১ মরে যাওয়া বসন্তের পলাশের রঙে কত ধুলো মিশে থাকে আজকাল। মিনুর পলাশ ভালো লাগে না। বড় আগুন-রাঙা মনে হয়। আগুন রঙের কোন কিছুই ভালো লাগে না। আগুন দেখলেই ভেতরে অস্বস্তির কাঁটা বেঁধে। আগুন দেখে মিনুর মুখের অবয়বের এই বদল চোখ এড়ায় না ছোট মার। প্রথম প্রথম পিয়ালী মানে মিনুর ছোট মা মিনুর সামনে গ্যাস জ্বালাতেও ভয় পেত। আগুনের লেলিহান শিখা যদি মিনুকে অতীত মনে করিয়ে দেয়! "ছোটমা, তুমি চিন্তা করো না। একদম ফ্রি থাকো। ব্যাঙ্গালোরে এসে আমি আর অতীত নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। কতদিন পর একটু সুখের আশায় আমরা এখানে এসেছি। আনন্দ করে থাকো।" মিনুর কথা আশ্বস্ত করতে পারে না পিয়ালীকে। মেয়েটার চোখ দুটোয় দুঃখের সামিয়ানা। হবে নাই বা কেন! জীবনটা কী হতে পারত ওর! আর কী হল! "ছোটমা! কী ভাবছো? আজ দক্ষিণী খাবার খাব রাতে। বাইরে চলো!" মিনু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। "এইতো কদিন হলো এলি। এরই মধ্যে বাইরে খাওয়াটাওয়া। সবে তো দুমাস হলে চাকরি পেয়েছিস!" টাকা নষ্ট করার কথাটা বলতে গিয়েও পিয়ালী থেমে যায়। মেয়েটার ভেতর একটা দুঃখ-পুকুর রয়েছে। তাই সবটা বলতে গিয়েও বলা হয়ে ওঠে না। মিনু তবে বুঝতে পারে। ছোটমার মুখের দিকে তাকায়। মুখের চারপাশে সাদা রংয়ের খোসা ওঠা দাগ। অযত্নের ফল। দুকামরার টিনের চালের ঘর থেকে ব্যাঙ্গালোরে সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটটায় আসার পথটা সহজ ছিল না কারোরই। ছোট কাকা মানে মিনুর ছোটমার স্বামী যখন চলে যায় মিনুর বয়স তখন দশ। জীবনটা ধূসর লাগত মিনুর। ওই ছোট্ট বয়সেই একরাশ পরিণতিবোধ ঘিরে ধরেছিল ওকে। পিয়ালী বোঝাত, "মন খারাপ করিস না মিনু মা, আমরা তো চৌধুরী বাড়িরই অংশ, পরিস্থিতির চাপে পড়ে তোর আমাদের কাছে আসা। তুই এরকম মন খারাপ করে থাকিস আমি চাই না।" ছোট কাকা সদ্য চলে গেছে তখন। পিয়ালী এক মনে ব্লাউজের প্রজাপতি আঁকছে। কিশোরী মিনুর মনে হত এই প্রজাপতিটাই একদিন রঙিন হয়ে উড়ে ছোট মা আর মিনুর মলিন চেহারায় রং ছুঁয়ে দেবে। শিশুমনের কল্পনা। মাসকাবারি চালের হিসেব, মিনুর বছরে তিনটে ফ্রকের দাম, স্কুল ড্রেসের মাপের হিসেব খুঁজতে খুঁজতেই ছোটমা মধ্য বয়সে পৌঁছে গেছে। মিনুর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়টা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। মিনুর বাবা মানে নিকুঞ্জ চৌধুরী বারবার ছোট মা আর ছোট কাকার কাছে টাকা পাঠানোর জেদ করত। "তোমরা বিষয়টাকে অহেতুক জটিল করে দেখছ। মা আমাদের পরিবারের গুরুজন। সন্ন্যাসী মহারাজের কথা মা ফেলতে পারেন না কখনো। আর আমার বিপদের কথা ভেবেই মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমার মেয়ে মীনাক্ষি তোমাদের কাছে থাকবে। মেয়ের দায়িত্ব নিতে তো আমরা কোনদিন অস্বীকার করিনি। টাকা নিতে তোমাদের অসুবিধা কোথায়?" মিনু তখন ছোট, ফুল ছাপ জামা পরে দরজার পাশে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়েছিল। বাবা-মার কাছ থেকে ছোট কাকা আর ছোটমার কাছে থাকতে আসার সময়টা আবছা মনে পড়ে মিনুর। একটা জগৎ থেকে অন্য জগৎ। এই বদলটা কেন হয়েছিল সেটা বুঝতে বুঝতে অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছিল মিনু। নাকি এই বদলের কারণটা বুঝেই একটা ধূসরতা গ্রাস করেছিল মিনুকে, তা ও বুঝতে পারে না আজো। তবে নিকুঞ্জ চৌধুরী টাকা পয়সার কথা তুললেই ছোটমার চোখের দিকে তাকাত মিনু। সেই চোখ আজও মনে আছে ওর। দৃঢ়, স্থির। সেখানে আগুন দেখতে পেত মিনু। যদিও তখনও আগুনকে ঘৃণা করতে শেখেনি মিনু। ২ চারটে বাজতেই কম্পিউটারটা অফ করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল রণজয়। এই সময়টাই বড়মাকে ফোন করে ও। ও দেশে এখন সকাল ৬:৩০ মতো বাজে। ঘুম থেকে উঠেই জেঠু আর বড়মা রণজয়ের গলা শুনতে চায়। শুধু শোনা নয় দেখাও। ভিডিও কলের জন্য জোরাজুরি চলতে থাকে। বড়মা বড় নাছোড়বান্দা। চ্যাটচ্যাটে আবেগে অস্বস্তি হয় রণজয়ের। বড়মা এ সময় স্কুলের জন্য তৈরি হতে শুরু করে। মর্নিং স্কুল। জেঠু বিছানায় শয্যাশায়ী বছর তিনেক হল। অসুস্থ মানুষের আবদার ফেলতে পারে না রণজয়। টুংটাং শব্দ করে মোবাইলের ভিডিও কল অপশনটায় ক্লিক করল রনজয়। "কিছু খেয়েছিস তো?" বড়মার গলার স্বরে স্বভাবজাত নরম রোদ ঝরে পড়ে। রণজয়ের বিরক্ত লাগে। "হ্যাঁ আমি সব ঠিকমতো করে নিয়েছি। তোমরা চিন্তা করো না। জেঠু ভালো আছে তো?" বিরক্তিটা যথাসম্ভব লুকিয়ে উত্তর দেয় রণজয়। "এত বছরেও অভ্যেসটা পাল্টালি না! মানুষটাকে বাবা বলতে ইচ্ছে করে না তোর? কতবার বললাম এই সময় ওই দেশে যাস না। আর কটা দিনই বা বাঁচবে লোকটা। তবুও জেদ করে চলে গেলি।" বড়মার গলায় দীর্ঘশ্বাস স্পষ্ট শুনতে পায় রণজয়। কিন্তু এই হতাশা প্রভাব ফেলতে পারে না ওর মনে। কোন উত্তর দেওয়ার আগেই ও প্রান্তে একটা আবছা অবয়ব স্পষ্ট হয়। জেঠু। "বাবা আমার না খেয়ে থাকিস না যেন। নিজের যত্ন নিস। তুই কষ্ট পেলে আমরা সকলেই কষ্ট পাব।" খানিক কষ্ট করেই কথাগুলো বলে রণজয়ের জেঠু অর্থাৎ নিকুঞ্জ চৌধুরী। কথাগুলো বলতে গিয়ে মানুষটার কষ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। রণজয়ের মনটা একটু নরম হয়। ও কি একটু হলেও কষ্ট পাচ্ছে মানুষটার জন্য! বড় মা বোধহয় ফোনটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে আবার। লাল টিপ, ঘিয়ে রঙের শাড়ি। চোখের কোণে দুঃখ-কাজল। মোটামুটি ধোপদুরস্ত সাজ। "স্কুল যাচ্ছ?" কেজো প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় রনজয়। উত্তরটা এড়িয়ে যায় ও প্রান্ত। “মিনুর সঙ্গে কথা হয় তোর?" বড়মার প্রশ্নে রণজয়ের ভেতর অস্বস্তির খোঁচাটা আবার জেগে ওঠে। "বোনকে রোজ ফোন করি আমি। ছোট মা আর মিনু ওদের নতুন ঘরটা সাজিয়েছে। খুব ভালো আছে ওরা একসঙ্গে। ব্যাঙ্গালোরে দারুণ চাকরি পেয়েছে ও।” শেষ কথাগুলো খোঁচার আকারেই বলল রণজয়। তবে ওর অবচেতনে এই ভাবনাটাই বিরাজ করে কি না তা ও নিজেও বোঝেনা। তবুও নিজের বলা শেষ লাইনটা আত্মতৃপ্তি দেয় রণজয়কে। কোন ছোটবেলার একটা অস্বস্তি আজও রণজয়, মিনু, বড়মা, ছোটমার মধ্যে অন্ধকার স্রোতের মতো বয়ে চলেছে। কথাগুলো বলেই বড়মার দিকে তাকায় রণজয়। চোখের কোণে কি চিকচিকে জল? ভার্চুয়াল জগতের এ এক অদ্ভুত দস্তুর। সবটা বুঝেও উপেক্ষা করা যায়। অবহেলা ভরে ছিঁড়ে ফেলা যায় যোগাযোগ। রনজয় সেটাই করল। ভিডিও কলের অপশনটা দুম করে কেটে দিল। ফ্ল্যাট-এর কাছাকাছি চলে এসেছে। ফোনটা কাটার সময় বড়মার চোখের কোণে চিকচিকে জল দেখেছিল আজ। চাপা আনন্দ অনুভব করে রণজয়। বড়মার পরে যাকে ফোন করবে সেটা ওকে স্বস্তি দেবে। ফোনের ও প্রান্তে ছোট বোন মিনুর গলা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করে রণজয়। ৩ "দাদা এইভাবে ছোটবেলার কষ্টের খোঁচাটা বয়ে বেড়াস না তো!” নম্রভাবে বললেও মিনুর গলায় বেশ ঝাঁঝ। বোনের দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছে রণজয়। বুঝতে পারে ও। সাধারণত অফিসের পর এই দুটো ফোন করে নেয় ও। তারপর বাড়ির টুকিটাকি কাজ নিয়ে বসে। ছোট থেকেই দুই ভাই-বোনের মধ্যে অদ্ভুত টান। একে-অপরের সুখ দুঃখের ভাগীদার ওরা। "আমি কিছুতেই সবটা ভুলতে পারি না।" নিজের পড়ার টেবিলটায় জোরে একটা চাপড় মেরে বলে। মিনু ও প্রান্ত থেকে দাদার অস্বস্তি বুঝতে পারে। চেষ্টা করে দাদাকে শীতল পরশ দেওয়ার। "দাদা, কষ্ট পাস না। তুই এই বিষয়টা নিয়ে এতটা কষ্ট কেন পাস বল তো? আমি যখন মেনে নিচ্ছি... তুই সব সময় আমার পাশে থাকিস, এটা আমার কাছে খুব তৃপ্তির। নইলে কোথায় হারিয়ে যেতাম!" কত মাইল দূরে বসেও বোনের কথার উষ্ণতা অনুভব করে দাদা। দুই দেশে থেকেও ছোটবেলার অস্বস্তির খোঁচাটাই ওদের ভেতরের সেতু। “ওই সময়টা যে কিছুতেই ভুলতে পারি না রে মিনু। একটা অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের জন্য আমাদের দুজনের ছোটবেলাটাই ওরা নষ্ট করেছিল। আমাদের বেড়ে ওঠা, ভালো থাকা কোন কিছুর পরোয়া করেনি। তুই কী করে পারিস বলতো সবটা ভুলে এমন স্বাভাবিক থাকতে?" রণজয়ের গলায় অভিমান ঝরে পড়ে। মিনু শীতল থাকে। ওর জীবনের লক্ষ্য, গতিপথ সবকিছুর মধ্যে অস্বস্তিটা মিশে থাকলেও মিনু এড়াতে পারে। উপেক্ষা করতে শিখে গেছে ও। সেই কোন ছোটবেলায় এক সন্ন্যাসী এসে নাকি মিনুর ঠাকুমা মানে নিকুঞ্জ চৌধুরী আর সুভদ্র চৌধুরীর মাকে বিধান দিয়েছিল যে বড়ছেলের মুখাগ্নি যেন কোন পুত্র-সন্তানই করে। নইলে এই পরিবারের ওপর নেমে আসতে পারে বিপদ। মৃত্যুর পর এই বাড়ির ছেলেদের আত্মার মুক্তি ঘটবে না। এমনকী মেয়ের হাতে পরিবারের বড় ছেলের মুখাগ্নি হলে চৌধুরী পরিবারের ভবিষ্যত প্রজন্মে কোন পুত্র-সন্তান জন্মাবে না! মিনুর ঠাকুমা তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মিনুর জন্মদাতা বাবা অর্থাৎ নিকুঞ্জ চৌধুরী যেন ছেলের হাতের আগুন পায়। তার ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তিনি স্থির করেছিলেন বড় ছেলে আর ছোট ছেলের সন্তানের অদল-বদল ঘটাবেন। মিনুর বয়স তখন তিন-চার। মিনুর জন্মদাতা মায়ের আর সন্তানসম্ভবা হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না শারীরিক অসুস্থতার কারণে। এদিকে সুভদ্র চৌধুরীর ঘরে তখন বড় হচ্ছে ওদের একমাত্র সন্তান রণজয়। দুই ভাইয়ের মধ্যে আর্থিক, শারীরিক, মানসিক সব ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট তফাৎ ছিল। রণজয় দু'বছরের বড় ছিল মিনুর থেকে। নিকুঞ্জ চৌধুরী মানে মিনুর জন্মদাতা বাবা আর সুভদ্র চৌধুরী আপন মায়ের পেটের ভাই। অবস্থার কারণে সুভদ্র চৌধুরী গ্রামের বাড়িতেই থাকতো। কাঁথির এক প্রত্যন্ত গ্রাম। পরবর্তীকালে নিকুঞ্জ চৌধুরী পরিবার নিয়ে কলকাতায় চলে আসে। তখনো সন্তান অদল-বদল ঘটেনি। মিনু আর রণজয়ের ঠাকুমা কলকাতাতেই থাকতো নিকুঞ্জ চৌধুরীর সঙ্গে। এক সন্ন্যাসীর বিধানে পাল্টে যায় দুই পরিবারের সন্তানদের জীবন। মিনুর ঠাকুমার কথাতেই নিকুঞ্জ চৌধুরীর মেয়ে মীনাক্ষি চৌধুরী থাকতে আসে সুভদ্র চৌধুরীর পরিবারে আর সুভদ্র চৌধুরীর ছেলে রণজয় চৌধুরীর ঠাঁই হয় নিকুঞ্জ চৌধুরীর পরিবারে। সবটাই মুখাগ্নির জন্যে। মিনু আর রণজয় একেবারে ছোট তখন। কারোরই মনে নেই সবটা। বড় হয়ে তবে কোনো পরিবারই এটা লুকোয়নি। যিনি এই ঘটনার কান্ডারী সেই নিকুঞ্জ চৌধুরীর মা-ই বলে দেয় ওদের। ওদের প্রাত্যহিক জীবন, কাজ সবকিছুতেই সত্যিটা কাঁটার মতো বিঁধেছে। আবার মিশেও থেকেছে। খুব অল্প বয়সেই মারা যায় মিনুর ছোট কাকা অর্থাৎ সুভদ্র চৌধুরী। মিনুর ছোটমা পিয়ালী স্নেহ, ভালবাসা সবটুকু নিংড়ে দিয়ে বড় করেছিল মিনুকে। রণজয়ের বড়মা মানে রীনাও ভালোবাসা দিয়েই বড় করেছে রণজয়কে। সুভদ্র চৌধুরীর দুর্বলতা তাকে নিজের মায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস যোগায়নি। মিনুর কাকিমা মানে ছোট মা বাকি লড়াইটা করেছিল। কাঁথা সেলাই করে, আয়ার কাজ করে বড় করেছিল মিনুকে। নিকুঞ্জ চৌধুরী, কর্তব্যের খাতিরে বারবার আর্থিক সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু মিনুর ছোটমার প্রত্যাখ্যানের দৃঢ়তার কাছে হার মেনে ছিল কর্তব্যের এই স্রোত। "নতুন হিসেবে তোর এই অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার কথাটা আমি বড়মা আর জেঠুকে ফোন করে বলব!" মিনু পুরস্কার পাচ্ছে। মিনুর সাফল্যে খুশি হয় রণজয়। অতদূর থেকেও একটা শক্ত হাতের মত করে বোনকে আগলে রাখে। দাদার উষ্ণ স্নেহ চাদরের মত গায়ে জড়িয়ে রাখে বোনও। ভাই-বোনের কথা হচ্ছে। বিশেষ পুরস্কার পাওয়ার কথা তাই মিনু প্রথম জানায় রণজয়কে। "জেঠুর শরীর একেবারে ভালো নয়, যায়-যায় অবস্থা। বড়মা বলল। আমার কী মনে হয় জানিস, বড়মা তোকে মিস করে। হয়তো বলতে পারে না, কিন্তু মিস করে।" মিনুর ভেতর অস্বস্তিটা পাকিয়ে ওঠে। "তুই তাহলে দেশে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখ দাদা।" অবচেতন মনে কথাগুলো বেরিয়ে আসে মিনুর মুখ থেকে। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে ফোনটা কেটে দেয়। ৪ "তুই যেটা বলছিস দাদা, সেটা অসম্ভব। যে বিষয়টার জন্য আমাদের শৈশবটা স্বাভাবিক হল না তুই আমায় সেই ক্ষতটায় খোঁচা দিতে বলছিস?" ফোনের ওপারে রণজয়। ব্যাঙ্গালোরে এখন রাত। ছাদে দাঁড়িয়ে মিনু। নিকুঞ্জ চৌধুরীর ব্যাপারে ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছে। হয়তো আর দু-তিনটে দিনের ব্যাপার। স্বাভাবিকভাবেই রণজয়ের ডাক পড়েছে। ফেরার চেষ্টা করেও পাচ্ছে না ও। অফিসে কাজের চাপও সামলে উঠতে পারছে না। তাই মিনুকে অনুরোধ করছে আসার জন্য। মিনুর ভেতরে একটা অন্ধকারের চোরা স্রোত বইছে। মিনু বুঝতে পারছে দাদা চাইছে না, ছোটবেলা থেকে ওদের দুই ভাই বোনের ভেতর যে একটা কাঁটা বেঁধা অস্বস্তি বাঁচিয়ে রেখেছে তার আগল খুলুক এবার। বারবার রণজয় বলছে,"যে অন্যায়টা হয়েছে তা ভাঙার সময় এসেছে মিনু, এইজন্যেই হয়তো আমার যাওয়াটা এইভাবে আটকে পড়েছে। জেঠুর সন্তান তুই। ঠাকুমার জন্য সবটা হয়েছিল। তোর দায়িত্ব পালন কর এবার।" আকাশে তারার মেলা। রণজয়ের পক্ষে কিছুতেই যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাঙ্গালোরের আকাশটা এই সময়ে ঝলমলে থাকে। ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছে মিনু। আজ আকাশটা একটু অন্যরকম। তারাগুলো স্পষ্ট হয়েও স্পষ্ট নয়। মিনুর ভেতর কাটাকুটি খেলা চলছে। অন্তরের টানাপোড়েনের জন্যেই কি আকাশটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না ও? নিকুঞ্জ চৌধুরীর অবস্থা একেবারে শোচনীয়। বড়মা ছোটমাকে ফোন করে জানিয়েছে। নিকুঞ্জ চৌধুরীর হাতে হয়তো আর দুটো দিন কোনমতে রয়েছে। নিজের জন্মদাতা বাবাকে কোন সম্মোধনেই ডাকতে পারেনি মিনু। সেই মানুষটার মৃত্যুতে মিনুকে মুখাগ্নি করতে হবে? অভিমানটা কী নিজের বাবা হিসেবে মেয়ের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদে নাকি ওর শৈশবটাকে এমন ধূসর করে দেওয়ার জন্যে, তা এ বুঝতে পারে না। শুধু ওর পা সরছে না কলকাতায় যাওয়ার জন্য। ঐ-দিন যখন নিকুঞ্জ চৌধুরী মিনুর ছোট কাকা আর ছোট মাকে মিনুর পড়াশোনার খরচের জন্য টাকা দিতে এসেছিল দরজার বাইরে ফুলছাপ জামা পড়ে ছোট্ট মিনু সবটা শুনেছিল। শৈশবটাই ঘেঁটে যায় মিনুর। একটা কাঁটা দুই ভাই-বোনের ভেতর বেঁচে থেকেছে আজীবন। নিজের মনকে মিনু কিছুতেই ওই ক্ষতটার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে পারছে না। শুধুমাত্র পুত্রসন্তান মুখাগ্নি করতে বলে মিনুর ঠাঁই হয়েছিল নিজের কাকার পরিবারে। সেদিনের পর থেকেই মিনু ঘেন্না করে আগুনকে, ঘেন্না করে সমাজের প্রথাকে, ঘেন্না করে মুখাগ্নিকে। তাই চাকরি পেয়েই নিজের অঙ্গদানটা সম্পন্ন করেছে মিনু। মন কিছুতেই নতুন করে কোন কাঁটার মুখোমুখি হতে চাইছে না। অথচ ছোটমাও চাইছে মিনু যাক। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের প্রতি কোনো অসূয়া রাখতে নেই, মনে মনে হলেও। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। বড়মা ফোন করছে। মিনুর ফোনেও নিজের মায়ের নাম এভাবেই সেভ করা। সন্তান অদল-বদল জানাজানি হওয়ার পর দুই ভাই বোনের কাছেই চৌধুরী পরিবারের দুই বউ বড়মা ছোটমা। ফোনটা নিঃশব্দে ধরে মিনু। খানিকক্ষণ নীরবতার পর কথা ভেসে আসে। "তুই আয় মা! জানি তোর সঙ্গে, তোদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে, তোর ঠাকুমা বড় জেদি মহিলা ছিলেন, তাই তাকে বোঝানোর ক্ষমতা আমাদের ছিল না।। কিন্তু পুরনো কথা মনে রেখে নিজের বাবার মুখাগ্নি করতেও আসবি না? আসবি না মা? সব ভুলে আমাদের ক্ষমা করতে পারিস না?" মিনুর ভেতর স্রোত বইছে। ফোনটা কেটে দেয়। চোখ দুটো ঝাপসা হচ্ছে। আকাশের সব তারা গুলো আজ এমন করে পালিয়ে গেছে কেন? আকাশটা হঠাৎ করেই নিশ্চিদ্র অন্ধকার মনে হয় ওর।