কাঁথার ফোঁড়ে জীবনগাথা

"নকশী কাঁথার মাঠ"- পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের এই কাব্যগাথায় নায়িকা সাজু তার প্রেমময় দাম্পত্যের কাহিনি সুতোর ফোঁড়ে বুনেছিল একটি কাঁথায়। তারপর সেটা বিছিয়ে দিয়েছিল তার স্বামী রুপাইয়ের কবরের ওপরে। রুপাই তাকে বলে গিয়েছিল,
"এই কাঁথাখানি বিছাইয়া দিও মোর কবরের পরে,
ভোরের শিশির কাঁদিয়া কাঁদিয়া এরই বুকে যাবে ঝরে।"
'কাঁথা', বাংলায় লোকায়ত শিল্প। কাঁথা শব্দটির কোন উৎস স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। পিছনের ইতিহাস থেকে ধারণা করা হয়, সংস্কৃত শব্দ কন্থা ও প্রাকৃত শব্দ কথথা থেকে কাঁথা শব্দের উৎপত্তি।
নিয়াজ জামানের মতে, কাঁথা শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃতি শব্দ "কঁথা" হতে যার বাংলা হল ত্যানা বা কাপড়ের টুকরা। রংপুর অঞ্চলে কাঁথাকে ‘দাগলা’, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর অঞ্চলে ‘গুদুরি’ বলা হয়। সূচিকর্মে অলঙ্কৃত কাঁথাকে বলা হয় নকশি কাঁথা। অনেক জায়গায় নকশি কাঁথাকে সাজের কাঁথা বা নকশি খেতাও বলা হয়ে থাকে।

  প্রধানত পুরানো কাপড় স্তরে স্তরে সজ্জিত করে পুরানো কাপড়ের সুতো দিয়েই সেলাই করে কাঁথা তৈরি করা হত। কারণ পুরান কাপড়ের উপর নতুন সুতায় কাজ করতে গেলে পুরানো কাপড়ের জমি কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকত। মহিলারা তাঁদের পুরানো শাড়ি থেকে কাপড়ের পাড় আলাদা করে নিয়ে বিভিন্ন রঙের সুতো তুলে রাখতেন। পাড় থেকে সুতো উঠানোর পদ্ধতি ছিল ঘরোয়া। পাড়টির এক দিকে এক পায়ের দু'আঙ্গুলে চেপে ধরে বাঁ হাতে টেনে নিয়ে পাড়ের ছেঁড়ার দিক থেকে সুতো টেনে ডান হাতের চার আঙ্গুলের মধ্যে রিং মত গোল করে গুটিয়ে নিয়ে পরপর সুন্দরভাবে বাঁশের অথবা কাঠের চালায় সাজিয়ে নিতেন। 

   কাঁথার সুতো তোলা, কাঁথা বোনা খুব কম ক্ষেত্রেই একক শিল্প হয়ে উঠত। বরং এতে একে অন্যকে সাহায্য করত মেয়ে বৌরা। আমরা কল্পনা করতে পারি কমলা রোদ পিঠে মেখে প্রাচীন বাংলার মেয়ে বৌরা গেরস্থালির গল্প করছে, আর তাম্বুল রঞ্জিত ঠোঁট সরু করে সূঁচে সুতো ভরে উঠোন জুড়ে পাতা কাঁথায় গল্প বুনছে।

   এমব্রয়ডারি বা সুতোর কাজ সারা পৃথিবীর সব জাতির মধ্যে প্রচলিত থাকলেও কাঁথা  কোথাও তার মধ্যে স্বতন্ত্র। নিতান্ত অবহেলার সামগ্রী যে পুরোনো ছেঁড়া ন্যাকড়া, সেগুলোর পুনর্ব্যবহার হয় কাঁথায়। প্রথম দফার সেলাইতে কাপড়গুলোকে আড়াআড়ি রেখে খোপ করে সেলাই করে জুড়ে নেওয়া হত। তারপর কাঁথার জমি সেলাইয়ের গুণে জমাট হয়ে উঠত। এই সেলাই দোরোখা, অর্থাৎ সামনে ও পেছনে দুদিকেই নকশা ফুটে উঠত। বাংলা দেশের সর্বত্রই কাঁথা বোনার চল ছিল। তবে পূর্ব বাংলার ঢাকা, ফরিদপুর, যশোহর, খুলনার কাঁথা বেশি জনপ্রিয় ছিল। উপকরণের নগণ্যতাকে ঢেকে দিত নিপুণ বর্ণময় সূক্ষ্ম সুতোর কাজ। ব্যবহারের ভিন্নতায় কাঁথা বিভিন্ন মাপের হত ও তাদের বিভিন্ন ধরণ প্রচলিত ছিল।

সুজনি কাঁথা: অতিথিদের বসা বা শোওয়ার জন্য বিছানায় বিছিয়ে দেওয়া হয়। এই কাঁথার দৈর্ঘ্য প্রায় ছয় ফুট এবং প্রস্থ  প্রায় সাড়ে তিন ফুট হয়। এই কাঁথা আকারে বড় বলে এর কেন্দ্রবিন্দুতে পদ্মের মটিফ যেমন থাকে, তেমন পাড়ের ডিজাইন, কলকা, নানান লতা-পাতার ডিজাইনের বাহারও দেখা যায়। ঝিকরগাছায় এই কাঁথার নাম "নাছ্নি কাঁথা।"

লেপ কাঁথা: শীতের সময় গায়ে দেয়ার জন্য বেশ মোটা ধরনের কাঁথা। মাপেও এটি সুজনি কাঁথার চেয়ে লম্বা ও চওড়ায় কিছুটা বড়। এতেও নানা ধরনের নকশা তোলা হয়, তবে সুজনির তুলনায় কম। এতে মোটামুটি সাত পরত কাপড় ব্যবহার করা হত।

ওয়াড় কাঁথা: বালিশের ঢাকনা হিসাবে ব্যবহার করা হত এই ধরনের কাঁথা। এই কাঁথার সাধারণ মাপ হল লম্বায় প্রায় দু-ফুট আর চওড়ায় প্রায় দেড় ফুট। এর দু-পাশে নানান লতা-পাতার ডিজাইন কিংবা কোনো কলকার ডিজাইন বা অন্য কোনো ডিজাইন দেওয়া হয়। আবার লেপের ঢাকনা হিসেবেও এই কাঁথার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তবে সে ক্ষেত্রে লেপের ওয়াড় কাঁথা মাপে অনেক বড় হয়। এই কাঁথাকে আবার ব্যটন কাঁথাও বলা হয়।

আর্শিলতা: আর্শি, চিরুনি ও প্রসাধনসামগ্রী রাখার জন্য এই ধরনের কাঁথা ব্যবহার করা হয়। এই কাঁথা তৈরি হয় ২৪ ইঞ্চি সরু টুকরো কাপড় দিয়ে, আবার কোথাও এই কাঁথা লম্বায় এক ফুট ও চওড়ায় আধ ফুট মাপেরও হয়। এতে চাকফুল, ময়ূর, কদমগাছ, কৃষ্ণলীলা, চাঁদ-তারা ইত্যাদি মটিফের প্রাধান্য বেশি দেখা গেলেও এর মধ্যিখানে পদ্ম, কলকা বা বিভিন্ন ধরনের লতার নকশাও দেখা যায়। সরু সূঁচে সূক্ষ্ম কাজ করা হত এই বস্ত্রখণ্ডে।

শিশুর কাঁথা: শিশুদের শোওয়া ও গায়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় এই কাঁথা। এই কাঁথা আকারে ছোট, অনেকটা তোয়ালের মত। একে আবার "মুতনি" কাঁথাও বলা হয়। মাপের দিক থেকে এটি লম্বায় এবং চওড়ায় তিন ফুটের হয়। এতে ঘন নকশা খুব বেশি ঘন থাকত না, শিশুর কোমল ত্বকে ঘষা লাগবে বলে। নরম শাড়ি ব্যবহৃত হত মূলত।
বর্তন ঢাকনি: খাবারের ঢাকনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অতিথিদের খাবারের থালার উপর ঢাকনি স্বরূপও এই ধরনের কাঁথার ব্যবহার দেখা যায়। কোনো কোনো অঞ্চলে একে আবার "বেষ্টনী" বা "গাত্রী" কাঁথাও বলে।

বগলি বা নকশি থলি: এই ধরনের কাঁথার ব্যবহার হয় বিভিন্ন ধরনের থলি হিসাবে। এটি লম্বায় দশ ইঞ্চি এবং চওড়ায় ছয় ইঞ্চি মাপের হয়। এই ধরনের থলিতে সাধারণত টাকা-পয়সা, পান-সুপারি, জপের বা তসবির মালা রাখা হয়। একে বৈরাগীর ঝোলা বা জপের থলেও বলা হয়। এটি আকারে খামের মত বা অনেকটা ছোট বটুয়ার মত দেখতে হয়। বাংলাদেশে এর নাম "খিচা "এবং পশ্চিমবঙ্গে এটি "দুর্জনী" নামে পরিচিত।

জোত্ বা বোচকা কাঁথা: জিনিসপত্র বাঁধার জন্য এই ধরনের কাঁথার ব্যবহার করা হয়। এই কাঁথায় নানান মটিফ দিয়ে ডিজাইন তোলা হয়। এই কাঁথার আকার চৌকো। কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য টুকিটাকি জিনিসপত্র যাতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে ও বাঁধতে সুবিধা হয়। এই জন্য কাঁথা গুলি চৌকো আকৃতির হয়।

রুমাল কাঁথা: এই ধরনের কাঁথা চৌকো মাপের হয় অর্থাৎ এটি লম্বা ও চওড়ায় এক ফুট মাপের হয়। ছোট চারকোনা টুকরো কাপড় দিয়ে তৈরি হয় এই কাঁথা। এটি রুমাল হিসাবে ব্যবহার হলেও ডিশ ঢাকার জন্যও ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের কাঁথায় প্রজাপতি, পদ্ম, কলকা, ফুল, লতা-পাতা, পাখি ইত্যাদি মটিফ লক্ষ করা যায়।

গিলাফ: কোরান শরীফের ঢাকনা হিসাবে ব্যবহার করা হয়। চৌকো নকশি কাঁথাকে বরফির মত রেখে তিন দিক একত্রিত করে সেলাই করা হয় এবং এক দিক খোলা রাখা হয়।

জায়নামাজ: এইটি প্রার্থনা করার জন্য অর্থাৎ নামাজ পড়বার সময় ব্যবহার করা হয়। আকারে এইটি লম্বা ধরনের হয়। এতে ফুল, লতা-পাতা, গম্বুজ ও মিনারের মটিফ দেখা যায়।

আসন কাঁথা: পুজোর কাজে এই ধরনের কাঁথা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এটি বর-কনে বা অতিথিদের বসার জন্যও ব্যবহার করা হয়। এই কাঁথার আকার চৌকো বা আয়তক্ষেত্র উভয়ই হতে পারে। পালকিতে বসার জন্যও এটি পেতে দেওয়া হয়।  এতে রাধা-কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, রথ ইত্যাদি মটিফ লক্ষ করা যেত। 

নকশি চাদর: গায়ে দেওয়ার জন্য শাল বা চাদর হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এতে নানা ধরনের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। বিশেষত কলকা মটিফ এতে লক্ষ করা যায়। তবে দু-পাশের বর্ডার পাড়ের ডিজাইন এবং কোন কলকা বা মধ্যিখানে বুটির মত ফুল বা লতা-পাতার ডিজাইন লক্ষ করা যায়

এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কাঁথা লক্ষ করা যায়। যেমন - পাইড় কাঁথা, লাহরী কাঁথা, লীফ কাঁথা, গোলাপ বা ঢাকনি কাঁথা, পর্দা কাঁথা, সারিন্দা বা আবরণী কাঁথা প্রভৃতি।
দেহ আবরণ করার কাঁথা দৈর্ঘ্যে চার পাঁচ হাত হত। প্রস্থে তিন চার হাত। 

 আয়তনের তারতম্যের জন্য নকশার বিন্যাসেও আলাদা হত। মাঝারি ও বড় ধরণের কাঁথাগুলোর অলঙ্কারের কেন্দ্রে অনেক সময়ে থাকত একটা বড় পদ্ম। পদ্মের চারদিকে অনেকগুলো পাপড়ি, শতদল বা সহস্রদল পদ্মের মত। তাকে ঘিরে না না রকমের ফুল পাতার নকশা। 

  কোনও কোনও কাঁথায় ফুটিয়ে তোলা হত মানুষের পারিপার্শ্বিক জগতের না ঘটনা ও চিত্র। যেমন শুরুতে নকশি কাঁথার মাঠ কবিতায় বর্ণিত কাঁথা। বিভিন্ন প্রাণীর আদল ফুটিয়ে তোলা হত সূঁচে ও সুতোয়। তার মধ্যে মীন নকশা, পাখি, হস্তী বেশি আঁকা হত। অন্য প্রাণীও নকশায় স্থান পেত। গাছপালা ফুল এই জাতীয় নকশা যথেষ্ট বোনা হত।  নানা যান বহন , যেমন পালকি, নৌকা, ময়ূরপঙ্খী এগুলো থাকত নকশায়। সিঁদুর কৌটো, লক্ষ্মীর ঝাঁপি ইত্যাদিও থাকত কাঁথার নকশায়।

উল্লেখযোগ্য নকশাগুলো হলোঃ
পদ্ম নকশাঃ পদ্ম নকশা নকশি কাঁথাগুলোতে সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায়। পদ্ম ফুল হিন্দুধর্মের দেবদেবীর সাথে যুক্ত, এই জন্যও এটি বেশ জনপ্রিয়। পদ্মফুল হলো স্বর্গীয় আসন। এটা অবশ্য মহাজাগতিক মিলন ও নারীর প্রয়োজনীয়তাকেও বোঝায়। পদ্ম শাশ্বত আদেশ এবং আকাশ, মাটি ও পানির ঐক্য হিসেবেও মূর্ত। এটি জলের জীবনদায়ক ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে এবং এছাড়াও পাপড়ির খোলা ও বন্ধ করা অবস্থাকে সূর্যের সাথে তুলনা করা হয়। এটি পবিত্রতার প্রতীক। এটি ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক। অষ্টদল থেকে শুরু করে শতদল বিভিন্ন ধরনের পদ্ম নকশা রয়েছে। পুরাতন প্রায় প্রত্যেকটা কাঁথাতে মাঝখানে একটি ফুটন্ত পদ্ম দেখতে পাওয়া যেত।

সূর্য নকশাঃ এই নকশা পদ্ম নকশার কাছাকাছি নকশা। কখনো কখনো এই দুই নকশা কাঁথার কেন্দ্রে একসঙ্গে দেখা যায়। এটি সূর্যের জীবনদায়ক ক্ষমতার প্রকাশ করে। সূর্য হিন্দুদের ধর্মীয় ও বিবাহ উভয় আচারেই গুরত্ব বহন করে।

চন্দ্র নকশাঃ চন্দ্র নকশা মুসলমান ধর্মীয় প্রভাব রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নক্ষত্র সহযোগে একটি অর্ধচন্দ্রাকার নকশা। এই নকশা মূলত জায়নামাজ কাঁথায় দেখতে পাওয়া যায়।

চাকা নকশাঃ সাধারণত চাকা নকশা হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয়েরই ভারতীয় কলার প্রতীক। এটি আদেশের প্রতীক। এটি অবশ্য বিশ্বকেও প্রতিনিধিত্ব করে। যদিও বেশির ভাগ কাঁথা নির্মাতা চাকার গুরুত্ব জানেন না, তবুও এটি বেশ জনপ্রিয়। এটি চাটাই ফোঁড়এর তুলনায় সহজ। 

স্বস্তিকা নকশাঃ সংস্কৃতিতে সু অস্তি মানে হলো এটি ভাল। এই নকশা সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক। এটি ভালো ভাগ্যের প্রতীক। এটি মিছরি অথবা গোলক ধাঁধা হিসেবেও পরিচিত। সময়ের সাথে, মহেঞ্জোদাড়ো আমলের সোজা রেখা সম্বলিত স্বস্তিকার চেয়ে বক্ররেখা বেষ্টিত স্বস্তিকা এখন বেশি ব্যবহৃত হয়। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন প্রত্যেকটা ধর্মে এই প্রতীকের গুরুত্ব রয়েছে।

জীবনবৃক্ষ নকশাঃ সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে ভারতের শিল্প-সংস্কৃতিতে এই নকশার প্রভাব রয়েছে। মনে হয় যে, সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা পিপুল গাছকে জীবনবৃক্ষ হিসেবে ধারণা করত... এর মধ্যে দিয়ে দেবতা তার সৃষ্টির শক্তি প্রকাশ করছে। বৌদ্ধ আমলেও এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। পিপুল বৌদ্ধদের পবিত্র বৃক্ষ, কেননা বুদ্ধ এই গাছের ছায়াই বসেই বোধিপ্রাপ্ত হন। এটি প্রকৃতির সৃষ্টির ক্ষমতা প্রতিফলিত করে এবং বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়। আঙ্গুরগাছ ও লতাপাতা কাঁথার নকশায় যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে এবং এতে জীবন বৃক্ষের মতো একই রকম প্রতীক বহন করে। পান পাতার লহরি রাজশাহীতে খুবই  জনপ্রিয়। কদম গাছের বাহুল্য দেখা যেত কৃষ্ণ জীবন লীলা সূঁচে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে।কদম ফুল ও কদম গাছের অনুষঙ্গও চোখে পড়ত।

কলকা নকশাঃ মুঘল আমল থেকে আজ পর্যন্ত এই নকশা ব্যবহার করা হয়। কলকা নকশার উৎপত্তি পারস্যে ও কাশ্মীর এবং এটি বর্তমানে উপমহাদেশের অবিচ্ছেদ্য নকশা।
এছাড়াও রয়েছে পর্বত নকশা, মৎস্য নকশা, নৌকা নকশা, পায়ের ছাপ নকশা, রথ নকশা, মসজিদ নকশা, পাঞ্জা নকশা, কৃষি সামগ্রী, প্রাণী-নকশা, সাজঘর সামগ্রী, রান্নাঘর সামগ্রী, পালকি নকশা।

   পাড় হল কাঁথার সীমানার দিকের অংশ। বেশিরভাগ নকশি কাঁথার পাড় থাকত। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি শাড়ির পাড়কেই কাঁথার পাড় বানানো হয়, কখনো নকশা সেলাই করে পাড় বানানো হয়। বিভিন্ন নকশায় পাড় বোনা হত। শামুক পাড়, চোক পাড়, অনিয়ত পাড়, অন্যান্য পাড়, ঢেউ পাড়, নক্ষত্র পাড়, ধানের শীষ অথবা খেজুর চারি পাড়, বিছে পাড়, বেকি পাড়, বরফি পাড়, চোখ পাড়, তাবিজ পাড়, মালা পাড়, মই পাড়, গাট পাড়, চিক পাড়, নোলক পাড়, মাছ পাড়, পাঁচ পাড়, বাইশা পাড়, আনাজ পাড়, শামুক পাড়, অনিয়ত পাড়, গ্রেফি পাড়, কলম পাড় ইত্যাদি। 

 কাঁথার নকশার সঙ্গে কিছুটা হলেও যোগাযোগ ছিল আলপনার । সহজ সরল নৈমিত্তিক জীবনকেন্দ্রিক বস্তু ও বিষয় আলপনা ও কাঁথা নকশা দুয়েরই মূল বিষয়। প্রাচীন বাংলার যে জনজীবনের ছবি বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য বা ব্রত কথায় পাওয়া যায়, তাতে বোঝা যায় গৃহগত জীবনে নারী সমাজ সুখ ঐশ্বর্য , পরিবারের কল্যাণ কামনায় ও গৃহকর্মে সময় অতিবাহিত করত। তাদের দৃশ্যমান জগৎ ও কল্পনার জগতই তাদের শিল্পসাধনার মূল বিষয় ছিল। তাই ময়ূরকন্ঠি নাও, সুখী  গৃহশোভা বেশির ভাগ নকশার বিষয় হত।

  কাঁথা সেলাইয়ের ক্ষেত্রে ফোঁড়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন স্টিচ বা ফোঁড় দেওয়া হত। যেমন,

১। রান ফোঁড়: সবচেয়ে সহজ। এটি খুব দ্রুত করা যায়। রান সেলাই কাঁথার প্রধান ফোঁড় এবং সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। কাপড়ে সুচ খানিকটা ঢুকিয়ে একটু কাপড় ছেড়ে নিচ থেকে উপরে তুলে এই ফোঁড় করা হয়। উপর ও নিচের লাইন সব সময়ই সমান থাকে। এই ফোঁড়ে কাঁথার মোটিফ তোলা হয়। ডিজাইন অনুসারে রান সেলাই লম্বালম্বি, কোনাকুনি, আড়াআড়ি, গোল কিংবা ত্রিভুজ বা চৌকোভাবে দেয়া যেতে পারে। এর প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি দেখা যেত। সময় ও প্রয়াস অন্য ফোঁড়ের চেয়ে কম লাগত।

২। ডবল রান ফোঁড়: প্রথমে একবার রান সেলাই করার পর ফাঁকাগুলোতে আবার পর পর রান ফোঁড় দেয়াকে ডবল রান ফোঁড় বলা হয়। ভরাট ঘন হয় বলে এই ফোঁড়ের সেলাই দেখতে খুব সুন্দর। কোনো কোনো অঞ্চলে একে ডুরে রান বলে।
৩। ডারনিং ফোঁড়: রিফুর মতো ছোট ছোট রান দিয়ে এটি করতে হয়। প্রথমে দুটি লাইনেই রান ফোঁড় দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় লাইনের ফোঁড় প্রথম লাইনের ফাঁকের মধ্যে দিতে হয়। এরপর রিফুর মতো ছোট ছোট রান দিয়ে পুরো অংশ ভরাট করা হয়। এই ফোঁড় দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইন করা হয়।

৪। বেঁকি ফোঁড়: এটি রান ফোঁড়, তবে ছোট-বড় করে রান সেলাই দিতে হয়। অর্থাৎ ছোট থেকে বড় কিংবা বড় থেকে ছোট রান সেলাই দিতে হয় সমান্তরালভাবে, যা দেখতে বাঁকা লাগে। এই ফোঁড়ের সাহায্যে পাতা, চালতাফুল, ঘূর্ণি বা চরকি, ধানের ছড়ি ইত্যাদি ডিজাইন করা হয়।

৫। বখেয়া ফোঁড়:  ব্যাক বা বখেয়া ফোঁড় হল কাপড়ে সুচ ঢুকিয়ে পাশে তুলে আবার পেছন দিক থেকে প্রথম ফোঁড়ের মাথায় সুচ গলিয়ে নিচে দিয়ে আবার তুলতে হয় সমান দূরত্বে। এই ফোঁড় রানের মতো ফাঁক-ফাঁক নয়, ভরাট বা স্পষ্ট হয়।

৬। ক্রস ফোঁড়: অত্যন্ত প্রচলিত সেলাই। এই ফোঁড় দুটি বিপরীতমুখী কোণের সমন্বয়ে হয়, যেটি পরস্পরকে মধ্যবিন্দুতে ছেদ করে। সাধারণত কাঁথায় ক্রস ফোঁড়ের ব্যবহার করা হয় না। তবে রাজশাহীর কাঁথায় এই ফোঁড়ের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কাপড়ের মধ্যে চৌকো করে সুতোয় ঘর কেটে তার মধ্যে ক্রস ফোঁড় দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইন তোলা হয়।

৭। বোতামঘর: কাপড়ে সুচ বিঁধিয়ে তুলে নিয়ে সুচের মাথার ওপর দিয়ে সুতাটা দিয়ে এই ফোঁড় সমান দূরত্বে করা হয়। তবে কোনো কোনো মোটিফের ক্ষেত্রে এবং বর্ডারের চারপাশে এই ফোঁড় ব্যবহৃত হয়। একে কম্বলমুড়ি সেলাইও বলা হয়।

৮। ডাল ফোঁড়: কাঁথায় অনেক সময়ে আউটলাইনের জন্য কিংবা ডিজাইন খুব স্পষ্ট করে দেখানোর জন্য ডাল ফোঁড়ের ব্যবহার করা হয়। সুচটাকে নিচ থেকে উপরে তুলে আবার আগের ফোঁড়ের পাশের একটু অংশ থেকে সামান্য বাঁকাভাবে সুচ তুলে আনতে হয়। সাধারণত গাছের ডাল, পাতার শির, লতা ইত্যাদি নকশা সৃষ্টি করতে এর ব্যবহার হয় বলে একে ডাল ফোঁড় বলা হয়।

৯। চেন ফোঁড়: কোনো কোনো কাঁথায় এর ব্যবহার দেখা যায়। সুচ নিচ থেকে উপরে তুলে সুতোটা সুচের মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে টেনে তুলে আবার আগের ফোঁড়ের মাথায় ঢুকিয়ে টেনে তুলে এটি করা হয়। দেখতে চেনের মতো হয় বলে একে চেন ফোঁড় বলা হয়। এর সাহায্যে নানা রকমের ফুল, লতা-পাতা ইত্যাদি নকশা করা হয়।

১০। ভরাট ফোঁড়: কোনো আলাদা ফোঁড় নয় এটি। বিভিন্ন ফোঁড় দিয়ে কাঁথায় বিভিন্ন মোটিফ, ফুল, পাতা ইত্যাদি ভরাট করা হয়। যেহেতু ভরাটের কাজ করে, তাই একে ভরাট ফোঁড় বলা হয়। বিভিন্ন মোটিফ বা ডিজাইন ভরাট ফোঁড়ে করা হয়। এটি দু’রকমের- একটা হলো দু’দিকেই সমানভাবে ভরাট হয়, আর একটা শুধু উপরে ভরাট হয়।

১১। হলবিন ফোঁড়: এটি বাংলার বাইরের কাঁথা বা লেপ সেলাইতে ব্যবহার করা হয়। এই ফোঁড়ে সমান জায়গার সারিতে একদিকে রান সেলাই করা হয়। তারপরে সুচের দিক উল্টে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় সারি দিয়ে প্রথম সারির শূন্যস্হান পূরণ করা হয়। জ্যামিতিক নকশার সূচিকর্মে হলবিন ফোঁড়ের ব্যবহার করা হয়। মাঝে মাঝে এটি ক্রস ফোঁড় সহযোগেও করা হয়। বাংলার কাঁথায় জ্যামিতিক নকশার কাজে অনেক সময় এই ফোঁড়ের ব্যবহার করা হয়।

এছাড়া হত স্যাটিন ফোঁড় (এটি কাঁথার নকশায় ভরাটের কাজ করত), হেরিংবোন ফোঁড় ও ডবল হেরিংবোন ফোঁড়, লিক ফোঁড় ইত্যাদি।

 কাঁথা বাঙ্গালির জীবনচর্যার সাথে কতটা অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত তা সংস্কৃতি ও বাংলা সাহিত্য পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়। বহু প্রাচীনকাল থেকেই সাহিত্যে কাঁথার উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলায় “ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা” এমন বাগধারা থেকে শুরু করে চন্দ্রাবলির রামায়ণে সীতার পারদর্শিতা সর্বত্র কাঁথার সমাদর।
" সীতার গুণের কথা কি কহিব আর।
 কন্থায় আঁকিল কন্যা চান সুরুজ পাহাড়।।
আরও যে, আঁকিল কন্যা হাসা আর হাসি।
চাইরো পাড়ে আঁকে কইন্যা পুষ্প রাশি রাশি।।"

  বর্তমান গতিশীল জীবনে কাঁথায় নকশা তোলার সময় ও ধৈর্য দুইই কম। তবুও বিভিন্ন হস্তশিল্প মেলায় বা প্রদর্শনীতে নকশি কাঁথার দেখা মেলে। প্রাচীন কালের কাঁথা আমরা দেখতে পাই সংগ্রহশালায়। ব্রতচারী গুরু গুরুসদয় দত্তের সংগ্রহশালায় এরকম অনেকগুলো কাঁথা আছে, যার নিপুণ শিল্পকর্ম আমাদের চমকিত করে। 'ছেঁড়া কাঁথা' আর 'লাখ টাকা' আজ আর বৈপরীত্যের অর্থ বহন করে না। হাতে বোনা ঘন কাজের কাঁথার দাম সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। পুরোনো দিনের হাতে বোনা নকশি কাঁথা আজ যাদের সংগ্রহে আছে, তারা সৌভাগ্যবান।

গ্রন্থঋণ
বাংলার নকশি কাঁথা, শীলা বসাক
বাংলার লোকশিল্প,  কল্যাণ কুমার গঙ্গোপাধ্যায়

বৈশাখী ২০২৪