কে যেন দরজার কড়া নাড়ছে, তন্দ্রা ছুটে যায় দিয়ার, আলগা ঝটকায় জোর করে নিজের নিঃসীম ক্লান্ত অবয়বটা চৌকি থেকে টেনে তোলে, শাড়ির বিস্রস্ত আঁচলটা ঠিক করে নিতে নিতে ছিটকিনি খুলে দরজাটা একটু ফাঁক করে বাইরে উঁকি মারে। গণেশ দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়, চোখে ওর অজস্র প্রশ্ন। হবেই তো, গত শুক্কুরবার ভোরবেলাতে কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে সেই যে হোস্টেল থেকে অদৃশ্য হয়েছিল দিয়া, আজ চার দিন বাদে, চুপিসারেই আবার তার প্রত্যাবর্তন, ঠিক যেন এক ধূমকেতু! “কখন এলেন দিদিমণি? একবারটি তো জানাবেন, আমি যে এদিকে চিন্তা করে করে সারা!” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দিয়াকে কয়েক পলক ভালো করে দেখে সে, কী বোঝে কে জানে! তারপর কাঁধের ঝোলা থেকে সযতনে বের করে আনে বিদেশি স্ট্যাম্প মারা একটা খাম; বলে, “এটা গতকাল বিকেলের ডাকেই এসেছে!” খামটা দেখেই দিয়ার বুকটা ধক করে ওঠে, গণেশের হাত থেকে প্রায় ছোঁ মেরেই সেটা তুলে নেয় সে। “নীল দাদার কাছে আপনার কবে যাওয়া দিদিমণি?” আলতো করে শুধোয় গণেশ, “আপনার এখানকার লেখাপড়া শেষ হতে কি আরও অনেক দেরি আছে?” কোনো উত্তর করে না দিয়া, চোখ নিচু করে নখ খোঁটে, গলার কাছটায় এখন শুধু দলা দলা ব্যাথা। আর কিছু না বলে, গণেশ হাঁটা মারে। দরজা বন্ধ করে, খাম হাতে, পায়ে পায়ে, চৌকিতে এসে বসে দিয়া। এই কয়দিন যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে ওর জীবনে! কোথা থেকে কী হয়ে গেল, ও জানে না, বোঝে না, মানতেও পারে না। নতুন কুটুমেরা এত তাড়াতাড়ি আসতে কি দেয়? রীতিমতো ঝামেলা করেই, গতকাল সন্ধের ট্রেন ধরে, প্রায় এক কাপড়ে চলে এসেছে, রাতভর জেগেই ছিল ও। পরম আদরে খামের ভিতর থেকে নীলের চিঠিটা বের করে আনে দিয়া। `আমার দিয়া সোনা, নিউইয়র্কের সাবওয়েতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি, একটা কালো ছেলে আমার পাশের সিটে ঘুমোচ্ছে, ওর মাথায় বাঁধা লাল ব্যান্ডানা, তারই ফাঁক দিয়ে ঝাঁকড়া চুল কপালে খেলে বেড়াচ্ছে, আমার কোলে খোলা, তোমারই দেওয়া বিভূতিবাবুর আরণ্যক, চোখের সামনে লবটুলিয়া বাইহার, এই ভবঘুরে মন তোমায় চাইছে, কবে তুমি আসবে? কোন সে সূর্য্প্রাতে? সেদিন``কণ্ঠে তোমার পড়াব বালিকা/ হংস-সারির দোলানো মালিকা!’ অঝোরে জল ঝরছে দিয়ার ভ্রমর-কালো চোখ দুটি বেয়ে। সামনের দেয়াল-আয়নায় ফুটে ওঠা ওরই ঝাপসা মুখ, ঘন কালো চুলের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা, সদ্য নতুন চিলতে সিঁদুর-চিহ্নটা বড় হতে হতে, কী বিষম আগ্রাসে এখন দ্রুত ঢেকে ফেলছে দিয়ার মুখ, শরীর, মায় গোটা অস্তিত্বটাই।