পেটপুজো

ভবানীপুর, কলকাতা

'পুজো'....! ধূপ-ধুনো, নতুন পোশাক - আনন্দ ছাড়াও পুজো মানেই 'পেটপুজো'। তা সে দুর্গাপুজোই হোক বা অন্নপূর্ণা পুজো বা লক্ষ্মী পুজো বা সরস্বতী পুজো বা জগদ্ধাত্রী পুজো। যে কোনো দেবদেবীর আরাধনা 'ভোগ' নিবেদন ছাড়া অসম্পূর্ণ। বিভিন্ন অভিজাত বনেদি পরিবারের বিশিষ্ট কুলদেবী বা কুলদেবতার পুজোয় এক অথবা একাধিক খাদ্যদ্রব্য নিবেদন করা হয় 'ভোগ' হিসেবে। এই যেমন আমার নিজের বাড়ির কথাই বলি না কেন, ঘটি পরিবারে জন্ম হবার দরুন ছোটো থেকে একটা সময় পর্যন্ত দেখে এসেছি আমাদের বাড়িতে বছরে চারটে 'লক্ষ্মীপুজো' হত। ভাদ্র, পৌষ বা  চৈত্রের লক্ষ্মীপুজোয় বিশিষ্ট কিছু পদ থাকলেও খুব ঘটা করে সে পুজোগুলি হত না। তবে কার্তিকী অমাবস্যার দিনে, অর্থাৎ কালীপুজোর রাতে আমাদের বাড়িতে অলক্ষ্মী বিদায়ের পুজো জন্মাবধি ঘটা করেই হতে দেখে আসছি। আট রকমের ভাজা (শাক, বড়ি, আলু, বেগুন, পটল, বিনস, ফুলকপি, কুমড়ো), পাঁচ রকম ব্যঞ্জন বা তরকারি (বাঁধাকপির ঘন্ট, আলু পটলের দম, থোড়, মোচা, পনির) তো থাকবেই। তাছাড়া  যে দুটি পদ বরাবর দেখতাম, তার একটা নিরামিষ পটলের দোলমা আর পটলের মুড়িঘন্ট। এর ওপর আবার আলু-কড়াইশুঁটি-ফুলকপি দিয়ে খিচুড়ি, লুচি আর শেষ পাতে খেজুর-আমসত্বের চাটনি, গোবিন্দভোগ চালের পরমান্ন এবং মিষ্টি! কাঁসার থালা আর নানান রকম ছোটো বড়ো কাঁসার বাটিতে সাজিয়ে, কাঁসার গ্লাসে জল পরিবেশন করে ঠাকুরকে ভোগ নিবেদন করা হত।

আমাদের যৌথ পরিবারে প্রথা মেনে ভোগ রান্নার দায়িত্ব আমার ঠাকুমা তাঁর জা-কে নিয়ে পালন করতেন। তাঁরা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করার পর আজ আর বছরে চারটে লক্ষ্মীপুজোও হয় না, ভোগেও এসেছে বদল। তবুও আজও টিকে আছে অলক্ষ্মী বিদায়ের পুজোটি, সেইরকম ঘটা করেই। তবে ভোগের থালায় পটলের মুড়িঘন্ট বা পটলের নিরামিষ দোলমা আর হয় না, সেও প্রায় বছর পনেরো কি তারও বেশি হল। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, থোড়-মোচাসহ ঐ দুটি বিশেষ পদের যে স্বাদ আমাদের পরিবারের কুলদেবী 'মা লক্ষ্মী' গ্রহণ করেছিলেন, সেই স্বাদ যদি মা-কাকিমাদের হাতের রান্নায় না পেয়ে দেবী কুপিত হন, সেই ভয়ে ঐ পদ গুলি বাদ রাখা হয়।

"তা সে না হয় হল, তাই বলে কি আমাদেরও খেতে নেই!" এসব বায়নাক্কা দিয়ে পটলের দোলমা আর পটলের মুড়িঘন্ট (এখন যেটাকে আমরা নাম দিয়েছি 'চাল পটল') আবার চালু করা হয়। তবে সত্যিই সেই স্বাদ পাই না, সে স্বাদ রান্নাদুটি থেকে বিলুপ্ত হলেও বড় ইচ্ছে করল এদের রান্নার প্রণালী জানাতে।

পটলের মুড়িঘন্ট :

সাধারণত মা'কে যেভাবে করতে দেখেছি, সে প্রণালীটাই জানালাম। প্রথমে পটল ভালো করে ধুয়ে হালকা করে খোসা ছাড়িয়ে দুটো মুখ কেটে মাঝখানে সামান্য চিরে নুন-হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে। এবার কড়াইতে সর্ষের তেল গরম করে ঐ পটল ভালো করে ভেজে তুলে নিতে হবে। আমার মা কড়াইতে ঐ একবারই মেপে তেল দেন (মাপ বোঝেন কী করে তা অবশ্য জানি না)। ঐ অবশিষ্ট তেলেই গোবিন্দভোগ চাল হালকা ভেজে নিতে হবে। যেহেতু গোবিন্দভোগ চাল রান্না করলে পরিমাণে খুব একটা বাড়ে না, তাই এই রান্নাটি অনেকেই বাসমতী চালে করে থাকেন। তবে কিনা গোবিন্দভোগ চালের স্বাদ আলাদা।

যাক সে কথা, এবার চাল তুলে নিয়ে ঐ তেলেই দারচিনি, এলাচ, তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা, লবঙ্গ দিয়ে একটু গন্ধ বেরোলে আদাবাটা দিতে হবে। বাজার চলতি আদার পেস্ট বা আদাগুঁড়ো নয় কিন্তু, একেবারে গোটা আদা বেটে নিয়ে দিতে হবে পরিমাণ মত। আমার মা দশ-বারোটা পটল এবং আড়াই মুঠো চালের ক্ষেত্রে এক টেবিল চামচের একটু বেশি আদা বাটা দেন। গন্ধ বেরোলে বড়ো একটা টম্যাটোর অর্ধেক বেটে দিয়ে দিতে হবে। হলুদগুঁড়ো, জিরেগুঁড়ো, বাটা কাঁচালঙ্কা স্বাদমতো, কাজুবাদাম, কিসমিস এবং নুন চিনি দিয়ে কষে নিয়ে ভেজে রাখা চালটা দিয়ে মিনিট দুয়েক নেড়ে কষিয়ে জল দিতে হবে। চাল ফুটলেই পটলগুলো ছেড়ে দিতে হবে। আঁচ কমিয়ে নিতে হবে। জল শুকিয়ে তেল ছাড়লেই ওপরে ঘি ছড়িয়ে গ্যাস বন্ধ করে দিয়ে একটু ঢেকে রেখে নামিয়ে নিতে হবে। গরম গরম পটলের মুড়িঘন্ট তৈরী। চাইলে এক্ষেত্রে সাদা তেল ব্যবহার করাই যায়, তবে কিনা আজন্মকাল ঠাকুমা সব রান্নাতেই সর্ষের তেল ব্যবহার করতেন এবং তার সঙ্গে সমস্ত মশলা শিলে বেটে রান্নায় ব্যবহার করতেন বলেই শুনেছি।

পটলের নিরামিষ দোলমা :

এবার যে রান্নাটির কথা বলব, তা কেবলমাত্র আমাদের পরিবারেই নয়, বহুযুগ কোনো নিমন্ত্রণবাড়ি বা কোনো বিয়েবাড়ির মেনুতেও খাইনি। অথচ এককালে বাঙালি পরিবারের 'সাবেকি' রান্না হিসেবে এই পদটি স্বীকৃতি পেয়েছিল। শুনেছি, শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোতেও অন্তত একদিন মায়ের ভোগে এটি থাকত। নারকেল আর খোয়াক্ষীরের পুর দিয়ে তৈরী হতো নিরামিষ পটলের দোলমা। আমাদের বাড়িতে যখন এই পদটি এককালে হত, তখন পটল ভাজা হয়ে গেলেই সেগুলো লুকিয়ে ফেলা হত! নাহলে যে সব শেষ হয়ে যেত 'চেখে' দেখার নামে। না..! আর গৌরচন্দ্রিকা না করে চলে আসি রান্নায়।

প্রথমেই বলে রাখি এই রান্নায় অনেকেই পনির বা ছানা ব্যবহার করে থাকেন, কিন্তু আমাদের বাড়িতে এই দোলমাতে খোয়াক্ষীরের ব্যবহার হত। আমার বাবার ঠাকুমাও তাই করতেন বলেই শুনেছি। ফলে পারিবারিক রান্নার সময় ছানা ব্যবহার হলেও পুজোর থালায় দেওয়ার সময় খোয়াক্ষীর দিয়েই বানানো হত।

একটু মোটা পটল ভালো করে ধুয়ে একটা ছুরি দিয়ে পটলের গা ভালো করে চেঁচে নিতে হবে। এবার পটলের মুখের দুদিকের একদিক কেটে একটা চামচ দিয়ে পটলের ভেতরে থাকা সব দানা বের করে নিয়ে পটলগুলো আবার ধুয়ে সামান্য নুন ও হলুদ দিয়ে মাখিয়ে রাখতে হবে।

একটা বড়ো নারকেলের যদি পাওয়া যায়, তাহলে থালায় নারকেলটা কুরে নিয়ে ওর সঙ্গে গুঁড়ো করে রাখা খোয়াক্ষীর ভালো করে মিশিয়ে ,আদাবাটা , লঙ্কাবাটা , এক চা চামচ জিরে গুঁড়ো , এক চা চামচ কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো, স্বাদমতো গরম মশলা গুঁড়ো, নুন এবং চিনি দিয়ে ভালো করে হাত দিয়ে মিশিয়ে নিতে হবে। মাখলে চলবে না, অর্থাৎ ঝুরঝুরে থাকবে। এবার কড়াইতে এক চা চামচ সরষের তেল দিয়ে গরম হলে ঐ পুরটা দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিতে হবে। কাজু কিশমিশ দিয়ে আবারও নেড়েচেড়ে মিশিয়ে নিতে হবে। এবার পুর তৈরী হয়ে গেলে তা নামিয়ে একটা পাত্রে ছড়িয়ে ঠান্ডা হতে দিতে হবে।

তারপর কড়াইতে চার টেবিল চামচ সরষের তেল দিয়ে ভালো করে গরম করে তাতে পটলগুলো দিয়ে ভেজে নিতে হবে। আগে থেকে তৈরী করে রাখা নারকেলের মিষ্টি পুরটা পটলের ভেতর ভরে দিতে হবে। এইটুকু স্পষ্ট মনে রয়েছে।

পরের পদ্ধতি মা যেভাবে করে সেটাই বলি (যদিও এখন কালেভদ্রে হয় এবং হলেও ক্ষীর নয় ছানা দিয়েই হয়)। একটা বাটিতে দুই চা চামচ কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো , এক চা চামচ জিরে গুঁড়ো , এক চা চামচ ধনে গুঁড়ো , দেড় চা চামচের একটু বেশি হলুদ গুঁড়ো ও সামান্য একটু জল দিয়ে ভালো করে গুলে নিতে হবে। কিছুটা ভাঙা কাজু , চারটে চেরা কাঁচা লঙ্কা, এক টেবিল চামচ টকদই মিক্সিতে ভালো করে বেটে একটি পেস্ট তৈরি করে নিতে হবে।

কড়াইতে দুই টেবিল চামচ তেল থাকা চাই। না থাকলে আগের বেঁচে যাওয়া তেলে আরেকটু সরষের তেল দিয়ে ভালো করে গরম করে নিতে হবে। গোটা জিরে, দু'টো  তেজপাতা, তিনটে ছোট এলাচ,  দু'টো দারচিনি, চারটে লবঙ্গ ফোড়ন দিয়ে ভালো করে একটু ভেজে নিতে হবে। এরপর আধ চা চামচ চিনি দিয়ে দিতে হবে। বাটিতে জলে গুলে রাখা মশলার পেস্টটা দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিতে হবে। তেল ছেড়ে এলে তাতে কাজুবাদাম ও দই এর পেস্ট দিয়ে আবার ভালো করে মিশিয়ে আরও কিছুটা সময় নিয়ে কষতে হবে। এবার স্বাদমতো নুন দিয়ে আর আধ কাপ উষ্ণ গরম জল দিয়ে কিছুক্ষন ফুটিয়ে পটলগুলো দিয়ে দিতে হবে। এরপর ঢাকা দিয়ে অল্প আঁচে তিন চার মিনিট রান্না করে নামানোর আগে ঘি ও গরমমশলা দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে মিশিয়ে নামিয়ে নিলেই তৈরি নিরামিষ ‘পটলের দোলমা’।

হোক না স্বাদের তারতম্য, হয়ত আমাদের জেনারেশন যখন পুজোর দায়িত্ব পাবে, তখন এই স্বাদও আর থাকবে না! সময়ের অভাবের কারণে একেবারেই বিলুপ্ত হবে এই রান্না। তাই চেষ্টা করলাম প্রণালী জানিয়ে রান্নাটিকে টিকিয়ে রাখার। মাছ পটলের দোলমা তো সবাই জানেন। একবার না হয় বাড়িতে অতিথি এলে এইভাবেও পটল রান্না করে দেখুন।

বৈশাখী ২০২৪