নাম

              বেশ কিছুদিন ধরেই রেবার আচরণে একটু অস্বাভাবিকতা দেখছি। এমনিতে ধীর স্থির, সাত চড়ে রা কাটে না। আজকাল অফিস থেকে ফিরেই দেখছি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা? কাজে ঢোকার সময় তো বলেছিল, কেউ কোত্থাও নেই। তাহলে? 
আমি আর মা, এই আমাদের সংসার। মা বেশ অসুস্থ। এদিকে আমারও অফিসে সব ছুটি শেষ। তাই রেবাকে পেয়ে মনে হল হাতে চাঁদ পেলাম। গত আট মাসে রেবা আমাদের সংসারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে। মায়ের এত যত্ন বোধহয় আমি মেয়ে হয়েও করতে পারতাম না! 
এ হেন রেবার প্রায় সব কাজেই ভুল হয়ে যাচ্ছে। 
কদিন আগে রেবার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় আচমকা চোখে পড়ল খাটের নিচে রাখা একটা বাক্স খুলে খুব মন দিয়ে কী যেন দেখছে! আমার পায়ের শব্দ পেয়েই তাড়াতাড়ি বাক্সটা বন্ধ করে দিয়েছিল। 
মনের মধ্যে একটা কাঁটা বিঁধে গেল! কিছু কী লুকোচ্ছে? চুরি টুরি করেনি তো?
 দুদিন আগে পাশের বাড়ির বৌদি বলল গলির মুখে রেবাকে দুজন অচেনা অল্পবয়সি ছেলের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে। রেবার মুখটায় খুব চিন্তা আর ভয়ের ছাপ! 
শুনে আশঙ্কা হল! এত বিশ্বাস যাকে করছি সে আমাদের চোখে ধুলো দিচ্ছে না তো? কোনও অসামাজিক কান্ডকারখানার সঙ্গে যুক্ত নয়ত? মনটা বড্ড তেতো হয়ে গেল। পৃথিবীতে কাউকেই দেখছি বিশ্বাস করা যাবে না! সতর্ক থাকলাম, যদি ওকে হাতেনাতে কিছুতে ধরতে পারি এই ভেবে!
রবিবার সকালে একটু দেরি করেই উঠি। কিন্তু আজ হঠাৎ ভোরের দিকে দরজা খোলার আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। উঠে পাশের ঘরে দেখি রেবা নেই! সদর দরজা খোলা! বাইরে এসে দেখি, রেবা দুজন কমবয়েসি ছেলের সঙ্গে কথা বলছে খুব নিচু গলায়। আমাকে দেখেই রেবা ভূত দেখার মত চমকে উঠল আর ছেলেদু'টো পালাল।
“ঘরে চলো, তোমার বাক্সটা খুলে দেখাও!” আমি গম্ভীরভাবে বললাম। 
 রেবা একতাও কথা না বলে বাক্স খুলল চাবি দিয়ে। 
বাক্সে দামি জিনিস কিচ্ছু নেই, ওর জামাকাপড় আর কয়েকটা রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশন!
“এসব কী রেবা?” বেশ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। 
একটু পরে উত্তর এল, “আমি রেবা নই, রাবেয়া!”
“মানে?"
"আমি রাবেয়া খাতুন দিদি। নাম ভাঁড়িয়ে কাজে ঢুকেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন দিদি আপনাকে বা মাকে কোনভাবে ঠকানো বা কোনো ক্ষতি করার কোন উদ্দেশ্য নেই আমার!” 

 আমার সবকিছুই কেমন যেন ধোঁয়াশার মত লাগছিল, "তাহলে নাম বদলালে কেন? লুকিয়ে কাদের সঙ্গেই বা দেখা করছো?”
“কী করব দিদি!? স্বামী নেই, সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলাম।  তার ওপর অসুস্থ ছেলে। আম্মির জিম্মায় ছেলেকে রেখে শহরে এলাম কাজের আশায় এক পাড়ার দিদির সঙ্গে। কিন্তু এই এলাকার কোন হিন্দু বাড়িতে কাজ পেলাম না মুসলমান বলে! দু একটা মুসলমান বাড়িতেও চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমার পোড়া কপাল, হল না। কিন্তু টাকার বড্ড দরকার ছিল দিদি। অসুস্থ ছেলেটাকে সুস্থ করে তোলার জন্য  রাবেয়া' বদলে হল “রেবা!’যাদের দেখলেন ওরা আমার ছোট দুই ভাই, স্কুলে পড়ে। ওদের হাত দিয়েই টাকা আর ওষুধ পাঠাই! আপনি যা শাস্তি দেবেন আমি মাথা পেতে নেব।"

“শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে।"

কখন যে মা ঘুম থেকে উঠে এ ঘরে চলে এসেছে বুঝতেই পারিনি। রেবা ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকাল!

“আজ থেকে আমার বাড়িতে রেবার জায়গা নেই!" 

রেবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। 

“আজ থেকে রেবা বলে কেউ থাকবে না, কিন্তু রাবেয়া থাকবে।!” মায়ের গম্ভীর আদেশ!
“মাসিমা!” রেবা ডুকরে উঠল! 
“হ্যাঁ মা! আমাদের কাছে রেবা, রাবেয়া সব সমান! আমরা যতটা পারি তোমার ছেলের চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। তুমি মিথ্যেই ভয় পাচ্ছিলে।!”

রাবেয়ার চোখে  দুকূল ছাপিয়ে বর্ষা নামল!

বৈশাখী ২০২৪