আশিতে আসিও না

নয়ডা, দিল্লি

রবিবার সকালে ড্রয়িংরুমে বসে পেপার উল্টাচ্ছিলেন ডাঃ অমিতেন্দ্র নাথ সরকার। নামকরা জেরিয়াট্রিশান (বার্ধক্যজনিত রোগের চিকিৎসক) হিসাবে ডাঃ সরকারের খুব নামডাক আছে। সপ্তাহভর প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর এই একটা দিনই তিনি বিশ্রামের সুযোগ পান। ডাঃ সরকারের বয়েস প্রায় ষাট বছর যদিও চেহারার সেইভাবে বয়েসের ছাপ পড়েনি বলে যা বয়েস তার চেয়ে কম দেখায়। গায়ের রঙ বেশ ফরসা, দেখতেও তিনি খুব সুপুরুষ। ডাঃ সরকার বিয়ে করেননি। পরিবারে তাঁর বৃদ্ধা মা ছাড়া আর কেউ নেই। 

 বাড়ির পুরনো কাজের লোক ভগীরথ এসে ডাঃ সরকারকে বলল, “একটা লোক এয়েছে আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমি তারে অনেক করে কইলুম যে রোববার ডাক্তারবাবু কারও সঙ্গে দেখা করেন না কিন্তু লোকটা যাচ্ছে না। বলে কিনা আপনি তারে চেনেন!” 
কাগজ থেকে মুখ তুলে ডাক্তার বাবু বললেন, “চেনা লোক! নাম বলেছে কিছু?” 
“না, নাম বলে নাই!”
“তাহলে আগে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করে এসো বরং ওনার কাছে কার্ড থাকলে সেটাই নিয়ে এসো!” 

খানিকক্ষণ বাদে ভগীরথ  'ডাঃ অনুজ মিত্র' নাম লেখা একটা কার্ড এনে হাতে দিল৷ নাম দেখে ডাক্তার সরকার বললেন, “ভগীরথ তুমিও বুড়ো হয়ে সব ভুলে যাচ্ছ, একে তো তুমি চেনো। আজকাল আর না এলেও আগে আমাদের বাড়িতে অনেকবার এসেছে। যাও এখানে নিয়ে এসো আর ওর জন্য কিছু খাবার পাঠিও।”

ড্রয়িংরুমে ভগীরথের সঙ্গে যে এল তাঁর বয়েস আন্দাজ বত্রিশ। গায়ের রঙটি সামান্য কালো হলেও মুখশ্রী বেশ সুন্দর। সুগঠিত চেহারা, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল তবে অতিরিক্ত লম্বা হবার কারণে একটু রোগা দেখতে লাগে। ছেলেটি প্রণাম করবার জন্য মাথা নামাতে যায়।
“আরে না না। প্রণাম করতে হবে না। তারপর বলো, তুমি কেমন আছো? কী যেন একটা বিষয়ে রিসার্চ করছো - পেপারে তোমার অ্যাড বেরিয়েছিল মনে আছে।” 

 স্যার, ওই ব্যাপারেই আপনার কাছে এসেছি। জেনেটিক্স নিয়ে রিসার্চ করছি। স্যার, আপনি কি ডেভিড সিনক্লেয়ারের 'লাইফ স্প্যান - হোয়াই উই এজ - অ্যান্ড হোয়াই উই ডোন্ট হ্যাভ টু ( কেন আমরা বৃদ্ধ হই আর কেন আমরা বৃদ্ধ হব না) বইটা পড়েছেন? 

ডাঃ সরকার হেসে বলেন, “সারা পৃথিবীতে সিনক্লেয়ারের বইটা হট কেকের মতো বিক্রি হচ্ছে। অ্যাস আ জেরিয়াট্রিশিয়ান স্বাভাবিকভাবে আমারও ব্যাপারটা জানতে খুব আগ্রহ হয়েছিল। যাই হোক, আগে তুমি খাবারটা খাও তারপর আমরা এই ব্যাপারে আলোচনা করব!” 

ভগীরথ একটা প্লেটে ধোঁয়া বেরুচ্ছে এমন  চারটি মটরশুঁটির কচুরি আর শুকনো সাদা আলুর দম  দিয়ে গেছে। সঙ্গে দুটো জাম্বো সাইজের চমচম। অনুজ কচুরি ছিঁড়ে আলুরদম দিয়ে মুখে ফেলে চোখ বুঁজে ' আঃ ' বলে ওঠে। ডাঃ সরকার তাড়াতাড়ি বলেন, “ কী হল! জিভে গরম লাগল নাকি? 
“না স্যার, আপনি বড্ড বেরসিক। এই আলুর দমটা পৃথিবীতে শুধু আপনার বাড়িতেই তৈরি হয়। আগেও খেয়েছি কিন্তু প্রতিবারই নতুন বলে মনে হয়। আপনার কুকটিকে আমি একদিন ঠিক কিডন্যাপ করব!”
 “তাহলে আমার মাতৃদেবীকেই অপহরণ করতে হবে। আমার বাড়ির সব রান্নাবান্না চলে আমার মায়ের নির্দেশে। আজকাল আর নিজে রান্না করতে পারেন না কিন্তু রান্নার সময়ে মোড়া নিয়ে কিচেনে বসে থাকেন।” 

খাওয়াদাওয়া শেষ করে অনুজ বলে, “স্যার এবার যে বিষয়টা নিয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি সেটা বলি। সারা পৃথিবীতে বর্তমানে যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি রিসার্চ চলছে সেটি হলো এপিজেনেটিক্স। এই রিসার্চের জন্য সবচেয়ে বেশি টাকাও বরাদ্দও রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ বরাদ্দ এই অর্থের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৬০ হাজার কোটি মানে ৬০০ বিলিয়ন ডলার। কাজেই বুঝতেই পারছেন কেউ যদি বার্ধক্য রোধ করার উপায় বের করতে পারে তবে তা হবে মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে চমকপ্রদ আবিষ্কার!” 

ডাঃ সরকার হেসে বলেন, “অলরেডি হরমোন থেরাপি করে বার্ধক্য পিছিয়ে দেওয়া  হচ্ছে। এটা তো নতুন কিছু নয়! বহুদিন ধরেই বিদেশে মহিলাদের মেনোপজের পরে হরমোন থেরাপি করা হয়। আজকাল এদেশেও শুরু হয়েছে।”

“হ্যাঁ, স্যার জানি,  কিন্তু হরমোন থেরাপির কিছু সাইড এফেক্টও আছে। বাইরে থেকে ইস্ট্রোজেন প্রোজেস্টেরন দেওয়ায় অনেক সময় অন্য গ্ল্যান্ড তাদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। দেখা গেছে হরমোন থেরাপি করতে গিয়ে অনেকেরই ডায়াবেটিস এসে যাচ্ছে। তাই আমি এক্সটার্নালি হরমোন থেরাপির পক্ষে নই।” 
“তাহলে আর কিভাবে বার্ধক্য রোধ করা সম্ভব?” 
“স্যার, আপনি তো জানেন এজিং নির্ভর করে দুটি ফ্যাক্টরের উপর। একটা হলো জেনেটিক্স অর্থাৎ বংশগত ভাবে যা আমরা পাই বাবা মায়ের থেকে আর একটা হলো অ্যানালগ থিওরি যাকে বলা হয় এপিজিনোম। আমাদের শরীরের সেলগুলোতে কোন জিন অ্যাক্টিভ থাকবে আর কোনটিকে বন্ধ করে দিতে হবে সেটি যে পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত হয় সেটাই হলো এপিজেনেটিক্স। আমি এর উপর রিসার্চ করছি এবং বেশ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছি!” 

“বার্ধক্য রোধ যদি সত্যিই সম্ভব হয় তবে তো মৃত্যুই আর থাকবে না!”

“না না স্যার, মৃত্যু বন্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু  মানুষের লাইফ স্প্যান বাড়িয়ে দিতে চাইছি কিন্তু আমার রিসার্চ চালিয়ে নেওয়ার জন্য সেটি হিউম্যান বডিতে প্রয়োগ করে দেখতে হবে! তাই জন্য ভলান্টিয়ার প্রয়োজন। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে কিছু ভলান্টিয়ার জোগাড় করেছিলাম, তাঁদের খানিকটা সাম্মানিক অর্থও দিয়েছি, বেশ ভালো প্রগেসও হচ্ছিল। কয়েকটি পেপারও লিখেছি এই ব্যাপারে কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ বড্ড অজ্ঞ। যেই শরীরে যৌবনের রেশ দেখা যাচ্ছিল অমনি ভলান্টিয়ারদের বাড়ির লোক ভাবতে আরম্ভ করল যে আমি বোধহয় তন্ত্র মন্ত্র কিছু একটা করছি, তাঁরা ভয় পেয়ে ভলান্টিয়ারদের সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এইরকম হলে আমি কী করে প্রগ্রেস করব স্যার? পুরো ব্যাপারটা আমাকে হাতেকলমে পরীক্ষা করে দেখতে হবে পূর্ণাঙ্গ রিসার্চ পেপার সাবমিট করার আগে।” 
“সবই বুঝলাম অনুজ কিন্তু এই ব্যাপারে আমি তোমাকে কী ভাবে সাহায্য করতে পারি? আমার বয়েস ষাট, কিন্তু আমি এখনও বেশ কর্মক্ষম। আমার পেশেন্টরা আমার জন্য ওয়েট করে আছে। আমি বাপু তোমার ল্যাবের গিনিপিগ হতে পারবো না। 
“স্যার, আমি অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি।” 
“একটা কথা ভাবছি। আমার মা স্বর্ণলতা দেবীর বয়েস প্রায় আশি কিন্তু এখনও যথেষ্ট শক্তপোক্ত আছেন। মা তেমন পড়াশোনা না শিখলেও বেশ আধুনিক মনের মানুষ। বাবা মারা যখন যান তখন আমি দেড় বছরের। একা হাতে আমাকে মানুষ করেছেন আবার আমাদের সম্পত্তিও সামলেছেন। মাকে গিয়ে সব বল, মা রাজি হলে তোমার আর কোন সমস্যা  থাকবে না।” 
অনুজ জিজ্ঞেস করে জেনে নেয় ডাঃ সরকারের মা দোতলায় কোথায় আছেন। গিয়ে দেখে একজন বৃদ্ধা জলচৌকিতে বসে জাঁতি দিয়ে সুপুরি কুচি করছেন। নিজের পরিচয় দিতে উনি  অনুজকে বলেন, “ওই চেয়ারটা টেনে নিয়ে কাছাকাছি এসে বসো দিকি! আজকাল আমি কানে একটু উঁচু শুনছি, দূরে বসলে শুধু বকেই মরবে। আমি কিচ্ছুটি শুনতেই পাবোনিকো। তারপর বলো দিকি আমার কাছে  কেন এয়েচো?”  
“আমি তো আগে অনেকবার এসেছি আপনাদের বাড়িতে। আপনার হাতের রান্নাও খেয়েছি।”

“অ, আগে এয়েছিলে! আমার বাপু আজকাল কিচ্ছুটি মনে থাকে না। তারপর কী মতলবে একেনে আগমন সেটি বলো দেকি?” 

“এই যে আপনি সবকিছু ভুলে যান বলছেন সেটি যদি আমি সারিয়ে দিই তাহলে কেমন হবে?”

“অ, বুঝলুম খোকা আবার একখান ডাক্তার পাকড়ে এনেছে। খোকার মনে হয় এখনই ভীমরতি ধরেছে! বুড়ো হলে মানুষের বিস্মরণ ঘটবে, তাপ্পর ভীমরতি ধরবে, তাপ্পর সে অক্কা পাবে, এটিই পৃথিবীর নিয়ম। ভগবানের সেই  নিয়মকে তুমি কী করে পালটে দেবে চাঁদু? তা তোমার কি বে থা হয়েছে নাকি  আমার পুত্তুরটির মতো লবকাত্তিক হয়ে ঘুরে মরতেছো?”
“না না, এখনও বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। আমি যে কাজটা করছি, সেটা যতদিন না শেষ হয় ততদিন বিয়ে টিয়ে করা আমার দ্বারা হবে না। তবে আপনাকে আবার আমি যৌবনে ফিরিয়ে দিতে পারি!” 

“বুজলুম তোমার মাথার ব্যামো আছে। বে থা ঠিক বয়েসে না করলে লোকের এমনটাই ঘটে। আমার সুপুত্তুরটিকে দ্যাকো, বুড়ো হয়ে গেল কিন্তু বে করল নিকো৷ আমার এই কতাখানা বুজিয়ে বলো দেকি, কাজের সঙ্গে বউয়ের কী সম্পক্কো? সে থাকবে তোমার ঘর আলো করে, তোমার ঘরের নক্কি হয়ে, তুমি ঘরে এসে তার চাঁদপানা মুকখানা দেখবে তবেই না তোমার বাড়িখানাকে ঘর বলে মনে হবে। তোমার কাজে মন বসবে!”

“আপনি যদি আমাকে একটু সাহায্য করেন তবেই আমার কাজটা হয়ে যাবে আর আপনাদের আশীর্বাদে হয়ত তখন  আমার বিয়েটাও হয়ে যেতে পারে!” 

“আমাকে কি ঘটকী ঠাকরুন ঠাওরালে নাকি গো? আমার কি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেইকো যে রাজ্যি সুদ্দি লোকের বে দিয়ে বেড়াব? চটপট কেটে পড়ো দিকি” 

“এই যে এতো ফাইন করে সুপুরি কুচি করছেন সেটা দিয়ে চিবিয়ে পান খেতে পারেন?” 
 স্বর্ণলতা দেবী হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলেন, “দাঁতে কি আর সেই জোর আছে? এই কুচিকে হামানদিস্তা দিয়ে গুঁড়ো করে তবেই খেতে পারব।”
“হামানদিস্তে দিয়ে কি আপনি নিজেই গুঁড়ো করতে পারেন?” 
 “ধুস! হাতে কি আর সেই জোর আছে? এখন তো হাঁটতে গেলেও দুমদাম পড়ে যাই!” 
 “আমার কাছে এই সবকিছুর ওষুধ আছে। এই যে আপনার চামড়া ঢিলে হয়ে গেছে, চোখের দৃষ্টি কমে গেছে, দাঁত নড়ছে, এই সবকিছু ঠিক করে দিতে পারব যদি তিনটি মাস আপনি আমার কথা শুনে চলেন!”  
“তুমি ম্যাজিক জানো বুজি! আচ্চা, ম্যাজিক দিয়ে যদি শরীরটাকে ঠিক করে দিতে পারো তবে বাপু আমি রাজি আছি!” 


অনুজ স্বর্ণলতা দেবীর ওপর পরীক্ষা করার জন্য নিজের জিনিসপত্র নিয়ে ডাঃ সরকারের বাড়িতে এসে উঠল। স্বর্ণলতা দেবীর সবসময়ের দেখাশোনার লোক মায়ার মা অনেক ওজর আপত্তি করেছিল কিন্তু অনুজ তাকে স্বর্ণলতা দেবীর ঘরে ঢুকতে মানা করে দিয়েছে। ওনার খাবার নিচ থেকে নিজেই নিয়ে আসে আর যখন বাইরে যায় তখন দরজায় তালা লাগিয়ে যায়। শুধু দিনে একবার ডাঃ সরকারকে ভিতরে ঢুকতে দেয়। 
 তিনমাস ধরে ডাঃ সরকার একটা অদ্ভুত অপ্রাকৃত জিনিসের সাক্ষী হলেন। অনুজ কী কী মায়ের উপর প্রয়োগ করেছিল তা তিনি জানেন না কিন্তু ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হতে থাকল। 
মায়ের মাথার সামনের দিকের চুল পাতলা হয়ে এসেছিল সেই ফাঁকফোকর ছোট ছোট কালো চুলে ঢেকে গেল। মায়ের মুখে যে অজস্র বলিরেখার আঁকাবাঁকা দাগ ছিল সব মিলিয়ে গিয়ে মুখের চামড়া সুন্দর মসৃণ হয়ে উঠল। আগে হাত পায়ের চামড়া ঝুলে গিয়েছিল, তার বদলে সুগোল শক্তপোক্ত  হাত পা তৈরি হল। 
আগে স্বর্ণলতা দেবী একটু এদিক ওদিক হলেই পেটের অসুখে ভুগতেন, এখন দুবেলা ওঁর খোরাক দেখলে যে কোন লোক লজ্জা পাবে৷ সকালে ডজন খানেক লুচি, দুপুরে ঘি ভাত, রাতে রাবড়ি দিয়ে ওনার কথা অনুযায়ী কোনো রকমে পিত্তরক্ষা করেন। 
চেহারায় শুধু পরিবর্তন হয়নি, মানসিক দিক দিয়ে নানারকম সমস্যা দেখা দিলো। কখনও তিনি নিজেকে যুবতী ভাবেন আবার পরমুহূর্তেই আশি বছরের বুড়ির মতো কথা বলেন। অনেক কিছুতে পরিবর্তন হলেও মাতৃস্নেহ কিন্তু পালটায়নি। শুধু নিজের বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর খোকার বয়েসও ভুলে গেছেন। তাঁর ধারণা অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে অকালে তাঁর খোকা বুড়িয়ে গেছেন। ষাট বছরের ছেলেকে দেখে ত্রিশের মা চোখে আঁচল চাপা দেন আর বলেন, “অসুখবিসুখ বাঁধিয়ে তোর খেয়াল রাখতে পারিনি। এইবার তোর বে দিয়ে বউ আনব। বউয়ের সেবাযত্নে যদি তোর শরীরটা ঠিক হয়।” 
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে অনুজের, স্বর্ণলতা দেবী ওকে কী ভাবে যেন ম্যানেজারবাবু ঠাউরে নিয়েছেন। একদিন অনুজের সামনেই বলে বসলেন, “কী সব চিমড়ে মার্কা চামচিকেকে ম্যানেজার বানিয়েচিস খোকা। রাতদিন আমায় এটা করবেন না, সেটা খাবেন না বলে জ্বালিয়ে মারতেচে!  একদিন ঠিক এটাকে কুলোর বাতাস দে দূর করে দোব!”
আবার মনমেজাজ ভালো থাকলে ছেলেকে ডেকে বলেন, “ওই চিমড়ে চামচিকে ম্যানেজারটার কাছে কিন্তু ভালো ওষুধ আছে। ও ম্যানেজার বাবু, আমার খোকার শরীরটাকে একটু ঠিক করি দাওনি গো!”

অনুজ আজকাল মনমরা হয়ে ঘোরে। একদিন ডাঃ বিশ্বাসকে এসে বলল, “স্যার এই আবিষ্কার দিয়ে মানুষের শরীরকে  তরুণ করতে হয়ত পারছি কিন্তু মন যে শরীরের সাথে একসূত্রে চলছে না! ত্রিশের শরীরে আশি বছরের বুড়ির মন আটকে রয়েছে। এইরকম যে হতে পারে সে ব্যাপারটা মাথায় আসেনি। ভেবেছিলাম শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনও তরুণ হয়ে উঠবে!
  “হতাশ হয়ো না। শরীরকে তরুণ করে দিয়েছ।, এবার মন নিয়েও ভাবতে হবে। কাউন্সিলিং করাটা খুবই প্রয়োজনীয়। 
মাকে বোঝাও যে এটি মায়ের নবজন্ম হয়েছে আর আমি মায়ের গত জীবনের ছেলে। আমাকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ঈশ্বরের এই বরদানটিকে মা যেন সার্থক করে তোলেন।”

অনুজ চোখ কপালে তুলে বলে, “খেপেছেন স্যার! আমি বোঝাব এইসব কথা। বাপ রে! এমনিতেই  আমাকে দুচক্ষে দেখতে পারেন না। কী সব গালাগালি দেন যা আমি কোনকালে শুনিনি। আমি নাকি ড্যাকরা! আমার মাথায় নাকি ষাঁড়ের গোবর, আমি নাকি দেখতে  চিমড়ে চামচিকে, যাচ্ছেতাই বলেন উনি! ওঁর বয়েস আর আচমকা পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে আমি চুপ করে যাই। আমি কিছু  বোঝাতে গেলে আমাকে না আবার জ্যান্ত পুঁতে ফেলেন!”

অনুজের অবস্থাটা ডাঃ বিশ্বাস বুঝতে পারেন এবং ঠিক করেন তাঁকেই এই ব্যাপারে অগ্রণী হতে হবে। একদিন রাতে নিজের চেম্বার থেকে ফিরে মায়ের ঘরে যান, দেখেন মা কুরুশ কাঁটা দিয়ে কিছু বুনছেন। 
মায়ের পাশে বসে মায়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, “মা আমাকে  বাবার কথা কিছু বলো। তুমি কখনও বাবার কথা তো বলতে চাও না!”
 “তোর বাবা বড় মাপের মানুষ ছিলেন। সবেতেই বড়, বয়েসে বড়, চেহারায় বড়, মানে বড়। বিদ্যের জাহাজ আর আমি গোমুখ্যু। আমাদের মধ্যি কোনও মিল ছেল না।  সবসময় ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতুম কিন্তু তারপর কখন আমাকে কিছু না বলেই চলে গেলেন!”

“মা, মাথা গরম না করে আমার কথা শোনো। ওই যেসব কথা বলছ সেটা হল তোমার আগের জন্ম। তোমার কোনও  শখ আহ্লাদ ওই জন্মে পূরণ হয়নি তাই ঈশ্বর তোমাকে আবার নবজন্ম  দিয়েছেন। আমি তোমার সব জন্মেরই ছেলে, আমি তোমার জন্য কিছু স্থির করেছি। তুমি কিন্তু না করতে পারবে না। আমি ওই অনুজের সঙ্গে  তোমার বিয়ে দিতে চাই। তোমাকে খুশি দেখতে চাই!” 
স্বর্ণলতা প্রথমে প্রচণ্ড আপত্তি জানিয়েছিলেন কিন্তু ছেলের জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করেন। আগে ডাঃ বিশ্বাসের ঘরে শুধু একমাত্র মা-ই ছিলেন, এখন ঘরভর্তি ভাইবোন তবে একদা ছাত্র অনুজকে তিনি নাম ধরেই ডাকেন। অনুজ তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে তাঁর সঙ্গেই প্র্যাকটিস করছে আর নিজের রিসার্চও চালিয়ে যাচ্ছে। 
সবার আশা অনুজ একদিন  শরীরের সঙ্গে সঙ্গে  মনেরও  যথাযথ পরিবর্তন আনার পদ্ধতি ঠিক আবিষ্কার করতে পারবে। 

বৈশাখী ২০২৪