এ আমাদের সেই অনেককাল আগের বিবেকানন্দ রোডের ওপর পাঁচমহলা বাড়ির রান্নাবাটির গপ্পো। সেই যে, যেই সময়ে বাবার ঠাকমা, জাঁদরেল বুড়ি, তিলথুবড়ি চুলের নুড়ি খোঁপা বেঁধে এ মহলা থেকে সে মহলা দাপিয়ে বেড়াতেন, সেই তেনার রান্নাঘরের রান্না। আমাদের বাড়ির প্রতিটি রান্নার বেশ একটি করে জব্বর নাম ছিল আর ছিল সেই রান্নার এক জবরদস্ত ইতিহাস। তা সেদিন হয়েছে কি, সব্জিপাতি কিঞ্চিৎ কমসম রয়েছে ঘরে। কারণ পরদিন রবিবার। বাবার দাদু মাখনলাল বেশ করে ধুতি ফতুয়া বাগিয়ে বাজারে যাবেন, এক গাড়ি বাজার করতে। তাই আজ ওই যা আছে তা দিয়ে নৈশভোজ তৈরি করতে বলবেন ঠাকমা নৃপেন্দ্রবালা। মাঝে মাঝে বিরক্তি ধরে বৈকি নৃপেন্দ্রবালা দেবীর। ছোট ছেলে আলোকলাল বাদে আর সব ছেলেপেলেদের বিয়েথাওয়া দিয়ে ভরভরন্ত সংসার। নাতি নাতনি আণ্ডাবাচ্চা, এই এতগুলিl তা সব্বাই খেতে বসবে তো। পাঁজা পাঁজা রুটি বানিয়ে তুলবে বুড়ো কালীচরণ, হরিয়া আর বৃন্দে ঝি। তা সে না হয় হল, কিন্তু ঘরে আছে বেশি বেশি বেগুন আর ডজন ডজন ডিম। তা তাই দিয়ে কী রান্না হবে বল দি’নি! নৃপেন্দ্র নথ নাড়া দেন, হাতের ঝিলিক দেওয়া মটর চুড়ি আঁটসাঁট করেন আর এক মুখ পান নিয়ে দুপুরের পর থেকে ভাবতে বসেন। আজ তাঁর নাটক-নভেল, মহাভারত পড়া সব চুলোর দোরে গেছে বৈকি। মশমশিয়ে পান খান আর কোলের নাতিনটিকে বাতাস করতে করতে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে থাকেন - কী রাঁধা যায়, কীই বা রাঁধা যায়! তখনই হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। অনেক আগে সোনা পিসিমার বানানো ডিম বেগুনের কথা মনে ওঠে। যেই ভাবা সেই কাজ। নৃপেন্দ্র তক্ষনি হাঁক পাড়লেন, "ওরে কে আছিস, আয় ছুটে লো!" সরমা, হরিয়া, ঠান্ডা ঝি, বসন্ত - অমনি যে যেমন পারে এসে দাঁড়াল। বুড়ি বলে ওঠেন - "কিলো দুয়েক পেয়াঁজ আদা কাটতে হবে কুচি কুচি। টমেটম আর ধনে পাতায়, সবার জেনো অভিরুচি। লঙ্কা নেবে আড়াইশো গ্রাম, বেটে, কেটে যেমন পারো, মাথা পিছু দুটি করে ডিম, খেলে পাবে দুটি আরও। তিন চার কিলো বেগুন কেটো, ফালা ফালা ইচ্ছে যেমন, বাকি যা আছে, বলবো পরে, যখন যেমন, তখন তেমন।" ও বাবা, মায়ের হলো কী? অন্যদিন তো বেশ করে বই পড়েন, ছুঁচের কাজ করেন, আর আজ যে হঠাৎ কোবতে বলছেন গা! তা ওরই মধ্যে হরিয়া একটু চালাক চতুর। সে বলে ওঠে, "তা তো বোজলাম গিন্নিমা, তা কী রান্না হবে বটে, এই এতকিছু দিয়ে?" নৃপেন্দ্রবালা তাঁর কমলা লেবুর আভা ছড়ানো গাল ফুলিয়ে বেশ করে চোখ মিটিমিটি করে হেসে নিয়ে বলে উঠলেন – "ব্রিঞ্জলিয়াম ল্যাটপেটিয়াম।" কাজের মানুষের দল বেবাক অবাক না হয়ে পারল না। তা হবে কোনো সাহেব সুবোদের রান্নাবান্না। এমনিতেই এ বাড়িতে তো স্যুপ বা সুরুয়া, কেক পুডিং লেগেই থাকে। বিকেল হতে না হতেই নৃপেন্দ্রবালা চললেন, রান্নাঘরে। এক দল নাতিনাতনি অমনি যে যার ঘুম থেকে উঠে পেছনে পেছনে চলেছে হাই হাই করে। "ও ঠাকমা, কখন খাব, কী খাব।" ঠাকমা বুড়ি, তালের নুড়ি খোঁপা বাগিয়ে ঝংকার দেন, "আরে ওরে হতচ্ছাড়া ছেলেমেয়ের দল, বলি শুকনো পেছনে আকন্দের আঠা যে লো, যা যা খেলগে যা। খাবার তো রাতে, এখন কী? এখন যা, গিয়ে মায়েদের কাছে সোনা হেন মুখ করে দুধ বিস্কুট খেগে যা সোনা মানিকরা।" ঠাকমা এবার প্রবল বিক্রমে রান্না ঘরে প্রবেশ করলেন। পেঁয়াজ কুচিয়ে, টমেটো কুচিয়ে, আদা কুচিয়ে সব প্রস্তুত। এদিকে বেগুন কাটা হয়েছে থরে থরে। ওদিকে বিশাল বড়ো ডেকচিতে ডিম ফেটানো হয়ে আছে। রোজই এ বাড়িতে যজ্ঞবাড়ির রান্নাবান্না হয়। পেল্লায় কড়াইতে তেল চাপিয়ে তাতে জিরে-শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দেন ঠাকমা। তারপর পেঁয়াজ, আদা, টমেটো বেশ করে লাল লাল করে ভেজে তোলেন। ওরে বাবা, সে কি আর এক-আধটু? একটু একটু করে বেশ বেরেস্তা করে ভেজে নেওয়া হয় পেঁয়াজ, আদা কুচি আর টমেটো। এর পর বেগুনের পালা সেই পেঁয়াজ টমেটোর সঙ্গে বেগুনের টুকরোগুলো দিয়ে ভাজা হয় আর তারপর বেগুন বেশ নরম নরম থাকতে থাকতে ডিম দেওয়া হয় আস্তে আস্তে। এরপর লবণ, লঙ্কা বাটা, হলুদ বাটা আর জিরে বাটা ইচ্ছে মতো। বেশ করে কষিয়ে নিয়ে মাখো মাখো হলে তবেই পরিবেশন করা হবে রুটির সঙ্গে। বেশ রান্না। কাঁচা লঙ্কা কুচি ছড়াতে ভোলেননি ঠাকমা। ছেলেদের আবার মুখের স্বাদে খাওয়া। আজকাল ভালো ভালো খেয়ে খেয়ে নাতিনাতনিরাও বেশ মুখের রুচিতে খেতে জানে। সবটা হয়ে যাবার পর, বেশ উঁচু কানা ওঠা কাঁসিতে ঢেকে দেওয়া হয় তরকারি খান। এরপর কুচি কুচি ধনেপাতা ছড়িয়ে টেবিলে দিলেই কেল্লা ফতে। এই রান্না নৃপেন্দ্রবালা দেবী তৈরী করতেন তাঁর বৃহৎ গাছের ডালপালাওয়ালা সংসারের জন্য। যার যেমন দরকার সে তেমন করে নেবেন আর কী। তবে মূল রান্না হবে এমন। উপকরণ : ডিম ফেটিয়ে রাখা বেগুন, ডুমো ডুমো করে কাটা পেঁয়াজ কুচোনো আন্দাজমতো আদা কুচি করা টমেটো কুচোনো ধনে পাতা কুচোনো কাঁচা লঙ্কা কুচোনো জিরে ফোড়ন শুকনো লঙ্কা ফোড়ন লবণ হলুদ গুঁড়ো বা বাটা জিরে গুঁড়ো বা বাটা লঙ্কা গুঁড়ো বা বাটা (অল্প) প্রণালী : প্রথমে কড়াইতে সর্ষের তেল গরম করে নিয়ে জিরে আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে নেড়ে চেড়ে নিয়ে পেঁয়াজ, টমেটো, আদা কুচি বেরেস্তা করে ভেজে নিতে হবে। তরকারিতে বেশ সোনা সোনা সূর্যের আভা ধরলে তখনি দিয়ে দিতে হবে কাটা বেগুনের টুকরো। লবণ, হলুদ বাটা, জিরে বাটা, লঙ্কা বাটা দিয়ে কষিয়ে নিতে হবে আরও। গন্ধ বেরোবে বেশ আর বেগুন যখন ললিতলবঙ্গলতার মতো বিগলিত হয়ে হেসে উঠবে, তখন ফেটানো ডিম ঢেলে দিয়ে বেশ করে নেড়েচেড়ে নেওয়ার পালা। এই নাড়াচাড়া যেন খুব মন দিয়ে হয় কারণ বেশ মাখোমাখো ভাব তৈরী হলে তবেই খাবার মজা আলাদা। আস্তে আস্তে তেল ছাড়তে থাকলে, বুঝবে, রান্না তৈরী। তখন আর কী, ব্রিনজেলিয়াম ল্যাটপেটিয়ামের আদরে ভাসতে ভাসতে কুচোনো কাঁচা লঙ্কা (উচিতমতো) এবং ধনে পাতা ছড়িয়ে পরিবেশন করে দেখো তো প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটে কিনা। ওহো বলতে ভুলে গেছি, আর একটু গার্নিশিং বা সিজনিং যাই বল না কেন, প্রাণঢালা ভালোবাসা কিন্তু মিশিয়ে দিতে ভুলবে না। বাবার ঠাম্মি তাই দিতেন কিনা! এত্ত এত্ত মুঠো মুঠো স্বর্গীয় ভালোবাসার মিশ্রণ, এমনি এমনি। রাতে মাখনলাল খেতে বসেই সেদিন হাঁকলেন – "বড় গিন্নি, আজ কী রেঁধেছ গো।" রুটি ছিঁড়ে তরকারি সহযোগে মুখে দিয়ে চোখ বুজে ফেললেন কর্তামশাই। "আহা অপার্থিব, স্বর্গীয়, মচৎকার। তা এ তো তোমার নিজের, একদম নিজের রান্না গিন্নি, নয়? তা কী নাম রাখলে এর?" নৃপেন্দ্রবালা চোখ বুজিয়ে আবেশে হাসলেন। বললেন – "ব্রিঞ্জলিয়াম..." বলতে না বলতেই নাতিনাতনিরা সমস্বরে বলে উঠল – "ল্যাটপেটিয়াম!"