"হ্যালো, হ্যালো পি 24 কপি? পি 24 কপি? আর ইউ দেয়ার? আর ইউ ওকে? পি24....! পি 24…!” র্যাডারের ওয়্যারলেস থেকে কল আসতে আসতেই যেন কোথাও একটা আওয়াজটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। পি24 জেটের উড়ান নিয়ে তো সন্দীপ্তাই বেরিয়েছিল সঙ্গে ছিল কোপাইলট প্রশান্ত ঠাকুর, কিন্তু কিছুদূর যেতেই...... আকাশ থেকে মুখ থুবড়ে মাটিতে একখানা বিরাট বড়ো গর্তের মধ্যে পড়েছে সন্দীপ্তা, পাশেই তার জেটের ধ্বংসাবশেষ থেকে দাউদাউ করা আগুনের লেলিহান শিখা দিগন্তে ঘন কালো কুন্ডলীর সৃষ্টি করে হাওয়ার সঙ্গে ভেসে চলেছে। জ্ঞান ফিরলেও সারা শরীর তীব্র যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন, কপালে আর গালে কিছু কিছু জায়গায় কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে, ভয়ে পা টা এখনও নাড়িয়ে দেখেনি, কোমর তুলে দাঁড়াতে পারবে কিনা তাও জানে না। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণায় যেন ঠিকমত ভাবতেও পারছে না। এখান থেকে ঠিকমত আকাশ দেখা যাচ্ছে না, যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাকিয়ে মনে হল সম্ভবত গোধূলির সময় এটা, একটু পরেই চারিদিকে মিশকালো অন্ধকার নেমে আসবে। কিন্তু কী করবে কিছুই ভেবে উঠতে পারল না সে, উঠে বসার মতো ক্ষমতাও নেই তার, এটা কোন জায়গা? দিগন্তের আলো মুছে গেল ভয়ঙ্কর গহ্বরের প্রান্ত হতে। সন্দীপ্তা জানে না এরপর কী হতে চলেছে! অনিবার্যভাবেই অন্ধকার নেমে এল গহ্বরের প্রান্তরে, সন্দীপ্তা একইভাবে মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে রইল, নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল। হঠাৎই সেই পরিত্যক্ত উন্মুক্ত বিরাটকায় গর্তে ঝকঝকে নীল আলোর আভা ফুটে উঠলো যেন, নীলার যেমনটা রঙ হয় ঠিক তেমনটাও নয়, পাথরের উপর আলো বিক্ষিপ্ত হলে ঠিক যেমনটা আলোয় ভরে ওঠে কিংবা সমুদ্রের তলদেশে ঘননীল আভার উপস্থিতি মেলে ঠিক তেমনটা ঘননীল আলোয় যেন সেই গর্তের আনাচেকানাচে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। সেদিকে চোখ পড়তেই এক অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল সন্দীপ্তার। আলোটা লক্ষ্য করে উপুড় হয়ে শোওয়া অবস্থাতেই বুকে ভর দিয়ে সরীসৃপের মত নিজেকে টেনে হিঁচড়ে গুহার আরও অভ্যন্তরের দিকে অগ্রসর হল সে। আলোর উৎস খুঁজে পেল আরও একটু গভীরে, নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না, স্বচ্ছ কাঁচের মতো দেখতে গোলাকার একটি বস্তু, যার থেকেই এই তীব্র ঘননীল আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে। আরো সামনে গিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল সন্দীপ্তা, স্ফটিকের মতোই স্বচ্ছ তবে এ পাথর নয়, অন্য কোনো পদার্থ! এই ঘন তীব্র অন্ধকারে, যেখানে নিজেকেই দেখা যাচ্ছে না সেখানে এমন একটি গোলক, যার অভ্যন্তর থেকে দিনের বেলার সূর্য কিরণের মত উজ্জ্বল আলো বেরিয়ে আসছে? আশ্চর্য ও মোহিত হয়ে গোলকটির দিকে তাকিয়ে রইলো সে। মহাকাশচারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুজেটের সঙ্গে কিছুদিনের আলাপ হয়েছিল সন্দীপ্তার, গোলকটাকে সামনে রেখে সুজেট ভালো করে সন্দীপ্তার চোখে চোখ রেখে বলে, "সন্দীপ্তা ব্যানার্জী, অ্যাম আই রাইট? "ইয়েস ম্যাম!” “টেল মি ডিয়ার, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?" গোলকটির দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে চমকে ওঠেন সুজেট, লাস্ট স্যাটারডে ইউ কেম টু মাই হাউস, অ্যান্ড সেদিনেও তো এই নীল গোলকটি তোমার সঙ্গেই ছিল, সেদিনেও তো একইভাবে প্রশ্ন করেছিলে, হ্যাঁ আমার তো স্পষ্ট মনে আছে। সন্দীপ্তা নিজেই হতবাক হয়ে পড়লো, এইখানে সে এল কী করে? সে তো অজানা, অচেনা কোনো গর্তে আহত অবস্থায় পড়েছিল। তবে এইখানে সুজেট ম্যামের অফিসরুমে সে কী করছে? সন্দীপ্তা আচমকা ভয় পেল। গোলকটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো, পেছন ঘুরে হাঁটতে আরম্ভ করলে সুজেট তাকে হঠাৎই পেছন থেকে ডেকে ওঠেন, "সন্দীপ্তা, শোনো!” "ইয়েস ম্যাম!” “তুমি ওইদিক দিয়ে যেও না, তুমি আমার সঙ্গে এসো, বলেই তার হাত ধরে পাশের রুমে নিয়ে আসেন সুজেট। "ম্যাম, আমি এখানে এলাম কী করে? মানে কিছুই তো বুঝতে পারছি না।" নিজের কন্ঠ যতটা সম্ভব চেপে বলে উঠল সন্দীপ্তা। "মাই ডিয়ার চাইল্ড, প্লিজ কিপ কোয়াইট। কেউ দেখে ফেললে অসম্ভব একটা ফলস পজিশনে পড়তে হবে আমাকে। প্লিজ তুমি একটু চুপ করো।" বলতে বলতেই দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বারবার বাইরেটা দেখে নিচ্ছিলেন সুজেট। দরজার বাইরে দুএকজনের জুতোর মচমচ শব্দ তখনও কানে আসছিল তাদের। আওয়াজগুলি একটু হাল্কা হতেই সুজেট বলে ওঠেন, "সন্দীপ্তা, তুমি ঋষিরাজের কাছে যাও!” "কিন্তু ম্যাম, আমি তো জানি না ঋষিরাজ কোথায়, আর আপনি হঠাৎ ঋষিরাজের কথা বলছেন কেন? প্রশান্ত আমার সঙ্গে ছিল।" কথাগুলি বলার সঙ্গে সঙ্গেই সন্দীপ্তা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক তার উল্টোদিকের আয়নার দিকে তার চোখ চলে গেল, সে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেইদিকে। আশ্চর্য তো! সে নিজেকে স্কুলড্রেসে দেখতে পেল, টাই ও স্কার্ট সমেত নিজের ছোটোবেলার স্কুলড্রেস যেমনটা ছিল, চুল ঘাড় পর্যন্ত ছোটো করে কাটা, তাকে একদম আগের মতোই দেখতে লাগছে। সে আবারও ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে দেখলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। “যা বলছি তাই করো সন্দীপ্তা!" সুজেট ধমকের সুরে বললেন। একটু পরে অফিসরুমে উঁকি দিয়ে দেখে সেখানে সুজেট লরেন্সের বড়ো ছবিতে ফুলের মালা ঝুলছে। সন্দীপ্তার মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল, সে ঝপ করে চোখের পাতা ফেলতেই আবার নিজেকে ঐ গর্তের মধ্যেই আবিষ্কার করল। গোলকটার মধ্যে এখনও যেন হাজার হাজার মলিকিউল, ফোটন কণা ও কোয়ান্টাম কণা গিজগিজ করছে, অথচ সেটি স্বচ্ছ কাঁচের মতোই স্পষ্ট, অগণিত কণার নিরন্তর চলাচল যেন প্রত্যক্ষ করতে পারছে সন্দীপ্তা। দম বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। প্রথম থেকেই এখানে একটা অদ্ভুত রকমের শ্বাসকষ্ট লক্ষ্য করছে সে, এর আগে তার কখনোই শ্বাসকষ্ট ছিল ই না। তীব্র শ্বাসকষ্টে কোনোরকমে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল সে। ম্যাডামের কথাগুলো মনে করতে করতে চোখ বুজল সন্দীপ্তা। "কুহু, কুহু, এদিকে এসো, পাপা আর কুহু থ্রিডাইমেনশনাল মুভি দেখতে যাবে, ইয়েএএএ!" কন্ঠস্বরটা শুনে সন্দীপ্তার মনে হলো যেন ঋষিরাজের গলা পেল, চমকে উঠে দেখল সে অত্যন্ত নরম একখানা বিছানায় আড়মোড়াভাবে শুয়ে রয়েছে। ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতেই লক্ষ্য করল তার নিজের একটি বড়ো ছবি দেওয়ালে টাঙানো, পাইলটের পোশাক পরিহিত, স্যালুট করছে সে,আর সেই ছবিতে ফুলের মালা দুলছে। সে ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে বিছানার নিচে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখল ঋষিরাজ সেই ঘরে ঢুকে তার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ একমনে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বলল, "দীপ্তা আজকের দিনেই তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। তবে তোমাকে কখনই আমরা দুঃখ দেব না। এই দেখো কুহু আর আমি গ্র্যান্ড করে আনন্দে দিন কাটাব আজ। তুমিই তো বলতে তোমার কিছু হলে আমরা যেন দুঃখ না করি, তোমাকে হ্যাপি রাখতেই আমি, আমরা আজও আনন্দে থাকি। হঠাৎ করেই ঘরের মেঝেতে দুটি নরম তুলতুলে ছোট্ট ছোট্ট পা, গুটিগুটি করে এগিয়ে আসছে, "পা...পা...আমরা কখন যাব?" সন্দীপ্তা ঘাড় কাত করে আগত ছোট্ট প্রাণটিকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে, কিন্তু দেখা করার কোনো সুযোগ নেই, কেন নেই তা নিজেও জানে না সন্দীপ্তা, এমন কিছু রহস্য রয়েছে যে তাকে অকারণে সবাই মৃত বলে ধরে নিচ্ছে। মনটা বিষিয়ে উঠল সন্দীপ্তার। ঋষিরাজ তার কন্যার মা? কিন্তু ঋষিরাজ তো সন্দীপ্তার স্কুলের বন্ধু ছিল, তেমন কিছু তো ভাবেওনি তার সম্পর্কে, তবে কখন তার বিয়ে হল, কিংবা কখনই বা তাদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হল, সবটাই কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে তার। ঋষিরাজ ও কুহু বেরিয়ে গেলে সন্দীপ্তা বিছানার নিচেই চোখ বন্ধ করে তবে এবার আরও সেই গর্তে দেখতে পেল না। ওখান থেকে বেরিয়ে এসে ওয়াশরুমে গেল, ভেতরে ভালো করে নিজের হাত পা ডলে রক্তগুলি ধুয়ে একটু স্নান করল সে। ঘরের মেঝেতে কাঠের পাটাতন দিয়ে বাঁধানো, জানালার দিকে চোখ যেতেই দেখে বাইরের পরিবেশ যেন তার নিজের দেশের নয়, এটা কানাডার কোনো একটি জায়গা কারণ টেবিলের উপর একটি কোনো কেনা জিনিসের প্যাকেট পড়েছিল, এবং তার উপর এই বাড়ির ঠিকানা লেখা রয়েছে। অর্থাৎ তারা নিজেদের দেশ থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে। তার মানে এখানে তাকে হয়ত তেমন একটা কেউ চেনে না। সে ভালো করে মুখ ঢেকে ও ঋষিরাজের গরম পোশাক পরে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। সারাদিন এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায় সন্দীপ্তা, তাকে কেউই বিশেষ লক্ষ্য করছে না দেখে আরো ভালো লাগছে তার। কিছুটা সময় পেরিয়ে সন্ধে নেমে এলে সে আবার ওই বাড়িতেই ফিরে আসে। কোনো কাজ না পেয়ে সারাদিন ঘর গুছোয়, টিভি দেখে, ভালোমন্দ রান্নাবান্না করে টেবিলে সাজিয়ে রাখে। কুহুর খেলনাবাটি থেকে পাশে ছোট্ট একখানা প্লেন রেখে দেয়। দরজায় লক খোলার শব্দ পেলে আবার আগের মতো বিছানার নিচে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। ঘরে ঢুকেই কুহু এত সুন্দর রান্নার গন্ধ পেয়ে আনন্দে বলে ওঠে, "পাপা, ম্যাজিক!” "কী ম্যাজিক সোনা?" "এই দেখো না পাপা, টেবিলে ভর্তি খাওয়া, কত্ত সব, যেমনটা আমরা দিদানের কাছে খেয়েছি, ওয়াও, ভারী মজা বলো?" ঋষিরাজ অবাক হয়ে যায়, কারণ ঘরে তেমন কিছুই ছিল না যে এত সব রান্না হয়ে যাবে। কে করল এত সব রান্না? তাছাড়া এখানে তো রান্না সে একাই করে, এত গুছিয়ে টেবিলে কে রাখবে? টেবিলের উপরে পড়ে থাকা কুহুর খেলনা প্লেনটা দেখে যেন চমকে ওঠে ঋষিরাজ, শূন্যেরর দিকে মুখ তুলে বলে, "তবে কি তুমি? তুমি এসেছিলে দীপ্তা? এই প্লেনটা এখানে থাকার মানে কী? তুমি কি একবার আমাদের সামনে আসতে পারো না দীপ্তা? কতবার তুমি এইভাবে আসবে আমাদের কাছে?" সন্দীপ্তা বিছানার নিচ থেকে কথাগুলি শুনে হতবাক হয়ে যায়, নির্বুদ্ধিতায় বুঝতে পারে না, তার মানে ও এখানে অনেকবার এসেছে? চোখের পলক ফেলতেই আবারও নিজেকে সেই উন্মুক্ত বিরাট গহ্বরে আবিষ্কার করে সন্দীপ্তা। শরীরটা এখনো টেনে তুলতে পারছে না । চোখের সামনে পড়ে থাকা গোলক থেকে অবিরাম তেজস্ক্রিয় রশ্মির মতোন ঘন নীল আলোয় সম্পূর্ণ গহ্বরটি আলোকজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। কী এই বস্তুটি? এখানে চোখ দিলেই সে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। --"এটা একটা আস্ত এক্সোপ্ল্যানেট বা গ্রহাণু, আমাদের মহাবিশ্বে আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি ব্যতীত অন্যান্য আরো বহু গ্যালাক্সি রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো অ্যান্ড্রোমেডা গ্যালাক্সি। আমাদের গ্যালাক্সির মতোই সেখানে সর্ববৃহৎ নক্ষত্র অর্থাৎ সূর্যের মতন নক্ষত্র রয়েছে। বলা যেতে পারে মহাশূন্যের কোনোস্থান ই পরিপূর্ণভাবে শূন্য নয়, সেখানে রয়েছে লক্ষকোটি সংখ্যক অণু পরমাণু বা কোয়ান্টাম কণা। এই কণা যখন কোনো তীব্র মৌলের সংস্পর্শে আসে তখন আলোক বিকিরণের ফলে নানারকমের কিছু ঘটতে পারে।" এতটা বলে কিছুক্ষণ থামলেন ম্যাডাম সুজেট। সন্দীপ্তা বুঝতেই পারেনি সে আবার কখন ম্যাডাম সুজেটের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। সুজেট আবারও বলে উঠলেন, "তোমার মনে আছে কি তোমার প্লেন ঠিক কোথা থেকে টেক অফ করেছিল এবং কখন?" "ম্যাডাম, আমাদের পোর্টস্ট্রিপ গুলি বেশিরভাগই বন্ধ থাকায় অপেক্ষাকৃত বন্ধ করে দেওয়া এয়ারপোর্ট থেকেই টেক অফের নির্দেশ আসে, আপনি তো জানেনই এখন মেডিকেল ইক্যু্ইপমেন্টের কী চাহিদা, সেইমতো আমরা জিনিসপত্র লোড করে বাঁকুড়ার পিয়ারডোবা থেকে টেক অফ করি।" সুজেট ভ্রূদ্বয় সামান্য সঙ্কুচিত করে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, "সন্দীপ্তা, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের নাম শুনেছো?" -"হ্যাঁ ম্যাম কেন শুনব না, আটলান্টিক মহাসাগরের উপরে অবস্থিত তো এই ট্রায়াঙ্গলটি, অনেক জাহাজ, উড়োজাহাজ, এই অঞ্চলের উপর দিয়ে গেলে অনেক সময় তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, মানে গিয়েছে আর কী, আর পরে তাদের অনেকের ই কোনো হদিশ থাকে না।কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত হয়েছে ঠিকই তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা আর হয়ে ওঠেনি।" "একদম ঠিক বলেছ, আটলান্টিক মহাসাগরের উপর তিনটি বিন্দুকে একত্রিত করে তৈরি এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, একে ডেভিল ট্রায়াঙ্গলও বলা হয়, যে তিনটি বিন্দু নিয়ে এই কাল্পনিক ত্রিভুজটি বানানো হয়েছে তার একটি প্রান্তে রয়েছে আমেরিকার ফ্লোরিডা, একপ্রান্তে পুয়ের্তো রিকো ও আরেক প্রান্তে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ। এই ত্রিভুজের মধ্যবর্তী কোনো অংশে কোনো যানবাহন অতিক্রম করলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আশ্চর্যজনক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় জানো কী, অনুরূপ আরো দুটি ট্রায়াঙ্গল রয়েছে এই বিশ্বে। একটি আমাদের ভারতবর্ষেই রয়েছে, যার নাম ভারতের বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। যার প্রথম বিন্দুটি রয়েছে ওড়িশার আমারদা রোড এয়ারফিল্ডে, দ্বিতীয় বিন্দুটি রয়েছে ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়ায় এবং তৃতীয়বিন্দুটি তোমাদের ঐ বাঁকুড়ার পিয়ারডোবায়। তিনটি বিন্দু একত্রে ত্রিভুজের আকার নিয়েছে। "কিন্তু এই ট্রায়াঙ্গলের সঙ্গে আমার নীলচে গোলকের খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে কী সামঞ্জস্য!" -"সন্দীপ্তা, এই ট্রায়াঙ্গল এখনো ভারতীয় বায়ুসেনার অন্তর্গত হলেও গত ৭৪ বছর ধরে এইখানে বহু বিমান ও উড়োজাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো রহস্যেরই কোনো সুরাহা করা হয়নি। ঝাড়খণ্ডের কাছে আমারদার কাছাকাছি একটি ইউরেনিয়ামের খনি রয়েছে। ইউরেনিয়াম একটি তেজস্ক্রিয় মৌল, বৈজ্ঞানিকদের অনুমান এই তেজস্ক্রিয়তার ফলে এর আশেপাশের যেকোনো বৈদ্যুতিন যন্ত্র এলে তা অবশ্যম্ভাবী হিসেবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। অনুরূপভাবে এর সংস্পর্শে আসলেই বিমানের র্যাডারও তাই কাজ করা বন্ধ করে দেয়। যেমনটা তোমার বিমানের ক্ষেত্রেও ঘটেছে, আমার অনুমান এই ছোট্ট এক্সোপ্ল্যানেটটি এই ইউরেনিয়ামের সংস্পর্শে এসে এমন কোনো বিক্রিয়া ঘটিয়েছে যে এর মধ্যে থাকা নানান মৌলের পরিবর্তন ঘটামাত্র এটি একটি বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন গ্রহাণুতে পরিণত হয়েছে।" সন্দীপ্তা আরো অবাক হয়ে পড়ে, "আমার কি তবে মৃত্যু হয়েছে ম্যাডাম? বলেই চোখটা আবার বন্ধ করে সে। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সে আবারও কানাডার সেই ঘরেই টেবিলের নিচে খুঁজে পায়। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে জানালার কাছে এক বৃদ্ধ বয়স্ক ব্যক্তি জানালার দিকে তাকিয়ে বাইরের বরফ পড়ার দৃশ্য একদৃষ্টে দেখছেন। একটু খেয়াল করতেই সন্দীপ্তা বুঝতে পারে সেই বৃদ্ধ আর কেউ নন, ঋষিরাজ বৈদ্য। চোখের জলে হয়তো তাকেই মনে করছেন তিনি। সন্দীপ্তা কিছুই বুঝতে পারছে না, তার সঙ্গে কী ঘটে চলেছে অবিরত। তবে তার সঙ্গে যা ঘটে চলেছে তা টাইম ট্রাভেল কি? মনে হচ্ছে না। কিন্তু এর উত্তর জানতে গেলে তো তাকে সুজেট ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতেই হবে। এবার জোর করে চোখ বন্ধ করে চিপে রাখলো সন্দীপ্তা। চোখ খুলতেই দেখল সে তার গ্রামের বাড়ির উঠোনে বসে প্রাণপনে পুতুল নিয়ে খেলছে, ছোটোবেলায় প্রায়শই মা মামার বাড়িতে নিয়ে আসতো তাকে, পুরুলিয়ার একটু ভেতরের দিকে তাদের মামার বাড়ি। মা খুব সাজগোজ করছে, মাঝেমধ্যে তাকেও নতুন জামাকাপড় পরিয়ে দিচ্ছে। ছোটোমামা ঘরবার করছে, "তোর এখনো হলো না মণি? ওদিকে সব শুরু হয়ে যাবে যে!" সন্দীপ্তার মা তার কপালে কাজললতার কালি দিয়ে বড়ো করে টিপ দিয়ে বলে, "আয় আয় চাঁদমামা, টি দিয়ে যা। ছোটদা তুই ব্যস্ত হোস না তো, এবারের মহিষাসুরমর্দিনী দেখেই বাড়ি ফিরব, এত আগে থেকে এসেছি কিছুতেই ভুল হবে না দেখিস। আমাদের গ্রামের ছৌনাচ সে তো পৃথিবী বিখ্যাত, তোদের পাইলট জামাইকে কত করে বললাম আসতে, তা সে সময় বের করতে পারলে তবে তো।" দিদা পেছন থেকে এসে তাকে বলে, "ওরে মুখপুড়ি এত্তো সেজেছিস তুই, আমার তো কপাল পোড়াবি মনে হয়।" সন্দীপ্তার তখনও মুখ ফোটেনি, সে অবাক নয়নে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে হাতদুটো শূন্যে তুলে বারকয়েক ঘুরিয়ে মুখে ইয়া ওয়া শব্দ করে। “ওই দেখো ওই দেখো, মা তোমায় আমি বলিনি দেখো আমার মেয়ে না ওই অ্যাস্ট্রোনট না কী যেন ঐ হবে। মহাকাশে পাড়ি দেবে, মোটেও ওর বাবার মতো ঘড়ঘড় করে প্লেন চালাবে না। কত কী বলে দেখো এই বয়সে।" সন্দীপ্তা সবটা বুঝতে না পারলেও তার মধ্যে কথা বলার কোনো অবকাশ নেই। ছৌনাচের মহড়ায় বিরাট বড়ো বড়ো লোক হারমোনিয়াম ও ততোধিক শব্দের বোল তুলে লম্ফঝম্প দেখে এসে ঘুমিয়ে পড়ে, আবারও নিজেকে ইউরেনিয়ামের খনিতে খুঁজে পায় সে। মনে মনে ভাবে এভাবে হবে না, তার এই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন গ্রহাণু সম্পর্কে জানতে হলে যেভাবেই হোক তাকে একবার হলেও সুজেট ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতেই হবে, একমাত্র তিনিই সঠিকভাবে এইসমস্ত ঘটনার ব্যাখ্যা করতে পারবেন। অসহ্য এই দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে কি তার মুক্তি নেই? আবারও চোখের পাতা বন্ধ করলো সন্দীপ্তা, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে সে, শরীরের ক্ষত বোধহয় ইনফেকশন ছড়িয়ে দিয়েছে তার দেহের সর্বত্র। বেশ কিছুক্ষণ সন্দীপ্তা নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ে, তবে ঘুম ভাঙলে আবারও এই তীব্র অন্ধকারের রাত্রি তাকে ভয়ালরূপে গ্রাস করে যেন। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে সন্দীপ্তা, "একটিবারের জন্যে ম্যাডাম সুজেটের সঙ্গে দেখা করিও দাও হে ঈশ্বর! এবার সে পুনরায় ঐদিনই চোখের সম্মুখে দেখতে পায়, হাতে একটি নীলচে গোলক নিয়ে সে ডঃ সুজেট লরেন্সের অফিসে পদার্পণ করছে। ঘটনাক্রমে সবটা সন্দীপ্তা আবারও বলে সুজেটকে। সুজেট এইবার নীলচে গোলকটি সম্মুখে রেখে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “আমার সবটুকু মনে পড়েছে সন্দীপ্তা, তবে তুমি আর বেঁচে নেই এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত।" সন্দীপ্তা যেন চমকে ওঠে, "একী বলছেন আপনি ম্যাম? "সন্দীপ্তা, তুমি ভালো করে লক্ষ্য করেছো কিনা জানিনা এই এক্সোপ্ল্যানেটটি শুধুমাত্র ভবিষ্যতের পরিকল্পনাই দেখায় বা বলা ভালো আফটার ডেথ ভিউস। মৃত্যুর সময়ে সব মানুষ ই চায় তার পরিজনরা ভালো থাকুক, তবে আত্মা তো অবিনশ্বর তবে সে কারোর ভালো চায় কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেছে। আমি 2015 এর অগাস্টে মারা গিয়েছি, যতদূর এই গোলকটি থেকেই জানতে পেরেছি, অর্থাৎ আজকে থেকে ঠিক একসপ্তাহ পরে, আর তুমি তো বলছোই যে সেদিনও তুমি আমার অফিসে এসেছিলে ও আমার ছবিতে মালা দেখেছো। অর্থাৎ তোমার আফটার ডেথের ভিউস গুলিই এই গোলক দেখাতে সক্ষম হয়েছে। তারমানে ধরে নিতে হবে ইউরেনিয়ামের বিক্রিয়ার ফরে এমনকিছু রাসায়নিক যৌগের সৃষ্টি হয়েছে যার দ্বারা এই গোলকটি একটি বিশেষ গোলকে পরিণত হয়েছে, অর্থাৎ এই গোলকটি তোমার মৃত্যুকে তার সময়রেখার আবর্তনে বেঁধে ফেলেছে। তাই তুমি একবার তোমার পাস্ট, একবার ফিউচার ও প্রেসেন্ট জীবনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছো যে এর মধ্যে সমানে অকারণে আবর্তিত হয়ে চলেছো অবিরত। অর্থাৎ তুমি সময়ের মাঝে হারিয়ে গেছো সন্দীপ্তা। এইকথাগুলি আমি ও তোমাকে বলতে পারতাম না যদি আমি মারা না যেতাম, কারণ এর দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার ভিসনগুলোও খুব ক্লোজলি দেখতে পাচ্ছি। "কিন্তু ম্যাডাম, আমি আমার ছোটোবেলার ঘটনাগুলিও ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি।" "সেটা তোমার ভিউস সন্দীপ্তা, তুমি কিংবা তোমার মা কি মামাবাড়িতে স্বেচ্ছায় যেতে পারতেন? "না, বাপি পছন্দ করতেন না, গ্রামের বাড়িতে যাওয়া।" -"তবেই মনে মনে ভাবো, এই গোলক সেইসমস্ত ভিউসই শেয়ার করে যা ঘটে গেছে তা নয়, বরং তুমি তোমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অতীতকে কিভাবে দেখতে চেয়েছো সেই মনোরেখার উপর আলোকপাত করে সেইমতো ভিউস দেখাতে চায় এই আশ্চর্য গোলকটি।" "ম্যাম যদি আমি ঐ ইউরেনিয়ামের খনি থেকে বেঁচে উঠি তবে?" সুজেট টেবিলের উপরে রাখা কম্পিউটারের দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করেন, সার্চ করে কিছুক্ষণ পরে বলতে ওঠেন, "সন্দীপ্তা, ইউরেনিয়ামের খনিটি যেখানে রয়েছে ঝাড়খণ্ডের আমরদায়, তার পাঁচশো একরের মধ্যে কোথাও কোনো জনবসতি নেই, সেখান থেকে বেঁচে ফেরাটাও ততটাই কঠিন। আচ্ছা, ওখানে এখন দিন না রাত আমাকে একটু বলো।" "ম্যাডাম চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজেকেই ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না।" "সন্দীপ্তা, তুমি আমার সবথেকে কাছের এক ছাত্রী ছিলে, মনে রেখো কখনো হেরে যেয়োনা কিন্তু, হতেই পারে এটাও তোমার মৃত্যু পর দেখা কোনো ভিসন, যা তুমি তোমার কাছে থাকা আশ্চর্য গোলকের জন্যেই দেখতে পারছো।" সন্দীপ্তার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে, আস্তে আস্তে তার চোখ ভারী হয়ে উঠলো, এক্সোপ্ল্যানেটটি। একঝটকায় তাকে খনির ভেতর নিয়ে গেল। চোখ খুলতেই আহত চোখে সামনের দিকে তাকাতেই ঝাপসা অন্ধকারে প্রশান্তকে দেখতে পেল সন্দীপ্তা। ওটা কী করছে প্রশান্ত! ফিউলের বাটনটা অলরেডি প্রেস করে রেখেছিল কেন? ওকি, প্রশান্ত প্যারাসুট পরে নেমে যাচ্ছে কেন? "প্রশান্ত! প্রশান্ত!" বলে বারদুয়েক চিৎকার করে ওঠে সন্দীপ্তা। "ইটস টাইম ফর ইওর ডেথ ম্যাম! গুড বাই!" বলেই ঠোঁটের কোণে তির্যক হাসি দিয়ে আকাশ থেকেই মহাশূন্যের দিকে নিজেকে ছুঁড়ে দেয় প্রশান্ত।