আমার বাপের বাড়িতে যে কোনও পুজোর আগে নিয়ম করে সংযম করা হত। সেদিন আমরা মেয়েরা মাথায় সাবান (হ্যাঁ, তখন শ্যাম্পু করা কে সাবান দেওয়াই বলা হত) দিতাম আর মরসুমি তরকারি দিয়ে ভাতে ভাত খাওয়া হত। আমার মাসিরা যেহেতু কাছেই থাকত, তাই তারাও মার সঙ্গেই উপোস করতো। আর সঙ্গে আমি লেজুড় তো ছিলামই। তা সে শিবরাত্রি হোক বা নীলের পুজো অথবা বিপত্তারিণী - সব পুজোর পরের দিন কিন্তু নিরামিষ খাওয়াটা মাস্ট ছিল। কারণ আগের দিন উপোস, তাই শরীর দুর্বল আর গ্রীষ্মপ্রধান দেশ (এখানে শুধু আমার বাংলার কথা বলছি). তাই উপোসের পরের দিন নিরামিষ খেলে শরীর ভাল থাকবে, অযথা পেট খারাপ হবে না। এই ছিল মার নিয়ম। তা এই নিরামিষ মেনুতে কী কী থাকত? সে তো অনেক বড় লিষ্টি! কিন্তু মেনুতে যে দু'তিনটে জিনিস থাকতেই হবে, সেগুলো হল তেতো - সে ডালে বা শুক্তোতে অথবা শাকের কোন তেতো পদই হোক। মাঝে পোস্ত, নয়তো ছানার বড়ার তরকারি। তাছাড়া অন্য কোনো নিরামিষ তরকারি আর শেষ পাতে টমেটো সহযোগে কুলের টক বা আমের টক-মিষ্টি ঝোল। সেটা আবার খাওয়ার শেষে জনে জনে কাপে করে দেওয়া হত। এখন যতই সুদৃশ্য চাটনির বাটিতে দেওয়া হোক না কেন, সেই অনুভূতিটা কিন্তু স্পেশাল ছিল। এখন দিন বদলেছে, অনেক কিছু পাল্টে গেছে। সুস্থ থাকতে গেলে কী কী খাব আর কীভাবে খাব - সবই তো নেট থেকে দেখে শিখি আমরা। সেখানে আমাদেরকে বলে দেওয়ার জন্য কত জ্ঞানী-গুণী মানুষ বসে আছেন। অথচ এই যে উপোস করার পর তেতো, ঘি (এখন যেটা ভীষণভাবে প্রচার পাচ্ছে গুড ফ্যাট বলে), পোস্ত আর টক খাওয়া শরীরের পক্ষে স্বাস্থ্যকর, এর সবটাই কিন্তু বিজ্ঞান মেনে । আমার মা-মাসিরা দিদার থেকে এই নিয়মে খাদ্যতালিকা সাজাতে শিখেছে এবং দিদা তার মার থেকে আর ধরেই নিচ্ছি দিদার মাও তাঁর মার কাছ থেকে এই রকম ভাবে খাওয়া-দাওয়া শিখেছেন। তাহলে কেন আমরা এই শুধু শুধু খাওয়ার সম্বন্ধে ভাল-মন্দ জানতে পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে থাকব? যেখানে আমাদের নিজেদের খাদ্য পরম্পরা রীতি-নীতি এতটাই সমৃদ্ধ! এবার আসি মুল কথায়। আমি এখানে যে রেসিপির কথা বলছি, সেগুলি হয়তো কালের নিয়মে হারিয়ে যায়নি। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আজ না হয় কাল হারিয়ে যাবে। তার প্রধান কারণ আজকালকার প্রজন্মের জীবন থেকে পুজো-আচ্চার নিয়মকানুন প্রায় উঠেই গেছে। আমি নিজেই এখন নীলষষ্ঠী ছাড়া আর কিছুই তো করি না। তাই উপোসের পর নিয়ম করে শুক্তো বা তেতো খাওয়াও তো উঠে যাবে। আমি বলছি না তারা মাঝেমধ্যে খাবে না। খাবে - তবে যখন ইচ্ছে তখন, মানে শখ করে। শুক্তো, মানে পাঁচ রকম মরসুমি সব্জি দিয়ে যে শুক্তো হয় আমি এখানে সেটার কথা বলব না। আমি ঝিঙে আর ঢুলা শাকের শুক্তোর কথা বলব। শীতের বিদায় আর গ্রীষ্মের আগমনের মাঝের সময়টাতে সবে কচি কচি ঝিঙে উঠতে শুরু করে বাজারে। মায়ের থেকে শেখা ঝিঙে দিয়ে দুধ শুক্তো রান্না করি আমি। প্রণালী: কচি কচি ঝিঙেগুলো সরু সরু লম্বা করে কেটে রাখুন। তেল গরম হলে রাঁধুনি, সরষে আর শুকনো লংকা ফোড়ন (হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন, লংকা - এখানে শুধু গন্ধের জন্য ব্যবহার করা হয়) দিয়ে ঝিঙেগুলো দিয়ে দিন। কিছুক্ষণ পরে নরম হয়ে এলে নুন দিয়ে দেবেন। ঝিঙের থেকে জল বেরোবে, গ্যাস বাড়িয়ে সেই জলটাকে মেরে ফেলতে হবে (তবে সবটা নয়)। এরপর সামান্যই সর্ষে-পোস্ত বাটা। তারপর নামাবার আগে অল্প দুধে আদাবাটা আর ঘি দিয়ে গ্যাস বন্ধ করে ঢেকে দিন (যাকে বলে স্ট্যান্ডিং টাইম)। এ তো গেল ঝিঙের শুক্তো। আর রইল ঢুলা শাকের শুক্তো। এই শাকটা লাল শাকের মতই দেখতে হয় কিন্তু ডাঁটিগুলো ফাঁপা থাকে। ভাঙলে মট-মট করে ভেঙে যায়। এই শুক্তোর রেসিপিও একই তবে এর মধ্যে কচি পেঁপে পাতলা পাতলা করে কেটে দিতে হয়। চাইলে বাঙালিদের প্রিয় আলুও দিতেই পারেন। আর হ্যাঁ, দুধের বদলে জল দেবেন। নামাবার আগে একটু পিটুলিগোলা, মানে আটা গুলে দিতে হবে। যদিও পিটুলিগোলা মানে আতপ চাল বাটা। ঐ দেখ, আরও কয়েকটা প্রথম পাতের রান্নার কথা মনে পড়ে গেল। ছোলা বা কলোই শাক এই দুটো শাক শুধুই শীতকালে পাবে। যতই বারোমাস সব কিছুই পাওয়া যাক, এই শাকগুলো কিন্তু পাবে না। এই শাক দুটো বাছাই করার বড় ঝামেলার, তাই এই শাক রান্নার পদ্ধতিও বেশিদিন এই পৃথিবীতে থাকবে বলে মনে হয় না। রান্নার মাসির সাথে গল্প করতে করতে বা ছানা-পোনাদের পড়াশোনা দেখতে দেখতে আগের দিন শাকটা বেছে রাখবেন, তাহলে সুবিধা হবে। না না, রান্নার মাসি আপনার মত অত সূক্ষ্ম আর যত্ন করে বাছবে না! তাই এই মহৎ কাজটা আপনাকেই করতে হবে। বাছার সময় খেয়াল করে শুধু পাতা গুলো নেবেন, একটাও ডাল নেবেন না। আর যদি কলোইশাক হয়, তাহলে শুধু মাথাগুলো ভেঙে নেবেন। যতই গল্প করুন না কেন, শাক বাছতে হবে মন দিয়ে, কারণ একটু এদিক-ওদিক হলেই খেতে বসে আপনার বাড়ির লোকের মুখে শক্ত ডাঁটা পড়বে। সেটা খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে যাবে। প্রণালী রান্নার করার আগে একটু গোবিন্দভোগের চাল ভিজিয়ে রাখুন। তেলে শুকনো লংকা ফোড়ন দিয়ে শাকটা দিয়ে দেবেন। দেখবেন শাক নাড়াচাড়া করতে গিয়ে শুকনো লংকাটা ভেঙে ফেলবেন যেন! লংকাটির ভূমিকা রান্নার শেষে বলা আছে। নুন আর সামান্য হলুদ দিয়ে ঢেকে ঢেকে শাক নরম হওয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এবার ভিজিয়ে রাখা গোবিন্দভোগ চাল এক ইঞ্চি আদার সঙ্গে বেটে নিয়ে শাকের উপরে এই বাটা গোলাটা দিয়ে ভাল করে নাড়াচাড়া করে নামিয়ে নিন। শেষে ছোট বাটিতে শাকটা সুন্দর এক জায়গায় করে মাঝখানে ঐ শুকনো লংকাটিকে গুঁজে দাঁড় করিয়ে দিন। দেখবেন ডাইনিং টেবিলে এমন করে সাজিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পদটি সবার নজর কাড়বে। তেতোর কি আর শেষ আছে বাঙালির পাতে! শিউলি পাতার গরম গরম বড়ার সঙ্গে প্রথম পাতে ঘি দিয়ে ভাত বা শিউলি পাতা আর কচি লাউ দিয়ে তেতো মুগ ডাল। তারপর আলু কুচিয়ে গীমা শাক, ব্রাহ্মী শাক - এই তেতোর কি অভাব আছে আমার খাল- বিলের দেশে! আমি ভেবে অবাক হই, কত কত বছর আগে আমাদের রান্না ও খাওয়ার পদ্ধতি কতটা বৈজ্ঞানিক ছিল! তাহলে এখন আমরা কেন অন্যের থেকে শিখব? আমি বিশ্বাস করি এই প্রজন্ম যদি তাদের অশেপাশে মা-মাসিদের রান্নাঘরে একটু উঁকি মারে তাহলেই হবে। ঘন্টার পর ঘন্টা ইউটিউব বা ফেসবুক খুঁজে মরতে হবে না। আমাদের "রান্নাঘর" অনেক বেশি আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক। সবাই যদি চেষ্টা করি, তাহলে কিছু হারিয়ে যাওয়া রান্নাও বেঁচে থাকে।