জলরং

“কী ব্যাপার, দু'দিন অনলাইনে দেখিনি যে! সব ঠিক?”
“হ্যাঁ, ওই আর কী! ঠিকই আছি!”
“আগেরদিন বলেছিলেন ডাক্তারের কাছে যাবেন। তা যাওয়া হয়েছিল নাকি খালি আপনার ঐ দুঃখবিলাস চলছে এখনো?”
“আপনি এখন আর যা-ই বলুন, আমার গায়ে লাগবে না তথাগতবাবু।”
“কেন? গায়ের চামড়া এতটা মোটা হয়ে গেছে নাকি এই ক'দিনে আপনার?”
“তা হয়ে গেছে। বেশি পাতলা চামড়া ফেটে রক্ত বেরোয়, জানেন তো?”
“বাজে বকবেন না তো!”
“হ্যাঁ সেই। আমি তো বাজেই বকি সবসময়। আর আপনি যা বলেন সব ঠিক।”

একটু যেন আহত হই আমি। আমি শুচিস্মিতা। এই একজন ব্যক্তি, যখন তখন আঘাত দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় আমাকে। আবার আমার যে কোনো লেখার প্রথম সমঝদার এই ব্যক্তিই। ওহ! বলাই তো হয়নি। আমি ব্যক্তিটি অর্থাৎ শুচিস্মিতা সেন নাকি আজকালকার একজন নামী লেখিকা, লোকজন অন্তত তাই বলেন। “অজাতশত্রু”, “বাসন্তীপুরের রূপকথারা”, “উতল হাওয়া” আরো অনেক অনেক উপন্যাসের বেস্ট সেলার এবং বাংলা সাহিত্যের ইদানীংকালের নক্ষত্রদের মধ্যে আমার নামটাও অনায়াসে নেওয়াই যায়। যদিও আমার বয়স সেই অর্থে খুব বেশি নয়। লেখালেখিটা শুরু করেছিলাম সামাজিক মাধ্যমে, তারপর কলমের জোরে সেখান থেকেই পরিচিতি, তারপর যেমন হয়, বন্ধুদের পরামর্শে এবং ফ্যান ফলোয়ারদের অনুরোধে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠাতে শুরু করেছিলাম। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। সাহিত্য জগতের কনিষ্ঠ লেখকদের মধ্যে খুব বেশিরকম ছাপ ফেলতে ফেলতে আজ আমি মোটামুটিভাবে এমন এক জায়গায় পৌঁছেছি, যেখানে এক ডাকে আমাকে চিনে ফেলা বা আমার বাড়ির ঠিকানাকে ল্যান্ডমার্ক হিসাবে ব্যবহার করাই যায়।

কিন্তু কম বয়সে সাফল্য যাদের হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেয়, তাদের অনেকেরই মাথার ঠিক থাকে না। আমি আবার সেই গোত্রের নয়। ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে মাথা উঁচু করে চলতে ভালোবাসি। কথা বলি কম, শুনি বেশি, আর যেটুকু বলার, সেটুকু উজাড় করে দিই আমার বিভিন্ন লেখায়। তবু তো তার বিনিময়ে মূল্য অন্তত পাওয়া যায়। কী বললেন? মূল্য? বাহ্! এটাই তো আমার পেশা, আর রয়্যালটির কথা যদি ছেড়েও দিই, তাহলেও মানুষের ভালোবাসা, সম্মান? এগুলোর দাম তো আছেই, নাকি? তাই আমার প্রথমদিকের লেখার সমাদর করে যাঁরা তার প্রশংসা করতেন, তাঁদের আমি আজও ভুলিনি। প্রথমদিকে যেরকম মেসেঞ্জারে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতাম, আজও তাঁদের সঙ্গে একইরকম সম্পর্ক আমার থেকে গেছে। শুধু পার্থক্য এটাই, যে সেই সম্পর্ক মেসেঞ্জার পার হয়ে এখন হোয়াটস্যাপের আওতায় এসে ধরা দিয়েছে। তবে, আগেকার মত অত কথা এখন আর হয় না, ব্যস্ততা বেড়েছে তো, আর গাম্ভীর্যও একটু আনতে হয়েছে, নাহলে আবার কিছু লোক ফ্যালনা ভাবতে পারে। 

কিন্তু এই যে বিশাল সংখ্যার পাঠকবৃন্দের সমাহার, যাদের প্রাত্যাহিক আবদারে আমি অতিষ্ঠ, এবং অনেকটা গর্বিতও বটে, সেই দলের মধ্যে এই একটিমাত্র ব্যক্তি, তথাগত রায় একজন মূর্তিমান আপদ। একটা কোনো পোস্ট আমি দিই, বা লিখি একটা কোনো গল্প, প্রথম কমেন্ট এই তথাগতর। সেই আমি যখন প্রথম লেখালিখি শুরু করেছিলাম, তখন থেকেই। পার্থক্য শুধু এই যে, আমার অন্যান্য পোস্টগুলোতে বা ছবিগুলোতে সব বাঁকা কমেন্ট দিয়ে যে আমাকে বিরক্ত করে মারে, সে ব্যক্তিই আবার আমার লেখনীর অন্ধ ভক্ত। শুচিস্মিতার লেখা প্রতিটি গল্পে তথাগতর অনবদ্য কমেন্টগুলো মন ছুঁয়ে যায় সবার! এমনকি লেখিকার নিজেরও।

এইত সেদিন, আমি রাতের দিকে একটা হাসি হাসি মুখের ছবি পোস্ট করেছিলাম। করব না-ই বা কেন? আমি কি সুন্দরী নই? পাঁচ মিনিটের মধ্যে মেসেঞ্জারে পিং!

“কাজ নেই? সকাল সকাল ফিল্টার করা ছবি পোস্ট করেছেন! পারেনও বাবা!”
“এই, বেশ করেছি ছবি দিয়েছি! তাতে আপনার কী?”
“আমার কি মানে? এদিকে রাত জেগে লিখবেন, তারপর তিনদিন বেপাত্তা হয়ে যাবেন, বলবেন রাত জেগে জেগে ঘুম নষ্ট হচ্ছে, পারেন বটে মিথ্যে বলতে! রাত জাগলে কাউকে এত ফ্রেশ লাগে, ফিল্টার ছাড়া?”
“আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়না যে একজন বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সময় আপনার একটু সৌজন্য সহকারে কথা বলা উচিৎ?”
“বিখ্যাত? আপনি? হুঁ! আপনাকে বিখ্যাত করল কারা? এই আমাদের মত লোকজন, বুঝলেন? আর শুনুন, দিনরাত নিজের মুখের ফিল্টার করা ছবি এমনিই না দেখিয়ে কিছু এডুকেশনাল ভিডিও পোস্ট করুন, আপনাকে যেটা মানায়।”

উফফ! পারেও বাবা লোকটা! কি ক্যাটোস ক্যাটোস কথা, কথা দিয়ে হুল ফোটায় যেন! আগে আগে আমার রাগ হত খুব। ভাবতাম, এই লোকটা তো নিজেই আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে, আমার লেখায় এত ভালো ভালো কমেন্ট করে! তাহলে লেখা ছাড়া তার অন্য পোস্টে লোকটার এত আপত্তি কেন? কিন্তু, কোনো এক অজানা কারণে লোকটাকে ব্লক করতেও সাহস হয়নি আমার। তার কারণ হল, ব্লক করলে যদি ঐ সুন্দর কমেন্টগুলো আর না পাই! আর তাছাড়া, মনের অগোচরে পাপ না রেখেই বলছি, এই টক-ঝাল-নোনতা অসমবয়সী বন্ধুত্বের সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার দায় আমার নিজেরও কম নেই। 

কোনোদিন যদি আমি ফুচকা খাওয়ার ছবি দিলাম, মেসেঞ্জারে গভীর রাতে একটা পিং! আচ্ছা, লোকটা কি সবসময় অনলাইন থাকে? 
“ফুচকা খাওয়ার না একটা আলাদা ঋতু আছে। জানতেন না, তাই তো?”
“ফুচকা খাওয়ার আলাদা ঋতু?” আমি অবাক হই।
“হ্যাঁ! ঐ প্রচন্ড গরমে ফুচকাওয়ালার হাতের নোনা জলের জাদু...”
“এই এই থামুন তো! আচ্ছা আমার পিছনে লেগে আপনি কী পান একটু বলবেন?”
“কিছুই না। শুধু আপনাকে একটু রাগাতে চেষ্টা করি, এই আর কী...”

অন্য কেউ হলে রেগেই যেতাম হয়ত আমি! হয়ত কেন, যেতামই। কিন্তু কেন জানি না এই মানুষটার ওপর আমি রেগেও যেতে পারি না। আমার মত রাশভারী একজন নামী লেখিকাকে যে এরকমভাবে বলতে পারে, তার মনে অন্তত কোনো ময়লা যে নেই এ আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি। বয়স কম হলেও, অভিজ্ঞতা তো অনেকটাই হল। মানুষ চিনতে খুব একটা ভুল হয়না এখন। সমবয়সী চেনা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিজন তো কম নেই আমার, কিন্তু আমার একটা বেস্টসেলার যখনই বাজার কাঁপায়, তখন তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেই আমি বুঝে যাই যে কতটা হিংসার আগুন তাদের মনে লেলিহান অগ্নিশিখা বিস্তার করেছে। এই যে মস্ত বড় ফ্ল্যাটটায় আমি থাকি, যেখানে সারাদিন শুধু আমি আর আমার লেখা চরিত্রগুলো ছাড়া কেউ থাকে না, কারোর অস্তিত্ব নেই, এই যে আমার নিভৃত বাসস্থান, সেখানেও আমি অপেক্ষায় থাকি ঐ অচেনা মানুষটার মেসেজ কখন আসবে সেইজন্য। আসলে সারাদিন বর বাড়ি থাকে না, আর সারাদিনে আমার অখণ্ড অবসরে আমি শুধু লিখে চলি। এই একাকীত্বের মধ্যে আমি খুব উপভোগ করি জানেন তো, যে তথাগত রায় আমাকে এত চেষ্টা করেও একবারও রাগাতে পারে না।

“আপনি এখন অনেকটা ভালো আছেন শুচিস্মিতা। রাগটা এখন আর অতটা হয়না তাইত?”
“সে তো হয় না ডাক্তারবাবু। কিন্তু... কিন্তু...”
“কিন্তু কী মিসেস সেন?”
“আপনার দেওয়া ওই একটা ওষুধ আমি খাই না।”
“কেন? ওটা তো আপনার জন্য খুব দরকার। ওটা খেলে আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবেন। তার ফলে পরের দিন আপনি অনেকটা ফ্রেশ মাইন্ডে লিখতে পারবেন।”
“কিন্তু ওটা খেয়ে ঘুমোলেই একটা অদ্ভুত জিনিস হয় ডাক্তারবাবু। আমি তার পরের তিন চার দিন তথাগতর আর কোনো মেসেজ পাই না। হয়ত আমি ঘুমোলে আমাকে মেসেজ করে করে ও রিপ্লাই না পেয়ে রেগে গিয়ে আর মেসেজ করে না, তাই, ঐ ওষুধটা খেয়ে ঘুমোতে আমার ভয় করে।”
“কিন্তু মিসেস সেন, ঐ তথাগতর সঙ্গে সারাদিন বকবক করলে আপনার লেখাগুলো কি শেষ করতে পারবেন আর? ওগুলো শেষ যাতে করতে পারেন সেইজন্যই তো আপনাকে নিশ্চিন্তে ঘুমোনোর ওষুধটা দিয়েছি আমি।”
“না ডাক্তারবাবু না! প্লিজ! আমি লেখাগুলো শেষ করেই নেব কিন্তু তথাগতর সঙ্গে কথা না বলে আমি একটা দিনও থাকতে পারব না। জানেন ওর সঙ্গে কথা বললে আমি একটুও রেগে যাই না? ওর সঙ্গে কথা বলা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আপনি নিজেই দেখুন না আমি আগে কত রেগে যেতাম। ও আমাকে কত রাগায়, কিন্তু আমি একটুও রেগে যাইনা। আমার অবস্থার উন্নতি হয়নি, বলুন?”
“হয়েছে মিসেস সেন, অনেক উন্নতি হয়েছে। আপনি ব্যস্ত হবেন না। যদি মনে হয় ঐ ওষুধটা না খেলে আপনি ভালো থাকবেন তাহলে বেশ! খাবেন না, মিটে গেল। কিন্তু তার বদলে অন্য একটা ওষুধ আপনাকে খেতেই হবে। খাবেন তো?”
“খাব ডাক্তারবাবু। নিশ্চই খাব।”

বলে তো দিলাম ডাক্তারবাবুকে যে উনি অন্য একটা ওষুধ দিলে আমি খাব, কিন্তু আসলে খাব না, জানেন তো? আমি আমার বরের সঙ্গে ডাক্তারবাবুর কথাবার্তা আড়াল থেকে শুনে নিয়েছি। ওরা আমাকে বোকা ভাবলেও, আমি কি আসলেই বোকা নাকি? ওরা দুজনে মিলে তথাগতকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিতে চায়। ঐ হিংসুটে লোকটা, আমার বর, আমার সঙ্গে তথাগতর যে এত কথাবার্তা হয় সেটা একদম সহ্য করতে পারে না, জানেন তো? আজকেও ডাক্তারবাবুকে বলছিল, আমার নাকি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে, আমি নাকি ফোনের দিকে রাতের বেলা ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকি, তথাগত রায় আসলে নাকি নেই, সে নাকি শুধুই  আমার মনের ভ্রম! তথাগতর জন্য নাকি আমার কেরিয়ারের বারোটা বেজে যাবে। ইয়ার্কি নাকি? আমার মনের ভ্রম? বললেই হল? যে মানুষটা আমার সঙ্গে এত কথা বলে, সে শুধুই ভ্রম? আমাকে যে এতটা ইন্সপায়ার করে, সে করবে আমার কেরিয়ার নষ্ট? যত সব বাজে কথা! হ্যাঁ, এখন যদি আপনারা জিজ্ঞাসা করেন যে ওর লেখা মেসেজগুলো কোথায়, বা ফেসবুকে ওর করা কমেন্টগুলো কোথায়, তবে আমি সেগুলো দেখাতে পারব না। কেননা ওর কমেন্টগুলো সব হাইড করে রাখা আছে। মেসেজগুলো রোজ সকালে মুছে দিই আমি। ওগুলো শুধু আমার। ওগুলো শুধু আমি দেখতে পাই। কিন্তু তাই বলে কেউ এটা বলে দেবে যে ওর অস্তিত্বই নেই? আমি জানি না কেন এরকম বলছে? কেন তথাগতকে মুছে ফেলতে চাইছে? হিংসা, হিংসা বোঝেন তো? বৌ অন্য একজনের সঙ্গে বন্ধুর মত কথা বলছে, এটা সহ্য হচ্ছে না মিস্টার অনির্বাণ সেনের। ইগোয় লাগছে। ওকে কে বোঝাবে, ওর বৌ পাগল নয়?

যাক! যার যা ইচ্ছে বলুক, আমার কিছু যায় আসে না। মোদ্দা কথা, তথাগতর সঙ্গে আমি রোজ রাতে কথা বলব। আমি পরেরদিন কী লিখব, কী খাব, ওষুধ ঠিকমত খাচ্ছি কিনা --এসব খবর কে নেবে ও ছাড়া? তাই আমি সব করব, কিন্তু যে ওষুধটা খেলে রাতে খুব ভালো করে ঘুমোই, সেটা খাব না। ওটা খেলে রাতের বেলা ঘুমিয়ে পড়ি, আর তথাগতর মেসেজের উত্তর দেওয়া হয় না। আসলে রাত ছাড়া ওর আবার মেসেজ করার সময় হয় না কিনা!!

আপনারাই বলুন তো, ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়াটা, না বন্ধুর সঙ্গে সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়াটা, কোনটা আগে? কোনটা ভালো?

বৈশাখী ২০২৪