মনে আছে ছোটবেলায় মায়ের কঠোর অনুশাসনে আমাদের যৌথ পরিবারে ভাইবোনেদের সন্ধেবেলা খেলাধুলো সেরে বাড়ি ফেরার পর, কিছু জলখাবার খেয়ে পড়তে বসতে হত - একটা নির্দিষ্ট রুটিন মেনে। সেই রুটিনে কোনদিন থাকত বাংলা রচনা আর ব্যাকরণ, কোনদিন ইতিহাস, কোনদিন অঙ্ক, কোনদিন বিজ্ঞান বা অন্য কিছু। উঁচু ক্লাস যাদের তারা নিজের নিজের ঘরে পড়লেও, মা এই রুটিন মানার বিষয়টি খুব কঠোরভাবে তদারকি করতেন - কোন বিচ্যুতি না ঘটে, শরৎচন্দ্রের 'মেজদা' র মত না অবস্থা হয়, সেদিকে ছিল তীক্ষ্ণ নজর। এর মধ্যে দুটো দিন মায়ের এই তদারকি থেকে ছিল ছুটি। একদিন অঙ্কের দিন, সবাই কেয়ার অফ ফুলপিসি, গণিত বিভাগ, সরোজিনী নাইডু কলেজ! অন্যদিন বিজ্ঞান, ভূগোল ক্লাস - কেয়ার অফ গৃহকর্তা, আমার বাবা, সরকারি চাকুরে। এতটা পড়ে যদি কেউ মনে করেন, আমি গল্প বলতে বসেছি, তাহলে একটু ভুল হবে। তবে গল্পের মতই ছোটবেলার এই স্মৃতিগুলো জীবনে সোনা হয়ে ফলে আছে, বোধের জানালা খুলে দিয়েছে। অন্য সব দিনের সঙ্গে অঙ্কের ক্লাসের একটা মূলগত পার্থক্য ছিল! অন্যদিন কড়া নজর সত্ত্বেও একটু এদিক ওদিক, ইশারা, খাতা ছেঁড়াছেড়ি, আবার সচকিত হয়ে পড়ায় মনোনিবেশ, মায়ের কাছ থেকে ইতিহাসের গল্প শোনা, এসব করে যা পড়াশোনা হত তা দিয়ে হোমওয়ার্ক, পরের দিনের স্কুলের পড়ার কিছুটা মোটামুটি উতরে যেত। তার সঙ্গে দল বেঁধে লেখাপড়ার করার যৌথ আনন্দটাও কম ছিল না! তবে যেদিন অঙ্ক থাকত, শীত গ্রীষ্ম বারোমাস একই স্টাইলে বিরচিত, উঁচু করে বাঁধা ডালের বড়ি টাইপের খোঁপা আর গোল চশমার ফ্রেমের মধ্যে থেকে ফুলপিসির গম্ভীর চোখ মুখ, কথাশিল্পীদের যতই আদর্শ অঙ্কের টিচারের ছবি আঁকতে সুবিধে করুক, আমাদের খুবই অসুবিধে হত। তারপর ছিল তেল মাখানো তিন মিটার লম্বা বাঁশ ধরে বাঁদরের ওঠানামা, চৌবাচ্চার জল ঢোকার কলের সঙ্গে জল বেরিয়ে যাওয়ার নল দিয়ে তার অপচয়, সিঁড়িভাঙা, কোয়াড্রেটিক ইক্যুয়েশন, অ্যালজেব্রার নেগেটিভ পজিটিভ এর কারিকুরি। এসবের জন্য কোনরকম মানসিক প্রস্তুতি, পরিবেশ তৈরি না করেই চিরতার জলের মত জোর করে গিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হত, যেমন স্কুলে, তেমনই বাড়িতেও। সমস্তটাই একজন ছাত্রের বিষয়ের প্রতি বিমুখতার আদর্শ সহায়ক। কোন মতে শুক্রবারের অঙ্ক ক্লাসের সময় কেটে যাওয়ার পর এক সপ্তাহের জন্য স্বস্তি। আজ অতীত খুঁড়তে গিয়ে মজার মোড়কে লিখছি হয়তো, কিন্তু সেইদিন ওই ক'জন কিশোর কিশোরীদের কাছে অঙ্কের প্রতি ভীতি, অনীহা অনেকের ভবিষ্যৎ জীবনকেও প্রভাবিত করেছিল। বিষয় যখন ছাত্রছাত্রীদের কাছে আনন্দের না হয়ে যন্ত্রণার হয়, প্রতি মুহূর্তে নিজের অপারগতার প্রমাণ দিতে হয়, সেই বিষয়ে ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহী হবে কেন? আর বিষয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করে দেন একজন প্রকৃত শিক্ষক। কাজেই শিক্ষার ক্ষেত্রে, প্রথম এবং প্রধান ভূমিকা একজন শিক্ষকের। তিনি সব সময় স্কুল কলেজের শিক্ষকতা না ও করতে পারেন। এর পরেই আসছি আমাদের ছোটবেলার ভূগোল বিজ্ঞান ক্লাসের কথায়। আমাদের সবার দারুণ আগ্রহের দিন, অফিস থেকে আসার সময় ভাল মন্দ কিছু খাবার আনবেন বাবা, এটা জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধের মত ছিল। এবার যা হত, তাকে ঠিক পড়াশোনা বলা যেত না, কিন্তু আমাদের বৈঠকখানা ঘরে কোন হৈচৈ বা গণ্ডগোল নয়, প্রত্যেককে দেখা যেত মনোনিবেশ করে থাকতে। পাঠ্য বই খুলে বাবা কখনো পড়াতেনই না, কারণ বিজ্ঞানের ক্লাস কোন নির্দিষ্ট ক্লাসের বা বয়সের জন্য তো ছিল না, সেদিনটা যে কোন ক্লাসের যা খুশি পড়ার দিন। বায়ুর চাপ, জলের চাপ এসব ছিল আমাদেরই আবিষ্কার করা। গ্লাসে কানায় কানায় জল ভরে পোস্টকার্ড চেপে নিয়ে বায়ুর ঊর্ধ্বচাপের পরীক্ষা আমরা বাড়িতেই করেছি। তখন ছিল চাইনিজ পেনের চল, কালি ভরার সময় দোয়াতে নিবটা ডোবালে কেন কালি ঢুকে যায় পেনের ভিতর এর উত্তর দিতে হত, কিন্তু এই সব প্রশ্নের উত্তর ভুল হলে বকুনির বদলে খানিক আলোচনা হত। কাজেই ছাত্রী হিসেবে নিজের গুরুত্বটা বুঝতেও পারতাম। তার সঙ্গে ছিল বাবার অনর্গল বলে যাওয়া চাপের পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে বিভিন্ন গল্প! আমাদের ভাইবোনেদের মধ্যে দুজনের ছিল ICSE বোর্ড। তাদের বইগুলো আমাদের বইয়ের তুলনায় অনেক অন্যরকম! এর সঙ্গে সঙ্গে দেখতাম NCERT র বই। একেবারে অন্যরকম দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। তাদের সিলেবাস ছিল আলাদা, আমাদের মাধ্যমিক বোর্ডের থেকে। মাধ্যমিক বোর্ডের সিলেবাসে ছিল ঘনত্ব, আর ICSE তে ঘনত্বের সঙ্গে সান্দ্রতার একটা উল্লেখ, যা থাকাটা খুব জরুরি। এতটা বয়সে এসেও আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান ক্লাস হল যেদিন আমরা শিখলাম সান্দ্রতা (Viscosity) আর ঘনত্বের পার্থক্য এবং সংজ্ঞা। গ্লাস, শিশি, ড্রপার, জল, মধু, সরষের তেল, নারকোল তেল, আরো কী সব নিয়ে আমাদের দারুণ উত্তেজনা! ড্রপারে জল ভরে নিয়ে চাপ দিলে টপটপ করে জল পড়তে দেখা যায়। সরষের তেল নিলে ড্রপার থেকে ফোঁটা যত তাড়াতাড়ি পড়ছে, নারকোল তেলের ক্ষেত্রে ততটা নয়। আবার মধু নিয়ে তো কোন ফোঁটা ফেলাই গেল না। তথ্যের সাহায্যে দেখলে বোঝা যাবে ধারণাগত ভাবে এটা বোঝা ছাত্রের পক্ষে কতটা জরুরি। সাধারণ ঘরের তাপমাত্রায় (ধরা যাক 20°C এ) কয়েকটা তরলের ঘনত্ব আর সান্দ্রতা নিচে দেওয়া হল। [ ঘনত্ব হল - একটা নির্দিষ্ট জায়গায় কতটা পদার্থ আছে, বিজ্ঞানের ভাষায় বলি একক আয়তনে ভর, মাপার একক gm/ mL আর সান্দ্রতা হল তরল প্রবাহের বিরুদ্ধে আভ্যন্তরীণ বাধা। যে তরল থকথকে, তার সান্দ্রতা বেশি, সে প্রবাহিত হয় কম। একে মাপার একটি একক হল Poise.] Name of density viscosity the liquid (gm/mL) (Poise) Water 1.0 0. 01 Coconut oil 0. 93 0. 55 Mustard oil 0. 96 0.117 Honey 0.00145 100.0 Mercury 13.6 0.015 [অর্থাৎ ঘনত্ব কম বেশি হওয়ার ওপর প্রবাহ মোটেও নির্ভর করছে না। এসব তথ্য তখন আমাদের বলাও হয়নি, বললেও বুঝতাম না হয়তো, পরে যখন বিজ্ঞান আরো পড়েছি, তখন মিলিয়ে দেখে চমৎকৃত হয়েছি।] যাই হোক, নিয়ম ছিল পরীক্ষা করার পরে এক এক করে তার কারণ, যার যা মনে হয়, সে কাগজে তাই লিখে জমা দেবে। যে কারণগুলো লেখা হত, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে মজার মজার হত, আবার সঠিক উত্তরের দিশায়ও নিশানা করা থাকত! এসবই কিন্তু হত পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং আলোচনা থেকেই। বেশিরভাগ সময়ে আমরা টপিকটার নাম জানতাম৷ না। দেখা গেল সেদিনের উত্তরগুলোর মধ্যে যেটা বেশি এসেছে, তা হল "থকথকে", "ঘন"। অর্থাৎ স্বাভাবিক ভাবে সবার মনে হয়েছে যে, যেগুলো ঘন বা থকথকে (আমাদের অনেকেরই এই ভুল ধারণা থাকে - থকথকে তরলকে ঘন ভাবি) বেশি সেগুলো ড্রপার দিয়ে পড়তে সময় নিয়েছে। তখন বাবা একটা কাণ্ড করলেন। পুরনো কাপে একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া থার্মোমিটারের বাল্বটা ভাঙা হল - ভেতর থেকে রুপোলি যে তরলটা বেরোলো, তা আমরা সবাই চিনতাম - পারদ। পারদ যে সবচেয়ে ঘন তরল তা আমাদেরই মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠল। এবার তরলের গড়িয়ে যাওয়া বা বয়ে চলার ক্ষমতা যদি সান্দ্রতা হয়, তাহলে জল আর পারদ বয়ে যেতে দিলে প্রায় একই ভাবে বয়ে যাচ্ছে বলে মনে হল। তখন বোঝা গেল এই বয়ে যাওয়ার সঙ্গে ঘনত্বের কোন সম্পর্ক নেই। এই যে তরলের গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম জানা হল, তা সকলের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। পরে শিক্ষকতা করতে এসে অনেক নতুন শিক্ষানীতি প্রয়োগের সময় Constructivist approach এর কথা শুনেছি, কিন্তু পেশাগত ভাবে শিক্ষক না হয়েও বাবা অত বছর আগে আমাদের পড়িয়েছিলেন সেই approach এ। এর ফলে ছাত্রের মধ্যে জাগে প্রশ্ন, তৈরি হয় পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাস এবং জানার সাহস। ভুল হলেও সিদ্ধান্তটা জানানোর সাহস। অঙ্কের ক্লাসের সঙ্গে পার্থক্য ছিল এটাই যে, একটা আপাত দৃষ্টিতে শক্ত বিষয়বস্তু অত্যন্ত সহজ ভাবে পরিবেশন হল, আর মজাটা সম্পূর্ণ নেওয়া হল, বিজ্ঞান পড়ার ভয় সম্পূর্ণ দূর হল। অথচ অঙ্ক ক্লাসে ফুলপিসি আমাদের পিছনে এর চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করতেন, কিন্তু সেই ক্লাসে আবিষ্কারের আনন্দ ছিল না, আগেই ভেবে নিতাম অনেক শক্ত বিষয়ের পড়াশোনা চলছে, সুতরাং "হাসতে মোদের মানা!"এই মনোভাবটা আমি,যারা অঙ্ক ও বিজ্ঞান পড়ান তাদের বেশিরভাগের মধ্যে দেখেছি । যে বিষয়ের ওপর আজকের আলোচনা, তার আসল কথা এটাই, আনন্দদায়ক পরিবেশ, ভয় দূর করা, আকর্ষণীয় করা টপিকটাকে, ভাল বই, আর ছাত্রের কিছু সাফল্যে একটু প্রশংসা, তার তাদের পারবারিক, সামাজিক সমস্যাগুলোকে জানা, একাত্ম হওয়া - শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের আদানপ্রদান - একটা প্রক্রিয়া কে তরতর করে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের দেশে মেধাবী মানুষের অভাব নেই, বিষয় বিশেষজ্ঞও আছেন অনেক, তারা অনেকেই শিক্ষক, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের সঠিক মনোভাব নিয়ে বিজ্ঞান অঙ্ককে উপস্থাপন না করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের, তথা আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের প্রশ্ন করার ক্ষমতা নেই, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর অভাব, বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করার দক্ষতার অভাব - ছাত্রাবস্থায় অত্যন্ত চাপের মধ্যে বিজ্ঞান পড়া অনেকাংশে দায়ী। শিক্ষকদের বিজ্ঞান ও অঙ্কের প্রতি মনোভাব, বিষয়ের ভয় কাটিয়ে তাকে মনোগ্রাহী করে তোলা, গল্প বলা, বৈজ্ঞানিকদের জীবন, তাদের লড়াই, সাফল্যের খতিয়ান রাখা - এগুলোর অত্যন্ত অভাব আমাদের দেশে। আমরা অনেক শিক্ষানীতি পেয়েছি, কিন্তু জীবন, সমাজ, মানুষ, প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে যে পূর্ণ শিক্ষা, তার কাছে আমরা পৌঁছোতে পারিনি- না স্কুলে, না কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন IIT, IISC তে পদার্থবিজ্ঞান, অঙ্ক, কেমিস্ট্রি, ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক বা উচ্চ স্তরে, গবেষণায় অনেক জীবনমুখী প্রোজেক্ট করানো হচ্ছে যেখানে সরাসরি অধীত বিদ্যাকে প্রয়োগ করার সুযোগ রয়েছে, এছাড়াও উৎসাহী ও সমান্তরাল ভাবনার অনেক অধ্যাপক, গবেষকদের উদ্যোগে স্কুল শিক্ষাকে আরো আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে বিজ্ঞান কে হাতে কলমে করার জন্য স্কুল শিক্ষকদের জন্য কর্মশালা হচ্ছে। কিন্তু তার সুযোগ নিতে পারছে হাতে গোনা কয়েকটি স্কুল। অথচ কোন অজানা কারণে রাজ্যের শিক্ষা দপ্তর এই কাজগুলিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেন, যার ফলে গ্রামের সরকারি স্কুল, বা প্রান্তিক মানুষরা এই ভাবে শেখার সুযোগই পান না ! 75 বছর হল আমাদের স্বাধীনতার, কিন্তু এখনও অনেক সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাটাতে পারেনি আমাদের সমাজ। এখনও কুসংস্কারের চাপ রয়েছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মুখে নারী পুরুষের সমানাধিকার বলি, পোস্টারে ছেয়ে ফেলি 'বেটি পড়াও বেটি বাঁচাও' স্লোগানে। কিন্তু অত্যন্ত নগণ্য একটা সংখ্যার মানুষজন এর সঠিক তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেন, সত্যি করে সম্মান করেন বাড়িতে মাকে বৌকে, মেয়েকে, বোনকে। এখনো লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয় মেয়েরা, নিজেদের স্বপ্নকে উড়ান দিতে শেখে না, নিজেদের পারঙ্গমতাকে অস্বীকার করে নিজেরাই। সংসারে ভাই, বোন বা দাদা থাকলে বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ জোটে ভাই বা দাদার, যোগ্যতার মাপকাঠি নয়, মেয়েটির মেধা থাকলেও শুধুমাত্র মেয়ে বলেই তার জন্য প্রাইভেট টিউটর দেওয়া হয় না পরিবার থেকে। এই তথ্য দেখে শহরের অনেক মানুষের ভ্রূকুটি দেখা যেতে পারে, কিন্তু আমার মত যারা দীর্ঘদিন গ্রামে কাজ করেছেন তারা জানেন সত্য কতটা রূঢ়। ভারতবর্ষে এখনো প্রতি চারজনে একজন মেয়ে তার তার জীবনের 'sweet seventeen' কাটায় তার শ্বশুরবাড়ির কড়া অনুশাসন বা অত্যাচারের মধ্যে। যেখানে জীবনযাপনটাই অনিশ্চিত, সেখানে বিজ্ঞান পড়ার মানসিকতা, সামর্থ্য এবং স্বাস্থ্য কোনটাই আর থাকে না ঠিকমত। বিগত কয়েকবছরে সাধারণভাবে বিজ্ঞান পড়তে আসা ছাত্র ছাত্রীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এর মধ্যে বলা বাহুল্য ছাত্রীদের সংখ্যা আরো কম। তবে, UNICEF কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছে, শিশু বিবাহ বন্ধ করার জন্য - নানা প্রোজেক্ট, যেমন মায়েদের শিক্ষিত করা, মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার সুবিধার দিকে নজর দেওয়া, কিছু ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়ে পরিবারকে গ্রাম থেকে শহর বা শহরতলীতে স্থানান্তর করানোর মাধ্যমে শিক্ষার সুবিধা করে দেওয়া ইত্যাদি। শিশু বিবাহ শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর চাপ ফেলে - অল্প বয়সে বিয়ে মানে বেশি সন্তান উৎপাদনের সম্ভাবনা, তা শেষ পর্যন্ত তৈরি করে বিপুল জনসংখ্যা - এই সব কথা লোকাল মিটিং বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝানো - এসবের পর যদিও আগের তুলনায় শিশু বিবাহের হার 2015-16 র হিসাব অনুযায়ী, 47% থেকে কমে হয়েছে 27%, সেটাও এই সময়ে দাঁড়িয়ে যথেষ্ট বেশি বলে মনে হয়। গ্রাম শহর নির্বিশেষে, আমাদের দেশে, বিশেষ করে আমাদের রাজ্যে, এতদিন শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে, এবং Centre for Physics Education and Research ( CPER) এ যুক্ত থাকার সুবাদে বলা যায়, ওপরের আলোচনার মধ্যে যে দিকগুলোর কথা বলা হল, তা প্রতিবন্ধকতা অবশ্যই। তবে এর মধ্যেও আশার আলো জ্বালানোর চেষ্টায় আছে বেশ কিছু সংস্থা আছে, যেমন Science Communicators' Forum, IIT kharagpur এর TLC ( Teaching Learning Centre) হাতে কলমে বা অন্য আনন্দদায়ক পদ্ধতিতে বিজ্ঞান শেখানোর জন্য নিরন্তর কাজ করে চলেছে। এদের তত্ত্বাবধানে এবং এদের সঙ্গে বহু স্কুলে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি ছাত্র ছাত্রীদের কাছে সমস্যাটা বলা, কীভাবে সমাধানের পথে এগোবে তার একটু সূত্র দিলে, আত্মবিশ্বাসে ভর করে এগিয়ে আসার ভরসা দিলে হাতে কলমে কাজ করাটা ওরা নিজেরা উপভোগ করে, আগ্রহ নেয়। এমন কি পিছিয়ে পড়া ছাত্রীটিও আমাদের ছোটবেলায় যেভাবে বিজ্ঞান আবিষ্কার করার আনন্দ পেতাম, সেটা পুরোপুরি পায় ! শুধুমাত্র লেখা পরীক্ষাই নয়, তার সঙ্গে আমাদের মূল্যায়ন ব্যবস্থার মধ্যেও যদি এই বিষয়টা ঢোকানো যায়, তা এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে বলে মনে হয়। অনেক ভাল ছাত্রের তুলনায়, সাধারণ মানের ছাত্র হাতে কলমে কাজ করতে পারদর্শী। যার মূল্য দিতে আমাদেরও শিখতে হবে। মনে রাখা দরকার, পরীক্ষার উত্তর লেখার জন্য ছাত্রকে ভাষার সাহায্য নিতে হয়, যে ভাষায় তার দখল নেই - সে ভাষা তার মাতৃভাষা হলেও না। এখন মোবাইল ফোনে মেসেজ করতে করতে, সবাই ভুলে যাচ্ছে বাংলা অক্ষর, বানান, বাক্যের গঠন। কাজেই বিজ্ঞান শিক্ষা বা কোন বিষয় শিক্ষা শুধুমাত্র সেই গন্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না, সার্বিক উন্নতির দাবিও করে। ভাষা নিয়ে জোর দেওয়া, গল্প শোনানো বা গল্প বলা, স্কুল থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া বিষয়- 'ডিবেট' এই সব বাধ্যতামূলকভাবে স্কুল কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা আমি দেখেছি IIT Kharagpur এর সেন্টারে। মুশকিল হল পরিকল্পনা রূপায়ণে! কারণ শিক্ষা দপ্তর যতক্ষণ না সিদ্ধান্ত না নেবেন, ততক্ষণ মূল ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে না, বিজ্ঞান শিক্ষার হালও ফিরবে না। আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, শিক্ষাকে শিশু বা ছাত্রের জীবনগঠনের একটা পূর্ণ প্রক্রিয়া যদি ভাবি, তাকে কখনই কোন বিষয়ের প্রকোষ্ঠের মধ্যে আটকে দেওয়া যায় না। জোয়ারের জলের মত তা ছড়িয়ে পড়বে পাড় উপচিয়ে তার জীবনের সব ক্ষেত্রে। তবেই তো উর্বরতায় ফলপ্রসূ হবে তা। কাজেই স্কুলের সঙ্গে যে পরিবেশে ছাত্র বা ছাত্রীটি থাকে সেই কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে হবে, অভিভাবকদের আনতে হবে স্কুলের সব সচেতনতার অনুষ্ঠানের মধ্যে। এটার অভাবেই পরিবারের থেকে তৈরি করে দেওয়া নেগেটিভ ব্যক্তিত্ব, চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা তৈরি না হওয়ার কারণেও ছাত্রীরা বিজ্ঞানে বিশেষ করে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি পড়তে আসতে ভয় পায়, মনে করে বিষয়টা কঠিন। তবে এই অবস্থাটা কম বেশি সব দেশেই। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীর মোট মহিলা গবেষকদের মধ্যে 47.6% ভারতীয় - চিত্রটা ততটা হতাশাজনক নয়। কিন্তু স্কুল বা কলেজে মেয়েদের যেখানে 57% সেখানে 84% ছেলেরা বিজ্ঞান পড়তে আসে মোট পড়ুয়াদের মধ্যে। বিগত কয়েকমাস ধরে মানব সভ্যতা অনিশ্চয়তার মুখে। সারা বিশ্ব জুড়ে লেখাপড়া প্রায় বন্ধ, কারণ অনলাইন ব্যবস্থার সুবিধে বিশেষ কিছু দেশে, বিশেষ কিছু অবস্থার মানুষজন ছাড়া আর কেউ তা পায়নি। বেকারত্ব বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দারিদ্র। কোভিডে মৃত্যুর সঙ্গে সমান তালে বেড়েছে অনাহার, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু। এর ফলে প্রতিটি সাধারণ পরিবারে কিছু প্রভাব পড়বে যা অনিবার্য। আমাদের দেশে, রাজ্যে, বিভিন্ন জেলায় জেলায় কম বেশি এমন ঘটনা দেখা গেছে - বাড়ির ছেলেদের, যারা ছাত্র ছিল, তাদের কোন রোজগার করার কাজে লাগানো হয়েছে, আর মেয়েদের দেওয়া হয়েছে বিয়ে, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সাহায্যে পাচারও করা হয়েছে। তবে কোভিড পরিস্থিতিতে আগের তুলনায় খুব বেশি এই পরিসংখ্যান বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন না। আবার যখন স্বাভাবিক হবে সব, তখন এই সংখ্যাগুলো আগের জায়গায় চলে আসবে। কিন্তু যারা এর শিকার হল, তারা চিরতরে হারিয়ে গেল অন্ধকারে। স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই সংখ্যাগুলো আমাদের ভাবায়নি, সেটাই আশ্চর্যের। শুধু কোভিডকে দায়ি করা নয়, দরকার চিন্তা ভাবনার আমূল বদল। বিজ্ঞান শিক্ষা মানে সারা জীবন তাকে শুধু অধ্যয়ন করা নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হওয়া। সেই দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র একজন ছাত্র বা ছাত্রীর তৈরি হলে তবেই সে বিজ্ঞান পড়তে আসবে বা তার জীবন গড়বে সঠিক ভাবনার আলোকে তা একেবারেই নয়। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে অভিভাবক, শিক্ষক, সরকার, সমাজ সর্বস্তরে। বিষয় পেরিয়ে যাবে তার গণ্ডী, 'সীমার মাঝে অসীম ' হয়ে তার সুর বাজবে, প্রকাশ পাবে সর্বজনীন এক বিভা, সেটাই যে কোন শিক্ষানীতির সার্থকতা।