অসমাপ্ত ডায়েরিটা

পশ্চিম বর্ধমান

ঠিক যেমন চাইলেই নিজের আকারের বড় কিম্বা ছোট ফটোফ্রেমে নতুন করে ফিট বসা যায় না, ঠিক তেমনিই নতুন করে অন্য কারুর মারফৎ সব ফিরে পাওয়ার বাসনাটা অতটাও সহজ হয় না। সব কেমন ধোঁয়াটে লাগে, চলন গমনে অসুবিধা হয়, যেন সংঘাত লাগে প্রতি মুহূর্তে একটা সত্তার সঙ্গে অন্যটির। তাহলে কি এটাই শেষ? এইভাবেই সব চলতে থাকবে?  

মুক্তার খুব অবাক লাগে আজকাল। শুধু মুক্তা নয়, বরং গোটা ক্লাস এমনকি স্কুলের টিচারদেরও এটা নজরে পড়ে বেশ। যে মেয়েটা কিনা লাস্ট বেঞ্চে বসত, প্রতিটি পরীক্ষায় কোনরকমে পাশ করত, সে কিনা এই দশদিনে সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ফার্স্টবেঞ্চে বসা, প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়া, ইউনিট টেস্টে সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়া, এগুলো সব একসঙ্গে কিভাবে রাতারাতি হয়ে গেল সেটাই কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। আমি আড়চোখে সবার মুখের ভাবগুলো দেখি। আমার হাসি পায়। ওরা আমাকে চিনতে পারে না, কিন্তু আমি ঠিক চিনতে পারি। ওদের সবাইকে। আর আড়চোখেই খুঁজে চলি তাকে।  

“মন্দিরা খুব বদলে গেছে তাই না?” রেখা ম্যাডামের কথা শুনে শিখা ম্যাডাম বললেন, “হ্যাঁ, আমিও এটাই ভাবছিলাম। মেয়েটা যেন রাতারাতি মন্দিরা থেকে…” বলতে বলতে চুপ করে গেলেন তিনি। টিচারস রুমে মুহূর্তেই একটা নীরবতা নেমে এল। সবাই জানে কী হয়েছিল সেদিন। কিন্তু কেউ আর আমার ব্যাপারটা নিয়ে কোন কথা বলল না। আমি চুপিসাড়ে সরে এলাম ওখান থেকে। সে আজও আসেনি। অপেক্ষা করতেই হবে।

দেখতে দেখতে আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা এসে গেছে। আমি নীরবে মাথা নিচু করে পরীক্ষার হলে ঢুকলাম। “স্টুডেন্টস, কিপ ইওর ব্যাগস আউটসাইড…,” গলাটা কানে আসতেই মুখটা তুললাম। সে এসেছে আজকে। খুব উত্তেজিত লাগছে আমার। সেই মুখ, সেই আওয়াজ আর সেই লোক। আমি ওকে ভালোভাবে দেখলাম। ও আমাকে একঝলক দেখল, কিন্তু চিনতে পারল না। পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আজকেও সেদিনের মতোই ইংলিশ পরীক্ষা। ঝড়ের গতিতে আমি লিখে চলেছি সব সিন, আনসিন। কিন্তু নজর আমার ওর দিকেই। আজকেও সময়ের আগেই পেপার কমপ্লিট আমার। জমা দিয়ে বেরোনোর সময়ে ওর বিস্মিত নজর দেখে আমার হাসি পাচ্ছিল। আমি বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম, সেইখানে যেখানে সেদিনও দাঁড়িয়ে ছিলাম…।

“স্যার, প্লিস এরকম করবেন না। আমার কষ্ট হয়…” 

“আরে মোনালিসা, তুমি কি চাও না ক্লাসে প্রতিবার তুমিই ফার্স্ট হও? আমি তোমাকে এক্সট্রা কেয়ার করবো, ফুল মার্কস দিয়ে দেবো। এসো, এসো এদিকে…”

“স্যার, প্লিস, আমাকে ছেড়ে দিন…”

না সেদিন, না কোনদিন ও আমাকে ছেড়েছিল। স্কুল শেষে একদিন ফাঁকা ক্লাসরুমে কিছু পড়ার ব্যাপারে ডিসকাস করার নামে আমাকে ডেকে  যে পৈশাচিক কাজটা করা শুরু করেছিল, সেটা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমাকে ফেল করার ভয় দেখিয়ে জারি রেখেছিল। আর যেদিন আমার সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেছিল সেদিন, স্কুলের ছাদ থেকে আমাকে…।

আমার পরিধি সীমিত, কিন্তু আমার বেস্টফ্রেন্ড মন্দিরার নয়। ও সেদিন আমার অসমাপ্ত ডায়েরিটা পড়ে আঁচ করতে পেরেছিল আসল সত্যিটা। এরপর শুরু হয় অসম্ভব পড়াশুনা এবং দ্বিতীয় মোনালিসা হয়ে ওঠার লড়াই। আমি মিশে ছিলাম ওর সত্তার সাথে, অতএব ওকে আটকায় কে! মন্দিরার এহেন অগ্রগতি ঐ পিশাচ মানে সিনিয়ার টিচার রাকেশেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। ও এবার টার্গেট করে মন্দিরাকে। মন্দিরা এটাই চেয়েছিল, আর আমিও। 

আজকে প্রতিটি নিউজ চ্যানেলে শহরের নামি স্কুলের একজন সিনিয়ার টিচারের আত্মহত্যার খবর দেখাচ্ছে শুধু। পিশাচটার কদর্যরূপটা সবার সামনে বেরিয়ে এসেছে, শুধু মন্দিরার জন্য। আর এটাও জানা গেছে আমি সেদিন আত্মহত্যা করিনি। এরপর পিশাচটার আত্মহত্যা ছাড়া আর কী গতি ছিল! আমার অসমাপ্ত ডায়রিটা যেন সমাপ্তি পেল পরিশেষে। মন্দিরা হাউহাউ করে কাঁদছে। একটু যদি জড়িয়ে ধরতে পারতাম ওকে…!

বৈশাখী ২০২৪