এ দিন আজি

টেনেসি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র


মাথার মধ্যে অনেক নাম গিজগিজ করছে আহুতির, কিন্তু কোনোটাই পরিষ্কার করে ধরা দিচ্ছে না।
 কে যেন বলেছিল ব্রেনের হার্ডড্রাইভে বেশি তথ্য ভরেছো কী পুরনো তথ্যগুলো ধামাচাপা পড়ে ভোকাট্টা হয়ে যাবে। একে মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেটর ঠেলায় নার্ভের তারে ঝনঝন করে সরোদের ঝালা, তায় নেই নেই করে বছর পঁচিশ পশ্চিমে থাকা! কী করে আর খুদু বনিকের নামটা মনে পড়বে?
 বাহ্, এইতো দিব্যি মনে পড়ে গেল! খুদু বনিক। এক ক্লাসে পড়া, গায়ে খড়ি ওঠা, মুখে বসন্তের দাগ ছেলেটা। আহা, বড় করে প্যাকেট বানিয়ে দিত বাবার সঙ্গে হালখাতা করতে গেলে। গোলাপী আর সবুজ দুটো চিনির ডেলা মিষ্টি আর সঙ্গে ঠান্ডা জল হয়ে যাওয়া, মামার দোকানের দুটো সিঙ্গারা আর গুটকে কচুরি। উফফ্, কী যে অমৃত লাগত তখন! সঙ্গে একটা জয়কালী ভান্ডারের ক্যালেন্ডার আর মেরুনরঙা ভেলভেটের ডায়েরি। ওটা অবশ্য মায়ের বাজারের ফর্দ লেখার জন্যে ব্যবহার হত। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে কালো রিক্সাঅলার পানের ঠেক আর তার পাঁচ হাত দূরে বাংলাদেশের গামছার দোকান ছিল খুদুর। ওর বাবাই চালাত, কিন্তু ভ্যানে করে মাল নিয়ে রেললাইন পেরোতে গিয়ে  সাতান্নতেই স্বর্গদ্বার দেখলেন বনিকজেঠু। গরীব, একদম দেহাতি গরীব। আহুতিদের কোয়ার্টারের পাশে বাতাপি লেবু গাছের গা ঘেঁষে বনিকজেঠুদের মাটির দালান। ঝকঝকে নিকোনো। খুদু, বুলি, বাদলদা, সবাই ঠোঁঙা বানাত তখন আর সাইকেলে চেপে কোনো এক ভাই দোকানে দোকানে বিককিরি করে বেড়াত। একটু বড় হবার পরে যখন আহুতি বুঝতে শিখল বুলির নতুন ফ্রিল দেওয়া জামা হয় না পয়লা বোশেখের দিন, পায়েসের স্বাদটা সেদিন থেকে কেমন যেন ফ্যাকফ্যাকে হয়ে গেল। মা কে বলে কয়ে একটা টেপ ফ্রক বুলির আর একটা নতুন সাদা গেন্জি খুদুর বরাদ্দ হল বছরের প্রথম দিনটায়। সে যে কি খুশী ওদের চোখে, তাই মনে হয় একটা গোলাপী মিষ্টি বেশী দিত ওদের প্যাকেটটাতে! হবে বা! 
আজ আর হালখাতাও হয়না, নতুন জামাও হয় না সাগর পাড়ে বসে। বাবা চলে গেলেন কোভিডের মাঝে না বলে কয়ে। আসলে মাস্ক পরে বোর হয়ে গিয়ে “ধুত্তোর নিকুচি করেছে” বলে সেই যে বাথরুমে সটান পড়ে গেলেন আর উঠলেন না। মারও একলা থাকা অভ্যেস হয়ে গেল। আহুতিরই কিছু অভ্যেস হয় না। নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিটার মত ঝিম ধরে বসে থাকে। এখন শুধু লাভ-ক্ষতির অংক না মেলাতে পারলে বস্ কোম্পানির সেভিংসের হিসেব চাইবে - সেই হিসেব নিকেষের দিকে মন দেওয়া। বর, বাচ্ছা সব তো বিদেশি, কেউ তো ভালোবেসে নলেন গুড়ের পায়েস বা বিউলির ডাল- পোস্ত খায়না, তাই নিজের ভালোলাগারও সদর্পে বিসর্জন! 
এখানে শুভ নববর্ষ হয়, বারে গিয়ে উত্তাল “ওল্ড ফ্যাশন” বারবন হুইস্কি আর সঙ্গে চিকেন টিক্কা মশালাও যেমন চলে, তেমন চলে “বৈশাখ হে মৌনিতাপস” কবিতা বলা । নতুন প্রজন্মরা আধো আধো বাংলায় মিষ্টি করে নেচে ওঠে, মা মাসীদের গাওয়া “এসো হে বৈশাখ” গানে! আহুতি, নতুন জেনারেশনটাকে চোখ মেলে দেখে বারান্দায় বসে। ভাবে, এতেই কত আনন্দ তবু কত কিছুই অজানা রয়ে গেল ওদের! ভালোবেসে বিটনুন দেওয়া ডাঁসা পেয়ারা বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে খাওয়া, কুলের আচার চুরি, চোখ বেঁধে রুমালচোর খেলা, কত কিছু। ওদের ও কি ভালো লাগত এসবের সঙ্গে পরিচিতি হলে? মনে হয় তার, মানুষ কী করে এত মেটিরিয়ালিস্টিক হয়ে গেল? সবার চোখের রঙিন চশমায় বুগাটি আর ল্যাম্বোরগিনির প্রতিফলন, কিন্তু কেউ আর এগিয়ে আসে না পুজোর প্রসাদ নিয়ে প্রতিবেশীর বাড়ি! তবে কি আহুতিই পিছিয়ে থেকে গেল? প্রতি হপ্তায় পয়লা বোশেখের জামা আসছে ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন থেকে, নতুনের গন্ধ তাই ফিকে হয়ে গেছে আজ! বাংলা সন এর সূচনা সেই সম্রাট আকবরের আমল থেকে, সে ইতিহাস ধুয়ে মুছে এখন শুধু বাহ্যিক চাকচিক্যের দিন। নতুন খাতায় সিঁদুর, আলতা দিয়ে বছর শুরু করার যে আনন্দ ব্যবসায়ীদের, চাষীদের সে কথা কি জানে নতুন জেনারেশন z রা? 
আমাদেরই তো দোষ, আমাদেরই তো সময় হয় না ওদের পাশে বসে এসব সত্যি কথা শেখানোর! ওরা তো স্পঞ্জের মত, যা শেখাবে তাই অবাক চোখে আহরণ করবে! চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে আহুতির এসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে, কখন যে গিনি পাশে এসে দাঁডিয়েছে খেয়াল করেনি সে। “What’s wrong with you mom? Why are you crying? Is Dimma ok?” স্বপ্নমেদুর সন্ধ্যের অগোছালো ভাবনায় রাশ টেনে ফিরে আসে বাস্তবের কোলে। “Everything is peachy beta, just been nostalgic a bit! Sign of getting old… isn’t it?” গিনি গলা জডিয়ে অভিমান করে বলে, “you will never be old to me and bhai (ভাই), you will always be our energetic, loving mom!” আহুতি ভাবে, ‘এই তো, এই তো অনুভুতিগুলো গেঁথে দিতে পেরেছে জেনারেশন z র মধ্যে”, সেটাই বা কি কম পাওয়া!’
 বলে ওঠে, 
“বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও
ক্ষমা কোরো আজিকার মত
পুরাতন বরষের সঙ্গে, পুরাতন অপরাধ যত!”

গিনি নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকে অপরাহ্নস্নাত মা র মুখের দিকে। একলা লাগে বড় মার চাহনিটুকু আজ!

ক্রিং ক্রিং, ক্রিং ক্রিং
ধ্যাৎ, দিল তো ঘুমটার সাড়ে তেরো বাজিয়ে। একদিন রবিবারের সকালে একটু বেশিক্ষণ ঘুমোবে তার উপায় আছে? সুইস বস ফোন করেছে নির্ঘাত, একটা দিন যদি নিজের মতো থাকতে দেয়! ইসস, সবে সাড়ে ছ’টা বাজল, এখন কেউ ফোন করে? আহুতি রবিবারে এত সকালে কোনো ভাষাই ঠিক করে বলতে পারে না। না পারে বাংলা, হিন্দি, স্প্যানিশ, জার্মান তো দূরস্ত! নির্বাক কি কোনো ভাষা হয়? হলে ওই ভাষাটাতেই রবিবারের সকালে, স্বচ্ছন্দ থাকে আহুতি। যাক্ গে, সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে, মনের কপাট খুলে ফোনটা ধরব বলে হাত বাড়াতেই , চার্জার সুদ্ধ নাইটস্ট্যান্ড থেকে ফোনের অধঃপতন। উফফ্, কে রে বাবা! কেটে যাবার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই আবার বৈদ্যুতিন কর্কশ আওয়াজ। মাটি থেকে ফোনটা কুড়িয়েই দেখে আয়ানের ছবি। 
“ওমা, কী রে, এত সকালে তুই? Is everything ok, বেটা?”
আয়ান, “Good morning Ma! Can you please open the door?” 
মানে? গিনি তো কিছুই বললোনা কালকে আয়ানের আসার কথা! ছেলে মা কে সারপ্রাইজ দেবে বলে রেড আই ফ্লাইটে সান হোসে থেকে সোজা বাড়ি! “Enough of sleeping mom, today is পয়লা বইশাক (বৈশাখ তো বেরোয় না অনভ্যাসের দৌরাত্মে), Gini and I planned to spend time with you only!”
“দুগ্গা বাড়ি যাবে না মা?” গিনি চা নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায়। 
আয়ান বলে, “ওe still can sing “এসো হে বইশাক, এসো এসো!” একসাতে গাইব চলো!” 
 আহুতি ভাবে জীবন তাকে দুহাত উপুড় করে দিয়েছে। এত বছর বাদেও ছেলেমেয়ে নিজের কাজকম্মো ছেড়ে, বাংলা নতুন বছরে, মার মন ভোলাতে এসেছে? আর তো কিছু চাওয়া নেই। নাইবা হল সবুজ মিষ্টি খাওয়া, দু দুটো সবুজ প্রাণ তো তাকে আগলে রেখেছে! 

সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায় 
যে জন না বুঝে, তারে ধিক্, শত ধিক্

সকালের আবিরলাগা আলো যেন গায়ে ছুঁয়ে দেয় নববর্ষের রেশ প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে। সারাদিন হইহই করে কেটে যায় আহুতির ছেলে মেয়ে গানবাজনা নিয়ে। মনে হয়, আচ্ছা, বুলির ছেলেমেয়ে কি মাকে চা করে দেয় পয়লা বোশেখের দিনে? খুদু বনিকের জয়কালী ভান্ডারটা এখনো চলে? এই মেগা ওয়েব শপিং র ঢেউ এ লাল গামছা দোকানের হালখাতা বোধহয় আর হয় না। ভাবে এর পরের বার দেশে গিয়ে, আয়ানকে নিয়ে, একটা ভালো লাল তোয়ালে আর সুগার অ্যান্ড স্পাইসের চকোলেট স্ট্রবেরি কেক দিয়ে আসবে খুদুর দোকানে। এভাবেই চলুক না পয়লা বোশেখের পরম্পরা জন্মান্তর ধরে।

বৈশাখী ২০২৪