তবু আনন্দ…তবু অনন্ত…

ইস্ট ব্রানসউইক, নিউ জার্সি

বাড়ি ফিরছিল রুমা। পাটা একটু টেনে টেনে হাঁটে, হাঁটতে হয় আজকাল, প্রতিটা পদক্ষেপে মগজটা যেন বলে, বলতে হয় তাকে পা দুটোকে.... ও হে... চলো...চলতে থাকো... পথ চলা শেষ হয়নি এখনও।

"আন্টি...আন্টি ...আন্টি..." ডাকটা যে তার উদ্দেশ্যেই, বুঝতে একটু সময় লাগে। এই ডাকটা তো এখন আর শোনে না বিশেষ। একটা সময় সারাদিন অসংখ্য বার বাজা বেল বা ফোনে এই ডাকটা শোনা যেত। এখন শুধু বৌদি, বা ম্যাডাম, বা রুমাদি। অবশ্য আরেকটা ডাকও শোনা যেত অহরহ ...বারবার ...,বাথরুমে ঢোকা মাত্র...শুয়ে চোখ দুটো একটু লেগে আসা মাত্র, রান্নাটা বসানো মাত্র...বিরক্ত লাগত একেক সময়...বাবা রেহাই দে না মাকে একটুক্ষণ! আজ আরেকবার ...একটিমাত্র বার যদি সেই ডাকটা আবার....
ছেলেমেয়ে দুটো ছুটে কাছে এসে দাঁড়ায়।  "আন্টি...কেমন আছো?"
শুভম আর প্রিয়াঙ্কা। কতদিন পরে দেখল ওদের। সেই কাজের দিন কি শেষ দেখা ? না ওরা দল মিলে পরেও একবার এসেছিল? সেই সময়টার স্মৃতিটা আবছা মতো হয়ে আছে তো...দিনক্ষণ গুলিয়ে যায় কেমন। 
"কেমন আছিস রে তোরা?"
"আন্টি...আমরা তো বাইরে চলে যাচ্ছি, তারই শপিং করতে এসেছিলাম। যাওয়ার সময় হয়ে এল।"
রুমা বলতে যায় একবার...যাওয়ার সময় হয়ে এল বোলো না ...কখনো বোলো না। কিন্তু ওরা নিজেদের মতো কলকল করে কথা বলে যায়। রাজধানীর একটা নামি কলেজের নাম বলে...দুজনেই চান্স পেয়েছে সেখানে। 
এখানেই বাবু যেতে চেয়েছিল না? না না...বাবু চায়নি ...তারা চেয়েছিল। সে ...আর সুজন। বাবু কী চায় তারা জানত কি?  
"কবে যাবি? একদিন একটু আয় বাড়িতে তার আগে" বলে ফেলে নিজেই অবাক হয়ে যায় রুমা। কতদিন পরে এইরকম কোনো কথা বেরোল তার মুখ থেকে !
উত্তরে ওরা কিছু বলার আগেই ওদের মায়েরা এসে পড়ে। সুমিতা আর রত্না তাড়াতাড়ি, "হয়ে উঠবে না গো...ওদের হাতে এখন একদম সময় নেই....আমরা আজ আসি..,” বলতে বলতে সরিয়ে নিয়ে যায় ছেলেমেয়েকে।
আলগা ভেসে আসে..."একটা ভালো কাজে বেরিয়ে কার সামনে পড়লাম...আমি বাবা পয়া অপয়া মানি... যাই বলো না কেন!"
রত্নার গলা। রত্না... ফিজিক্সে মাস্টার ডিগ্রি..অনেকবার শুনিয়েছে...যখন তারা একসঙ্গে বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছতে যেত। 
আচ্ছা...সে অপয়া ...না? সত্যিই তো...তাই বোধহয় আজ অফিসে নতুন ট্রান্সফার হয়ে আসা ছেলেটা নিজের নবজাতকের সুখবরটা দিতে সবার কাছে এলেও তার কাছে এল না। রুমা মনে মনে ঝালিয়ে নিচ্ছিল...আজকাল আগে থেকে ভেবে না রাখলে এইসব কথাগুলো তো ঠিক মনে আসে না...ছেলেটাকে অভিনন্দন জানাব, তারপর বাচ্চার ছবি দেখতে চাইবে...ভাবতে ভাবতে ছেলেটা তার কাছাকাছি আসার আগেই কে যেন তাকে ডেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। 

শুভম প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে সাক্ষাৎ আবার মনে করিয়ে দেয় বছর খানেক আগের সেই দিনটা। অবশ্য ভোলে না, ভোলেনি কখনোই...আজ আবার নতুন করে সেই দিনটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ক্লাস ইলেভেনের রেজাল্টের দিন। রুমা বাড়ি ফিরে দেখে বাবু তখনো ফেরেনি। সুজন ফিরল...তখনো বাবুর দেখা নেই। বাবুর ক্লাসেই পড়ে রেশমী, তিনতলায় তাদের ফ্ল্যাটে বেল বাজাতে বেরিয়ে এসে তাদের দেখেই রেশমীর মুখটা শুকিয়ে যায়।  "আন্টি..বাবু তো...বাবু তো..."
পিছন থেকে তার মা এসে ধমকায়..." বাবু কী সেটা বল না ঠিক করে...দেখছিস ওঁরা চিন্তা করছেন!"
"বাবু পাস করেনি আন্টি!" 
মাধ্যমিকের পরে হাতে পায়ে ধরেছিল বাবু। "আর্টস পড়বো মা...লিটারেচার পড়ব!" সুজনের দাদার মেয়ে অঙ্কে মাস্টার্স করছে। সুজনের ছেলে সাহিত্য পড়লে চলে! চিরকাল দাদার থেকে একটু পিছিয়ে থাকাটা সে আজ বাবুকে দিয়ে পুষিয়ে নেবে না! মেরে ধরে মাধ্যমিকে নম্বর ভালই তোলানো গেছে, সায়েন্স হয়ে যাবে বাবুর পুরোনো স্কুলেই।" আমি চাই না, পারব না "... কেঁদেছিল বাবু। তারা শোনেনি।

রাত বাড়ে। সব বন্ধুর বাড়িতে আত্মীয়ের বাড়িতে ফোন যায়। বাবুর বন্ধুরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে , সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয় বাবুর ছবি। অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারাও বেরিয়ে পড়েন খুঁজতে। তারপর থানা। বারবার বাবুকে ফোন করে রুমা...সুইচড অফ ! 
ভোরের দিকে থানা থেকে ফোন পেয়ে ছুটে যায় সুজন বিজন... টালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে কাটা পড়া দেহ শনাক্ত করতে। ফিরে আসে...সুজন হাঁটতে পারছে না...প্রায় বয়ে নিয়ে আসছে দাদা বিজন । বিজনের মেয়ে ...যার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য বাবুকে সায়েন্স পড়ানো ....আজ আছড়ে পড়ে কাঁদছে। তাকে সামলাতে গিয়ে কেঁদে ফেলছে তার মাও। শুধু রুমা চুপ। বাড়িতে ঢল নামে মানুষের...আত্মীয় প্রতিবেশী স্কুলের শিক্ষক .... ভিড় করে আসে বাবুর বন্ধুরা ...তাজা কিশোর মুখগুলো আকস্মিক আঘাতে দিশাহারা ... প্রায় সকলেরই জীবনের প্রথম দেখা মৃত্যু.... হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে প্রিয়াঙ্কা রেশমী শুভম আয়ুষরা...রুমা চুপ। 

 রুমা সেদিনও চুপ, যেদিন মাসদুয়েক পরে রাস্তা পেরোতে গিয়ে বাসের নীচে পড়ে সুজন। "আহারে ...ছেলের শোকে মাথার ঠিক ছিল না গো... কোনোদিক না দেখে রাস্তায় পা দিল" পাড়ার যারা সামনে ছিল সেদিন তারা এই কথাই বলে...সেই কথাটাই ছড়ায় মুখে মুখে। তাই কি...ভাবে রুমা। যেদিন তার মাথাটা ছিঁড়ে আসে যন্ত্রণায়...মুঠো মুঠো ওষুধেও কাজ দেয় না...সেদিন ভাবে ...পালিয়ে বেঁচেছে সুজন... ভিতু কাপুরুষ লোকটার দম ছিল না অপরাধ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকার ...ইচ্ছে করেই বাসের সামনে...
যেদিন ঘুমের ওষুধের বেশি ডোজ খেয়ে তবু একটু ঘুম আসে...সেদিন ভাবে...প্রায়শ্চিত্ত করেছে সুজন,শান্তি পেয়েছে...আহা ...পাক...!
কিন্তু তার তো রেহাই নেই এত সহজে। কেউ জানে না ...সে নিজে তো জানে... সেদিন সকালে রেজাল্ট আনতে যাওয়ার আগেও বাবু বলেছিল... "রেজাল্ট ভালো হবে না মা...আমি কিছু বুঝি না ...ভালো লাগে না...পরীক্ষা ভালো হয় নি মা...কী করব!"
শোনেনি রুমা ভালো করে...শোনার দরকার মনে করেনি...শুধু বলেছিল..."এতগুলো টিউটর লাগিয়েছি...এরপরেও রেজাল্ট ভালো না হলে দেখবে মজা!"
মজা দেখার জন্য আর বাড়ি ফেরেনি বাবু...দেখিয়েছে ...দেখিয়ে দিয়ে গেছে । রুমাকে তো সুজনের সহজ পথ বেছে নিলে চলবে না...তাকে তো দেখে যেতে হবে এই মজা আরো অনেক অনেক বছর । চোখের জল ফেলার অধিকার নেই তার।

তার এই শুকনো চোখ, নিয়ম করে অফিসে যাওয়া, বাজার করা, রান্না করা...এই নিয়ে রীতিমত গুজগুজ ফুস ফুস হয়...আন্দাজ করতে পারে রুমা। কি পাষাণী গো... কী করে পারে বাবা...এখনও খিদে পায়...মুখে খাবার তুলতে পারে...,অফিসে কাজ করতে পারে...হাওয়ায় ভাসতে থাকে কথা। সে বোঝাতে পারে না... চায়ও না...যে এই রুটিনটাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ছুটির দিনগুলোতে সারাদিন কি করবে...ঘণ্টাগুলো কাটবে কি করে...,,সে বুঝে উঠতে পারেনা। এক রবিবার তার বড়ো জা এসে তাকে নিয়ে যায় নিজের গুরুদেবের কাছে...,ধর্মকথা শুনলে মনটা একটু শান্ত হবে। গুরুদেব যথেষ্ট চেষ্টা করেন তাকে জীবন মৃত্যুর তত্ত্ব বোঝানোর । ফেরার সময় জা বলে ...ভালো লাগলো...আবার আসবি? রুমা ভাবে, সে ঠিক মত বোঝেনি বোধহয়... যা হয় ভালোর জন্য হয়, বাবুর যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে...এটা নিশ্চয় উনি বলতে চাননি, সে নিজেই ভুল বুঝেছে। আর ফিরে যায় না।
 আরেক ছুটির দিন তার বান্ধবী সুমনা এসে তাকে নিয়ে  যায় এক অনাথআশ্রমে...দেখ রুমা ...এই বাচ্চাগুলো কি অভাগা...একটু ভালোবাসার কি কাঙাল এরা,...তুই যদি এদের সঙ্গে একটু সময় কাটাস ! চুপচাপ সরে আসে রুমা। এরা কেউ তার কেউ নয়...এরা কেউ তার বাবু নয় !

অফিসের নিয়ম , ফাইল,ডেবিট ক্রেডিট....তার থেকে কোনো অনুভূতি চায় না...ভালোবাসা, বিশ্বাস ,অশ্রু দাবী করে না...কয়েক ঘন্টা সেখানে সে তবু ঠিক থাকে। একদিন অবশ্য তাও ভুল করে ফেলেছিল...অনেকদিনের পুরোনো কাস্টমার এসে আস্তে করে বলেছিল..."আমাকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বেশি দিয়ে দিয়েছেন ম্যাডাম...এই নিন...ক্যাশে ফেরত রেখে দিন...বুঝতে পারছি...,এই সময়...খুব স্বাভাবিক..."

আচ্ছা...লোকটা কি করে জানলো? তাকে দেখে বোঝা যায়...না? একটা বড় লাল টিপ দিত কপালে আগে.... সুজন যাওয়ার পরে আর দেয় না...তাতেই কি জানলো? বাবুর কথাও কি জানে? সমাজের কি অদ্ভুত নিয়ম ...না? যাকে তিল তিল করে নিজের দেহে বড়ো করেছে...যে আসার বার্তা তাকে সদ্য বিবাহিতা ছিপছিপে তরুণীর থেকে আসন্ন মাতৃত্বে ভর ভরাট নারী মূর্তি দিয়েছে...যাকে বাড়িতে রেখে ছুটির শেষে কাজে যোগ দেবার পর অনেকদিন অবধি স্নেহরসে ভিজে যেত তার ব্লাউজ...কোনরকমে আঁচল দিয়ে ঢাকা দিত...আর ঘরে রেখে আসা কচি মুখটা মনে করে চোখ ভিজে যেত...সে চলে যাওয়াতে তার চেহারায় সাজে কোনো তফাত নেই, তফাত করার কোনো নিয়ম নেই !

 সেদিন বাড়ি ফিরে একটু বসেছে, জোরে জোরে বেলটা বাজে। চমকে ওঠে রুমা। এভাবে তো বেল বাজাতো একজনই...,টিউশন থেকে বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার সময়। আজকাল তো কাজের মাসিও আস্তে বেল দেয়। 
খুলে দেখে শুভম আর প্রিয়াঙ্কা...মুখে একগাল হাসি।  "তুমি যাওয়ার আগে দেখা করতে বলেছিলে আন্টি!"
হঠাৎ কী করবে বুঝে উঠতে পারে না রুমা। তার রুটিনের বাইরের ঘটনা তো এটা পুরো। 
"আয় আয়...ভিতরে আয়!" 
কী খেতে দেবে ওদের? তেমন কিছু তো নেই ঘরে...আগে জানলে এনে রাখত। 
ফ্রিজ হাতড়ায়। 
"কিছু খাবো না আন্টি... বসব না বেশিক্ষণ...একটু তোমার সঙ্গে দেখা করতে..."
"বেশি কিছু নেইও রে...কাল একটু পায়েস করেছিলাম...ওর জন্মদিন ছিল তো কাল..." 
"ওহ্...হ্যাঁ হ্যাঁ...দাও...খাব!"
তাড়াতাড়ি খায় ওরা... মায়েদের অজান্তে এসেছে অল্প সময় বার করে ...বোঝা যাচ্ছে। 
বেরোবার আগে একবার বাবুর ছবির সামনে দাঁড়ায় দুজনে চুপ করে। 
"কী যে করলো সায়নটা..." অস্ফুটে বলে শুভম। রুমাকে একবার জড়িয়ে ধরে প্রিয়াঙ্কা।  "সাবধানে থাকবে আন্টি, ঠিক করে খাবে, ডাক্তার দেখাবে। আমরা ফোন করব...বাড়ি এলে আসবো...,আজ যাই!"
"যাই বলে না সোনা...এসো.."

কী সুন্দর হয়েছে মেয়েটা... যেমন মিষ্টি দেখতে তেমন মিষ্টি কথা...কেমন মায়ের মত শাসন করে গেল! আর শুভম... শুভমটা এদিকে বড়ো হয়ে গেছে...অন্য শহরে পড়তে যাচ্ছে...এদিকে এখনও হুম হাম করে খায় ....মুখে খাবার লেগে যায়!
রুমার মনে পড়ে বাবুর দশ বছরের জন্মদিন... কেক কাটার পর বাবুর গালে অল্প কেক লাগিয়ে দিলো শুভম...বাবু এক খাবলা নিয়ে লাগাল শুভমের চুলে মুখে...তবে রে...বলে বাবুর মুখটাই ধরে কেকে ঘষে দিল শুভম।
সারা মুখে কেক লাগা বাবুর চেহারাটা মনে করে আজ হেসে ফেলে রুমা। অনেকদিন পর হাসে...প্রাণ খুলে হাসে। জানতেও পারে না ...কখন হাসি বদলে যায় কান্নায়...বুকের ভিতর গত এক বছর চেপে বসা বরফের পাথরটা আজ প্রিয়াঙ্কা আর শুভম তাদের ওম দিয়ে গলিয়ে দিয়ে গেছে...বাবুর সাদা চাদর ঢাকা চেহারাটা পেরিয়ে তার পুরোনো চেহারাটা কিছুতেই মনে করতে পারত না...ওদের মধ্যে দেখলো সেই আগের বাবুকে । বাঁধ ভেঙে গেছে আজ...গ্লানি অপরাধবোধ আফসোস  ... যা কিছু জীর্ণ দীর্ণ জীবনহারা...সব অশ্রু হয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে আবার...আবার ভিজছে তার বুক...সেই প্রথম মা হওয়ার দিনগুলোর মত। বাবুর ফটোটা জড়িয়ে ধরে আজ জন্মের শোধ কাঁদে রুমা।

অনেক অনেক পরে উঠে বসে একটা ফোন করে।
"সুমনা...কেমন আছিস...না না আমি ঠিক আছি... এই গলাটা একটু খারাপ ...আচ্ছা শোন...,,আমাকে ওই অনাথআশ্রমে নিয়ে যাবি আবার এই রবিবার?"

বৈশাখী ২০২৪