সেদিন ‘মুক্তধারা’ পড়াতে পড়াতে আবার একবার মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত ভাবনা। যে ভাবনা কোন অবাস্তব কষ্ট কল্পনা নয়, বরং এক ভারসাম্য রক্ষাকারী লয় বা harmony। এই লয় বাঁধতে চেয়েছিলেন বিশ্বভারতীতে; এই লয়ের বোধ জাগ্রত হয়েছিল কিশোর বয়সের শুরুতেই পিতার সঙ্গে হিমালয়ের পথে পথে। পুঁথি পোড়োর মুখস্থ পাঠ নয়, পায়ে হেঁটে চিনতেন গাছগাছালির সবুজ সতেজ ক্লোরোফিল। আগাছার ভিতর থেকে উঁকি মারত যেসব নাম নাম না জানা ফুল, তাদের গুরুত্ব বুঝতে খুব বেশি বিজ্ঞানের ডিগ্রি লাগে না। যেটা লাগে সেটা হল বিজ্ঞানের সহজ স্বাভাবিক ধারণার সঙ্গে মানুষের কল্যাণের সুন্দর সমন্বয়। জীবনস্মৃতি-র একটি অংশে দেখি, "সীতানাথ দত্ত মহাশয় আসিয়া যন্ত্রতন্ত্রযোগে প্রাকৃতবিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন।" এই হাতে কলমে শেখার মজা রবিকে রবিবারের আনন্দ এনে দেয়। জীবনস্মৃতির এই অংশটি যুক্ত হয়েছে 'বিশ্বপরিচয়' প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধে, এখানে পিতার সঙ্গে পাহাড়ে ঘোরার মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানে রস লাভের উল্লেখ করেছেন। তবে তাঁর রসগ্রাহিতার ছন্দে সবটুকুই হয়েছে রসসমৃদ্ধ। তাঁর নিজের কথাই শুনি, “বিজ্ঞান থেকে যাঁরা চিত্তের খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেন তাঁরা তপস্বী। – মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ, আমি রস পাই মাত্র।" এই রসিক মানুষটিকে গানে-কবিতায়-নাটকে-উপন্যাসে-গল্পের মধ্যে তো খুঁজে পাইই, তবে খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম তাঁর পরিবেশ সচেতনতার কথা ও কাজের সিরিয়াসনেস সম্পর্কে পড়াশোনা করে। অবশ্য আশ্চর্য হবার কীই বা আছে? তিনিই তো এমন উদার সুরে ভাবতে পারেন, বাঁধতে পারেন সৌরজগতের সবক'টি তারকে, পারেন আপন আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল করেও এক ভারসাম্য রক্ষাকারী লয় বজায় রাখার চেষ্টা করতে। এই তো তাঁর কর্ম। আমরা ছোটবেলায় একটি-দুটি রচনা খুব অভ্যাস করতাম - দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ? একটি পয়েন্ট খুব চলত লেখায় যে বিজ্ঞান যদি অভিশাপ হয়, তাহলে কি মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে আদিম যুগে! হাত দিয়ে মাটি খুঁড়তে হবে! সাঁতার কেটে নদী পার হতে হবে! এরকম কথা রবীন্দ্রনাথ বলবেন তা তো হতেই পারে না! কারণ সবসময় সর্বত্র তিনি এগিয়ে যাওয়ার কথাই বলেন। এই যে গত দু’বছর ধরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। আচ্ছা আর কোন ঋতু কি দেশে আসবে না? মাঝে মাঝে একটু আধটু শরৎ উঁকি ঝুঁকি মেরে চলে যায়, হেমন্তের তো নামই শোনা যায় না। শীতের দাপট কয়েকটি দিন থাকে বটে, তবে মূল দুই গায়েন হল - গ্রীষ্ম ও বর্ষা। এরা একেবারে জাঁকিয়ে বসছে মানুষের জীবনে। আপনারা ভাবছেন তো, জানা কথাগুলো আবার জানাচ্ছে কেন সুস্মিতা? কী করবো বলুন, পড়ছি যে -শুনছি যে এই ঋতুকেন্দ্রিক প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টির ফলেই নাকি এত দুর্যোগ, এত মহামারী। ছয়টি ঋতু ঘুরে ফিরে আসে যায় - এই তো ধরিত্রী'র বরাবরের নিয়ম। সিজন্যাল ফুল, ফল ও সবজি টাটকা খেতে পাই আমরা, হিমঘরের ঠান্ডা কুঁচকে যাওয়া মহার্ঘ বস্তু নয়। বেশ, তাহলে দেখা যাক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'শারদোৎসব' নাটকের মধ্যে কীভাবে শারদলক্ষ্মীর বন্দনা করেছেন। শরৎকাল এসেছে, কবিগুরুর কাছে অনুরোধ এসেছে একটি শারদ-বন্দনা মূলক নাটক লিখে দিতে হবে। আচ্ছা বেশ - নাটক লেখা হল, তার মধ্যে এক সন্ন্যাসী চরিত্র আছেন। তিনি কী করলেন দেখুন -ধানের মঞ্জরী, এক মুঠো শুভ্র টগর, শেফালী, মালতী ও কাশ ফুল নিয়ে গাইতে গাইতে বনপথ প্রদক্ষিণ করতে শুরু করলেন। শারদলক্ষ্মীকে স্বাগত জানিয়ে গান ধরলেন - 'আমার নয়ন ভুলানো এলে ...' অবাক কান্ড! মন্ত্র পাঠ না, যাগযজ্ঞ না, বিরাট মাপের মঞ্চে বক্তৃতা না, মাইক নিয়ে প্রচার না, শ্লোগান না - কিচ্ছু না। কবি শুধু সহজ সরল ভাষায় ও ভাবে শরতের আবাহন সঙ্গীত সৃষ্টি করলেন। বুঝিয়ে দিলেন যে, এই শরৎকাল আর পাঁচটি কালের মতোই জগত ও জীবনে অনিবার্য এবং অপরিহার্য। তাকে স্বাগত জানাতে লাগে শুধু ঐ শরতের নিজস্ব কিছু ফুলের অঞ্জলি। এরকম আরো কত ঋতু কেন্দ্রিক নাটক আছে তাঁর - যেমন বসন্ত, বর্ষামঙ্গল, শ্রাবণগাথা ইত্যাদি। পরিবেশবিদ রবীন্দ্রনাথকে চেনার জন্য এর থেকে ভালো কিছু আর হয় কি? শুধু কি নাটক? ' পঞ্চভূত' নামক একটি প্রবন্ধে তিনি বৈঠকী আড্ডার আদলে পঞ্চ ভূত অর্থাৎ পাঁচটি ভৌতিক উপাদানের প্রসঙ্গ এনেছেন। এই পাঁচ ভূত হলেন ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম। আমাদের জগত ও জীবনের পাঁচ জরুরী প্রাকৃতিক উপাদান। এঁদের যৌক্তিকতা শুধু ভারী ভারী বক্তব্যের মাধ্যমে না বলে তিনি মজার ছলে পাঁচটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন ঐ পঞ্চভূতের বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখে। যাতে অন্ততঃ বায়ু অর্থাৎ মরুৎকে দূষিত করার আগে একবার মানুষ একটু ভাবে, একটু সমঝে কাজ করে। এঁরা দেবতা জ্ঞানে পূজিত হতেন প্রাচীনকালে। এখনো কেউ কেউ তাই মনে করেন, কিন্তু তাদের দূষণমুক্ত রাখতেও পারেন না। 'মুক্তধারা' নাটক নিয়ে প্রবন্ধ শুরু করেছিলাম। সেখানে বাঁধ নির্মাণের প্রসঙ্গ এসেছে, উঠে এসেছে যন্ত্রবিদ বিভূতির উদাসীন ক্যাজুয়াল মানসিকতার পরিচয় - বাঁধ দেবে তো দেবে, তাতে শিবতরাইয়ের নিরন্ন অসহায় মানুষগুলো জলের অভাবে শুকিয়ে মরলে মরলো! কার কী? ঠিক এইখানেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ভাবনা শুরু। এই নাটক লেখার কিছুদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সভ্যতার লোভী আগ্রাসী মনোভাব দেখেছেন। খুব কষ্ট অনুভব করেছেন, কিন্তু বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের দোষ দেননি। দোষ দিয়েছেন ব্যক্তিবিশেষের প্রাণঘাতী নৃশংসতা ও লোভকে। বারেবারে বিজ্ঞানীদের আগমন ঘটেছে শান্তিনিকেতনে ভূপরিবেশ মানবের কল্যাণের কাজে মানানসই করার জন্য। দুজনের নাম তো এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য - আর্থার গেডেস এবং প্যাট্রিক গেডেস। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে এসেছিলেন শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের উন্নতি প্রকল্পে। আসলে এইসব কাজগুলো এতো সহজে, এতো নীরবে, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তিনি করে ফেলেছিলেন যে আমরা তার গুরুত্ব বুঝিনি। এই ঋতু বন্দনা যে পৃথিবীর লয় (harmony) ঠিকঠাক গতিতে বজায় রাখার জন্য - এই সরল সত্যটি আমরা তখনো বুঝিনি - এখনো না। করোনা'র ঠেলায় পড়ে আমাদের প্রাচীন ভারতীয় তপোবন ভিত্তিক শিক্ষার আদর্শ এবং ত্যাগের মহিমার কথা মনে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ কতো যুগ আগে সেই জরুরী কাজটি যাকে বলে 'sustainable development' (সংরক্ষণযোগ্য এবং সহজ বিকাশ) অব্যাহত রাখতে চেষ্টা করেছেন। এ তো গেল ঋতুকেন্দ্রিক নাটকের কথা। এবারে আসি তাঁর বৃক্ষরোপণ পালন অনুষ্ঠানে। বৃক্ষবন্দনা তো সর্বদা করে চলেছেন, এবারে মহা সমারোহে বৃক্ষরোপণ উৎসবের শুভ সূচনা। এক নৃত্যগীতিময় পরিবেশে তরুলতাদের সঙ্গে এল বালিকারা। এইরকম উৎসব রবীন্দ্রনাথ বলিদ্বীপে দেখেছিলেন। ভারতীয় আদর্শে সৃষ্ট তাঁর তপোবন-ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুন্দর ভাবে এই ভাবনার রূপায়ণ ঘটালেন। এই সময়ে হালচালনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জমিদার রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিলেন যে প্রজা ও রাজা উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পরিবেশ সুস্থ ও সুন্দর রাখার এও এক পদ্ধতি। সীতা জনক রাজার লাঙলের আগায় উঠে এসেছিলেন, সীতার সঙ্গে তাই কৃষির এবং বসুন্ধরার নৈকট্য যুগে যুগে আমরা খুঁজে নিতে চেষ্টা করেছি। শান্তিনিকেতনে 'শ্যামলী' নামক মৃত্তিকা নির্মিত গৃহ নির্মাণে মাটির সঙ্গে মাটি মিশে যাওয়ার প্রয়াস সত্যিই অভাবনীয়। তবে তাঁর মত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষের কাছে এটাই স্বাভাবিক। বায়ো-ডিগ্রেডেবল অর্থাৎ জীববিভাজনযোগ্য পদার্থ, যা সহজে মাটিতে মিশে যেতে পারে, তাই দিয়ে বাড়ি বানালে দূষণমুক্ত পরিবেশ গঠন করা যায়। 'শ্যামলী' তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ তো গেল মাটির বাড়ি - সহজলভ্য কাঁচামাল ব্যবহার করার প্রসঙ্গ ইত্যাদি। শান্তিনিকেতনে তিনি বাগানও তৈরি করেছেন সম্পূর্ণ ইকোলজি মেনে। যেমন, অপরাজিতা, ব্রাহ্মী, তুলসী, রঙ্গন, গুলঞ্চ, কামিনী প্রভৃতির সঙ্গে শালবন ,আমলকিবন, শিরিষ, শিশু, শিমূল, বকুল, আম, জামের মতো বৃক্ষ সারি - পাতাবাহারি এবং প্রতিটি ঋতু অনুযায়ী ফুল ও ফলের গাছ। অর্থাৎ বড়ো, ছোট, লতানে, ওষধি সবরকম উদ্ভিদের সহাবস্থানে তাঁর বিদ্যানিকেতনটি হয়ে উঠেছিল সম্পূর্ণ ভাবে eco-friendly। জলাশয়ের পুনরুজ্জীবন এখন একটি বড়সড় কাজ - তিনি ভুবনডাঙার মজে যাওয়া একটি বৃহৎ জলাশয়ের পুনরুজ্জীবন করেছিলেন। তাঁর একটি কবিতার উদ্ধৃতি আমরা প্রায়ই শুনি এবং বলি বেশ আবেগ দিয়ে, টেনে টেনে। "দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর" - এই পংক্তিটির সরলীকৃত অর্থ ধরলে তো সবাইকে গ্রামে গিয়ে লণ্ঠনের আলোয় বাস করতে হয়, হাত দিয়ে মাটি কোপাতে হয়। রবীন্দ্রনাথ কি এতটাই অবাস্তব কিছু প্রত্যাশা করেন সভ্যতার কাছে? তিনি কি এটাই বলতে চাননি যে, নগর গড়ে উঠুক তার সমস্ত রকম আধুনিকতা নিয়ে, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার হোক, মানুষ এগিয়ে যাক নতুন শতাব্দীর দিকে। কিন্তু, প্রকৃতি ও পরিবেশকে কেটে ছেঁটে ধ্বংস করে নয়। একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী লয়ের মাধ্যমে টিঁকে থাকতে হবে। থাকতে তো হবে সকলকেই একসাথে মিলেমিশে - শুধু মানুষের ঐ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদগ্র বাসনাকে কিছুটা দমিত করে। 'বিসর্জন' নাটকের কথাই ধরুন না কেন, কবেই তো তিনি নাটকীয় কৌশলে বন্যপ্রাণী হত্যা বন্ধ করে দিতে চেয়েছেন রাজার আদেশে। একমাত্র প্রশাসনই পারে দেবতার কাছে বলি দেওয়ার নামে নিরীহ বন্যপ্রাণী হত্যা বন্ধ করতে। সম্প্রতি একটি প্রবন্ধে পড়লাম যে যথেচ্ছ অরণ্য নিধনের ফলে জীবজন্তু বেরিয়ে এসেছে লোকালয়ে এবং তারা মানুষের খাদ্য তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। নির্বিচারে কোন রকম হাইজিন রক্ষা না করে সোজাসুজি একেবারে খাবার প্লেটে। এর ফলে কী হল, তা তো চোখের সামনে। তবুও আমরা অল্প বিস্তর আশাবাদী, তাই রবীন্দ্রনাথের মতোই বিশ্বাস করি একদিন আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কারণ হয়তো আমরা এবারে ঠেকে শিখব। মনে পড়ছে 'বলাই' গল্পের ছোট্ট বলাইএর গাছের সঙ্গে বন্ধুত্বের মায়া জড়ানো আখ্যান। ঐ মনটাই তো হারিয়ে ফেলেছি এই জেট জমানায়। একটি শিমূল গাছ কাটতে না দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল বলাই। এ হয়তো বা গল্প, তবে সত্যি সত্যি কিছু মানুষ গাছকে নিবিড় মমতায় জড়িয়ে ধরে গাছের মৃত্যু আটকানোর চেষ্টা করেছিল। সেই ঘটনার কথা বলব কখনো সুযোগ পেলে। আজকের উপসংহারে থাকুক আমার প্রিয় কবির এই সংবেদনশীল উক্তিটি। কবি বলেন, "এই ধুলো-মাটি-ঘাসের মধ্যে আমি হৃদয় ঢেলে দিয়ে গেলাম, বনস্পতি-ওষধির মধ্যে। যারা মাটির কোলের কাছে আছে, যারা মাটির হাতে মানুষ, যারা মাটিতেই হাঁটতে আরম্ভ করে শেষকালে মাটিতেই বিশ্রাম করে, আমি তাদের সকলের বন্ধু, আমি কবি।"