বেলগাছিয়া মেট্রো থেকে বেরিয়ে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটছে তুলি। মেট্রোর গেট থেকে লাইন দিয়ে লেকটাউনমুখি অটোগুলো দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট দুয়েক হাঁটা পথ। রাস্তার দুপাশে দুটো ক্যাম্পাস। ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অব অ্যানিম্যাল অ্যাণ্ড ফিসারি সায়েন্সেস। তুলি ভেটেরিনারি সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। সেকেণ্ড ইয়ার।ডেইলি স্কলার। গোলপার্কে বাড়ি। বাম দিকের ক্যাম্পাসে ঢুকে ডিন অফিস ছাড়িয়ে ও এগিয়ে যায়। একটা সুন্দর বাঁধানো পুকুর আছে এখানে।ছবির মতো। পুকুরের চারপাশে সারিবদ্ধ দেবদারু। পুকুরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কাউন্সিল বিল্ডিং, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, ভাইস চ্যান্সেলরের কোয়ার্টার। রাস্তার শেষে একটু দূরে লেডিজ হস্টেল। পুকুরের বাঁধানো পাড়ে অফ পিরিয়ডের আড্ডা দিচ্ছে, অহনা, অদিতি, সোহন, সূর্য,মিতি আর শিবপ্রাসাদ। তুলি গিয়ে দাঁড়াল। সপ্তরথীর সমাহার বলা যায় একে। এরকম ছোট ছোট গ্ৰুপ সব কলেজ ইউনিভার্সিটিতেই থাকে। আড্ডা দেওয়ার। পড়ার। পেছনে লাগার।সিনেমা নাটক দেখার। গান করার। এইসব। তুলি আসছে দেখেই সোহন ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে, সবাইকে চুপ হতে বলে। সবাই জানে, এবার তুলির পেছনে লাগবে সোহন। সোহনেই তুলিকে খুব খ্যাপায়। আবার সোহনই তুলির সবচেয়ে ভাল বন্ধুও। মার্চের মাঝামাঝি এই সময়টায় ক্যাম্পাসটা দারুণ লাগে। দেবদারু গাছগুলো যেন পতাকার মতো হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে। বাকি যে সব গাছ আছে, শীতের শেষে কাঁদতে কাঁদতে পাতা ঝরিয়ে ক্লান্ত, তারাও নতুন সবুজ চাদরে মুড়ে নিয়েছে নিজেদের। সবুজের ক্যানভাসে রোদের আলোর আভায় এক আশ্চর্য কোলাজ তৈরি হয়। তুলি এসে দাঁড়িয়েছে তোতা পাখির মতো। কচি কলাপাতার মতো সবুজ একটা নক্সা করা টপ, ডেনিম জিন্সের উপর। খোলা চুল। শ্যমাঙ্গি তুলি কিছু বলার আগেই সোহন বলে, "কাল কোথায় ছিলি তুই? শুনলাম সায়ন্তকে নিয়ে নন্দনে গিয়ে নাটক দেখেছিস ব্রাত্য বসুর ‘উইঙ্কেল টুইংকেল!’ আমাকে একবারও বললি না?" একটা থমকে যাওয়া হাসির আভাস পায় তুলি। সোহনের মুখের দিকে তাকায়। চোখে চোখ। একটু রাগত এ দৃষ্টি। তারপর বাকিদেরকে দেখে। মিতিকেও। তুলি জানে মিতি সোহনকেই পছন্দ করে। সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই। মিতির উপর টানা দৃষ্টি রেখে বলে, "এই মিতি, তুই ওকে খুশি করতে পারছিস না? ওর এত হিংসে কেন? আমি একদিন গ্রুপের বাইরে গিয়ে একটা নাটক দেখলাম , আর তাতেই ও পুড়ে যাচ্ছে। মিতি তুই কিন্তু সাবধান!" তুলির একটা অসম্ভব জেদের জায়গা আছে। ও মিতিকে একদম সহ্য করতে পারে না। মিতি অপূর্ব সুন্দরী। দুরন্ত গানের গলা তার। ওর জন্য ইউনিভার্সিটির অনেকেই পাগল। কিন্তু ওর সীমারেখা অতিক্রম কেউ করতে পারে না। এই ছোট সাতজনের গ্রুপটাও আদতে মিতিকেন্দ্রিক। দিন সাতেক আগে মিতির সঙ্গে সোহনের ঝগড়ার ব্যাপারটা তুলি জানে। সোহনের সঙ্গে কথা বন্ধ ছিল। এর বেশি জানে না। ঝগড়ার পরও মিতি এই কমন গ্রুপে আছে। এভাবে থাকা মানে নিজেকে, নিজেদেরকে আর একটু বোঝা।প্রত্যেকের ব্যাখ্যাগুলো আর একবার শোনা।যাতে ঝগড়া কাটিয়ে আগের মতো সহজ হওয়া যায়।মিতি এখনও কথা বলছে না সোহনের সঙ্গে। মিতির এত বেশি গুরুত্ব পাওয়াকে তুলি কিছুতেই মানতে পারে না। তুলি ফর্সা নয়। মিতির মতো অত সুন্দরী নয়। কুৎসিতও নয়।তবে কেন মিতি বা মিতির মতো সুন্দরীর সঙ্গে ওকে লড়তে হয়? প্রতিদিন।প্রতিমুহূর্তে। এই আজন্ম লড়াই কি ওর একার না ওর মতো মেয়েদের প্রত্যেকের? এই প্রতিযোগিতার জন্ম কি হীনমন্যতায়? এটাই কি জেদের ভিত। মানসিক জটিলতার অদৃশ্য জাল। তুলির উত্তরে গ্রুপের সবাই চুপ করে যায়। মিতি আহত। এতক্ষণ চুপ থাকলেও রাগে ফুঁসতে থাকে। বলে, "কী ব্যাপার বল তো, তুলি তুই কী ভাবিস নিজেকে? তোকে কী এমন খারাপ কথা বলেছে? আর অন্য কারোর কথার জবাব তুই তাকেই দে। কোথা থেকে আমাকে টেনে উত্তর দিলি! এত জটিল কেন তুই? যা , আজ আবার, আয়নায় দেখ নিজেকে। তারপর জুলুম দেখাস। কী আছে তোর?" রাগে কাঁপছে মিতি। সোহন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তুলি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। কোনও কথা বলে না পাল্টা। ঝড়ের মতো ছিটকে বেরিয়ে আসে। হনহন করে হেঁটে চলে যায়। গাছের ছায়ায় বসেই থাকে বাকিরা। তাকিয়ে থাকে সোহনও, তুলির চলে যাওয়ার দিকে। পুকুরের জলে পড়া তুলির প্রতিবিম্বটাও দ্রুত যাচ্ছে। হঠাৎ গাছ থেকে একটা বিবর্ণ পাতা ঝরে জলে পড়ে। একটা তরঙ্গ তৈরি হয়। তুলির প্রতিবিম্বটা খানখান হয়ে যায়। # রিসেসের পর বিকেলের দিকে গাইনি প্র্যাকটিক্যাল। দেবশ্রী ম্যাডামের ক্লাস। সোহনরা সবাই আছে। তুলিও। ঘটনাচক্রে, সোহনদের পুরো গ্ৰুপটাই একই প্র্যাকটিক্যাল ব্যাচে। মাইক্রোস্কোপে একটা স্লাইড দেখছেন দেবশ্রী ম্যাডাম। ওঁর পেছনে এবং পাশাপাশি স্টুডেন্টস। কী হল,কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেবশ্রী ম্যাডাম একশ আশি ডিগ্রি ঘুরলেন। আর ঠিক পেছনেই সোহন। সবার অলক্ষ্যে শিবপ্রসাদ সোহনের পেছন চলে এসেছে। দেবশ্রী ম্যাডামের সুশ্রী ফর্সা মুখ রাগে রক্তবর্ণ। দুটো চোখ বড় বড়।সোহন বিহ্বল। কিছুই বুঝতে পারে না। ম্যাডাম চিৎকার করে বলেন, "হোয়াট দ্য হেল ইউ ডিড, ইউ ইডিয়ট! এত সাহস তোমার হয় কী করে?" সোহনের মুখ ফ্যাকাশে। গোটা ক্লাস থমথমে। মাইক্রোস্কোপের নিচে স্লাইডটা সরে গেছে। পিন ড্রপ সাইলেন্স। শুধু দেওয়াল ঘড়ির টিক টিক আওয়াজ। দেবশ্রী ম্যাডাম থামেন না। "তোমরা বরাবরের বেপরোয়া। বিশেষ করে তোমাদের এই ব্যাচটা। অ্যান্ড লিসেন ইউ অল। ইউ হ্যাভ টু পে আ লট ফর ইওর ইনটলারেবল বিহেভিয়ার! নো বডি উইল বি স্পেয়ার্ড।" কথাগুলো বলতে বলতে ল্যাব থেকে বেরিয়ে যান দেবশ্রী ম্যাডাম সোজা ডিন অফিসের দিকে। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে সোহনের উপর। বেচারা সোহন কিছু বলতেই পারে না। ও জানেই না আসলে কী হয়েছিল। সবাই আলোচনা করে ঠিক করে, যেই কাজটা করে থাকুক, ক্ষমা চাইতে হবে। কার দোষ, কে ম্যাডামের চুল টেনেছিল, কেন টেনেছিল এসব পরে ভাবা যাবে। আগে ক্ষমা চেয়ে পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে হবে।সোহন বলে, "চল ম্যাডামের চেম্বারে। আমি ক্ষমা চাইব।" বিপদের সময় এরকম নীলকন্ঠ হওয়া সোহনের অভ্যাস। ম্যাডামের ঘরে গিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চায় সোহন। দিনের ক্লাস শেষ করে, বিকেল চারটের সময় সবাই বেরোচ্ছে ক্লাস থেকে। সোহনের ঠিক পেছনে তুলি। তার পেছনে মিতি। বাকিরাও আছে। লাইব্রেরির দিকে হাঁটে সবাই। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির গেটে এসে একটু থমকে দাঁড়ায় সোহন। আজ মুড অফ। আর পড়ার ইচ্ছে নেই। মনও নেই। তুলির সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। মিতি সেদিনের ঝগড়ার পর থেকে এখনও অব্দি একটাও কথা বলেনি। ওর আচরণেও কোনও তফাৎ এখনও চোখে পড়ছে না। একটা ভুল করেও তার মধ্যে আত্মগ্লানি হয় না কেন! এটাই মিতির চরিত্রের সবচেয়ে খারাপ দিক। তুলি কাছাকাছি এলে সোহন বলে, "সকালের ঘটনাটা ভুলে যা। সরি। আজ তোর কাছে একটা জিনিস চাইব। দিবি?" তুলি একটু চুপ। অপ্রস্তুত বা অভিমান বলা যায় এই নীরবতাকে। কিছু একটা ভেবে নেয় একটুক্ষণ। আসলে সোহন এত অবলীলায় সবকিছু কেমন যেন ভুলিয়ে দেয়। ঠিক জাদুর মতো। ওর উপরে লম্বা সময় রেগে থাকলে, অন্যদিকের মানুষটাই হাঁপিয়ে যায়। তারপর বলে, "দোষ তো আমারও। অমন রেগে যাওয়া! ঠিক হয়নি । কী চাস বল?" "তোর বিকেল।" "মানে?" তুলি আশ্চর্য হয়। মিতি পাশ দিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকতে যাচ্ছে। সোহন বলে, "বিকেল আলোর চুরি। বুঝিস?" "না।" "চল আমার সঙ্গে।" "কোথায়?" "বলা যাবে না এখন। আগে চল আমার সঙ্গে।" মিতি থমকে আছে। লাইব্রেরির গেটের মুখে। মার্চের বিকেল কী অপরূপ ভাললাগার! উদাস হাওয়া ছুঁয়ে যায় মন। মিতি রাগে, অস্থিরতায়, অধিকারের জোরে তাকিয়ে আছে সোহনের দিকে। এ দৃষ্টি প্রশ্নের, ব্যাখ্যা চাওয়ার, বাধা দেওয়ার এবং ধরে রাখতে না পেরে জ্বলে যাওয়ার। পুকুরের জলে গাছেদের ক্লান্ত ছায়া পড়েছে। মিতির দৃষ্টিক্ষেত্রের ভেতর দাগ কেটে কেটে ইউনিভার্সিটির মেইন গেটের দিকে এগোচ্ছে সোহন আর তুলি। পাশাপাশি। পাল্টা হাওয়ায় মিতি দেখে, সোহন আর তুলির জলজ প্রতিবিম্ব কাঁপতে কাঁপতে একে অপরকে স্পর্শ করছে। মিলেমিশে যাচ্ছে। মিতি মানতে পারে না। চোখ বন্ধ করে। ভাবে, ওর বন্ধ চোখ যেন অসহ্য হাওয়াকে অনেক দূরে সরিয়ে দেবে। ও লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে ধসে যাওয়া একটা পাহাড়ের মতো। অনিন্দ্য সৌন্দর্য আর বহুবিধ গুণের সমষ্টির ভিতে গড়ে ওঠা ওর ব্যাক্তিত্ব আজ একটা সাধারণ কালো মেয়ের কাছে ম্লান। এ অপমান নিতে পারছে না মিতি। তুলি উড়ছে। এতটা সহজ হবে আজকের বিকেল ও ভাবেইনি। সকালের অত বড় একটা অপমান এরকম উপহারে বদলে যেতে পারে, তুলি ভাবেনি। ও উড়ছে পাখির মতো। ডানায় তার বিকেল রোদের গন্ধ। চোখে সবুজ স্বপ্নের সমাহার। স্বপ্নে, অনেক উপরে উড়ানের বার্তা। আজ ও জয়ী।একটা চেনা ছকের সমীকরণকে ও ভেঙে দিয়েছে। ইউনিভার্সিটির গেট থেকে বেরিয়ে সোজা বেলগাছিয়া মেট্রোর দিকে হাঁটছে ওরা। রেশমের মতো চুল উড়ছে তুলির। ভেতরে গিয়ে দুটো টিকিট নেয় সোহন। তুলিকে বলে, "বল তো, কোথায় যাচ্ছি আমরা ?" "জানি না।" "জাহান্নামে।" "তুই একা যা। ওটা আমার জায়গা নয়। আমার তো স্বর্গে যেতে ইচ্ছে করে।" তুলি হাসে। দস্যিপনায়। মেট্রো স্টেশনে কবি কাজী নজরুল ইসলামের বৃদ্ধ বয়সের বিশাল একটা ফটো । ওটাকে অতিক্রম করে টিকিট পাঞ্চ করে প্লাটফর্মে নেমে আসে ওরা। রবীন্দ্রসদনে এসে তুলি অবাক। অসম্ভব এক ভাললাগায় ও বিভোর। এই ভাললাগার উৎসমূল কি মিতিকে হারানোর উল্লাস, না কি হঠাৎ করে সোহনের এরকম স্বপ্নের মতো ঘুরে যাওয়া, ঠিক কী, তুলি বুঝতে পারে না। মিতিকে হারানোর সন্তুষ্টি আর সোহনের সঙ্গে রবীন্দ্রসদনে একাকী আসার ভেতর নতুন সমীকরণ তৈরি করতে থাকে তুলি। সোহন কি আদৌ বিশেষ কিছু ভাবছে তুলিকে নিয়ে, ও ধরতে পারে না। সোহন এমনই । ব্যাপ্ত। গভীর। সাধারণ দৃষ্টি আর বোধে অধরা। এখানেই ও স্বতন্ত্র। এটাই ওর চরিত্রের বিরল বিশিষ্টতা। সোহন, তুলির দিকে চেয়ে, মৃদু হেসে বলে, "বল। আজ নাটক না সিনেমা দেখবি।" "তুইই তো নিয়ে এসেছিস। পছন্দটা তোরই থাক।" "আমার পছন্দ আলাদা।" "কী করতে চাস, বল। আমার আপত্তি নেই।" তুলি ওর চারপাশের অদৃশ্য সীমারেখাটুকু ভেঙে দেয়। নিজেকে ঘুড়ির মতো ওড়ায়। অনন্ত আকাশের দিকে। সোহন বলে, "পাশের সিটিজেন পার্কে বসে তোর সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছে।" "বেশ। তাই চল। বসি।" একটা কোল্ড ড্রিংকসের বোতল নেয়। কিছু স্ন্যাকস। পার্কে বসে। সিটিজেন পার্কে বিকেল, তার অপূর্ব আলোর আভা ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছে। ঘুড়িটা আরও দ্রুতি নিয়ে উর্দ্ধগামি। অনন্ত আকাশের বুকে, বিকেলের সঙ্গে মেশার মতো নেশা নিয়ে উড়ছে।তু লি আনমনে, লম্বা একটা ঘাসের পাতা ছিঁড়ে মুখে নেয়, দাঁত দিয়ে কাটতে থাকে। সোহনকে বলে, "আমার কিছু বলার আছে তোকে। কিছু প্রশ্ন আছে।" সোহন হাসে। বলে, "নির্দ্বিধায় বল।" "দুপুরে, দেবশ্রী ম্যামের ক্লাসে ওই রকম একটা ঘটনা ঘটল। তার দায় তুই পুরো নিলি কেন? শিবপ্রসাদ নিজেই তো ক্ষমা চাইতে পারত।" "ওটা আমার অভ্যেস। কাউকে না কাউকে তো দায়টা নিতেই হত।" সোহনের এই উদারতা মুগ্ধ করে তুলিকে। দেখে, আসলে এটা একটা লিডারশিপ কোয়ালিটি। ওনারশিপ অনেকের সহজাত থাকে যাকে বলে বর্ন লিডার। তুলি আবার বলে, "আজ হঠাৎ আমাকে, এভাবে, এখানে নিয়ে এলি কেন?" "জায়গাটা অপছন্দ তোর?" "না না তা কেন! ভীষণ পছন্দের এ জায়গা আমার। খুব ভাল ফিল করছি। কিন্তু, তুই...।" কথা শেষ হওয়ার আগেই সোহন বলে, "তোর জন্যই। তোর জন্য এতদিন সে অর্থে কিছুই করিনি। কিছু করার ইচ্ছেয় তোকে এনেছি। তোর মুখে হাসি দেখব বলেই।" "কিন্তু কেন? মিতি? ওর জন্যও তো তোর কিছু করা উচিত। ও তোকে এত সঙ্গতা দেয়।" "সে সব কথা তুই বুঝবি না।" একটা প্রবল ভাঙনকে চাপা দেয় সোহন। সন্ধে নামছে। পার্কের হ্যালোজেন লাইটগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। জলের ফোয়ারার রঙিন আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। রবীন্দ্র সংগীতের আবহ ঘিরে আছে চারপাশ। সোহন একটা শাশ্বত সত্যির জায়গাতে পৌঁছয়। মিতি সুন্দরী। অপরূপ তার সুন্দরতা। কিন্তু অহংকারীও তো! ওর কাছে সঙ্গতার দাম কতটুকু। সামান্য বিষয়ে প্রবল ঝগড়া করে। কোনও আত্মগ্লানি নেই। অথচ, সামান্য একটা বিকেলের সময়যাপন তুলিকে যে কত বেশি মাত্রায় খুশি করতে পেরেছে, তা স্পষ্ট হচ্ছে ওর মুখে চোখে ফুটে ওঠা আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর বিবিধ অনুভূতির অনুচ্চারে। কই এই এত খুশি তো মিতির অভিব্যক্তিতে কখনও ফুটে ওঠেনি! এখানেই তুলি অনন্যা। ওর কোনও কৃত্রিমতা নেই। পুরোটা জুড়েই ও। বাইরে ও ভেতরে এক। এটাই ওর সম্পদ।ওর এই অকৃত্রিমতাকে ধরার জন্যই তো এই বিকেল আলোর চুরি। তুলি তাকিয়ে আছে সোহনের দিকে। বলে, “সোহন, চল, এবার বাড়ি ফিরতে হবে!” সোহন ওর মুখের সমস্ত হাসি আর স্বাভাবিকতাকে মুছে ফেলে। এক অদ্ভুত মুখ নিয়ে তুলিকে বলে, "আমাকে ক্ষমা করে দে।" তুলি অবাক। বুঝে উঠতে পারে না, ঠিক কী বলতে চায় সোহন।মু খে বলে, "তুই তো কোনও অন্যায় করিসনি। কেন ক্ষমা চাইছিস?" "অন্যায় তো করেইছি। আজ তোর বিকেলটা চুরি করেছি যে!" তুলি হাসে শব্দ করে। হাসিটা ছড়িয়ে যায় অনেকদূর। তারপর সোহনের হাত দুটোকে নিজের দুই হাতের মধ্যে নেয়। পার্কের আলোয় সোহনকে দেখতে থাকে তুলি।এই দেখা যেন নতুন করে পুরনোকে দেখা। হঠাৎ এক বিকেল জুড়ে বৃষ্টি এসেছে আজ। সুদূরগামী পথিকের মতো সেই হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজছে তুলি। সোহন। জীবনের সমূহ দোলাচল ভেসে যাচ্ছে এই বৃষ্টিতে। বৃষ্টির মিষ্টি শব্দে ওরা কান পাতে আর শোনে এগিয়ে যাওয়ার অমোঘ এক বার্তা। সোহন তুলির মতোই ধরা দেয়। হাতে আরও জোরে চাপ দেয় তুলি। রিফ্লেক্সে চিৎকার করে ওঠে সোহন। বলে, "আরে খেপি, লাগছে । ছাড় এবার। সত্যি বলছি, তোর কোনও বিকেল আর আমি চুরি করব না। কখনও না।" তুলি ছেলেমানুষির জেদে হাত দুটো ছাড়ে না। তুলির এই উচ্ছ্বলতায় সোহন মুগ্ধ। কথা বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে। তুলির দিকেই। লক্ষ করে, অনতিদূরে, জলের ফোয়ারায় বিভিন্ন রঙের আলোর ছটা তুলির সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তুলির খোলা চুলে বিম্বিত হচ্ছে এক আশ্চর্য বিভা। ওর ঠোঁট নড়ছে। আর খেপির মতো বলে চলেছে, "বল। বল। কথা দে। আজ থেকে তুই আমার সব বিকেলেই চুরি করবি।"