তুতানদের ক্লাসে সপ্তায় সপ্তায় সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট রোটেশন অনুসারে বদলায়। আজ যে ফার্স্ট বেঞ্চ, কাল সে সেকেন্ড বেঞ্চ, পরদিন থার্ড বেঞ্চ - এভাবে। গত মাস থেকে থার্ড বেঞ্চে গেলেই তুতানের সমস্যা শুরু হচ্ছে। বোর্ডের চকের সাদা লেখাগুলো ধেবড়ে ঝাপসা হয়ে সাদা মোটা দাগ মনে হচ্ছে শুধু। গাল কুঁচকে চোখ সরু করে মোটামুটি পড়া যাচ্ছে। ফোর্থ বেঞ্চে গেলে সব লেপা পোঁছা। একটু দূরে থাকা বাসের নম্বর বোঝা যাচ্ছে না, ভোরবেলার কুয়াশার মত দূরের সবটুকু হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সঙ্গে চোখ দিয়ে জল পড়া, মাথায় অল্প ব্যথা। ভয়ের কিছু আছে? জানি শুনেই সক্কলে বলবে, “ওহ, চোখে পাওয়ার এসেছে। চশমা নিতে হবে।“ পাওয়ার মানে শক্তি। কোথায় কমল চোখের জোর, তা নয় সকলে বলতে লাগল, "পাওয়ার এসেছে।" বেচারা তুতান! কাঁহাতক বন্ধুদের খাতা দেখে বোর্ডওয়ার্ক কপি করবে! করবেই বা কেন? অপথ্যালমোলজিস্টের কাছে যাবে। একটা চেয়ারে বসিয়ে প্রথমে যন্ত্রে চোখ দেখা হবে। তারপর চোখে একটা মেটালের চশমা পরিয়ে দেওয়া হবে। তার একটা চোখে কালো কাচ দিয়ে ঢাকা। আরেক চোখ দিয়ে সামনের বোর্ডের লেখা পড়তে বলা হবে। ওপরের লাইনে বড় বড় করে লেখা B T R Y তারপরের লাইনে তার চেয়ে ছোট হরফে U H K F। --তারপর? --তার পরের লাইনে.... মনে হচ্ছে... চশমায় কাচ পড়বে সারি সারি গোল কাচ থেকে একটা। --এবার স্পষ্ট E R S G। তার পরের লাইন ঝাপসা। একটা কাচ আবার... --না তাও বেঁকে যাচ্ছে লেখাগুলো। একটু ঘুরিয়ে দেওয়া হল কাচ। এবার স্পষ্ট A D V... এভাবে দুই চোখেই। তারপর মাপসই পাওয়ারের কাচে তৈরি মনপসন্দ ফ্রেমের ঝকঝকে চশমা। তুতান আয়নার সামনে নিজেকে দেখে বেশ খুশি, নতুন গয়না দিব্যি মানিয়েছে। তো হচ্ছে কথা চশমা নিয়ে। বাসে ট্রেনে ট্রামে সর্বত্র যদি দশজন মানুষের মুখোমুখি আমরা হই, খেয়াল করলে দেখব তার মধ্যে চার জনের চোখেই চশমা। গানেও এর গুরুত্ব স্বীকার করে নেন বর্তমান গায়ক। অঞ্জন দত্তের গানের কলি, "চশমাটা খসে গেলে মুশকিলে পড়ি, দাদা আমি এখনো যে ইস্কুলে পড়ি..." খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতকে প্রথম কাচের মধ্য দিয়ে বড় করে দেখার প্ৰচলন শুরু হয়। হায়রোগ্লাফিক চিত্রলিপিতে এর প্রমাণ মেলে। সরু মোটা বিভিন্ন রকম কাচের ব্যবহার ছিল সে সময়ে। রোমেও রোমান সম্রাট নিরো গ্লাডিয়েটর দের লড়াই দূর থেকে স্পষ্ট দেখার জন্য একরকম কাচ ব্যবহার করতেন। কথিত আছে তার উপদেষ্টা দার্শনিক ‘সেনেকা’ (Seneca) দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা দূর করতে তাকে পালিশ করা এমারেল্ড ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সরু ছিদ্রের মাধ্যমে দেখলে দূরের ঝাপসা জিনিস খানিক স্পষ্ট হয়। এই মেকানিজম কাজে লাগিয়ে বর্তমানে পিনহোল চশমার প্রয়োগ। বহু প্রাচীন কিন্তু এর ঐতিহ্য। মেরুবাসী ইনুইট বা এস্কিমোরা হাতির দাঁতে ছিদ্র করে তার মধ্যে দিয়ে দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখার চেষ্টা করত। এটা অনেকটা আমাদের সেই ছোট্টবেলার স্কুলের স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়। ওই যে, সেই গল্প, একজন কড়া স্যার পরীক্ষার হলে সামনে খবরের কাগজ ধরে আছেন। ছাত্ররা নিশ্চিন্তে তাদের কাজ করছে। স্যার কাগজ নামিয়ে খপাত করে ধরে ফেললেন আসামীকে। কী করে? খবরের কাগজে ফুটো করা ছিল যে। তবে চশমা বলতে যেরকম ফ্রেমে বাঁধানো একজোড়া কাঁচ বোঝায়, সেটার প্রথম উদ্ভব হয় ইতালিতে। আতশ কাচের ব্যবহার আগে থেকেই ছিল। সেরকম একজোড়া কাচ মাঝে একটি কব্জা দিয়ে জুড়ে ব্যবহার উপযোগী চশমার রূপ দেওয়া হয়। এটাই আদি চশমা। ইতিহাসবিদদের অনুমান, ১২৮৬ সাল নাগাদ ইতালির জিওর্দানো দা পিসা চশমার নকশা করেন। আধুনিক চশমার আবিস্কারক হিসাবে তাঁকেই মান্যতা দেওয়া হয়। কে বলতে পারে, সুন্দরী ইতালিয় মেয়েদের দেখে হয়ত যুবকরা গেয়ে উঠত, "গোরে গোরে মুখরে পে কালা কালা চশমা।" এই গানটা নিশ্চয়ই নয়। এর ইতালিয়ান ভার্সনের কিছু একটা সুর। কে জানে! তবে হ্যাঁ, এই চশমা পরে হেঁটে যাওয়ায় একটু সমস্যা ছিল। কীরকম? এই চশমা তো কানের পাশে ডাণ্ডা দিয়ে লাগানোই থাকত না। দুটো কাচ, মাঝে শুধু জোড়া দেওয়া। হাতে ধরে কাজ চালাতে হত। ইতালির পরে স্পেনেও ক্রমশ ছড়িয়ে যায় চশমার ব্যবহার। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি চীনের বিচারকরা ধূসর রঙের একরকম ক্রিস্টালের চশমা পরে মুখের অভিব্যক্তি আড়াল করত। তখন একচক্ষু চশমা বা monocle খুবই জনপ্রিয় ছিল, বিশেষত সম্ভ্রান্ত সমাজে। একটি গোলাকার উত্তল লেন্সের প্রান্তের দিকটা ধাতব রিং বা তার দিয়ে ঘিরে রাখা হত। রিংয়ের একটা অংশ পোশাকের সাথে আটকানো থাকত। লেন্স যুক্ত ধাতব রিং চোখের কাছে এনে দেখা হত। জিওর্দানো দা পিসা চশমা তৈরির পর ক্রমশ চশমা আরো সুবিধাজনক আকার পায়। হাতে ধরে যাতে ব্যবহার করতে না হয়, তাই কানের সাথে লাগিয়ে রাখার হাতল জোড়া হয়। আধুনিক চশমার উদ্ভাবক হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে গিরোলামো সাভোনারোলা নামের এক ইতালিয়কে। তিনি ১৭২৭ সালে বর্তমান সময়ের চশমার প্রাথমিক নকশাটি তৈরি করেন। তার আগে দুই চোখের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা এড়াতে চোখের সামনে কাচ ধরা হতো। নকশা তৈরি করেন ব্রিটিশ চশমা বিক্রেতা এডওয়ার্ড স্কারলেট। হাতল ফোল্ডিং করার ব্যবস্থাও প্ৰচলিত হয় । জানা যায় ১৩০১ সালে ভেনিস সরকার চশমা বিক্রির জন্য কিছু নিয়ম তৈরি করেন। অর্থাৎ ততদিনে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চশমা একটা অন্যতম পণ্য হয়ে উঠেছে। তখনকার চশমা কেমন ছিল তা আমরা বিভিন্ন সমকালীন চিত্রে পাই। যেমন, ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী তোমাসো দা মদেনা ১৩৫২ সালে একজন সম্ভ্রান্ত মানুষের ছবি আঁকেন, যিনি চশমা পরে কাজ করছেন। চশমার জন্মস্থান ইতালি বলে প্ৰচলিত থাকলেও ভিন্ন মতও উঠে আসে। 'ব্রিটিশ জার্নাল অফ অপথ্যালমোলজি'তে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ঋষিকুমার আগরওয়ালের একটি প্ৰবন্ধ, 'অরিজিন অফ স্পেকটাকলস ইন ইন্ডিয়া'তে দাবী করা হয়, ভারতীয় স্থপতি দেবনারায়ন ভুবনঐক্যবাহু আনুমানিক ১৩৪৪ থেকে ১৩৫৩ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কা যান বৌদ্ধ স্তম্ভ নির্মাণের জন্য। তিনি চশমার ব্যবহার করেছিলেন এরূপ কিছু প্রমাণ মেলে। তারও পূর্বে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শঙ্করাচার্য (সময়কাল ৭৮৮ - ৮২০ খ্রিস্টাব্দ) 'অপরোক্ষানুভূতি'র ৮১ তম শ্লোকে 'উপনেত্র' শব্দটি প্রয়োগ করেন। 'উপ' উপসর্গটি নৈকট্য সদৃশ বোঝাতে প্রযুক্ত হয়। সেক্ষেত্রে 'উপনেত্র' বলতে চশমাই বোঝানোর সম্ভাবনা। তবে ইতালি বা ভারত যেখানেই আবিষ্কার হোক না কেন, কাছের ও দূরের দেখার সমস্যার ক্ষেত্রে দুটো আলাদা কাচ ও আলাদা চশমা ব্যবহার করা হত। একই চশমায় মায়োপিয়া (দূরে দেখার সমস্যা) ও হাইপরোপিয়া (কাছে দেখার সমস্যা) দূর করার উপায় এল কী করে? যাকে এখন আমরা 'বাইফোকাল' বলি? এর স্রষ্টা হলেন আমেরিকান বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন কে জানেন তো? ওই যে যিনি ঘরের বিদ্যুৎ আর আকাশের বিদ্যুৎ এক বলেছিলেন। তিনি একাধারে বিজ্ঞানী, একদিকে রাজনীতিবিদ। আমেরিকার সংবিধান তৈরিতেও তাঁর বড়সড় ভূমিকা ছিল। ১৭৮৫ সালে তিনি একটি দুরকম বৈশিষ্ট্যের দুটো লেন্স একত্র করেন, যাতে দূরের ও কাছের জিনিস দেখা একই চশমার দ্বারা সম্ভব হয়। এর মেকানিজম অনেকটা এনবল্পস মাছের চোখের মত। দুটো অংশে ভাগ করা। একটা অংশ ওপরে জলের ওপরের অংশ দেখার জন্য। আরেকটা অংশ নীচের দিকে তাকানোর। পরবর্তী কালে J L Borsch দুরকম লেন্সকে একত্র জোড়া দিয়ে একটি লেন্স হিসাবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করেন। আরও পরে ১৯৫৫ সালে ওই জোড়ার অংশের দাগ মিলিয়ে প্রোগ্রেসিভ লেন্সের উদ্ভব হয়, Irving Rips এর প্রচলন ঘটান। দেখার ক্ষেত্রে আরেকটা সমস্যার জায়গা হল, বিষমদৃষ্টি বা astigmatism। সিলিন্ডার আকৃতির অবতল বা কনকেভ লেন্সের প্রয়োগ ঘটিয়ে এই সমস্যা দূর করেন একজন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ জর্জ এইরি। চশমার প্রয়োজনের দিক ছাড়াও দৃষ্টিগত নান্দনিকতার দিকটিও উপেক্ষিত থাকেনি। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে Pinee nez নামে এক ধরণের নাকের ওপর ঝুলে থাকা চশমা জনপ্রিয় হয়েছিল। আমার নিজের তো মনে হয় নাকের ওপর ঝুলে এলে বেশ অসুবিধা হবারই কথা। কে জানে! হয়ত হত না। নাহলে কখনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট অমন স্টাইল পছন্দ করতেন! অতঃপর চশমা-সমাজে এসে উপস্থিত হয় স্টাইল আইকন সানগ্লাস। ঠিক যেমন করে কচুরি ছোলার ডালের পর মাটন কষা অবতীর্ণ হয়, বা একদল কলেজের ছোকরা গল্প করছে, এমন সময়ে বুকের বোতাম খোলা নায়ক ধুলো উড়িয়ে এসে দাঁড়ায় - তেমনই আবির্ভাব। ব্যাকগ্রাউন্ডে ড্রামের বিট। ১৯৩০ সালে তিনি আসিলেন। আমেরিকা মজল সেলুলয়েডে নির্মিত সানগ্লাসের ছায়ার মায়ায়। হলিউড তারকা থেকে তরুণ প্রজন্ম সকলের প্রয়োজন ও রুচির প্রতীক হয়ে উঠল রোদ চশমা। রোদ থেকে সুরক্ষা দিতে নানা ফিল্টার যোগ হল। দীর্ঘ সময় ধরে চশমা কেবল অভিজাতদের ব্যবহারের জিনিস ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্রমশ এর ব্যবহার বাড়তে থাকে। তবে তখনো প্লাস্টিক আবিষ্কার হয়নি বলে উৎপাদনের খরচ বেশিই হত। ষাটের দশকে প্লাস্টিকের সহজলভ্যতার কারণে কাঁচামালের দাম কমে। ফলে চশমার কারখানা আরো অনেক গড়ে ওঠে। চশমা শিল্পে এখনো ইতালিই এগিয়ে। জেনেটো অঞ্চল চশমা তৈরির ৭০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। তবে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিত্য নতুন ফ্রেম, স্টাইল ইত্যাদি আধুনিকতার বাঁক বদল ঘটাচ্ছে। বিবর্তন থেমে থাকে না। এক্ষেত্রেও থাকেনি। নিত্যযাপনের সাথে জড়িয়ে থাকা জিনিস হল চশমা। ফলে সুবিধাজনক থেকে সুবিধাজনক-তর বানানোর প্রয়াস অব্যাহত। কাঁচের বদলে এসেছে প্লাস্টিকের লেন্স। ফ্রেমে এসেছে মজবুত টাইটেনিয়াম। রিমলেস চশমা জনপ্রিয় হয়েছে। একই চশমায় যাতে সাধারণ চশমা ও সানগ্লাসের প্রয়োজন মেটে সেজন্য তৈরি হয়েছে ফটোক্রমাটিক লেন্সের চশমা। একসময়ে যা ছিল ধনীর সম্পদ, এখন তা সাধারণের বান্ধব। 'রাজার ঘরে' যে ধন ছিল, এখন তা টুনির ঘরেও। আমাদের দেশে আই ক্যাম্প হয়, যাতে দরিদ্র মানুষকে বিনা পয়সায় চশমা বানিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে লাখ লাখ টাকা বা তারও বেশি দামের চশমাও তৈরি হয়। ক্রয়ক্ষমতা অনুসারে যার যেমন ক্ষমতা ও রুচি, তার সঙ্গে পাল্লা দেয় অন্যান্য পণ্যের মত চশমাও। সাধারণ চশমার দামও বেশি হয়ে ওঠে ব্যক্তিবিশেষের ব্যবহারে। যেমন, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ব্যবহৃত চশমা বিক্রি হয়েছে ২৫০ কোটি টাকারও বেশি দামে। প্রযুক্তির উন্নতির ছোঁয়ায় চশমা কী হয়ে উঠতে পারে, তা হয়ত আজ বসে কল্পনা করাও অসম্ভব। বর্তমানে কন্ট্যাক্ট লেন্স চশমার জনপ্রিয়তায় সামান্য ভাগ বসালেও প্রয়োজনের তাগিদে, সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব অন্যের কাছে ফুটিয়ে তুলতে চশমার জুড়ি ছিল না, নেইও।