এক স্বর্ণালী প্রভাতে স্বর্গের নন্দন কাননে সুরম্য সব উদ্ভিদরাজির মধ্যে পুলকিত চিত্তে ভ্রমণ করছিলেন উদ্ভিদ তত্ত্বের আবিষ্কর্তা বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। পারিজাত পুষ্পের সুবাস তাঁকে মোহিত করেছিল। তাঁর মোহভঙ্গ হল থেকে শ্রদ্ধাপূর্ণ আহ্বান কর্ণগোচর হতে, “আচার্য!” দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখেন নত মস্তকে দন্ডায়মান কনিষ্ঠ ভ্রাতৃসম বৈজ্ঞানিক প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বোস। আহ্লাদিত হয়ে বয়ঃজ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কনিষ্ঠকে সমাদরে আহ্বান করেন, “এসো সত্যেন। এই পারিজাত বৃক্ষতলে উপবেশন কর।” পারিজাত বৃক্ষছায়ায় দুই বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক উপবেশন করে মুগ্ধ চিত্তে চতুর্দিক অবলোকন করেন। আচার্য জগদীশ বসু বলেন, “তোমার কীর্তি আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে সত্যেন। আমি তোমার জন্য গর্ব অনুভব করছি। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন তোমার তত্ত্বকে সানন্দ চিত্তে গ্রহণ করে তোমাকে যে সম্মান দিয়েছেন তা আমাদের বিজ্ঞানী সমাজের সকলের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তাছাড়া বাংলা ভাষায় যে বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব, তার পথপ্রদর্শক তুমিই। তুমি বাঙ্গালীর গৌরব!” সত্যেন বোস বয়ঃজ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন, “আপনার মহান সৃষ্টির কাছে আমার আবিষ্কার নগণ্য আচার্য। আপনার উদ্ভিদতত্ত্বের ব্যাখ্যা শুনে জগত জুড়ে বৈজ্ঞানিক মহল চমকিত হয়ে গেছেন। সর্বত্র ধন্য ধন্য রব। আপনি আমার প্রণম্য!” “সবই বুঝতে পেরেছি সত্যেন”, একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে জগদীশ বাবু বলেন, “কিন্তু আমার মনঃকষ্ট অন্যত্র। আমি সেই কষ্টের কথা কাউকে বোঝাতে পারব না!” “কী বলছেন আপনি, সত্যেন বোস বলেন, “সমস্ত বিশ্ব আপনার জয়গান করছে, আর আপনি বলছেন আপনি অসুখী? সে কেমন করে সম্ভব আচার্য?” “তুমি আমার মর্মবেদনা বুঝতে পারছ না বোস,” আকাশ পানে উদাস দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন জগদীশ বাবু, তারপর বলেন , “বায়ু তরঙ্গের ভেতর দিয়ে বেতারে শব্দপ্রেরণের যে গবেষণা আমি করছিলাম তা ব্যর্থ হয়ে গেল, সে সব কথা তো তুমি জানো!” তাঁর কথা শুনে সত্যেন বোস তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে। জগদীশ বাবু বলতে থাকেন, “আমার গবেষণা প্রায় সাফল্যের মুখ দেখছিল। কিন্তু অর্থাভাবে সেই তত্ত্ব হাতে কলমে প্রমাণ করার পূর্বেই জার্মানীর বৈজ্ঞানিক মার্কনি সাহেব তা প্রমাণ করে ফেললেন আর সমস্ত কৃতিত্ব তিনি অর্জন করলেন!” আবার দীর্ঘঃশ্বাস ফেলেন আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু। প্রফেসর বোস তখন বলেন, “কী করবেন আচার্য? আপনার দুর্ভাগ্য যে আপনি এই দেশে জন্মেছিলেন। আপনি যদি ইউরোপের কোন দেশে বা আমেরিকায় জন্মাতেন, দেখতেন আপনার গবেষণা সাফল্যমণ্ডিত করবার জন্য অজস্র অর্থ সবাই ঢেলে দিত। এই দুর্ভাগা দেশে আপনার কদর কেউ বুঝল না,” সত্যেনবাবু মস্তক নত করেন। চমকে উঠে জগদীশ বাবু বলেন, “কী বলছ তুমি সত্যেন, আমার পরম ভাগ্য যে এদেশে আমি জন্মেছিলাম, যে দেশের সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দের মত মহান ব্যক্তিত্বরা! আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, যদি তিনি আমাকে দ্বিতীয়বার জন্মলাভের সুযোগ দেন, আমি যেন জন্ম নিই এই ভাগীরথীর তীরে। ভাগীরথীর কুলুকুলু শব্দ স্বর্গের অলকানন্দার ধ্বনি অতিক্রম করে এখনও আমার কর্ণ কুহরে প্রবেশ করে। না, না, সত্যেন, তুমি ভুল করছ, সকল দেশের সেরা আমার এই বঙ্গভূমি। ধন্য আমি এই দেশে জন্মলাভ করে!” মনের দুঃখে এই কথাটা আমার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল, সত্যেনবাবু বলেন, “আপনি আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন আচার্য!” “ঠিক আছে সত্যেন, মুখ তোল,” জগদীশ বাবু সস্নেহে বলেন, “শুনলাম মহাবৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন নাকি তাঁর আবিষ্কৃত তত্ত্বের সঙ্গে তোমার নাম যুক্ত করে দিয়েছেন!” “সে আমার সৌভাগ্য,” সত্যেনবাবু বলেন, “আইনস্টাইন স্বয়ং আমাকে লিখেছেন যে আমার সংযোজন তিনি সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেছেন এবং এই বার্তা তিনি বিশ্বের সর্বত্র প্রচার করেছেন। সত্যিই আমি ভাগ্যবান। তিনি তাঁর তত্ত্বের সঙ্গে আমার নাম জুড়ে দিয়ে আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন তার জন্য আমি তাঁর কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব। আরো বড় কথা তিনি আমার নাম তাঁর নিজের নামের অগ্রে দিয়েছেন, তাঁর চিত্ত উদার বলেই। কিন্তু আপনার উদ্ভিদ তত্ত্বের কথা কেউ কোনদিন কল্পনায় আনতে পারেনি। বিশ্ব জুড়ে সবাই আপনাকে ধন্য ধন্য করছে!” “আমার কথা ছেড়ে দাও,” জগদীশবাবু বলেন, “সেই দিক থেকে বলতে গেলে বলব আমাদের বঙ্গমাতা রত্নগর্ভা। পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা স্বামী বিবেকানন্দের কথা বাদ দিলেও আমাদের বিজ্ঞানের জগতে বঙ্গ পুত্রদের দান কিছু কম নয়। ধর তোমারই সতীর্থ মেঘনাদের কথা।” “আপনি সাহার কথা বলছেন,”সত্যেনবাবু বলেন, “সে ও এক বিরাট প্রতিভা। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের তাপীয় আয়নীকরণের যে ব্যাখ্যা মেঘনাদ দিয়েছে, তা সমগ্র বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের বৈজ্ঞানিক মহলে তাঁর নাম সসম্মানে উচ্চারিত হয়।” “মেঘনাদ তো এখানেই আছে,” জগদীশবাবু বলেন, “তাঁকে একদিন নিয়ে এসো আমার কাছে।” কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। হঠাৎ জগদীশবাবু বলেন, “আচ্ছা সত্যেন, তুমি তো আমার পরে আরো বেশ কিছুদিন মরলোকে ছিলে, সেখানে শুনেছি যথেচ্ছভাবে অরণ্য ছেদন হচ্ছে। কথাটা কি ঠিক? তুমি কিছু জানো?” বিহ্বল দৃষ্টিতে সত্যেন বাবু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন বয়ঃজ্যেষ্ঠর দিকে, তারপর বলেন, “আমি বলতে লজ্জা অনুভব করছি আচার্য, আপনি যা বলছেন তা বর্ণে বর্ণে সত্যি।” “কেন? কেন?”বলতে বলতে সজল হয়ে ওঠে জগদীশবাবুর চোখ দুটো। তিনি নিকটস্থ পারিজাত বৃক্ষের গাত্রে হস্ত অবলেপন করে অশ্রুজড়িত কণ্ঠে বলেন, “কেন আমার সন্তানসম বৃক্ষদের উপর এই অত্যাচার? কী অপরাধ তাদের?” “লোভ,” সত্যেনবাবু মস্তক অবনত করে বলেন, “এখন লোভ মানুষের মজ্জায় মজ্জায় গেঁথে গেছে আচার্য। লোভের বশে তারা বৃক্ষছেদন করছে, অরণ্য ধ্বংস করছে, আপনার ভাগীরথী নদী কলুষিত করছে। কী বলব আপনাকে?” জগদীশবাবু বলেন, “তোমার কথা শুনে আমার মরজগতে প্রত্যাবর্তন করার বাসনা লুপ্ত হয়ে গেছে সত্যেন। উদ্ভিদের কান্না আমি সহ্য করতে পারব না বোস। কবিগুরুর শান্তিনিকেতনের ও কি একই অবস্থা?” “অল্পবিস্তর তাই,” বোস বলেন, “সর্বত্র উন্নয়নের জিগির, আর সেই জিগিরে প্রাণ দিচ্ছে বৃক্ষসমূহ।” “গুরুদেব বেঁচে থাকলে খুবই মনোকষ্ট পেতেন,” জগদীশবাবু বলেন। “বেঁচে থাকতেই তিনি সভ্যতার এই কুফলের কথা অনুমান করেছিলেন আর তাই তিনি বিধাতাকে উদ্দেশ্য করে লিখে গেছেন, ‘দাও ফিরে অরণ্য, লও এ নগর,’ কবিগুরু যে প্রকৃতিকে কত ভালবাসতেন আপনি জানেন।” একটু থেমে সত্যেনবাবু আবার বলেন, “আর একটা কথা শুনলে তো আপনি শিহরিত হয়ে উঠবেন।” “কী সে কথা,” আচার্য বসু জিজ্ঞেস করেন। “শুনেছি আমাজন অঞ্চলের একটা বিশাল অংশ অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে গেছে!” “কী বলছ তুমি বোস,” সত্যি সত্যি শিহরিত হয়ে আচার্য বসু বলেন, “আমাজন তো পৃথিবীর ফুসফুস। সেই আমাজন ধ্বংস করে মানুষ যে নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে সেকথা তারা বোঝে না?” “বললাম যে,” প্রফেসর সত্যেন বোস বলেন, “লোভ মানুষকে বিবেকহীন করে তুলেছে।” নন্দন কাননের পারিজাত বৃক্ষমূলে বসে অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন করতে থাকেন এক শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আর তাঁর পদতলে অবনত মস্তকে উপবিষ্ট হয়ে তাঁর মনের ব্যথা উপলব্ধি করেন আর এক শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক।