(১) চারিদিক ভীষণ শান্ত হয়ে আছে কয়েকদিন ধরে। মন খারাপ করে পাথরের উপর বসে আছে মিস্টার রকুরু। তীব্র দৃষ্টি সমুদ্রের ভিতর যেন কিছুর অপেক্ষা করছে। হঠাৎ ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নামতেই জলের ভেতর নীলচে আভার ছোটাছুটি শুরু হল। রকুরু ঘনঘন শ্বাস পড়ছে। হ্যাঁ, ঐ তো দুজনেই উঠে আসছে। একী? এত স্বাভাবিক ভাবে হাঁটছে ওরা কী করে? ওদের শরীরের নীচের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল রকুরু। “কেমন আছো তোমরা? গত একমাস ধরে কোন খোঁজ নেই কী ব্যাপার?” “এসেছিলাম আপনার চেম্বারে, আপনি তাড়িয়ে দিয়েছেন।” “আমার চেম্বারে? কবে?” “যেদিন আপনি পরিকল্পনা করছিলেন একটা সভ্যতা ধ্বংস করার সেদিন।” “কী সব বাজে বকছো?” “বাজে না স্যার, আপনার উদ্দেশ্য আমরা বুঝে গেছি। আর আপনি আমাদের পাবেন না।” “পাব না মানে? তোমাদের জীবন আমার হাতে সেটা কি ভুলে গেছ?” রকুরু হাজার চেষ্টা করেও আর কথা বলতে পারল না। ওরা চলে গেল। বর্ষাতি গায়ে চাপিয়ে ছপছপ করতে করতে রকুরু পৌঁছে গেল ল্যাবরেটরিতে। বড়ো একটা যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে হিংস্র হাতে একের পর এক সুইচ বন্ধ করতে লাগল। দপদপ করতে লাগল সামনে থাকা মনিটর। সমুদ্রের জল দীর্ঘ সময় ধরে আলোড়িত হল। তারপর সব শান্ত। সমুদ্রের ভেতর নীলচে আলোর রেখাগুলো কিছুক্ষণ ছুটোছুটি করে এক সময় শান্ত হয়ে গেল। জলের নীচে আর আলো দেখা গেল না। রকুরু বাঁকা হেসে গা এলিয়ে দিল চেয়ারে। নিশ্চিন্তে একপেগ ওয়াইন গ্লাসে ঢেলে স্ত্রী তাসিমাকে ফোন করল। তাসিমা আর ওদের মেয়ে নিমোসাকি জাপানের শ্রীরাহামা বিচের খুব কাছেই থাকে। কুমাগুসু মিউজিয়ামে কর্মরতা তাসিমা ভীষণ শান্ত। স্বামীর গোপন কাজের প্রতি তার কোন আকর্ষণ নেই। মেয়ের সঙ্গে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দেয় পড়াশোনা আর গান নিয়ে। রকুরুর ফোনটা পেয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল, “বলো।” “কী খবর সব ঠিকঠাক!” “হ্যাঁ আমরা ঠিক আছি। তবে তোমার গলায় আজ উদ্বেগ নেই দেখে ভালো লাগছে।” “একদম ঠিক বলেছো। আসলে শত্রুর ডানা ছাঁটতে পারলে আমার ভারী আরাম হয়।” “কে কার শত্রু?” “মানে?” কথা আর বাড়ে না। রকুরু ফোন রেখে দিলে তাসিমা কানের পাশে লাগানো চিপটিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক বার চাপ দিতেই মেয়ের ইতিহাস শিক্ষকের গলা পেল। মন দিয়ে পড়াশোনা চলছে। এটা রকুরুর উদ্ভাবন। ছোট্ট ট্রানজিস্টার মেয়ের হাতে, চাইলেই ওর আশেপাশে কি হচ্ছে শোনা যায়। নিশ্চিন্তে কাজে মন দেয় তাসিমা। সারারাত বৃষ্টির পর একটা মেঘলা ভোর। শ্রীরামাহা বিচের গোল ডিমের মতো অংশের ডান দিক ঘেঁষে নির্জন এলাকায় তাসিমাদের বাংলো। এদিকটায় পর্যটকরা বিশেষ আসে না। তীর বরাবর পায়ের পাতা চেপে চেপে হাঁটছিল নিমোসাকি। ভীষণ আরাম পায় এমন স্পর্শে। হঠাৎ ওর চোখ গেল জংলা ঝোপের গা ঘেঁষে একটা মেয়ে শুয়ে আছে। একী! শরীরে কোনো কাপড় নেই! দ্রুত ছুটে গিয়ে গায়ের জ্যাকেটটা চাপা দেয় নিমো। তারপর সেলফোনে শূন্য ডায়াল করে লোকেশান অন করে রাখে। মুহূর্তে মিনি এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে ডঃ কোসা চলে আসেন। পরখ করে বোঝে প্রাণ আছে মেয়েটির। অতি দ্রুত মেয়েটিকে নিয়ে ফেরে দুজনে। এ্যালার্ম বেজেছিল বলে তাসিমাও চিন্তিত, যদিও ট্রানজিস্টারে শুনে নিমোর কোনো বিপদ হয়নি বুঝে কিছুটা আশ্বস্ত ছিল। মেয়েটিকে নিয়ে আসার পর প্রাথমিক চিকিৎসা করতে গিয়ে হতবাক হয়ে গেলেন কোসা। “এ হতেই পারেনা!অসম্ভব!” তাসিমা কৌতূহলী, “কী হয়েছে?” “এদিকে আসুন ম্যাডাম দেখুন। দুই কানের নিচেই মাছের মতো গিলস্। আর মনে হচ্ছে দুটো হৃৎপিণ্ড!” “আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি ডঃ কোসা?” “একশো শতাংশ ম্যাডাম!” “বেশ তবে এই কথা আমরা তিনজন ছাড়া কেউ যেন না জানে!” লড়াইটা সহজেই জিতে গেলেন ডঃ কোসা। মেয়েটি অতি দ্রুত সেরে উঠল। যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি ওকে জাগিয়ে তুলছে ভেতর থেকে। তাসিমার স্নেহের ছোঁয়ায় আর নিমোর বন্ধুত্বে ও বেশ তরতাজা হয়ে উঠছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সমুদ্রে নেমে যায় আর ফিরে আসে মিনিট দশেক পরেই। নিমো দেখেছে সমুদ্র থেকে ফিরলেই ওর মন অন্ধকার হয়ে থাকে। নিমো ওকে ডাকে বিয়স বলে। মেয়েটা রিনরিন করে কথা বলে। জাপানিজ বলে ঠিকই, তবে বোঝা যায় এটা ওর ভাষা নয়। শেখানো হয়েছে ভাষাটা। “বিয়স মানে জীবন! আমার তো জীবনটাই নেই নিমো। তুমি কেন এমন নামে ডাকো আমায়?” “তোমার তো দুটো জীবন বিয়স। জল, স্থল সব তোমার। তাহলে কেন এত উদাস থাকো? আমাকে বলবে না?” চুপ করে যায় মেয়েটি। সমুদ্রের গভীর ছায়া ভেসে ওঠে ওর দু’চোখে। নিমো ওর হাতে হাত রেখে গান শুরু করে। এখনো ভীষণ ঠান্ডা ওর হাত। যদিও মেয়েটি কিছু বলেনা। ডঃ কোসা জানিয়েছেন দীর্ঘ সময় জলে থাকার সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে ওর, রক্তে একটা কোনো কেমিক্যাল মিশে আছে যেটা ওর শরীরের কোষগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে। অনার মতে কোনো এক এক্সপেরিমেন্টের শিকার বিয়স। এর কোনো চিকিৎসা উনি খুঁজে পাননি। ওর মন ভাল করতে নিমো গান গায়। গানের শেষে বিয়স খানিকক্ষণ কাঁদে। “নিমো, পৃথিবীতে তোমার মতো বন্ধু মানুষ আজও আছে ভাবলে বাঁচতে ইচ্ছে করে!” তাসিমা কাজের ফাঁকে ক্রমাগত অনুসন্ধান চালিয়ে যায়। শেষে একটা আর্টিকেলে ওর চোখ আটকায়। জিন নিয়ে যে সব আশঙ্কাজনক পরীক্ষা পৃথিবীর নানা প্রান্তে হচ্ছে, তার মধ্যে মানুষের সঙ্গে মাছের মিল ঘটানোর চেষ্টা সফল হয়েছে বলে কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক দাবি করেছেন। এমনকি ভারতের একজন সাংবাদিক জানিয়েছেন, 'বহু যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ আসামী কোনো না কোনো ইস্যুতে এখন জেলে নেই। তারা কোথায় আছে? জীবিত না মৃত এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে এবং এই বিষয়টি আমি এই জন্য উচ্চারণ করছি যে, বছর দুয়েক ধরে আমি সমুদ্রের অভ্যন্তরে খুব কম সময়ের জন্য হলেও আশ্চর্য জীব দেখেছি। তার ভিডিও ফুটেজ আমি একটি আলোচনা সভায় দেখিয়েও ছিলাম কিন্তু সেটাকে জলপরী, মৎস্য কন্যা, দানব ইত্যাদি ভুলভাল বলে ভাইরাল করা হয়েছে। আমার ধারণা এটা একটা এক্সপেরিমেন্টের অংশ। এই দুটি বিষয়ের মধ্যে যোগ আছে বলেই আমার বিশ্বাস!” তাসিমা সেই সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতেই জানতে পারে এক অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি সম্পূর্ণ জড় পদার্থে পরিণত হয়েছেন। তাসিমার মনের কোণে একটা মেঘ উঁকি দিতে থাকে। (২) ড.কোসা বারবার অনুরোধ জানান মি.রকুরুকে সব বিষয় জানাতে, কিন্তু এক অজানা আশঙ্কায় কিছুতেই রাজি হতে পারে না তাসিমা। ওর বুকের ঘা আজও বড্ড টাটকা। মনে হয় এই তো সেদিন। তুইতুই একটা ছোট্ট স্প্যানিয়েল, তাসিমার নয়নের মণি, বুকের ধন। কতবার অনুরোধ করেছিল, “প্লিজ, তুমি অন্য কোনো কুকুর আনো এক্সপেরিমেন্টের জন্য। আমার তুইতুই কেন?” একদম শান্ত হয়ে বলেছিল রকুরু, 'যা একান্ত আমার তার উপর পরীক্ষা করাই চরম সাবধানতা!” অপারেশানের পর তুইতুই করুণ চোখে তাকিয়েছিল। ওর শরীরে কোন প্রাণীর জিন প্রতিস্হাপন করা হয়েছিল তাসিমা জানত না, শুধু দেখেছিল জ্ঞান ফেরার পর তুইতুইএর চোখের দৃষ্টি বদলে গিয়েছিল। ভয়ংকর এক বাঘ যেন। এক ছেলের টুঁটি চেপে ধরেছিল। ওর চেহারা বেড়ে গিয়েছিল আড়াইগুণ। তাসিমার চোখের সামনেই তুইতুইকে গুলি করে মেরেছিল রকুরু। সেই প্রথম নিজের প্রেমের প্রতি ঘৃণা নিয়ে তাকিয়েছিল তাসিমা। তারপর একটু একটু করে সরে এসেছে। এমনকী নিমোর হৃৎপিণ্ডের সমস্যা দেখা দিলেও রকুরুকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। মেয়েটা নিমোর সঙ্গে বসে গান শুনছে। গান খুব ভালোবাসে মেয়েটা। ওটাই যেন ওর থেরাপি। শুধু ওর জীবনের ইতিহাস বড়ো করুণ। ওর আসল নাম কনিশা। যার মানে সুন্দর চোখ যে মেয়ের। ওর বাড়ি দক্ষিণ ভারতের এক গ্রামে। ফাঁসির আসামি কণিশা করুণ হেসে বলেছিল, “আমি অনুতপ্ত নই ম্যাম। যা করেছিলাম বেশ করেছিলাম। আমার নারী শরীরটাকে পণ্য বানিয়ে ব্যবসায় উন্নতি করতে চেয়েছিল আমার ভালোবেসে বিয়ে করা মানুষটা। প্রথমে হতবাক হয়ে ছিলাম। বিশ্বাস করতেই পারিনি ও কী বলছে। তারপর যখন বুঝলাম ওকে ছেড়ে সোজা বাপের বাড়ি এসে উঠলাম। মিথ্যে দোষ দিয়ে গ্রামের লোক লেলিয়ে আমার মা বাবার ঘর পুড়িয়ে আমার মাথা ন্যাড়া করে সারা গ্রামে পোশাক ছাড়া ঘুরিয়েছিল!” আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিল নিমো। তাসিমা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছে। “আমিও প্রতিশোধ নিয়ে নিলাম সুযোগ পেতেই। ওই লোকটাকে খুন করে আমি একটুও কাঁদিনি ম্যাম! ও তো সমাজের আবর্জনা। তবে এখন দেখছি ওর চেয়ে অনেক বেশি সাংঘাতিক মানুষ এই পৃথিবীতে আছে। আরো ভয়ংকর! কথা বলতে বলতে কনিশার চোখ ভিজে ওঠে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ। খানিকটা শোক হজম করতে চায় অথবা বুঝে নিতে চায় দগদগে ব্যথায় কতটা আগুন আছে জমানো। “সেই মানুষটা যখন এসেছিল জেলে আশার কথা শুনিয়েছিল। বলেছিল এই পৃথিবী আমার মৃত্যু চায় কিন্তু চাইলে তিনি আমায় জীবন দিতে পারেন। বদলে ওনার জন্য কিছু কাজ করতে হবে। যে কাজ আসলে ভালো কাজ।” “কী কাজ?” “প্রথমে জানতাম না। প্রথম প্রথম উনি কথা বলতেন, ছবি দেখাতেন। তারপর কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করালেন। তারাও সব হয় ফাঁসীর সাজা পেয়েছে নয় যাবজ্জীবন। সুদেবনের সঙ্গে আলাপ হল। ভারী ভালো ছেলে। কী করে যে ভুল পথে এল জানি না। এরপর একদিন রাতের অন্ধকারে আমরা ভ্যানিশ হয়ে গেলাম।” “মানে?” “সেদিন রাতের খাবারের পর আর ঘুম ভাঙেনি। যখন ঘুম ভাঙল সারা শরীর জুড়ে যন্ত্রণা। ভীষণ কষ্ট। খানিকপর আর নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। হঠাৎ মনে হল কোথাও ডুবে যাচ্ছি আর ডুবতেই ভারী আরাম বোধ হল।” “তারপর?” চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে থাকা নিমোসাকির হাতটা বুকে নিয়ে কনিশা বলল, “আর জীবন থাকল না নিমো। সব বদলে গেল। ঐ একটি নির্দিষ্ট তটের কিনার ঘেঁষে আমরা থাকতাম। যদিও বহুদূর অবধি যাতায়াত করতে পারতাম তবে কিনারে পাথরের খাঁজে খাঁজে আমাদের কিছু ওষুধ থাকত যেটা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়। ওটা নিতে হত রোজ। না নিলে শরীরে ভীষণ অস্বস্তি হত। পরে বুঝেছিলাম...” “ওটা ড্রাগ! আসলে তোমাদের নেশায় রাখত!” “একদম তাই। তাছাড়া আমাদের শরীরে ট্রান্সমিটার ছিল। সে নানা বিচিত্র কাণ্ড কারখানা। আমাদের গতি নজরে রাখতে আমাদের ট্রান্সমিটার থেকে নীল আলো বার করার ব্যবস্থা করেছিল লোকটা!” “তোমাদের কাজটা কী ছিল কনিশা!” “একটা অজানা দ্বীপ আমাদের লক্ষ্য ছিল ম্যাম। ঐ দ্বীপ ঘন কুয়াশার চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। ওখানে রয়েছে দুষ্প্রাপ্য রোডিয়াম। মানুষের পক্ষে সেখানে যাওয়া অসম্ভব। তাই আমরা মানে এই মাছ মানুষরা সেখানে যেতাম। এনেও দিচ্ছিলাম প্রয়োজনমতো। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে মাটির গান শোনার জন্য বুকটা হুহু করে উঠত।” “কেন তোমরা ঘরে ফিরতে না?” “নাহ্, আমরা জল ছাড়া থাকতে পারতাম না। কিন্তু ঐ আশ্চর্য দ্বীপ আমাদের বদলে দিচ্ছিল। আমাদের বলা হয়েছিল ওখানে কেউ থাকে না। অথচ ওখানে মানুষ বাস করে। যারা নিজেদের মতো নিজেদের জগৎ নিয়ে খুশি। জানো নিমো, ওখানকার সব মানুষ আকারে আয়তনে একটা দশ বছরের বাচ্চার সমান অথচ বুদ্ধি, জ্ঞান, ধৈর্য ভালোবাসায় আমাদের হিমালয়ের সমান!” চতুর্দিক অন্ধকারে ঢেকে আসছে। তাসিমা উঠে তিনকাপ কফি নিয়ে আসে। সন্ধ্যা হতেই অটোমেটিক আলোগুলো জ্বলে ওঠে ধীরে ধীরে। কনিশার মুখে ভালোবাসার আলো। “ওরা আমাদের যেদিন সমুদ্রের জলে প্রথম দেখল, সেদিন থেকেই ভালোবাসল। কী বুঝেছিল জানি না। তবে আমাদের দিকে মায়ায় ভরা চোখ নিয়ে তাকাত। ভালোবাসার কোনো ভাষা লাগে না, আমাদের মন যেন ওরা পড়তে পারত। আমাকে আর সুদেবনকে রোজ একটা পানীয় দিত জানেন ম্যাম। ওষুধ ওষুধ গন্ধ ছিল তাতে। আমরাই যেহেতু একটু সাহসী বা নিয়ম ভাঙতে আগ্রহী ছিলাম তাই ওদের সঙ্গে যোগাযোগ আমাদেরই বেশি ছিল। মাস দুয়েক আগে ওরা আমাকে আর সুদেবনকে রোডিয়াম সংগ্রহ করে দ্রুত সমুদ্রে ফেরার সময় ঘিরে ধরল। বুঝলাম হয়তো শাস্তি পাব। হয়তো মৃত্যু কিন্তু আমরা অবাক হলাম। ওরা আমাদের মারল না বরং আমরা বাতাসে শ্বাস নিতে পারছিলাম। আমাদের পায়ের পাতা, হাতের পাতা মানুষের মতো হয়ে উঠছিল। ওদের ওষুধ আমাদের অ্যাম্ফিবিয়ান বানিয়ে দিল। শুধু এই কানকোটা ঢাকতে পারছিলাম না!” “এতো খুব ভালো ব্যাপার তাহলে কী এমন হল যে...” “আমাদের সঙ্গে দ্বীপের মানুষদের সখ্যতার কথা লোকটা জেনে গিয়েছিল আগেই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানতে চাইত। ছবি তুলেও এনে দিতে বলেছিল। বলেছিল এই মানুষেরা পৃথিবীর অনেক উপকার করতে পারবেন, এদের পৃথিবীতে ফেরানোর কাজটা আমাদের করতে হবে। আমরা যে অ্যাম্ফিবিয়ান এটা কিন্তু উনি জানতেন না। একদিন আমি আর সুদেবন ঠিক করলাম ওনাকে চমকে দেব। ওনার থেকেও বড়ো বিজ্ঞানী আছে এই পৃথিবীতে সেটা জানা দরকার। ওনার অফিস কোথায় সেটা জানতে সুদেবন লুকিয়ে ওনার পিছু নিয়েছিল এক ঝড় বৃষ্টির রাতে। যদিও সেটা ওর ল্যাবরেটরি। ওখানে সিকিউরিটি খুব। পরে ওর অফিসটার খোঁজ আমরা পেয়েছিলাম। ওনার অফিসে পৌঁছলাম শেষ বিকেলে। সকলে তখন বেরিয়ে যাচ্ছে। সুযোগ বুঝে কেবিনে ঢুকতেই শুনি উনি বলছেন, 'ওদের ট্রান্সমিটার তেমন ভাবেই তৈরী স্যার। ঐ দ্বীপে আগামী সাতদিনের মধ্যেই আমাদের এজেন্টরা পৌঁছবে। বিস্ফোরণের তীব্রতা কেবল মানুষগুলোকে ধ্বংস করবে। পরে এজেন্টদের সাহায্যে সব রোডিয়াম আমরা নিয়ে আসব। না স্যার সব এজেন্টকে আত্মঘাতী স্কোয়ার্ডে রাখা যাবেনা। তিনজন যথেষ্ট। বাকিদের দিয়ে সমুদ্রের সব সম্পদ দখল করতে হবে তো ধীরে ধীরে। এরা সব মৃত মানুষ স্যার এদের মৃত্যুর কী দাম!’ বিশ্বাস করুন ম্যাম আমরা মানুষ আমরা মেশিন নই। লোকটা আচমকা পেছন ফিরে আমাদের দেখে চিৎকার করে গার্ড ডেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। আমরাও ঝাঁপিয়ে পড়লাম জলে। আমরা মানুষ, প্রমাণ করার সুযোগ এসেছিল।” যেন এক রুদ্ধশ্বাস থ্রিলার দেখছে তাসিমা আর নিমোসাকি। কনিশার চোখ ভিজে উঠল, ঠোঁট কামড়ে ধরে খানিকক্ষণ কান্নাটাকে আটকাল। তারপর মুখ নামিয়ে নিল। “সব মাছ মানুষ আমাদের কথা না শুনলেও বেশির ভাগেরাই আমাদের পরিবর্তন দেখে নতুন জীবনের আশায় দ্বীপে চলে আসার প্রস্তুতি নিল। ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছিল সবাই। যারা আসেনি তাদেরো সবাইকে বললাম কোনমতেই যেন বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে যোগাযোগ না করে। তাহলে মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যুভয় সবারই আছে। দীর্ঘ একমাস আমরা সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম কিন্তু লোকটা সাংঘাতিক। আমাদের মতো কয়েকজন নতুন মাছ মানুষ দ্বীপটার চারিদিকে ঘোরাঘুরি করতে লাগল তারা ভয়ংকর হিংস্র। রোডিয়াম নিয়ে যাওয়াই তাদের উদ্দেশ্য যে নয় বুঝতে পারছিলাম। বাধ্য হয়ে আমি আর সুদেবন দেখা করতে গেলাম। আমাদের সব সঙ্গীরাই সেদিন আমাদের সঙ্গে ছিল কিন্তু বিশ্বাস করুন ম্যাম আমরা জানতাম না আমাদের ট্রান্সমিটার আসলে আমাদের জীবন থামিয়ে দিতে পারে। ওনার সঙ্গে আমরা নেই একথা জানিয়ে আমরা যখন দ্বীপে ফিরছি ঠিক তখন হঠাৎ আমাদের শরীরে তীব্র কাঁপন শুরু হল। আমাদের গিলস্ কাজ করা বন্ধ করে দিল।আর শরীরে কী যেন শুরু হল। যেন ভেঙে যাচ্ছি আমরা। কেবল আমি আর সুদেবন জলের উপরে উঠে শ্বাস নিতে লাগলাম। বাকিরা তখনো পুরোপুরি শ্বাস নিতে শেখেনি। চোখের সামনে ছটফট করতে দেখলাম সঙ্গীদের। আর তখনি ঝড়ের দাপটে আমার হাত থেকে একটা বন্ধু হাত হারিয়ে গেল ম্যাম। সুদেবন হারিয়ে গেল। আমি জ্ঞান হারালাম।” কথা শেষ করে খুব কেঁদেছিল কনিশা। বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল তাসিমা। মেয়েটা রোজ সমুদ্রে সুদেবনকে খুঁজতে যায় কিন্তু ওর গিলস্ কাজ করে না তেমন তাই বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। খুঁজেও পায় না সুদেবনকে। তাসিমা জানে এ কাজের যে কাজি সে হয়তো প্রতিনিয়ত বানিয়ে চলেছে মাছ মানুষ। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই নিমোর গানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তাসিমা। ওরা দুজনা তাকায়। “আচ্ছা কনিশা হেলিকপ্টার থেকে ঐ দ্বীপে নামা যায় না?” “না ম্যাম, ঘন কুয়াশা সমুদ্রের এই অঞ্চলে। আকাশ থেকে কিছু বোঝাই যায় না। আর এই দ্বীপে শক্তিশালী চুম্বক থাকার কারণে এর আশপাশ দিয়ে জাহাজ, প্লেন কিছুই যেতে পারে না। আছড়ে ভেঙে পড়ে।” তাসিমা অবাক হয় এত বিচিত্র এই পৃথিবী! কিন্তু মেয়েটাকে কী করে বাঁচানো যায়? ডাক্তার বলছে ওর কোষ ভাঙছে। আচ্ছা যদি ট্রান্সমিটারটা চালু করা যায়!” রকুরুর আজ আনন্দের দিন। বৌ মেয়ে একসঙ্গে তার কাছে এসেছে। এ এক বিশাল সারপ্রাইজ। সারাটা দিন ওদের সঙ্গে আনন্দে কাটিয়ে দিল। সন্ধ্যেয় মেয়ে ওদের একা রেখে নিজেই বেরোল শহর দেখতে। ঘন হয়ে কাছে বসল তাসিমা। রকুরু উত্তেজিত। তাসিমা বুকের কাছে এসে বলল, “আজ তোমার ল্যাবরেটরি দেখব। তোমার সব অভিমান মুছে দেব।” হাজার আনন্দ উন্মাদনার শেষে দুজনে মিলে ল্যাবরেটরিতে এল। সব ঘুরে ঘুরে দেখল। বিচিত্র গন্ধ,বিচিত্র কাজ। নজর পড়ল নীচের দিকে সিঁড়ি নেমে গেছে। “নীচে কী? দেখাবে না? গোপনীয়?” “তোমার কাছে কিছুই গোপনীয় নেই। ওটা একটা অসফল প্রোজেক্ট।” “তবু চলো। যেখানে যেখানে তোমার স্পর্শ আছে সব দেখতে চাই আমি!” অভিভূত রকুরু নীচে নিয়ে যায় স্ত্রীকে। গোপন সংকেত খুলে ভেতরে ঢোকে। সব বুঝিয়ে বলে। “আসলে এই এক্সপেরিমেন্ট ভীষণ সফল হয়েছিল জানো কিন্তু ঐ যে শত্রু। সে তো সব খানেই আছে। এই যে সুইচ সব বন্ধ করে দিতেই খেল খতম!” “আর সুইচ এখন অন করলেই শত্রু জেগে উঠবে?” “নাহ্, সব ঘুমিয়ে গেছে চিরতরে। পুরোপুরি নিশ্চিত করতে আর দশটা দিন অপেক্ষা করব। তারপর আবার চালু করব। নতুন অস্ত্র রেডি করে ফেলেছে তোমার রকুরু!” ব্যাগ থেকে ডার্ক চকোলেট বার করে রকুরুকে দিয়ে অভিনন্দন জানায় তাসিমা। ভীষণ ভালোবাসে রকুরু ডার্ক চকোলেট। কামড় দেয় দু তিনবার। চোখে চোখ তাসিমার সঙ্গে। ঝাপসা হয়ে যায় সব, দুলে ওঠে ল্যাবরেটরি। পাগলের মতো সব সুইচ অন করে দেয় তাসিমা। রকুরু অস্ফূট আওয়াজ করে পড়ে যেতেই তাসিমা দ্রুত ল্যাবরেটরি ছেড়ে বেরিয়ে আসে। নিমোকে ফোন করে। “কোথায় তোরা? “এই তো সমুদ্র পাড়েই আছি। কনিশার শরীর ভালো আছে মা। ওর গিলসে কিছু পরিবর্তন হচ্ছে।” “ওকে বল এটাই সময়। বারো ঘন্টা আছে ওর হাতে। এর মধ্যে ওকে দ্বীপে পৌঁছাতেই হবে। আর বলিস আমি ভালোবাসি ওকে।” ঝাঁপিয়ে পড়ে কনিশা সমুদ্রে। নিমো দেখে নীল আলোর রেখা অতি দ্রুত সমুদ্রের জলের ভেতর দিয়ে দূরে, আরো দূরে সরে যাচ্ছে। এবার নিমো আর তাসিমাকেও সরে যেতে হবে দ্রুত! বারো ঘন্টা পর শয়তানের ঘুম ভাঙলে সবার আগে তাদের বিপদ হবে। গন্তব্য স্হির করা আছে।ভারতবর্ষের অরুণাচল। ওখানকার মনেস্ট্রিতে বিশেষ গবেষণামূলক কাজের জন্য ফর্ম ফিলাপ করেছিল তাসিমা। আহ্বান এসেছে সেখান থেকেই। এদিকে কনিশার দূরত্ব দ্রুত কমতে থাকে ভালোবাসার দ্বীপের থেকে!