চোখের জলের স্বাদ নোনতা

কলকাতা – ৫৪

মিলি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। ওর চারপাশে কাঁচের আবরন বন্ধ হল। আমি নিজের কেবিনে ফিরে অন্য সমস্ত তথ্য পর্যবেক্ষণ করছিলাম। এই সব তথ্য মিলির মেমরি কপি করে পাওয়া। জায়গাটা রম আইল্যান্ড। অনৈতিক কার্যকলাপের কেন্দ্রস্থল। মিলি সেই দলেরই একজন। ওর সিগন্যাল ধরেই আমরা এখানে এসেছি। ওর কাছে আরও অনেকের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। 
“প্রফেসর এল টি … “
আমার নামের যান্ত্রিক স্বর ভেসে এল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। আমার মেমারি ফাইল সংযুক্ত করার নির্দেশ এল। আমার ঊর্ধ্বতন আমি ছাড়াও প্রফেসর এল এস, এল আর কেও এই নির্দেশ দিয়ে থাকবে। তারাও একই উদ্দেশ্যে এই আইল্যান্ডে এসেছে। শেষ নির্দেশ এল ডক্টর ওয়ানকে রিসিভ করার। আমরা তিনজন ডক্টররের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তার ব্যাপারে যেটুকু জানি তা খুবই অল্প। মেডিকাল রেভেলিউশনের পূর্ব যুগের ব্যাপারেও তিনি রিসার্চ করেন। আমাদের সঙ্গে আমাদের তিনজন সহকারী। পি ২০ আমার সঙ্গে অনেকদিন ধরে রয়েছে। ওয়ার্কিং জীবনের আগের মেমরি মুছে দেওয়ার পর আমার প্রথম মেমরিই পি ২০। 
এল আর বলল, “ডক্টর ওয়ান ওয়েলকাম টু রম!”
“বন্দি কি আমাদেরই মত? নাকি অন্যরকম? 
“একটু আলাদা।” 
“কতটা আলাদা?” 
“এই দেখুন!”

মিলির এখনকার অবস্থান সামনের স্ক্রিনে ফুটিয়ে তুলল এল আর। এল আর আমার থেকে বেশি উন্নত আর বুদ্ধিমান। তাই তার ক্রমমান আমাদের থেকে আগে। মিলির দিকে আমাদের দৃষ্টি ঘুরল। তার জ্ঞান ফিরেছে। তার মাথা নোয়ানো। তার মুখমণ্ডল তীব্র আলোর ঝলকানিতে ঝলসে উঠল। তার চোখ বিস্ফারিত হল। ওর চোখের দিকে আমাদের নজর গেল।   
“ও অন্যরকম। এরকম আগেকার দিনের মানুষদের মধ্যে দেখা যেত। আমাকে নিশ্চিত হবার জন্য আরও কয়েকটা পরীক্ষা করতে হবে!”
ডক্টর ওয়ান নিজের গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বললেন। আমরা এব্যাপারে কোন প্রশ্ন করলাম না। পরের মিশনের জন্য তৈরি হতে লাগলাম। সি বিচের ৫০ মিটার দূরে একটা গুহার মধ্যে মিলি কখনও কখনও আস্তানা গাড়ত। এই জায়গাটা আমাদের সার্চ করার অর্ডার এসেছে। আমরা ওখানে পৌঁছলাম। ডক্টর ওয়ানও সঙ্গে রয়েছেন। আমরা অনেকটা এগোনোর পর গুহাটা দেখতে পেলাম। দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যে =তে হয়। আমাদের হাতের ডিজিটাল স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করে নিলাম। দেখলাম কয়েকজন রয়েছে এই গুহায়, যারা পিছনের দিকের কোন রাস্তা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছে। ওপর থেকে অর্ডার এল এদের বন্দি না করার। ডক্টর কোনও একটা পরীক্ষা করবেন। আমরা সেই মত গুহার ভেতরে ঢুকে ওদেরকে আটকালাম। চারজনকে ডিটেক্ট করা গেছে। মিলির মেমারিতে এদের নাম জেকে, নিমি, সুকু আর বাসব। দুজন মহিলা বাকি পুরুষ। এদেরকে ডক্টর ওয়ানের তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দিয়ে আমরা সরে দাঁড়ালাম। পি ২০ ঠিক আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। তখনই আমার কাছে আদেশ এল, পি ২০ কে ডক্টর ওয়ানের হাতে তুলে দেবার। আমার আদেশটা বুঝতে একটু অসুবিধা হয়েছিল। তাই দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করেছিলাম। দ্বিতীয়বারও ওই একই আদেশ এল। পি ২০ কে আদেশ দিলাম ডক্টর ওয়ানের সহায়তা করার জন্য। ও এগিয়ে গেল ডক্টর ওয়ানের কাছে। বাসব একজন পূর্ণবয়স্ক মহিলা। কোমর পর্যন্ত কুঁচকানো কালো চুলের অধিকারী। এই জিন বৈশিষ্ট্য যুক্ত মানুষ এখন বেশি পাওয়া যায় না। ডক্টর ওয়ান তার হাতের শক গানটা তুলে নিলেন। এই ধরনের গান আমাদের কাছে নেই। এর প্রয়োজন পড়ে না। এটি বহু পুরনো প্রযুক্তির। এটি ইলেকট্রিক শক দিতে পারে। ডক্টর বাসবের শরীরে শক গান ঠেকালেন। এবং মুহূর্তের মধ্যে সেই শক গান পি ২০ র শরীরেও ঠেকালেন। পি ২০ সামনে তাকিয়ে রইল। এইটুকুতে তার কিছু হবার নয়। তাকে ভস্ম করতে আরও জোরালো শক প্রয়োজন। কিন্তু বাসবের আচরণ অদ্ভুত। সে উচ্চস্বরে কিছু বলছে! তার দেহ কেঁপে উঠছে! তবে কী! আরও বার কয়েক শক গান প্রয়োগ করতে পি ২০ ভস্ম হয়ে গেল। তার ওয়ারর্কিং আইডিটা নীচে পড়ে রইল। কিন্তু সেদিকে আমাদের নজর গেল অনেক পরে। প্রতি শকে বাসবের মুখভাব যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছিল যা আমরা আগে কখনোই দেখিনি। আমরা দেখলাম তার চোখ থেকে কোন এক তরল নির্গত হচ্ছে। ঠিক যেমনটা মিলির ক্ষেত্রে দেখা গেছিল। বাসব ভস্ম হল। পেছনে দাঁড়ানো তিনজনও একই ভাবভঙ্গী নিয়ে পেছনের দিকে সরার চেষ্টা করছিল। ডক্টর ওয়ান তা হতে দিলেন না। ফেরার আগে আমি কেন জানিনা পি ২০ র ওয়ারর্কিং আইডিটা কুড়িয়ে নিলাম।   
ডক্টর ওয়ান যখন এই পরীক্ষা প্রসঙ্গে ঊর্ধ্বতনকে জানাচ্ছিলেন তখন আমরা ওখানে উপস্থিত ছিলাম। মেডিকাল রেভেলিউশনের পূর্ব যুগ সম্বন্ধে যে গুটিকয়েক তথ্য পাওয়া যায় তা দুস্প্রাপ্য। তাই আমরা এ ব্যাপারে একেবারেই অবহিত নই। কিন্তু আমরা বাসবদের অপরাধ সম্বন্ধে জানতাম। তারা অবৈধ। তাদের জন্ম নেওয়ার কোন অনুমতি নেওয়া হয়নি। জন্মের পূর্বে যে জিন বিশ্লেষনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেই পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হয়নি। তারা ন্যূ্নতমও উন্নত বৈশিষ্টযুক্ত নয়। তাদের কোন নিবন্ধকরনও নেই। কীভাবে যে তারা নজর এড়িয়ে বেঁচে রইল তা আমাদের ব্যবস্থাপনার ত্রুটিকেই দর্শাচ্ছে। এদের অস্তিত্ব মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর। এরকম আরও কারা কারা রয়েছে তাদের খুঁজে বের করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই আমাদের কাজ।
“কিন্তু এই মানুষগুলোকে কি বন্দি করা যায় না?” 
 ঊর্ধ্বতনের কোন এক প্যানেলিস্ট এই প্রশ্নটা করলেন। ডক্টর ওয়ান গম্ভীর গলায় বললেন, “এটা উচিত হবে না। তারা আমাদের মত নয়। তাদের বাঁচিয়ে রাখার থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই তাদের জন্য ভালো। তারা যে দুঃসহ বিজ্ঞানহীন জীবন কাটাচ্ছে তার থেকে মুক্তি দেওয়া আমাদের কর্তব্য।” 
“তারা কি পূর্বের মত?” 
“হ্যাঁ। আপনি তো সবটাই জানেন স্যার। তারা জন্মের পূর্বে এবং পরে মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টের মধ্যে দিয়ে যায় নি। তারা বর্বর এবং দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছিল।” 
এল আর এগিয়ে গিয়ে বলল, “ এবং তারা অপরাধ সংগঠিত করতে চাইছিল স্যার!”
“কী রকম?” 
“তারা আমাদের অগোচরে আমাদের শহরের একাংশ দখলের পরিকল্পনা নিয়েছিল। এবং তার মূলচক্রী মিলি আর তার সহকারী। যাকে এক্স বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। মিলির স্মৃতিতে তার বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। রজার, আনন্দ আরও অনেক। যার সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু মিলির সম্পূর্ণ স্মৃতি আমরা পাইনি। অনেক কিছু জানা যায়নি”। 
“তাহলে এক্সকে খুব তাড়াতাড়ি লোকেট করার চেষ্টা করো। দেরি কোরো না। 
“অবশ্যই স্যার!”
অন্য এক ঊর্ধ্বতন বললেন, তাদের কি এখনও আমাদের মতো করা সম্ভব?” 
ডক্টর ওয়ান বললেন, “করা যেতে পারে।”  
“ঠিক আছে। তাহলে মিলিকে সেই ট্রিটমেন্ট দেওয়া হোক।” 
প্যানেলের বাকিরাও এই সিন্ধান্তে সহমত হলেন। তারপর একজন বললেন, “এক্সের অবস্থান সম্পর্কে কোনও তথ্য দিতে পারলে অবশ্যই মিলিকে ট্রিটমেন্ট দেওয়া হবে!”
বেদনাহীন হওয়া মিলিদের কাছে স্বপ্নের মত। এই পার্থক্য ঘোচানোর জন্যই তো তাদের লড়াই। আমি পি ২০ র জায়গায় অন্য এক সহকারী পেয়েছি। মিলিকে এই প্রস্তাব দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর। ওর সামনে গেলাম।  কাঁচের আবরণ সরে গেল। ও আমার দিকে নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকাল। 
আমি বললাম, “তোমার দাবি কী?” 
“সবার জন্য ট্রিটমেন্ট দাবি করেছিলাম আমরা!” 
“কজন আছো তোমরা?” 
“আমরা ছজন!”
“এখন তোমরা দুজনই বেঁচে আছো।”
“বেদনাহীন মৃত্যু দিয়েছেন। নাকি?” 
“তোমাকে ট্রিটমেন্ট দেওয়া হবে। বেদনাহীন মৃত্যু!” 
“মৃত্যু যে হবে তা আমি জানি। একদিনের জন্যও যদি বেদনাহীন হতে পারতাম!” 
“তোমাকে শুধু তোমার সহকারীর অবস্থান সম্বন্ধে নিশ্চিত করতে হবে!” 
ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হাসল মিলি।  
“কক্ষনও না। আপনি জানেন চোখের জলের স্বাদ না নোনতা! এই স্বাদ আপনারা কক্ষনও পাবেন না! কোনও কষ্টই আপনাকে কাঁদায় না, তাই না?”  
আমি চলে আসার আগে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম। কেন জানি না। হয়ত কোনোদিন এধরনের কথা শুনিনি বলে। 
কিছুদিন পর আমার কার্যকাল শেষ হবে। এইসব স্মৃতি মুছে আবার অন্য কোন জীবন বাছা হবে আমার জন্য। আগেও হয়ত কয়েকবার এটা হয়েছে আমার সঙ্গে। কিন্তু তার আগে কিছু একটা জানার ইচ্ছে তীব্র হচ্ছে আমার মধ্যে। মেডিকাল রেভেলিউশনের পূর্বে মানুষ কেমন ছিল? ডক্টর ওয়ানের কাছে এব্যাপারে তথ্য পাওয়া যেতে পারে। আমি ওনার সঙ্গে দেখা করে এ ব্যাপারে জানতে চাইলাম। আমাদের তথ্য সংগ্রহের পূর্ণ অধিকার ছিল। এতে স্তর উন্নীত হবার সম্ভবনা থাকে। উনি আমাকে অনেক কিছুই বললেন। তারা নাকি দুঃসহ কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেত। বিজ্ঞানের উন্নতির মাধ্যমে দীর্ঘকালের জন্য এই ব্যবস্থাপনা করে সকলকে সভ্য জীবনের দিকে নিয়ে গেছিলেন যিনি - তিনি কালসে দা গ্রেট। আমি শহরের নানা জায়গায় তার মূর্তি দেখেছি। 
আমি একটাই প্রশ্ন করলাম, “আবার আগের পর্যায়ে ফেরার কোন উপায় আছে?” 
ডক্টর ওয়ান কিছুক্ষণ কোনও উত্তর দিলেন না। পরে বললেন তা ওনার জানা নেই। ফিরে এলাম। মিলির সিদ্ধান্ত ঊর্ধ্বতনকে জানাতে গেলাম। যদিও তারা সবই দেখে থাকবেন। তাও এরপরের আদেশ না আসা পর্যন্ত আমরা এগোতে পারছিলাম না। এক্সকে খুঁজতে আমাদের সার্চ টিম রম আইল্যান্ডের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
আমি সমস্তটা জানানোর পর নির্দেশ এলো মিলিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার। আমি এবং এল আর এই দায়িত্ব পেলাম। মিলি অন্ধকার কাঁচের আবরণের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল। আমরা ওকে খোলা জায়গায় এনেছিলাম। সামনে বিশাল সমুদ্র। ওকে মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু আমাদের পদ্ধতিতে নয়। শক গানের মাধ্যমে। এটাই ওর শাস্তি। শক গানটা এল আরের হাতে ছিল। ওর দৃষ্টি সোজা আমার দিকে। 
“রজার সব ধ্বংস করে দেবে। ও নতুন কাল আনবে। যেখানে সবার বাঁচার অধিকার থাকবে!” 
এল আর ওর শরীরে শক গান ঠেকাল। ওর চীৎকার আকাশ বাতাস আন্দোলিত করছিল। ওর চোখের দিকে আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে রইল। বেশ অনেকক্ষণ। যতক্ষণ না ওর গলার আওয়াজ থেমে যায়। ওর গলায় একটা পাথরের মালার মত কিছু ছিল। সেটা ছাড়া আর কিচ্ছু পড়ে থাকল না। 
চারদিন কেটে গেল। কাল আমার কার্যকাল শেষ। আমি কার্যালয় থেকে কিছু দূরে নিজের ঘরে ছিলাম। সেখানে নজরদারি থাকে না। তখন মধ্য রাত। হঠাৎ আমার সার্চ টিম আমাকে একটা খবর দিল। এক্সকে লোকেট করা গেছে। 
 “কোথায়?” 
“এনরিক বিচ থেকে একটা বোট নিয়ে দক্ষিণের দিকে যাচ্ছে।” 
“আচ্ছা। তোমরা প্রথমেই কি আমাকে জানাচ্ছো?” 
“হ্যাঁ।”  

আমি সঙ্গে সঙ্গে ইনভিসিবেল গান প্রয়োগ করে ওদের তিনজনকে নিশ্চিহ্ন করে দিলাম। তারপর এগোলাম এনরিক বিচের দিকে। চোখের জলের স্বাদটা ঠিক কেমন তা জানতে বড্ড ইচ্ছে করছিল। 

বৈশাখী ২০২৪