ভূমিপুত্র

লালমণির হাট, বাংলাদেশ

তৃষ্ণার্ত শিশুটি আকাশের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে৷ সারা গায়ে ধুলো, কোথাও কোথাও রক্ত জমাট বেঁধেছে। চারদিকে বিস্ফোরণের শব্দে যখন বুক কেঁপে উঠছে তখন শিশুটি  নীলচে আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে চলা বিচ্ছুরিত রকেট বোমের দিকে তাকিয়ে থাকে; সেগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে সাঁই সাঁই করে চোখের পলকে হামলে পড়ে শহর জুড়ে৷  শত শত মানুষের চিৎকার ভাসে। দালান গুঁড়িয়ে যায়, ধ্বংসস্তূপে মৃতদেহের ছিন্নভিন্ন অংশ থরথর কাঁপে। উন্মত্ত বারুদে চোখ ধাঁধায়৷ 

 শিশুটি বিল্ডিংয়ের স্তূপ থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উঠে এসে ধ্বংসস্তুপের একটা ভাঙা অংশে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়; যতদূর চোখ যায় শুধু আগুনের ঝলকানি এবং ধোঁয়ার কুণ্ডলী। তারও দূরে সৈকতের নীল জল। ও ভাবে হয়ত সমুদ্রের অপরদিকেই আছে শান্তির শেষ ঠিকানা !

 কতটা সময় কেটেছে কেউ জানে না। আকাশ সন্ধ্যা তারার রূপে সাজছে একটু একটু। আবছা অন্ধকার ঢেকে ধরেছে ভূমির ধংসযজ্ঞ। কে বলবে এই আকাশে একটু আগেও মরণবাণ  ঘুরে বেরিয়েছে,এই মাটি জুড়ে ছিলো বহমান নিশ্চিহ্নের ক্ষত,  বায়ুতে ছিলো রক্তের গন্ধ। অথচ এখন শুধু নিস্তব্ধতা। 

পুবে পাহাড়ের উপর একে একে বহু অবয়ব  ভেসে উঠতে দেখা যায় । তারা সারিবদ্ধভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত! 
তবে শিশুটির  সরে যাওয়ার ইচ্ছে জাগে না। ওর চোখে  মৃত্যুর আর কোন ভয় নেই,  শুধু ভীষণ ক্লান্তি শরীর জুড়ে। 
ও অপেক্ষা করে,  শুধু অপেক্ষায় থাকে....

 

এসব স্বার্থের খেলা, সংঘাত দেখেই তো বড় হচ্ছে শিশুটি৷ দেখছে ধর্মের নামে অধর্ম। এ খেলা কোন দেবতা সৃষ্টি করতে বলেনি।  এ খেলা শুরু করেছিল কিছু অমানুষ যারা ক্ষমতার শিখরে অমরত্বের নেশায় ভ্রান্ত ছিল। ওরা তো শান্তি চায়নি শুধু যুদ্ধ চেয়েছে। 

ও ফুটবল খেলতে পারেনি – ওকে ওরা তুলে দিতে চেয়েছিল বন্দুকের নল। ও ইবাদত করতে চেয়েছিল কিন্তু কানে ঢালা হয়েছিল বিষবাক্য। দুমুঠো পেট ভরে খাবার বদলে  পেয়েছিল উপবাস।  মুক্ত বাতাসে কবিতায় ভাসতে চেয়েছিল শিক্ষা, কিন্তু জ্ঞানের আলো পায়নি।

ও জন্মলগ্ন থেকেই সাক্ষী পাশবিকতার। তবুও ও ঘৃণা করতে শেখেনি কাউকে। ও ফুলের মত পবিত্র হয়ে আজন্ম লালিত শান্তির বার্তা পৌছে দিতে চেয়েছিল সেইসব দালান-কোঠা-প্রার্থনালয়ে যেখানে হয়ত এখন আর সত্যের কথা বলে না কেউ!
 

 
একদল সশস্ত্র সেনা শিশুটিকে ঘিরে ধরে। ওকে খোঁচা দেয়, পরিচয় জিজ্ঞেস করে।  

শিশুটি স্মিত হেসে নিশ্চুপ থাকে। সেনারা ওকে রাইফেলের নলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসায়। 

 শিশুটি নির্বাক দেখতে থাকে ওদের কার্যকলাপ।
 
 সেনারা ওর জাতীয়তা, ধর্ম নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে। +

শিশুটি স্মিত হেসে ক্লান্ত কন্ঠে উত্তর দেয়, "আমি মানুষ, তোমাদের মতই এই মাটির সন্তান।"

সেনাধ্যক্ষ হিসহিস করে বলে, "তোরা এই মাটির কেউ না শয়তানের দল,  মরার জন্য প্রস্তুত হ!"

শিশুটি চোখে চোখ রেখে বলে, “আমাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করো কিন্তু শুরু করো একটা নৈতিক জীবন!”

সেনাধ্যক্ষ রেগে যায়, শিশুটির গায়ে থু থু ছিটায়। ভীত না হয়ে একদৃষ্টিতে শিশুটি তার চোখে তাকিয়ে বলতে থাকে, “যুদ্ধ চাও, যুদ্ধ করো; কিন্তু একটা সময় পর তোমরা ক্লান্ত হয়ে যাবে, ভুল বুঝতে পারবে, ক্ষমাশীল হয়ে উঠবে। কিন্তু ঘৃণা এতই ভয়ংকর যা মানুষ পুষে রাখে রক্তের বীজে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে ডুবিয়ে দিয়ে যায় অন্ধকার কৃষ্ণগহ্বরে, যার শেষ বলে কিছু নেই!”

 
সেনাধ্যক্ষ থমকে যায় ওর কথায়, গালিগালাজ করে, তারপর হঠাৎ ওকে ছেড়ে সামনে রওনা হয় তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে। 
শিশুটি অন্ধকারেই প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে থাকে ধ্বংসস্তূপের দিকে চেয়ে, যেখানে কিছু আগেও ভালোবাসার জনেরা ছিল জীবিত! চারদিকে শুধু  হাহাকার উপচে পড়ে.... 

শূন্যতা ছাড়া ওর কথা শোনার কেউ নেই তখন আর...!

বৈশাখী ২০২৪