলের কথা কানে নিলেই গোল বাধবে...।” বলেন বটে, কিন্তু নিমেষের মধ্যে মনস্থির করেন কলকাতার বাসস্থান ছেড়ে সপরিবারে আবার মুর্শিদাবাদে ফিরে যাবেন। এখানে যা আছে থাক। মাঝেমধ্যে এসে রক্ষণাবেক্ষণ করলেই চলবে। যদি সত্যিই অমন এক প্রলয়ঙ্কর ঝড় আসে, যদি সত্যিই ভেঙে পড়ে নবরত্ন মন্দিরের আকাশছোঁয়া চূড়া, যদি সত্যিই তাণ্ডবলীলায় ছারখার হয়ে যায় শহর... তার চেয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে একবার প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করাই সমীচীন।    
লোকটার চোখের মধ্যে কী যেন এক আলো জ্বলছিল, একেবারে পাগল বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। কে না জানে, সাবধানের মার নেই। যোগীশ্বর ঘরের পথে রওনা হন। তাঁর ভুরুজোড়া কী এক অজানা আশঙ্কায় কুঁচকে রয়েছে।   
বেশিদিন লাগেনি, মাত্র বছর পাঁচেকের মধ্যেই যোগীশ্বর মুর্শিদাবাদে বসে সংবাদ পেয়েছিলেন কলকাতার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর তাণ্ডবলীলার। সেই প্রবল ঝড়ে নবরত্ন মন্দিরের চূড়ো ভেঙে পড়ার খবরে তিনি আরও বিচলিত হন। সেদিন নদীর উত্তাল ঢেউ, তুমুল হাওয়া, প্রচণ্ড বৃষ্টি আর মারাত্মক বজ্রপাত চলেছিল রাতভর। প্রকৃতির তাণ্ডবে তোলপাড় হয়ে যায় সদ্য গড়ে ওঠা শহর। যোগীশ্বরের কানে আসে, ভেঙে পড়েছে ইংরেজদের বানানো গির্জার মাথা। মন্দির আর গির্জার চূড়া ভেঙে পড়া সুতানুটিতে মৃত্যু হয় হাজার হাজার মানুষের। সেই সময় জনগণনার ব্যবস্থা ছিল না, কাজেই মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারেনি আজ অবধি। কিন্তু সেই অজানা মানুষটির ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী কোন আমবাগানে কে কার ওপর কীভাবে হানা দিয়েছিল, সেই দুঃসংবাদ পাবার আগেই পরলোকগমন করেন যোগীশ্বর। 
বাংলার নবাবই হোক বা লালমুখো সাহেব, এই বাংলাদেশে এদের কারও পরিণতি আর জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি যোগীশ্বর।                   	
	        	
.............................................................................................................................................
তথ্যসূত্রঃ
•	পলাশীর যুদ্ধ – তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়
•	কলিকাতার ইতিবৃত্ত – প্রাণকৃষ্ণ দত্ত
•	ক্যালকাটা থেকে কলকাতা – গৌতম বসুমল্লিক 
•	কলকাতা – শ্রীপান্থ 
•	এক যে ছিল কলকাতা— পূর্ণেন্দু পত্রী
•	কলিকাতা শহরের ইতিবৃত্ত – বিনয় ঘোষ   

বৈশাখী ২০২৪