নীল আয়না

দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান

উতরাই! পাকদন্ডী ঘুরে আবার উতরাই। তালে তালে শরীরে লেগে থাকা ছন্দটাকে কিছুতেই থামাতে ইচ্ছে করে না রূপকের। বাগান থেকে আজ অনেকটাই নেমে এসেছে সে। ধুপির জঙ্গল কিছুটা পাতলা হলে রূপকের বাগান দেখা যায়। পাহাড়ের ধাপে ধাপে গোল ছাতার মতো চা-পাতার ঝোপগুলো দেখলে বুকটা ফুলে ওঠে। তবে ওই সবুজ সাম্রাজ্যে সবকিছু থেকেও যেন আজ বড্ড ফাঁকা। নীল চাদর ঢাকা আকাশে সবুজ পাহাড়েরা বড্ড এবড়োখেবড়ো করে লাইন করেছে আজ। পোস্টকার্ডের ছবির মতো রঙ মাখলেও সাজসজ্জায় ত্রুটি ধরা পড়ছে। প্রায় তেইশ বছরের পাহাড়ি জীবন রূপকের। মুগ্ধ হওয়া চোখ দু’টো কি এবার বৃদ্ধ হতে চাইছে?  
 
বাগানের মধ্যেই বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে রূপকের কটেজ। মর্নিং ওয়াক সেরে ঘরে পা দিতেই ছুটে এল কচুরি। রূপকের পোষ্য। জার্মান শেফার্ড। রূপক ওর মাথা, পিঠে, পেটে হাত বোলাতে বোলাতে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকোল। অন্তত কচুরিটা তো থাকবে সঙ্গে। যদিও একাকিত্ব পালন করাটা রূপকের বিলাসিতা।  চা বাগানের শ্রমিক ও তাদের পরিবার নিয়ে বিরাট সংসার তার। একেকদিন খাদের উদর থেকে কখন সূর্য ওঠে আর কখনই বা সেই খাদই আবার গিলে ফেলে তাকে তা টেরই পায় না রূপক।   
 
'আলু পরাঠা আর আচার আছে সাব নাস্তায়। চা দিব?'
ম্যানেজার করণ রাইয়ের বৌ পদমা। রূপকের রান্নাঘরের দায়িত্ব আজ থেকে তার। এতদিন সে ছিল নীলের সহকারী। দেশ-বিদেশ, পাহাড়-সমুদ্রের স্বাদের উৎসবে সে শুধু হাসিমুখে জোগাড় দিয়ে যেত নীলকে। আজ গোটা হেঁশেল রাজ্যটাই তার। যেমন খুশি তেমন রাঁধো। 
'বাইরে দাও। লনে বসি।' 
ক্যাসেরোল থেকে বের করা গরম পরোটার ওপর মাখনের প্রলেপ পিছলে যাচ্ছে, সঙ্গে লঙ্কার আচার। সবুজ ধনেপাতা সাদা পরোটার আস্তরণে চোখের আরাম দেয়। রূপক নিজেকে নাড়া  দেয়। এমন শৈল্পিক চোখ নিয়ে আগে কখনো সে দেখেনি কোন খাদ্যসামগ্রী। পরোটার টুকরো মুখে চালান করে চোখ বুজতেই মাথায় যেন ভাজা মশলা, মাখনের মেলবন্ধনের সঙ্কেত পৌঁছয়। নীল সত্যি চলে গেল? রুক্স্যাক পিঠে গতকাল যখন বাগান থেকে নেমে নিচে অপেক্ষারত বোলেরোটায় উঠছিল ও, কটেজের লনে   দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল রূপকের, সেই ছোট্ট নীল। এক্ষুনি ছুটে আসবে। ফুঁপিয়ে কাঁদবে খুব। রূপক হাঁ করে দেখছে গাড়িটা পাকদণ্ডী ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ ছোট হচ্ছে।  
 
'জাস্ট পৌঁছলাম। রুম পেয়ে গেছি। চণ্ডীগড়ের একটা ছেলের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। প্রোডাকশনের ছেলেরা ডাকছে। লাঞ্চ দেবে তারপরেই মিটিং ডাইরেক্টরের সঙ্গে। কাল পসিবলি দেখা করবেন জাজেরা।'  
 
নীল খুব উত্তেজিত। ফোনের ওপারে তার উচ্ছল কন্ঠস্বর পাহাড়ি ঝোরার মতো বয়ে চলেছে। রূপকের কান অব্দি কিছুটা পৌঁছলেও বাকিটা অনেক দূর থেকে ভেসে আসা পাহাড়ি গানের মতো শুধুমাত্র রেশ রেখে যাচ্ছে। রূপক কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেল। গির্জার ঘন্টা বাজল। স্কুল ছুটি হলে যেমন বন্ধুদের ছেড়ে আবার গৃহবন্দি হওয়ার মনখারাপ উঁকি দেয় ঠিক তেমনই একটা অনুভূতি রূপককে কুয়াশার মতো ঘিরে ধরছে।  
 
‘সাব!’ করণের ডাকে রূপকের তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাটা কাটল। এক্ষুনি একবার ফ্যাক্টরির দিকে যাওয়া দরকার। জীবনে অনেক সময় নষ্ট করেছে রূপক। বহুবছরের কাঠখড় পোড়ানোর ফল তার এই ‘ব্লু হেভেন টি গার্ডেন।’ পরিবার, সমাজ, সংসার আরো কত কী বলি দিয়েছে রূপক শুধুমাত্র আত্মতুষ্টির জন্য। গোর্খাল্যান্ড এর দাবি, ধর্মঘট, অনশনে অভ্যস্ত পাহাড়ি মানুষদের বাগে আনতে রূপকের চেষ্টার অন্ত নেই। এখন এই একশো আশি পরিবারই রূপকের আত্মীয়। এটুকু যে তাকে ধরে রাখতেই হবে অনেক কিছুর মতো। ক্রিপ্টোমারিয়া জাপানিকা বা ভিনদেশি পাইন ওরফে ধুপিতে পাহাড় ছেয়ে গেলেও রূপক এখনো কিছু বার্চ, ওক, ম্যাগ্নোলিয়া  বাঁচিয়ে রেখেছে ফ্যাক্টরির পাশে। যেভাবে বৃদ্ধ পরিজনদের বাঁচিয়ে রাখার অদম্য চেষ্টায় মাতে সন্তানেরা।  
 
পাহাড়ে এখন পর্যটকদের ভিড়। সিটং-এ এখন কমলালেবুর সময়।  বাগানে বাগানে মানুষের ঢল বাড়ছে। যারা   ভিড় থেকে পালিয়ে সামান্য নির্জনতা চায় তারা কেউ কেউ ভাব জমাচ্ছে রূপকের চা বাগানে। অহলদাড়ার কাছেই ছোট্ট একটা গ্রামে রূপকের বাগান। বাগানে দু’টো ফ্যাক্টরি। একটা পুরনো যেটি এখন অচল।  নতুনটিতে উন্নত মেশিনারির সাহায্যে চায়ের কচিপাতাকে প্রসেসিং করে পানীয়যোগ্য করে তোলা হয়। তবে  পুরনোটিকে রূপক নির্বাসন দিতে পারেনি। তৈরি করেছে মিউজিয়াম। ব্যবস্থা আছে টি টেস্টিং-এর। কিছুদিন আগে সামান্য কেক, বেকারি সামগ্রীরও ব্যবস্থা ছিল নীলের সৌজন্যে। দিনের বেলা ভেসে আসত লোভনীয় সব সুবাস, ভ্যানিলার হাতছানি। খুব কম লোকই জানে এই মিউজিয়াম তথা কাফের কথা। ভুলপথে যারা চলে আসে তাদের আতিথেয়তা করা হয়। 
 
‘নীল টিভিমা কাম গরনা গয়েকো ছা, টিভিমা দেখাউনেছু’। 
ফ্যাক্টরির আনাচেকানাচে নীলকে নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। রূপক সামনে এলেই চুপ সবাই। নীল টিভির কোন চ্যানেলের জন্য কাজ করতে গেছে, ওকে দেখাবে খুব শিগগিরি টিভিতে। এসব ফিসফাস  এড়াতে চাইলেও রূপক বারবার জড়িয়ে পড়ছে সেই মায়াজালে। কিছুটা কাজকর্ম সেরে পাহাড়ের ধাপে মেয়েদের কাজ দেখতে দেখতে নীচের ভাঙাচোরা রাস্তায় অজান্তেই সে নেমে যায়।   
 
২)
'চুনো মাছের টক আর ডাল দিলাম। বাজার তো করলে না'।
সন্ধ্যা অভিযোগটুকুও জোর দিয়ে করে না। সাহস সঞ্চয় হলেও তার কন্ঠ বেইমানি করে। মিনমিন করে সারে তার বক্তব্য।  
'সারাক্ষণ বিরক্ত কোর না তো। অফিসে বেরনোর সময়ই এসব মনে পড়ে নাকি? সন্ধেবেলা কি গাঁজা টানো?' 
 
সন্ধ্যা কথা বাড়ায় না। চাঁদের মতো অমাবস্যা রাতের আড়ালে সরে যায়। নীলকে তৈরি করতে গেলে নীলের পছন্দ হয় না, মায়ের এই গ্রাম্য হাতে তার চুলের পরিপাটি নষ্ট হয়। মাথা সরিয়ে নেয় ঝটকা মেরে। রূপক আবার গর্জে ওঠে। 
'আমার পেছন ছেড়ে আবার ওর পেছনে পড়লে কেন? বাপের বাড়ি থেকে শিখিয়ে পাঠিয়েছে? যাও রান্নাঘরে।’
বাইকে স্টার্ট দিয়ে নীলকে বসিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল রূপক। অভুক্তের মতো পড়ে রইল সন্ধ্যার দু’ চোখ। সামান্য বালির দানা যেন চোখে বিধে গেল। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ ডলছে ঘন ঘন।
'রূপক ছোট থেকে অমনই, তুমি অ্যাদ্দিন ঘর করছ, জানোই তো। এই গ্রামে ওর মতো পড়াশুনোয় কেউ ছিল না যে। কতো বড়ো চাগরি করে ভাবো তো। গ্রামের সব্বাই আমাদের কতো মানে দেকেছ? ওই রূপকের জন্যই তো। তুমিও মানিয়ে নাও, মনখারাপ কোর না।' 
সন্ধ্যার শাশুড়ি সবসময়ই সান্ত্বনা দেন। রূপকের ভয়ে ওঁরাও গুটিয়ে থাকেন যে। রূপকের  মেজাজের আগুন  থেকে কেউই ছাড় পায় না নীল ছাড়া। ক্লান্ত পোড়া দাগ নিয়ে একে অপরকে সান্ত্বনাটুকুই দিতে পারে। নীলকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে রূপক অফিস পৌঁছল। পানাগড়ে একটি বেসরকারি সংস্থায় অ্যাকাউন্টেন্টের কাজ করে  সে। নাচন গ্রাম থেকে বাইকে আসতে প্রতিদিনই এক ঘন্টার ওপর লেগে যায়। গ্রামের বেশিরভাগই চাষ অথবা দোকানদারি, ব্যবসাপাতি করে। বেশিরভাগই অর্ধশিক্ষিত অর্থ বা ইচ্ছের অভাবে। রূপক সেখানে মাস্টার্স করা ছাত্র। পড়াশোনায় ভালো ছিল বলে রূপকের বাবা ভূপতিবাবুও কার্পণ্য করেননি। ঈশ্বরের কৃপায়  বেশ কয়েক বিঘে জমি, জায়গা, বাড়ি আছে তাদের। ইউনিভার্সিটির পাঠ চুকিয়ে চাকরিটাও জুটিয়ে ফেলেছে সে। খুব আহামরি কিছু নয়। কিন্তু রূপকের ঠাটবাটে তা বোঝা দায়।   
 
'স্যর ডাকছেন রুমে'। 
ঢুকতেই বেয়ারা রাজেনের সঙ্গে মোলাকাত। মেজাজটা খিচড়ে গেল রূপকের। ছোট্ট করে খিস্তি দিয়ে বিরক্তি  প্রকাশ করল। বাকি টেবিলের সকলেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। প্রকাশ্যে সিনিয়রকে গালিগালাজ, সবাইকে হেয় করা, একজনের নামে অপরজনকে কানভরা, লোকের পেছনে লাগা- এসবে রূপক সিদ্ধহস্ত। অফিসে কেউই তেমন পছন্দ করে না রূপককে। সকলেরই ইচ্ছে, ঊর্ধ্বতন ওকে শাস্তি দিক। 
 
'একটু দেরি হয়ে গেল স্যর, অনেকটা পেরতে হয় তো, আমার এরকমই হবে ঢুকতে'। 
রূপক যেন ফিরিস্তি নয় নিজের সিদ্ধান্ত জানাচ্ছে।
'সে তো রোজই, এ আর নতুন কী। তবে তোমার জন্য তো আলাদা নিয়ম হবে না ভাই। যাইহোক ডেকেছিলাম অন্য ব্যাপারে, তুমি নাকি সুদের কারবারি করো? তা করতেই পারো। কিন্তু কোম্পানির হিসেবে কিছু গরমিল দেখা যাচ্ছে। কোম্পানির টাকা খাটাচ্ছ না তো? খুব শিগগিরি অডিট করব, তৈরি থেকো।' 
কোম্পানির এম ডি রজতবাবু আগে কোনদিন এইভাবে কথা বলেননি রূপককে। রূপকই বরং যেটুকু সম্মান না দেখালেই নয় সেটুকু ছাড়া পাত্তাই দেয়নি। নিমেষে রূপকের মাথায় আগুন জ্বলে গেল।
'হ্যাঁ হ্যাঁ সবাই মিলে আমার পেছনে লাগুন। আপনাদের আর কোন কাজ নেই তো। ভেতরে ধরণীবাবু সারাদিন পেপার উলটে পঞ্চান্ন হাজার নিয়ে যায়। সেসব দেখতে পান না। আমি খাটছি তা দেখতে পান না। আমায় চোর বানাতে এসেছেন? জানেন আমি কোন গ্রামের ছেলে? এক্ষুনি ছেলে ঢুকিয়ে না সব তছনছ করে দেব।' 
 
'বেরিয়ে যাও অফিস থেকে!'
রজতবাবু উত্তেজিত। রূপকেরও তখন মারাত্মক আস্ফালন।  
'আপনার অমন চাকরিকে লাথ মারে রূপক সামন্ত, আমার যা জমিজায়গা আছে এরকম চারটে কোম্পানি কেনার ক্ষমতা রাখি। কাজেই মুখ সামলে'। 
পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাওয়ার আগে, সবাই মিলে রূপককে এম ডি রুম থেকে বের করে আনল। রূপক কাউকে তোয়াক্কা না করে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে। 
এতবছর পর পাইনের ফাঁকে লেগে থাকা মেঘ দেখতে দেখতে অতীতের কঙ্কাল ছবিগুলো আবার কেন ভেসে আসছে কে জানে। তেইশ বছর আগের রূপক আজকের রূপকের অচেনা। অভিযোগ মিথ্যে ছিল না, তবে ধরা পড়ে যাওয়ার অপমানে সারাদিন ক্লান্ত, শ্রান্ত পালিয়ে বেড়ানো লোকটা যখন নীলকে নিতে স্কুল গেল তখন নীলের মুখোমুখি হতে পারছিল না ও। তাও দমল না। একটা কাপুরুষ, লম্পট লোকের দংশন শুরু হল সন্ধ্যা ও মা বাবার ওপর। সুইসাইডের ভয় দেখিয়ে সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে, সকলের অলক্ষ্যে সেসব বিক্রি করে তিনটে অসহায় মানুষকে গ্রামে ফেলে রেখে নীলকে নিয়ে পালিয়েছিল পাহাড়ের অজানায়। পরের লড়াইটা  আরও দীর্ঘ ছিল। দাঁতে দাঁত চেপে তার মোকাবিলা করতে করতে রূপকের খোলনলচে বদলে গেল। যে আক্রোশ কাউকে না মানার ঔদ্ধত্য শিখিয়েছিল সেই স্বভাবই পাহাড়ের সামনে মাথা নত করতে শেখাল। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান, সহজ সরল মানুষের সান্নিধ্য রূপককে ঘষেমেজে খাঁটি সোনা বানিয়ে ফেলল। কিন্তু ততদিনে মায়ের আত্মহত্যার খবর এসেছে, শয্যাশায়ী বাবার মৃত্যুসংবাদ এসেছে, পুত্রশোকে নীরব সন্ধ্যাকে যখন রূপক নিয়ে এল পাহাড়ে তখন সন্ধের আঁচল ছেড়ে ক্যান্সারের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার দেহে। বছরখানেকেই সব মায়া শেষ। রূপকের সুযোগ ঘটেনি প্রায়শ্চিত্ত করার। 
৩)
করণ রাই সবাইকে সবার কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। কটেজ, ফ্যাক্টরি সাজানো হচ্ছে ঢেলে। মেয়েরা পদমার পরিচালনায় পাহাড়ি মোমো, থুকপা, সেফালে, মুরগির চাটনির আয়োজনে ব্যস্ত। সব মিলিয়ে জনা তিরিশেক লোক আসছে। রূপক পরিচিত সব হোটেল বুক করেছে। ডিরেক্টর, জাজ, নীল আরও কয়েকজন কটেজেই থাকবে অবশ্য। পর্দা থেকে কাপ-প্লেট সব বদলাচ্ছে। রূপক নিজে সব খতিয়ে দেখছে। নীল চলে যাওয়ার পর  একটা জগদ্দল পাথর বয়ে বেড়াচ্ছিল রূপক। বারবার মনে হচ্ছিল নীলকে তো কখনো বঞ্চিত করিনি। সন্ধ্যা  যেক’দিন ছিল, নীল নিজে হাতে রেঁধে খাওয়াত সন্ধ্যাকে। রান্নার প্রতি কী যে ঝোঁক ছেলেটার। দেশবিদেশ ঘেঁটে শুধু উপকরণ জোগাড় তারপর তার নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা নিয়েই থাকত। সন্ধ্যা মারা যাওয়ার পর পড়াশোনাটা একদম ছেড়ে দিল। শত চেষ্টা করেও রূপক ওকে বইমুখো করতে পারল না। প্রতিযোগিতা, শো এসব করতে প্রায়ই উদ্বায়ী বস্তুর মতো হারিয়ে যেত নীল। রূপক তখনই প্রমাদ গুণত। একেবারে শিকড় উপড়িয়ে পালাবে নাতো ছেলেটা? তার ভাবনা অমূলক ছিল না। নীল মুম্বাই চলে গেল। টিভি চ্যানেলে প্রচারিত কুকিং শো’য়ে অংশগ্রহণ করতে। রূপক ভীষণভাবে আটকানোর চেষ্টা করেছিল। ও জানত, নীল আর ফেরার  রাস্তা রাখছে না। নীল নাকি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। রূপক অভিমানে দেখেনি কোন পর্ব। কিন্তু পাহাড়ে পাহাড়ে নীলের প্রশংসার প্রজাপতি ফড়ফড় করে উড়ে বেড়াচ্ছে টের পায়। কখনো স্থানীয় টিভি চ্যানেল, কখনো  মিডিয়া এসে ভিড় জমাচ্ছে বাগানে। করণই সামলাচ্ছে যদিও সবটা। রূপকের মনের জমাট কালো মেঘটা কি সরে যেতে চাইছে? মেঘ কাটল। নীল জানালো ওরা রূপককে নিয়ে একটা এপিসোড করতে চায়। নীলের বাবার একটা ভূমিকা আছে নীলের শেফ হয়ে ওঠার পেছনে। ওরা সেটা নিয়ে গল্প বলতে চায়।  
সারাজীবন সবাইকে সন্দেহ করেছে রূপক। কেউ ওর ভালো চায় না, এটাই ধ্রুবসত্য। বাবা, মা সন্ধ্যা সবাই ঘৃণার পাত্র। ঘুরপথে বেশি টাকা রোজগার করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার খেলায় অন্যায় পথ বেছে নিয়েছে। ধরা পড়ে যাওয়ার পরেও মানসিক অত্যাচারে পরিবারের মানুষগুলোকে জর্জরিত করেছে।  পাহাড় যখন মনের কলুষতা নিংড়ে এক অন্য রূপকের সন্ধান দিল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সন্ধ্যাকে ফেরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে তখন। তবু ভেবেছিল এই গারো, খাসি সারল্যে মাখা হাসিমুখগুলো আর  কচুরি, নীলই নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে দেবে। কিন্তু নিজের অংশই যখন নাড়ি ছিঁড়ে মুক্ত হতে চাইল, তখন রূপকের আশা আকাঙ্ক্ষা মেঘের দলে মিশে চেনা পাহাড় ডিঙিয়ে দূরের কোন পাহাড়ে ভাব জমালো। রূপক তাদের আর খুঁজে পেত না। কিন্তু না, প্রতিবারের মতো এবারও রূপক ভুল প্রমাণিত হল। নীল যে তার  বাবারই অংশ সেটা সারা দুনিয়াকে জানাতে চায়। রূপক আজ কানায় কানায় পরিপূর্ণ। ব্লু হেভেনে সত্যি স্বর্গ নেমে এসেছে। একা রূপক নয়, গোটা গ্রাম মেতেছে এ উৎসবে। 
 
মেকাপম্যান রূপককে টাচআপ দিচ্ছে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে ওর। নীল সেই ছোট্টবেলার মতো চোখে দুষ্টুমি ভরে মিটিমিটি হাসছে। ডিরেক্টর রাহুল শর্মা এলেন। 
 
‘ওকে! মিস্টার সামন্ত? আপ রেডি হ্যায়?’
‘ইয়েস স্যর’। 
রূপকের লজ্জা লাগছে। তাহলেও নীলের জন্য আজ নিজেকে সমর্পণ করতেই হবে।
‘সরোজ প্লিজ ব্রিফ কর দো’।  
সরোজ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। বাঙালি করিতকর্মা ছেলে। 
“স্টোরিটা এরকম হবে, আপনি নীলের জীবনে সবচাইতে বড়ো শত্রু। ওর এই কেরিয়ার, ওর  নামডাক,  আপনি এসব কিচ্ছু চান না। ওর এই প্রতিভাকে আপনি কোনদিন শারীরিক তো দূরের কথা মানসিক সমর্থনও করেননি। নিজের জেদে ও পৌঁছেছে। আপনিও জেদি। অনড়। অপছন্দ নীলের এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ!” 
 
রূপকের শব্দেরা হারিয়ে যাচ্ছে। নীল চকচকে লোভী চোখে তাকিয়ে আছে রূপকের দিকে। ঠিক যেমন করে রূপক জমির দলিলপত্র দানের কাগজে বাবা মায়ের সই করার সময় তাকিয়েছিল। নীল যেন রূপকেরই আয়না।
“কাম অন বাবা। পাবলিক এরকম স্টোরি দারুণ খাবে, আমার পর্বগুলো খুব জনপ্রিয় হবে, চ্যানেলের টিআরপি  আমার জন্য যদি বাড়ে তাহলে আমিই জিতে যাব এই প্রতিযোগিতা। জাজদের সেরকমই ইন্সট্রাকশন দেওয়া আছে। আমাদের চা বাগানের সিনিক বিউটি তার সঙ্গে আমার ভিলেইন বাবা, দুর্দান্ত কম্বিনেশন। ডিরেক্টর  যখন আমায় বললেন, আমি বলেছি আমার বাবা আমার জন্য সব করতে পারে’। 
 
রূপকের মতোই ধূর্ত চেহারা নীলের। পৃথিবীর কোন দর্পণই আজ পর্যন্ত রূপককে রূপকের সঠিক ছবিটি  দেখাতে পারেনি। আজ সব পাহাড়ি ঝলমলে সকালের মতো পরিস্কার। এমন বিশুদ্ধ পরিবেশেও চারিদিকে ম্যানহোলের ঢাকনা সরে যাওয়া দুর্গন্ধ। বাবা, মা, সন্ধ্যারা যেন আজ ভারি তৃপ্ত।   
 
রূপক দু’ হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। ভেতরে ভেতরে খুঁজে চলে সেই দুর্গম পর্বতমালা যেখান থেকে ছোট হতে হতে বিন্দুর মতো মিলিয়ে যাওয়া যায়। শ্বেতবিন্দু। যার বিষাক্ত অতিবেগুনি রশ্মিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়েছে চিরতরে।   

বৈশাখী ২০২৪