মড়া

দুবরাজপুর, বীরভূম

“আজ কি উপোস থাকতে হবে চানা? কোন সক্কাল থেকি আড়া পেতে বস্যে আছি, একটো মালের দেখা নাই মাইরি" - কথা ক’টি জগা চানাকে শোনায়। এলাকায় জগন্নাথ 'জগা' আর চন্দ্রশেখর 'চানা' নামেই পরিচিত। চানা দাঁত খিঁচিয়ে একটা হাল্কা খিস্তি দিয়ে বলে, “শ্লা, আমি কি জানগুরু যি সব কুছু জানি? তু যেথা আমুও সেথা।” 
চানা নাকে কথা বলে। সব কথা সবাই বুঝতে পারে না। কাছাকাছি যারা, তারা ধরে নেয়। চানার কথা ধরেই বুলেট বলে, “কালকে মাইরি এসুময় মাল খালাস।” 
ও একটু দূরে দাঁড়িয়ে রাস্তায় নজর রাখছিল। মড়াটার উদ্দেশ্যে বলে, “শ্লা কুপেকো। জানতাম আজ বয়নি হবেক নাই। চটপট কাজ শ্যাষ করে কাটতে পারলেই বাঁচোয়া - হেব্বি রিক্স।”

ষাট নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে হিংলো নদীর কিনারে শিমুল গাছের নিচে সাদা কাপড়ে ঢাকা আছে মড়া। পাশেই শ্মশান। গরিবের মড়া, ইত্যাদি, প্রভৃতি পাঁচরকম ইনিয়েবিনিয়ে ব’লে লরির ড্রাইভারদের কাছ থেকে পয়সা কামানো কাজ। জায়গাটা সেই হিসাবে খুব উপযুক্ত। বিশাল এক বাম্পার - গাড়ি স্লো না করে যেতেও পারবে না। সেটাই সুযোগ। মড়ার পাশে ধূপকাঠি পুড়ছে। গাঁদার মালা দিয়ে মড়া সাজানো হয়েছে। মড়া ফিসফিস করে কথা বলে, “আর পারছি না ভাই। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাইরি বলছি, মুখের কাপড়খান এট্টু খুলে দে ভাই।”
চানা দূর থেকে ধমক দিয়ে বলে, “চুপ শ্লা, একটো পয়সা এখুনো বয়নি হয়নি। দম বন্ধ হয় হোক। তেবু মুখ খুলবি না। কাল যি আমু ছিলেম? আমার কষ্ট হয়নি বুঝি? কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলবে?”
এদিকে গাড়ির শব্দ শুনেই চানা বলে, “নেপা সাবধান। শুরু হন্ছে। মাল আসছে। মুনে রাখিস - তু মড়া।”  
এভাবেই রোজগারের একটা সহজ, অথচ বিপজ্জনক পথ খুঁজে নিয়েছে চার বন্ধু মিলে। ঘন্টা দুয়েক সকালের দিকে মড়া আগলাতে পারলে আর কী চাই? তারপর সারাদিন ফূর্তি। ঘরের লোকরাও খুশি। কে কী করছে, ওসব খোঁজের কী দরকার? পয়সা তো দিচ্ছে। খবরের কাগজ, লটারির টিকিট, ঝালমুড়ি বিক্রি করে ক'টাকাই বা কামাবে? নিজের পেটেই বাকী - ঘর তো অনেক পরে। 
                   
বিকেল বেলায় চানার সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু মিলে রোজগারের পথ খোঁজে। লটারির টিকিটবিক্রেতা জগাও ভাবছিল, অন্য কিছু করতে হবে। 
সাইকেলে কলিয়ারী থেকে কয়লা টেনে টেনে বুলেটেরও জীবনটা কয়লা হয়ে যাচ্ছিল। চানাকে বলে, “মাইরী বলছি, একটো কিছু সবাই মিলে কর তো। আর খাটতে পারছি না। এক মাত্তর তুই পারবি। তু যা বলবি আমরা তাতেই রাজি। সি আর পি, জি আর পির ঠ্যাঙানি তো খেতে হবে না! বড়ো বেদো শালারা, টাকাও লেবে আবার ঠ্যাঙানিও খেতে হবেক! পুলিশের মার তবুও ভালো। এই দ্যাখ,” বলে ডান পায়ের হাঁটুটাকে দেখায়, “এমন খেদালো, গিয়ে গাড়ায় পড়ে হাঁটু ভাঙলাম। শ্লা, এখনো ব্যথা।”
চানা মাথাটা চুলকিয়ে বিড়িতে একটা জোরসে  টান দিয়ে ধুয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, “বুঝলি, মাথাতে এনেক দিন থেকি একটো পেলেন ঘুরঘুর করচে। শুন তুরা। রোটেশন সিস্টেম।” 
জগা কথাটা বুঝতে না পেরে শুধোতে গেলে চানা খেঁকিয়ে বলে, “শ্লা, হাঁদা কোথাকার? উলোপালা তো  বুঝিস?”
“হঁ হঁ, সিটা খুব জানি।” 
“ইটো তাই,” চানা বলে। “তু একদিন তো আমু একদিন - মড়া হতে হবে। ঐ শেমুলতলায়। যখন বাইরের লড়ি গুলান সাঁই সাঁই করে সক্কাল বেলায় পাশ হবে ঠিক তখুন। মড়া পোড়াতে সব ডাইভাররাই পাঁচ-দশ-পঁচিশ টাকা চাইলেই ছুড়ে দেবে। ঘন্টা দুয়েকের কাজ। পারবি না?”
বুলেট বলে, “হেব্বি রিস্কি। ধরা পড়লে আবার সেই পুলিশের প্যাদানি!”
চানা দাঁত খিচিয়ে বলে, “তাইলে ঘরে বসে থাকগা। ধরা পড়ার আগে রাস্তাটা সাফ রাখতে হবে, বুইলি? আর পুলিশ? দু-দশটাকা হাতে পেলে রা কাড়বে না - মাথা মোটা কোথাকার! তুর কয়লাই ভালো রে।”
জগা চানাকে সমর্থন করে বলে, “তুর মাইরি হেডে হেব্বি মাথা আছে। নেহাত পড়াশুনাটাই নাই, নইলে বড়ো সাহেব হয়ে যেতিস রে।” 
একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চানা বলে, “ওসব আর বলিসনা ভাই। মনটায় খুব কষ্ট হয়। অনেক লেখাপড়া করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু  হবে কেনে? গরীবের  কোন দাম কেউ দেয় না ভাই,” গলাটা ধরে আসে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “তাহলে বল, কী করবি?”
জগার সঙ্গে গলা মিলিয়ে নেপলাও দেড়খানা পায়ে লাফিয়ে উঠে বলে, “গুরু, আর কোন কথা হবে না। আমরা আছি।” 
চানা বলে, “তাহলে হাত মেলা। কাল থেকেই শুরু। ঠিক তো?”
সবাই বলে, “হ্যাঁ তাই।”

কারবারটা কয়েকদিনেই বেশ জমে উঠেছে। দিন দিন নূতন নূতন অভিজ্ঞতা। কে কী করছে এসব নিয়ে মানুষের আগ্ৰহ নেই। কত রকম ভাবেই মানুষ বেঁচে আছে। চেনাজানা কারো নজরে পড়ৃলে টুকদি মজা করে মুচকি হেসে কেটে পড়ে। শিমুলতলা খুব খতরনক জায়গা। রাস্তায় ছিনতাই, খুন এই জায়গাতেই বেশি হয়। যারা জানে তারা সন্ধ্যার পর ঐরাস্তায় গাড়ি আনে না। 
                     *                  *              *
এই মুহূর্তে সাঁ সাঁ শব্দে গাড়ি আসা-যাওয়া করছে। পাঁচামীর পাথর বোঝাই লরি আসছে দুবরাজপুরের সাতকিন্দুলীর হোটেল থেকে। রাতটুকু হোটেলে কাটিয়ে সকাল সকাল গাড়ি ছেড়েছে। তিনজনেই বেশ হাঁফিয়ে উঠেছে। খিদেও পেয়েছে। শিমুল গাছের তলায় তিনজনে বসে বসে খোশমেজাজে বিড়ি টানে। ওদের হাসিঠাট্টা মড়ার কানে আসে। নেপলার মনটা ছটফট করে। দু'টান দিতে পারলে যেন বাঁচে। বুঝতে পেরে বুলেট শুধোয়, “নেপা দুটান নিবি নাকি রে?”
মড়া নড়ে ওঠে। উঠতে পারে না। হাত-পা বাঁধা। 
বুলেট ছুটে গিয়ে মড়ার মুখ খুলে বিড়িটা গুঁজে দিতেই জোরসে একটা-দুটো টান দেয়। মুখটা আবার ঢেকে দেয় বুলেট।
 
হঠাৎ একটা সাদা গাড়ি রাস্তা ছেড়ে ওদের দিকে টার্ন নিতেই তিনজনেই সতর্ক হয়ে যায়। বুলেট চিৎকার করে ওঠে, “নেপলা, পুলিশ. পু-লি-শ…” 
তিনজনেই ছুট লাগায়। পাশেই আখের ক্ষেতে ঢুকে পড়ে। নেপলা হতচকিত হয়ে পড়ে। কী করবে ঠিক করতে না পেরে বাঁচার জন্য চটপট বাঁশের মাচা নিয়েই ছুটতে থাকে। বাঁশগুলি এখানে ওখানে ছিটকে পড়ে। তালাইটা তখনো বাঁধা। সোজা গিয়ে ধান মাঠে গিয়ে উবুড় হয়ে পড়ল। এমনিতেই সে খোঁড়া। পোলিওতে একটা পা ছোট। ছুটতেই পারে না। তবুও প্রাণের মায়ায় কোন রকমে উঠে তালাইটা খুলে ফেলে নদীর দিকে হাঁটে। 

পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে মড়ার ছোটা দেখে হতবাক। ফুলমালা ছড়িয়ে রয়েছে। ধূপ তখনো পুড়ছে। 
ততক্ষণে তিন সন্তানকে ইক্ষুবৃক্ষ বাহু প্রসারণ করে বক্ষে স্থান দিয়েছে। গাড়িটা চলে যেতেই হিংলোর স্বচ্ছ শীতল বারিধারায় কণ্ঠাগত প্রাণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে তিনজনে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরে খুশির হাওয়ায় হো হো করে তিন বন্ধু হাসিতে ফেটে পড়ে। নেপলা ততক্ষণে প্রায় পৃথিবীটাকে একটা চক্কর দিয়ে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে তিন বন্ধুকে খুঁজে পেয়ে রাগে-অভিমানে অভিযোগের কণ্ঠে বলে, “সব শ্লা বেইমান। আমাকে একা ফেলে তোরা কেটে পড়লি? এই তোদের বন্ধুত্ব? সব্বাইকে চিনে নিলুম।”
চানা বলে, “হারামজাদা, তু একটা আস্ত গাধা। জানিস না, তু তো মড়া! মড়ার মতো শুয়ে থাকলেই পারতিস। ছুটতে গেলি কী জন্যে?”
“হুঁ কেনে গেলুম, সিটো আমিই জানি। পুলিশের মার খাসনি তো! এই নাক কান মুলছি - আজ ই আমার শ্যাষ। বেঁচে থাকার চেয়ে 'মড়া'তে হেব্বি রিস্ক মাইরি!”

বৈশাখী ২০২৪