শুধু পটে লিখা

ক্যালগারি, কানাডা

[একদিন গান্ধারপতির চোখে পড়ল মদ্ররাজকন্যার ছবি। সেই ছবি তার দিনের চিন্তা, তার রাত্রের স্বপ্নের 'পরে আপন ভূমিকা রচনা করলে। - শাপমোচন নৃত্যনাট্য, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার কোনো বংশধর একবার দেবাদিদেব মহাদেবের বিনা অনুমতিতে তাঁর চিত্রাঙ্কন করেন। পরে দেবাদিদেবের ক্রোধ এড়াতে সেই কীর্তি গোপন করার চেষ্টা করেন হাতের তুলিটি মুখের ভিতর পুরে। কিন্তু মহাদেবের তা দৃষ্টিগোচর হয় এবং তুলি উচ্ছিষ্ট করার কারণে তিনি সেই শিল্পীকে অভিশাপ প্রদান করেন। এই অভিশাপের ফলে তাঁরা জাতিতে পতিত হন এবং তাঁদের নির্দিষ্ট কোনো ধর্মাচরণ থাকে না। তাঁরা তারপর থেকে যেমন নামাজ আদায় করেন তেমন দেবদেবীর ছবি এঁকে তাঁদের মহিমা কীর্তনও করেন। এঁরাই নাকি আদি পটশিল্পী বা পটুয়া। তবে এ হল কিংবদন্তী। কিন্তু আমার সবসময়েই মনে হয় কিংবদন্তী কেবল অলীক কল্পনা নয়, তাতে রূপকের মাধ্যমে অনেক সত্যি কথা বোধহয় বলা হয়ে থাকে। পটুয়াদের এই প্রাচীন কিংবদন্তী কী বলতে চায়? শিল্পীরা ধর্মাচরণের ঊর্দ্ধে? না তার থেকেও বেশি কিছু?

তবে এই পটশিল্প বা পটুয়াবৃত্তি বহুকাল ধরে সমাজজীবনের বিশেষ অঙ্গ হয়ে ছিল। ঠিক কত যুগ আগে ভারতবর্ষে পটুয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটেছিল তা একেবারে নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও বহু প্রাচীন পুঁথিতে এঁদের উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর (কোনো কোনো গবেষকের মতে অষ্টম শতাব্দী) সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পাণিনি রচিত অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে গ্রামশিল্পীদের কথা আছে। তাঁরাই সম্ভবত প্রাচীনতম পটুয়া। চতুর্থ (ভিন্নমতে অষ্টম) শতাব্দীর কবি বিশাখদত্ত রচিত বিখ্যাত মুদ্রারাক্ষস নাটকে দেখা যায় পটুয়াগণ গুপ্তচরবৃত্তিতে নিযুক্ত। সমাজের সর্বস্তরে এঁদের গতিবিধি অবাধ হওয়ার কারণে এঁদের গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করা যুক্তিপূর্ণ বলেই মনে হয়। মুদ্রারাক্ষসে পটুয়াদের যম পট্রিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সপ্তম শতকের কবি বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিতে এই যম পট্রিকদের পট প্রদর্শন নিয়ে সুন্দর একটি দৃশ্যের বর্ণনা আছে। পটের শেষে যমের রাজ্য দেখানোর প্রাচীন রীতি থেকেই সম্ভবত এই যম পট্রিক বা যমপট নামের সূচনা হয়েছিল। জীবন যে অনিত্য, তা বোঝানোর জন্যই পটের শেষে ওই যম রাজ্য দেখানোর রীতির সূত্রপাত।

মজার ব্যাপার হলো, পটুয়ারা পট আঁকাকে বলেন পট লেখা। আসলে প্রাচীন ভারতে আঁকা ছবি এবং ভাস্কর্যশিল্প দুইই বোঝানো হতো চিত্র শব্দটি দিয়ে। তুলি দিয়ে আঁকা ছবিকে আলাদা করে বোঝাতে লেখ্য চিত্র বলা হতো। বাংলার পটুয়ারা হয়তো সেই জন্যই পট আঁকা না বলে পট লেখা বলে এসেছেন বরাবর। 

বাংলার পটুয়াদের জীবন ও ধর্মযাপন প্রাচীনকাল থেকেই বড় বিচিত্র। আগেই বলেছি, কিংবদন্তী অনুযায়ী তাঁরা নিজেদের বিশ্বকর্মার সন্তান বলে যেমন মনে করেন, তেমন নামাজ আদায় করাও তাঁদের নিত্য জীবনের অঙ্গ। আবার সমাজের ধর্ম আন্দোলনেও তাঁদের ভূমিকা বড় কম ছিল না। বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে একসময়ে এঁদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। জাতকের গল্প নিয়ে বিশেষ এক ধরণের পট তৈরী করা হতো, যার নাম মষ্করী পট। কিন্তু তারপরেই ভারতবর্ষ এক টালমাটাল সময়ের মধ্যে গিয়ে পড়ে। তুর্কী-আফগান আক্রমণের ফলে বৌদ্ধ যুগের অবসান ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই পটুয়া সমাজ হয়ে পড়ে অসহায়, আশ্রয়হীন। হিন্দুধর্ম তখন শিথিল, দুর্বল। পটুয়ারা এমনিতেও চিরকাল সমাজের তথাকথিত নীচুস্তরেই থেকে গিয়েছিলেন। সেই শুরুর দিন থেকেই বৈশ্য বা শূদ্র সমাজের মানুষরাই এই বৃত্তি গ্রহণ করতেন। ক্ষত্রিয়দের চিত্র অঙ্কন নিষিদ্ধ না হলেও পেশা হিসেবে এটা তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। আবার ব্রাহ্মণদের পক্ষে এটি ছিল ঘোর নিষিদ্ধ কর্ম। এমনকি নট, নর্তক বা শিল্পীদের গৃহে অন্নগ্রহণ পর্যন্ত করতেন না তাঁরা। করলে, সেটা সামাজিক অপরাধ বলেই গণ্য করা হত।  স্বাভাবিকভাবেই যেহেতু সেকালের হিন্দু সমাজ মূলত পরিচালনা করতেন ব্রাহ্মণরা, তাই তাঁদের সাথে এই পটুয়া সম্প্রদায়ের বিস্তর দূরত্ব তৈরী হয়েছিল। 

ঠিক এরকম সময়ে ভারতের শাসনব্যবস্থা ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের হাতে। এই সামাজিক সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আত্মরক্ষার জন্য পটুয়া সমাজ সহজ উপায়টাই বেছে নিয়েছিলেন। তাঁরা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়ে গেলেও, জীবিকার জন্য হিন্দু কাহিনিই অনুসরণ করতে থাকেন, কারণ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে পট জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। তাই পটুয়ারা ফিরে গিয়েছিলেন রামায়ণ, কৃষ্ণলীলা, চাঁদবণিক সহ নানা জনপ্রিয় কাহিনিতে।

দুর্ভাগ্যবশত অষ্টাদশ শতাব্দীর আগের কোনো পটশিল্পের নিদর্শন এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে গবেষকদের মতে, প্রাচীনকালে পট আঁকা হতো চটের উপর। কাদা আর গোবরের মিশ্রণ দিয়ে চটের যেদিকে ছবি আঁকা হবে সেদিকটা মসৃণ করে নেওয়া হতো প্রথমে। এই প্রলেপ শুকিয়ে গেলে শুরু হতো ছবি আঁকা। পরে চটের বদলে কাপড় বা তুলোট কাগজ ব্যবহার করা শুরু হয়। ঠিক কোন সময়ে বা সঠিক কোন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে পটুয়ারা বাংলায় এসে বসবাস করা শুরু করেছিলেন সেটা ঠিক পরিষ্কার ভাবে বোঝা না গেলেও ধীরে ধীরে দেখা যায় বঙ্গদেশের বিভিন্ন অংশে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছেন। সেই সঙ্গে তৈরী হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ধারার পটচিত্র। তবে ধর্ম শিক্ষার তাগিদটা সব রকম ধারার সঙ্গেই থেকে গেছে। পরবর্তী সময়ে বাংলায় ও উড়িষ্যাই পটুয়াদের বাসভূমি হয়ে দাঁড়ায়। রাজস্থানের কিছু অঞ্চলে পটচিত্র দেখা গেলেও তা কোনোভাবেই বাংলার পটচিত্রের মতো সমৃদ্ধশালী নয়।

শুরুতে জড়ানো পট বা দীর্ঘ পটেরই প্রচলন ছিল। এই পটে ধারাবাহিক ছবির মধ্যে দিয়ে নির্দিষ্ট কোনো কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হতো। আট থেকে দশ হাত তো বটেই, এমনকি আঠারো উনিশ হাত পর্যন্ত লম্বা জড়ানো পটের নিদর্শন পাওয়া গেছে। দুই পাশে দুটি কাঠি দিয়ে জড়িয়ে রাখা হত এই দীর্ঘ পট। সেই থেকেই এর নাম জড়ানো পট। এই পট দেখানোর পদ্ধতিটিও অভিনব। পটুয়া জড়ানো পটটি বাঁশের ছোট পায়ার উপর রেখে বাঁ হাত দিয়ে উপরের কাঠি ঘুরিয়ে পট খুলে ধরেন। ডান হাত দিয়ে পটে আঁকা চরিত্রগুলো দেখিয়ে সুর করে তিনি ঘটনার বর্ণনা দিতে থাকেন। জড়ানো পট দেখানোর রীতি আজও কিন্তু একইরকম। পটুয়া এখানে একাধারে শিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান আর মুর্শিদাবাদ জেলায় কয়েকটি পটুয়া পরিবার আজও এই ধারা বজায় রেখেছেন। ষোড়শ শতকে শ্রীচৈতন্যদেবের বাণী প্রচারের জন্য নবদ্বীপে এরকম জড়ানো পটের ব্যবহার ছিল। চণ্ডীমঙ্গল সহ অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে এই পট গান বা পট পড়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। 

পটুয়ারা আশ্চর্যরকম স্বয়ংসম্পূর্ণ। রঙের জন্যও তাঁরা কোনোদিন অন্য কারুর উপর নির্ভর করেননি। প্রথমে হয়ত আর্থিক কারণে পরে পরম্পরাসূত্রে লব্ধ জ্ঞান অনুযায়ী প্রকৃতি থেকেই রঙ সংগ্রহ করতন তাঁরা। হলুদ রঙ আসতো কখনও হলুদ গাছের শিকড় কখনও বা আলামাটি থেকে। সবুজ আসতো শিমপাতা বা হিঞ্চে শাকের রস থেকে। বেলপাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করেও সবুজ রঙ তৈরী করা হতো। বেগুনী রঙের জন্য পটুয়ারা জাম অথবা পাকা পুঁই মেচুড়ি ব্যবহার করতেন। এটা বোধহয় ছোটবেলায় খেলাঘরে আমরা অনেকেই ব্যবহার করেছি। নীল রঙের জন্য ছিল অপরাজিতা ফুল, লাল রঙের জন্য পাকা তেলাকুচা, কালো রঙের জন্য ভুষোকালি। শুধু কি তাই? একাধিক জিনিস মিশিয়ে রং তৈরীর ক্ষমতাও তাঁদের কম ছিল না। খড়িমাটির সাথে নীল মিশিয়ে তৈরী হতো সাদা রঙ। আলামাটির সাথে খয়েরের টুকরো মিশিয়ে পটুয়ারা দক্ষতার সাথে তৈরী করতেন খয়েরি রঙ। আবার জেলাভেদে এসব রঙের উপাদান বদলে যেত। অবশ্যই যেখানে যেটা সহজে মিলত, সেটাই ব্যবহার করার রীতি মেনে চলতেন পটুয়ারা। বর্তমানে হয়তো কোনো কোনো পটুয়া দোকান থেকে কেনা রঙ ব্যবহার করে থাকেন, কিন্তু রঙ তৈরীর এই প্রাচীন জ্ঞানকে আজও অবজ্ঞা করতে পারেন না তাঁরা। এখনও কিন্তু রঙ গোলা হয় ঐতিহ্য মেনে মাটির খুরিতে বা নারকেলের মালায়। 

রঙ পটে ভালোভাবে ধরানোর জন্য রঙে মেশানো হতো বেল, শিরিষ বা নিমের আঠা। এখন অবশ্য বাজার চলতি গঁদের আঠা ব্যবহার করেন পটুয়ারা। তবে নিমের আঠার ব্যবহার এখনও রয়ে গেছে, কারণ নিমের আঠা পটকে পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচায়। এছাড়া আধুনিক পটুয়ারা ভিজিয়ে রাখা তেঁতুলের বীজ সিদ্ধ করে থকথকে প্রলেপ বানিয়ে ব্যবহার করেন রঙ ধরানোর কাজে। ডিমের কুসুমের ব্যবহারও করে থাকেন আধুনিক পটুযারা। বলা বাহুল্য, শেষের বস্তুটির ব্যবহার প্রাচীন পটুয়ারা জানতেন না।

যাঁদের রঙের উৎস এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ, তাঁদের তুলিতেও অভিনবত্ব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। পটুয়ারা তুলি তৈরী করতেন ছাগশাবকের ঘাড়ের বা পেটের লোম থেকে। সরু তুলির জন্য ব্যবহৃত হত কাঠবেড়ালির লোম বা বেজির লেজের চুল। আধুনিক পটুয়ারা অবশ্য এত সমস্যায় না গিয়ে বাজার চলতি তুলিই ব্যবহার করেন।

এবার বাংলার বিভিন্ন ধরণের পটের দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক। চোখ অবশ্য ধাঁধিয়েও যেতে পারে তাতে।

প্রথমেই মনে আসে চালচিত্রের কথা। সবারই অত্যন্ত পরিচিত এই পট। সাবেকি দুর্গা প্রতিমার উপর দিকে নানারকম ছবি আঁকা অর্ধগোলাকার যে পটচিত্র দেখা যায়, তাই চালচিত্র বা দুর্গাচালা। সাধারণত কৈলাস, নন্দীভৃঙ্গী, মহিষাসুর বধ, দশাবতার ইত্যাদিই দেখা যায় চালচিত্রে। কিন্তু এর রকমফেরও আছে। কৃষ্ণনগরের রাজরাজেশ্বরী দুর্গার চালচিত্র বেশ অন্যরকম। এখানে মাঝখানে থাকেন পঞ্চানন শিব, পার্বতীকে পাশে নিয়ে। তাঁদের একপাশে থাকে দশমহাবিদ্যা ও অন্য পাশে থাকে দশাবতার। কী কারণে সেখানের পটুয়ারা এই ভিন্ন ধারার চালচিত্র এঁকেছিলেন, তা অবশ্য জানা যায়না। হয়তো কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে সে কাহিনি। আজকাল অবশ্য পৌরাণিক ছবি ছাড়া আরও নানা ধারার ছবি বা আলপনা চালচিত্রে স্থান পাচ্ছে।

চালচিত্রের মতোই আর এক অতি পরিচিত পটচিত্রের ধারা হলো সরা চিত্র। সরার উপর দেবদেবীর চিত্র, বিশেষ করে দুর্গা, লক্ষ্মী বা মনসা দেবীর চিত্র বহুল প্রচলিত। অনেকের বাড়িতেই লক্ষ্মীদেবীর সরা পূজার প্রচলন আছে। সরা চিত্রের উৎপত্তিস্থল অবশ্য বাংলাদেশ। দেশভাগের পর বেশ কিছু সরাশিল্পী পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন আর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে বসতি স্থাপন করেন। সরাশিল্পীরা কিন্তু আসলে পেশায় কুম্ভকার। তাহলে কি কোনো কোনো পটুয়া বংশ কুম্ভকার বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন কোনো এক সময়ে, আর তাদের পটচিত্রের ধারা বজায় রাখতেই শুরু হয়েছিল সরা চিত্রের ঐতিহ্য?

যমপটের কথা আগে সামান্য বলেছি। নীতি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এই পটের প্রচলন। সংসারে ন্যায়শীলতার পুরস্কার ও অন্যায় কাজের শাস্তিভোগের ছবি দিয়েই তৈরী হয় যমপট। সাধারণত দীর্ঘপট বা জড়ানো পটেই আঁকা হয় যমরাজের ন্যায় বিচার ও শাস্তিবিধানের দৃশ্য। অবশ্য যে কোন অন্য দীর্ঘপটের শেষাংশেও যমরাজ্যের ছবি আঁকার রীতি ছিল। সেগুলোকেও যমপট বলেই উল্লেখ করা হয়। এই পট পড়ার ক্ষেত্রে পটুয়ার ভূমিকা হয় লোকশিক্ষকের। পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে হোক বা শাস্তির ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে অন্যায় করা থেকে বিরত করাই যমপটের উদ্দেশ্য। সুতরাং সমাজ গঠনে পটুয়াদের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় থাকে না।

গাজীর পটের কথায় আসা যাক এবার। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এ হলো মুসলমানি পট। গাজী এবং পীরদের বীরত্ব ও অলৌকিক ক্রিয়াকর্ম এই পটে বিবৃত হয়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, গাজীর পটে ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায় ও বনবিবির ছবিও দেখা যায় অনেক সময়ে। কী অদ্ভুত অসাম্প্রদায়িক ধর্মবোধ এই পটুয়া সমাজের। তবে শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস আর অলৌকিকত্ব নয়, নানা কৌতুক, হাস্যরসাত্মক কাহিনি, সামাজিক দুরবস্থা এমনকি ব্যঙ্গচিত্রও স্থান পায় গাজীর পটে। বাঘ, প্যাঁচা, গরু, গাছপালাও বাদ যায় না। মোটকথা গাজীর কাহিনীর পাশাপাশি সমাজের প্রায় সব স্তরের একটা আভাস দিয়ে যায় এই গাজীর পট। গাজীর পট বাড়িতে রাখলে দুঃখ দুর্দশা বা দৈব দুর্বিপাকের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।

এবারে আসা যাক আর এক অদ্ভুত পটের কথায়। আদিবাসী ও উপজাতিদের মধ্যেই এই পট সীমাবদ্ধ থেকে গেছে চিরকাল। পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া অঞ্চলে এখনো এই পটের চল আছে। মনে করা হয় এই পটের চিত্রকররা জাদু জানেন। সেই অনুসারে এই পটের নামও জাদুপট। আদিবাসী পরিবারের মধ্যে কারুর মৃত্যু হলে এই পটুয়ারা সঙ্গে সঙ্গে সেই মৃত মানুষটির ছবি এঁকে ফেলেন। অন্য সমস্ত কিছু আঁকলেও মৃত মানুষটির চোখের মণি আঁকা হয় না। তারপর মৃতের পরিজনদের সেই পট দেখিয়ে পটুয়ারা বলেন, পরলোকে গিয়ে মৃত ব্যক্তির আত্মা দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কারণ চোখের মণি দুটি নেই। উপযুক্ত অর্থ পেলে পটুয়ারা মণি দুটি এঁকে দেবেন এবং মৃতের আত্মা তাহলে নিজের পথ খুঁজে নিতে পারবে। স্বাভাবিকভাবেই আদিবাসীরা সরল বিশ্বাসে পটুয়াকে তাঁর চাহিদামতো অর্থ দিয়ে ছবিটি সম্পূর্ণ করিয়ে নেয়। এই কারণে জাদুপটকে চক্ষুদান পটও বলা হয়। 

এছাড়া আছে লৌকিক পট, যেখানে পটুয়ারা পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, কৃষ্ণলীলা থেকে শুরু করে চৈতন্যদেবের জীবন, অন্নদামঙ্গল থেকে মনসামঙ্গল পর্যন্ত অফুরন্ত কাহিনির ভান্ডার তুলে ধরেন। গবেষক ও সমালোচকদের মতে অঙ্কন শৈলীতে এই পট শ্রেষ্ঠ। এই পটের ধারা আজও বহমান। 

এবার আসব এমন এক পটের কথায় যার ধারা বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত। অথচ তার বিষয়বস্তুর আধুনিকতা বর্তমান প্রজন্মের মানুষকেও মুগ্ধ করতে বাধ্য। তার আগে এই বিশেষ ধারার জন্ম কীভাবে হয়েছিল সেটা নিয়ে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন। 

কলকাতার কালীঘাট মন্দিরের প্রতিষ্ঠা নিয়ে নানারকম কাহিনি আছে ঠিকই, তাও বলা যেতে পারে বর্তমান মন্দিরটির  গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৭৯৮ সাল নাগাদ। ছোট একটি মন্দির তার আগে ছিল বটে, তবে চারিদিকের ঘন জঙ্গল ও মন্দিরের ভগ্নদশার কারণে ভক্ত সমাগম সেরকম ছিল না। এবার পাকা মন্দিরের নির্মাণকার্য শুরু হওয়াতে আশপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করে মানুষের বসতি শুরু হয় এই অঞ্চল জুড়ে। ভক্তের সংখ্যাও দিনে দিনে বেড়ে উঠতে থাকে। মন্দিরের নামডাক ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বহু মানুষ জীবিকার টানে মন্দিরের দুইপাশে দোকান তৈরী করতে শুরু করেন। এটা অবশ্য নতুন কোনো দৃষ্টান্ত নয়, মন্দির সংলগ্ন বাজারের চল বরাবরই ছিল। তীর্থযাত্রীরা পুজো দিয়ে ফেরার পথে তীর্থভ্রমণের স্মৃতি হিসেবে পুতুল, বাসন ইত্যাদি কেনাকাটা করতেন। একদল পটুয়াও সেই সময়ে কালীঘাট অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। হয়ত তাঁদের আদি বাসস্থানে ব্যবসার আর বিশেষ সুবিধা হচ্ছিল না, বা অন্য কোনো কারণ ছিল। মোট কথা একদল ছিন্নমূল কিন্তু গুণী শিল্পী এসে পৌঁছালেন কালীঘাটে। তখনকার সামাজিক পরিবেশে হিন্দু তীর্থের পাশে মুসলমান শিল্পীর দল কীভাবে স্থান পেয়েছিলেন, নাকি যারা এসেছিলেন তাঁরা নিম্নবর্ণের হিন্দু ছিলেন - সেটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না। তবে এঁরা আসার ফলে কোনো সামাজিক গোলযোগ উপস্থিত হয়েছিল বলে মনে হয় না।

এই পটুয়ারা প্রথমে মাটি দিয়ে দেবদেবীর ছোট মূর্তি আর অন্যান্য নানারকম পুতুল তৈরী করতেন। এই রঙিন পুতুলগুলো তীর্থযাত্রীদের মন কেড়েছিল। পুতুলের পাশাপাশি মাটির সরায় দেবতার মূর্তি আঁকাও শুরু করলেন পটুয়ারা। প্রথা অনুযায়ী গোল পটেই আঁকা হতো প্রথমে। কিন্তু ধীরে ধীরে ছিন্নমূল পটুয়ার দল শুরু করলেন চৌকো পটের ব্যবহার। তৈরী হল এক নতুন ইতিহাস, এক নতুন পটের ধারা, যার নাম কালীঘাটের পট। 

পাল ও সেন যুগের মন্দিরের গায়ে এরকম চৌকো পোড়ামাটির কাজ দেখা যায়। তাই অনেক গবেষক কালীঘাটের চৌকো পটকে সেই চৌকো টেরাকোটার উত্তরসূরী বলে মনে করেন। 

ইতিমধ্যে কালীঘাটের পটুয়া সম্প্রদায় চৌকো সরা ছেড়ে চৌকো কাগজে চিত্রাঙ্কন শুরু করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বিষয়বস্তুর মধ্যে আসতে শুরু করেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনই কালীঘাটের পটকে পৌঁছে দিয়েছিল এক অন্য মাত্রায়।

ভারতবর্ষে তখন চলছে ইংরেজ শাসন। তার প্রভাবে পাল্টাতে শুরু করেছে কলকাতার সমাজজীবন। একদিকে ইংরেজের শোষণে সাধারণ দরিদ্র মানুষের যেমন দুর্দশার শেষ নেই, তেমন অর্ধশিক্ষিত অথচ ধনী বাবুদের জীবনযাপনের পরতে পরতে নেমে এসেছে অবক্ষয়। বাবু পরিবারের নিষ্কর্মা বংশধরদের তখন একমাত্র কাজ তাদের পূর্বপুরুষের অর্জিত অর্থ বিভিন্ন ঘৃণ্য পন্থায় অপচয় করা। তাদের না ছিল কোনও সংযম, না ছিল কোনো বিবেকবুদ্ধির দংশন। দীনবন্ধু মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাইকেল মধসূদন দত্ত প্রমুখ সাহিত্যিকের কলম তখন ঝলসে উঠছে এই ব্যাভিচারী বাবু কালচারের বিরুদ্ধে। ঠিক সেই সময়ে কালীঘাটের পটুয়ারাও এগিয়ে এলেন তাঁদের অসামান্য প্রতিভা নিয়ে। আবার প্রমাণ করলেন নিজেদের। শুরু হলো এক নতুন ধারার ছবি। এতদিনের দেব-দেবী-ফুল-পাখি আঁকা তুলি যেন জ্বলে উঠল ব্যঙ্গ বিদ্রূপে। পাকানো চাদর গায়ে বিলাসী বাবু, পটের বিবি, গড়গড়ার নল মুখে সাহেব, মাছ কুটুনি গিন্নি - এসব রোজকার সামাজিক চিত্র তো ছিলই, কিন্তু তার সঙ্গে যোগ হল মদ্যপ স্বামীর অত্যাচারের চিত্র, বাবুদের নিষ্কর্মা জীবনের নানা মুহূর্ত, বাইজি বিলাস, বুলবুলির লড়াই, বিড়ালের বিয়েতে অকাতর অর্থব্যয়ের নথি।

কালীঘাটের পটুয়া সম্প্রদায় জীবিকা শুরু করেছিলেন পুতুল তৈরী দিয়ে, তাই সম্ভবত ব্যঙ্গ চিত্রগুলির চরিত্রেও সেই পুতুলের মতো রচনাশৈলী ফুটে ওঠে। গোলাকার মুখ, পুতুলের মতো সুডৌল হাত পা, টানা চোখ ও ভ্রূ, কোঁকড়া চুল এই পটচিত্রের বৈশিষ্ট্য। কালীঘাটের পটে কিন্তু রঙের ব্যবহার সীমিত। নির্দিষ্ট কয়েকটি রঙই ব্যবহার করা হয়েছে বারবার। তাছাড়া কালীঘাটের কোনো পটেই চরিত্রের সংখ্যা বেশি নয়, একটি বা দুটি চরিত্রের ব্যবহার করেই পটুয়ারা ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের অনন্য ছবি তুলে ধরেছেন। সেই অর্থে এই ব্যঙ্গচিত্রকে কিন্তু বঙ্গদেশের প্রথম কার্টুন বলা যেতে পারে।

দুর্ভাগ্যবশত সাধারণ মানুষের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় হলেও তৎকালীন চিত্র সমালোচকরা কিন্তু চিরকাল কালীঘাটের পটকে অবজ্ঞার চোখে দেখেছেন। নাকি সমাজের তথাকথিত উচ্চস্তরে থাকা শিক্ষিত সম্প্রদায় ভয় পেতে শুরু করেছিলেন পটুয়াদের এই অসামান্য ক্ষমতাকে? ব্যঙ্গচিত্র তো চিরকালই প্রশাসন বিরোধী, তাই না?

কারণ যাই হোক, মাত্র একশ বছর টিকে ছিল এই অত্যন্ত আধুনিক পটের ধারা। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে চিরকালের জন্য লুপ্ত হয়ে যায় কালীঘাটের পটচিত্র। লৌকিক পট, সরাচিত্র, চালচিত্র আজও আঁকা হয়ে থাকে। বেশ কিছু পটুয়া পরিবার আজও বর্তমান, কিছু কিছু অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন এনে তাঁরা এখনও বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের পূর্বসূরীর পেশা। কিন্তু কালীঘাটের পট আর আঁকা হয় না কোথাও। হয়ত দুর্লভ জিনিস সহজে মেলে না বলেই।

রুডিয়ার্ড কিপলিং ভারতে থাকার সময়ে পটচিত্রের সৌন্দর্য দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং যথারীতি বেশ কিছু চিত্রকর্ম সংগ্রহ করে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া ও অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে দান করেছিলেন। সেই সংগ্রহে ৬৪৫টি কালীঘাটের পট রয়েছে। প্রাগ মিউজিয়ামেও রয়েছে কালীঘাটের পটের শ্রেষ্ঠ কিছু নিদর্শন। সত্যি কিনা জানি না, তবে শোনা যায় প্রখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসো নাকি প্যারিস থেকে একটি কালীঘাটের পট কিনেছিলেন। সেই পট প্যারিসে পৌঁছল কী করে সেই কাহিনী জানা যায় না। পশ্চিমবঙ্গে গুরুসদয় দত্তের সংগ্রহটি উল্লেখযোগ্য। সেখানে পটশিল্পের নানা ধারার নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।

ছাপানো বই, ছবির উদ্ভবের সাথে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল বাংলার পটশিল্পের। মনোরঞ্জনের জন্য তো নয়ই, লোকশিক্ষার জন্যও পটুয়ারা আজ আর অপরিহার্য নন। প্রায় সব পটুয়ারাই অন্য বৃত্তি বেছে নিয়েছেন। কেউ কেউ এখনও আঁকড়ে রেখেছেন পরম্পরাগত এই শিল্পকে। তবে তা কতদিন আর, সমস্ত রকম পটশিল্পই প্রায় অবলুপ্তির পথে।

তাও ভাবতে ভালো লাগে একদল প্রতিভাশালী শিল্পী ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে লোকশিক্ষার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কখনও মনোরঞ্জন করেছেন সাধারণ মানুষের, কখনও দিয়েছেন ধর্মশিক্ষা, কখনও সমাজের অবক্ষয়ের দিকে তুলে ধরেছেন তরবারির মতোই তীক্ষ্ণ তুলিকা। বদলে কিছুই পাননি তাঁরা। তাঁদের নাম পর্যন্ত অজানা থেকে গেছে কখনও কখনও।  অনন্ত শ্রদ্ধা রইল সেই সাধারণ হয়েও অসাধারণ মানুষগুলির জন্য। তাঁরা না থাকলে গান্ধারপতির কাছে মদ্ররাজকন্যার ছবি পৌঁছতই বা কীভাবে?  

তথ্যসূত্র
https://kothatobolarjonyei.blogspot.com/2012/11/pot.html?m=1 
https://nandimrinal.wordpress.com/2015/09/26/
কালীঘাটের পটের কদর ছিল বিশ্বব্যাপী
http://susmitanandy171927.blogspot.com/2018/06/blog-post_90.html?m=1 http://susmitanandy171927.blogspot.com/2018/06/blog-post_90.html?m=1

বৈশাখী ২০২৪