পাখপাখালি

গড়িয়া, কলকাতা ৮৪

খাটের পাশে জোড়া জানালায় বিস্তৃত নীল আকাশ ত্রিলোচনবাবুর। ঘন সবুজ গাছগাছালি। বসন্তের রংমিলান্তি। কোথাও কৃষ্ণচূড়ার আগুনে-লালের সঙ্গে জড়াজড়ি করে আছে গায়ে-হলুদ রাধাচূড়া। স্বভাবগম্ভীর শিরীষ গাছগুলো একটু যেন তফাতে, স্বমহিমায়। সন্ধে হলেই ছাতিম ফুলের ভারি গন্ধ ভেসে আসে হু হু হাওয়ার সঙ্গী হয়ে। 

আর আসে ঝাঁক-ঝাঁক পাখি। ভোর হতে না হতেই, একে একে। ছাতারেগুলো বেজায় পাজি। কাচের জানালায় টরেটক্কা বাজিয়ে প্রতিদিন অসময়ে ঘুম ভাঙাবেই। উঠোনের রঙ্গন গাছের ঝোপে বুলবুলি দম্পতি তাদের ছানাপোনা নিয়ে ভারি ব্যস্ত থাকে সারাদিন। ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে খালি আসে আর যায় কত্তাগিন্নি মিলে। কাক, শালিক আর চড়াইয়ের দল অবশ্য নিজেদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা নিয়েই মজে থাকে অহরহ। 

ত্রিলোচনবাবু ওদের দেখেন রোজ। মুগ্ধ হয়ে দেখেন। মাঝেমাঝে ঘষা আলাপও সারেন ওদের সঙ্গে, ইশারায়। জড়ানো জিভ ঘড়ঘড় আওয়াজ তোলে, "আঃ আঃ আঃ..." 

নাহ্, দানাপানি পাওয়ার তোয়াক্কা করে না ওরা। এমনিই কাছে আসে ওঁর ডাকে। এমন নিঃস্বার্থভাবে কেউই আজ অব্দি ধরা দেয়নি ত্রিলোচনবাবুর জীবনে। কম তো মালকড়ি ছড়াননি তিনি এই হিসেবনিকেশের সংসারে! 

ডানা ঝাপটানোর আওয়াজের প্রতীক্ষায় কান পেতে থাকেন তিনি। প্রায় বছর চারেক হল পক্ষাঘাতে অচল শরীর। হুইলচেয়ার-বন্দী নিস্তরঙ্গ জীবন। তবু সকাল-সন্ধে পাখিগুলোর ওই উন্মুক্ত আকাশে ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে যেন তিরতির করে কাঁপন লাগে তাঁর অক্ষম দেহেও। বেশ হালকা, একটা ফুরফুরে ভাব আসে থেকে-থেকেই । পিঠের দু'পাশে উঁচু হয়ে জেগে থাকা হাড়দুটো হঠাৎই তখন ফরফর শব্দে ঝাঁপতাল লিখে ফেলতে মরিয়া হয়ে ওঠে...
ডানা হয়ে উঠতে চায় কিনা কে জানে! 

ত্রিলোচনবাবু অনাবিল হেসে ওঠেন। কেউ দেখতে পায় না যদিও। শুধু তাঁর জড়ানো জিভ খোলা আকাশের দিকে লোভাতুর চোখ রেখে বলে চলে, "আঃ আঃ আঃ..."

বৈশাখী ২০২৪