সবুজ চোখ

দাশনগর, হাওড়া

সকালবেলা জিনির মনটা খারাপই থাকে। মায়ের হাজারটা বায়নাক্কা মেটাতে হয়। তার ওপর গগন স্যারের বাড়ি গেলেও দেখা পাওয়া যায় না এই সময়টায়। স্যার এই সময়টা নিয়ম করে হাঁটাহাঁটি করেন নাকি বাড়ির বাগানে। বৈজ্ঞানিক গগনেন্দ্র তরফদারের কথা জিনি প্রথম শুনেছিল মায়ের কাছে। মায়ের কলেজের বিজ্ঞান সম্মেলনে এসেছিলেন নাকি স্যার। তখনই মা জানতে পারে গগনস্যারের বাড়ি জিনিদের বাড়ির একেবারেই কাছে। তার কয়েকদিন পর থেকে শুরু। গগন স্যারের বাড়িতে রোজ যায় জিনি। বিজ্ঞান জিনিকে টানে। অষ্টাদশী জিনি জানে বিজ্ঞান ছাড়া ওদের গতি নেই।

তবে গগনেন্দ্র তরফদারের সঙ্গে জিনির আলাপ নেহাতই কাকতালীয়ভাবে। সকালবেলা জিনি মায়ের কোলে লেপ্টে থাকে সাধারণত। মায়ের কাজে সাহায্য করে। সারাদিনের মতো মায়ের গন্ধ সঞ্চয় করে নেয়। তারপর মা বেরিয়ে যায়। কলেজ খুলে গেছে এখন। মা যাওয়ার আগে জিনিকে আদর করে। জিনিও খেয়াল রাখে মায়ের। মা রোজ বলে রায় একই কথা।
“সময়মত নিজের কাজ করে নেবে জিনি!”
জিনি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। জিনির বিরক্ত লাগে না। জিনি জানে ওটাই মায়ের স্নেহ। 
সেদিন সকালে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি জিনিকে অবসন্ন করে। যদিও কয়েকদিন আগে থেকেই জিনির মনে হচ্ছিল বৃষ্টি আসবে। মাকে বলেছিল ও। মায়ের চোখে-মুখে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল দেখেছিল জিনি। আকাশের ঝলমলে রোদ, অথচ জিনির মুখে বৃষ্টির কথা। মা বিশ্বাস করেনি। মানুষ কী এমনই হয়! কিছুতেই সবটুকু উজাড় করে বিশ্বাস করতে চায় না। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে একটা অদ্ভুত বিষয় সেদিন নজরে এসেছিল জিনির। গগনেন্দ্রনাথ তরফদারের বাড়ির ছাদে একটা লোক পায়চারি করছে। এই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিতে অদ্ভুতভাবে একটুও ভিজছে না লোকটা। জিনি আশ্চর্য হয়। তার কদিন পরেই জিনির প্রথমবার সরাসরি দেখা হয় গগনেন্দ্র তরফদারের সঙ্গে। জিনি লাইব্রেরী এসেছিল। মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের বই নিতে। একটা বই জিনিকে বড় টানছিল। লেখক সিগমুন্ড ফ্রয়েড। ''দ্য ইন্তেরপ্রিটেশন অফ ড্রিমস''। বইটায় জিনির হাতের সঙ্গে আরেকটা হাত পড়ল। জিনি খানিকক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়েছিল। কোন একটা বিষয় যেন চুম্বকের মত টানছিল ওকে। তবে ঠাওর করতে পারছিল না ঠিক করে।

''তুমি কে? তোমার নাম কী? এইভাবে কী দেখছো?''

জিনির চমক ভাঙে। সাদা চুল, সোনালি চশমা, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। 

''আমার নাম জিন্সি।''
“বাহ! সুন্দর নাম। একা এসেছো লাইব্রেরিতে? মানুষের মন নিয়ে বড় কৌতূহল না তোমার?”
জিনি আবার অবাক হয়। গগনস্যার কি তবে মন পড়তে পারে! 
জিনি উত্তর দেবার আগেই গম্ভীর কণ্ঠস্বর বলে, ''তুমি ঠিকই ভাবছো, আমিই গগনেন্দ্র তরফদার। সেদিন ছাদে আমিই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, আর ঠিক ধরেছো, বিশেষসুরক্ষা ব্যবস্থা আমায় ভিজতে দেয়নি।''
''ইয়ে মানে...'', জিনি তোতলায়। ও কিছু বলার আগেই আবার গম্ভীর অথচ মোলায়েম কণ্ঠস্বর কথা বলে ওঠে।
''আমি আজ একটু তাড়ায় আছি। বইটা বরং তুমি নাও। একদিন বাড়ি এসো। কথা হবে।''

গগনেন্দ্র তরফদার পা বাড়ান উল্টোপথে। জিনি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। মায়ের কাছে অনেক শুনেছে এই বিজ্ঞানীর কথা। জিনির ভেতরে একটা সম্ভ্রমভাব ছিল। মায়ের কাছ থেকে শোনা মানুষের কল্যাণসাধনকারী এক বিজ্ঞানীর সঙ্গে সদ্য দেখা হওয়া গগনেন্দ্র তরফদারকে কি জিনির মেলাতে অসুবিধা হচ্ছে? জিনির অবচেতনে যে ছবি আঁকা হয়ে ছিল, আসল মানুষটার সঙ্গে কি ঠিক মিলছে না সেই ছবি? জিনি উত্তর খুঁজে পায় না। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসে। মনের কোথাও যেন হালকা রোদের ছোঁয়া দেওয়ার চেষ্টা করে জিনি। আচ্ছা, ওর বুঝতে ভুল হতেও পারে! মাকে কি সব কথা বলবে! মায়ের কাছ থেকে এই বিজ্ঞানীর কথা শুনেই আগ্রহ বেড়েছিল জিনির। তবে একটা জিনিস ও মনে মনে স্থির করে নেয়। গগনেন্দ্র তরফদারের বাড়ি ওকে যেতেই হবে। কিন্তু মা! লাইব্রেরি, আর স্কুল ছাড়া যে মা ওকে কোথাও যেতে দেয় না! অন্য কোথাও বেরোনোর কথা বললেই ব্যাজার মুখে তাকায়। তবে একটা টোটকাও ভেবে ফেলেছে জিনি। মায়ের কলেজের অনলাইন মিটিং-এর সফটওয়্যারটা কাজ করছে না ঠিকমত। এইসব ব্যাপারে মা একমাত্র জিনিকে ভরসা করে। মায়ের বিশ্বাস জিনি হাত দিলেই ম্যাজিক হয়। জিনিরও বিশ্বাস ও সারিয়ে দিতে পারবে। মা যখন নিজের ল্যাপটপের অসুখ সেরে যাওয়ার আনন্দে ডগমগ হয়ে থাকবে, জিনি চেয়ে নেবে গগনেন্দ্র তরফদারের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি।

২
''সেদিন আপনি আমার মনের কথা বুঝলেন কী করে?''

গগনস্যারের বাড়ি গিয়ে সপাটে প্রশ্নটা করেছিল জিনি। গগনেন্দ্র তরফদারকে বোধহয় এমন সরাসরি কেউ কখনো প্রশ্ন করেনি। উত্তরে একটা গোলাপি রঙের তরল ভর্তি শিশি এনেছিল গগনেন্দ্র তরফদার। 

“এটার নাম রোজিট্রাল। গোলাপ ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি। কোথাও যাওয়ার আগে শরীরে ছড়িয়ে নিই এটা। অদ্ভুত তরঙ্গ তৈরি হয় তাতে। ‌ সেই তরঙ্গের ফলে আমি পড়ে ফেলতে পারি মনের সব কথা। এই যেমন তুমি এখন ভাবছো, আমি সত্যিই একজন বিজ্ঞানী নাকি প্রতারক?''

বলেই হে হে করে হেসে ওঠে গগনেন্দ্রনাথ তরফদার। আসলে একটু পরেই একটা কাজে আমি বেরোবো। তাই একটু রোজিট্রাল শরীরে ছড়িয়েছি।

জিনি অস্বস্তিতে পড়ে যায়। অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করতে থাকে ওর মধ্যে। গগনস্যারকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় ওর। কিন্তু কোথাও যেন একটা বাধা। বিশ্বাস করতে চেয়েও পুরোপুরি ভরসা করতে পারছে না। 

''জানি বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে, সেটাই স্বাভাবিক। আমার এসব অদ্ভুত ক্ষমতা বিশ্বাস করা বেশ কঠিন। তোমার ভেতরের দোলাচল নির্ভেজাল।'' 

''আমি কি মাঝে মাঝে আপনার গবেষণাগারে আসতে পারি?''

এবার আর গগনস্যারকে আগে থেকে জিনির কোন ভাবনার কথা বলার সুযোগ দেয়নি ও। নিজের ইচ্ছের কথা একেবারে উগরে দিয়েছিল। জিনি শুনেছিল, বাড়িতেই নিজস্ব গবেষণাগারে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন গগনেন্দ্র তরফদার। জিনির এই দোষ। মা যদিও বলে এটাই জিনির গুণ। জিনি ওর ভেতরের কোন অস্বস্তিকে কাঁটার মত ফুটে থাকতে দেয় না। উপড়ে ফেলার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়ে। এবারেও তাই করছে জিনি।

“অবশ্যই এসো। তোমাদের মতো ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞানের গবেষণায় সাহায্য করলেই পৃথিবী আরো আধুনিক হবে। নকুল, একটু চা দিয়ে যাও এই মেয়েটাকে।''

কথাগুলো বলার সময় নিজের মুখটা অনেকটাই এগিয়ে দিল গগনেন্দ্র তরফদার। চোখের মণির রং সবুজ। বুদ্ধিদীপ্ত ভাবটা প্রকাশ পাচ্ছে বটে, তবে চোখের অদ্ভুত রংটা ইঙ্গিতময়। আজ গগনেন্দ্র তরফদারের চোখে চশমা নেই। তাই সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। জিনির অস্বস্তিটা বাড়ছে। তবে সাময়িক স্বস্তির প্রলেপ পড়ে। চা আর বিস্কুট নিয়ে এসেছে একটা বেঁটেমত লোক। নকুল। জিনি দেখল নকুলবাবুর চোখের রংটাও সেই সবুজ। কোথাও যেন ছন্দ মিলছে না। জিনি আবার আসবে কাল। রোমাঞ্চের আকর্ষণ ওকে টানছে।

৩

কয়েকদিনের জন্য জিনির অস্বস্তির কাঁটায় অভ্যস্ততার আস্তরণ পড়েছিল। নিত্য যাতায়াত গগনস্যারের ল্যাবরেটরিতে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখাচ্ছিল গগনস্যার। মানুষের মনের নানা স্তরে পৌঁছনোর হাজার যন্ত্রপাতি রয়েছে গগনস্যারের গবেষণাগারে। শুধু রোজিট্রাল ছাড়া প্রায় সমস্ত রাসায়নিক তৈরি দেখে ফেলেছে জিনি। 

“আপনি রোজিট্রাল কিভাবে তৈরি করেন স্যার?''

''কেন বলতো?''

জিনি একটু থতমত খায়। তবু সামলে নয় নিজেকে। 

''আসলে‌ ওই বৃষ্টিতে না ভেজার টেকনিকটা শেখার ইচ্ছে ছিল আর কী''

সবুজ চোখ নিয়ে গগন স্যার তাকায় জিনির দিকে। চোখ থেকে সবুজ রঙ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। ক্রূর দৃষ্টি। গগন স্যারের চোখ বাঁক নেয় বাঁদিকে। ল্যাবরেটরির পাশে একটা ছোট্ট ঘর। তালা ঝুলছে। জিনির চোখের সন্দেহ বোধহয় পড়ে ফেলেন গগনেন্দ্র তরফদার। 

''রোজিট্রাল তৈরির জিনিসপত্র এভাবে যেখানে-সেখানে রাখা যায় না, একটা মানুষকে বৃষ্টিতে না ভেজানোর জন্য যে প্রযুক্তি দরকার, সব রকমই রয়েছে এই রোজিট্র্যালে, এছাড়াও বিশেষ তরঙ্গ বিক্ষিপ্ত করে এই ওষুধ। তার সঙ্গে এভাবে আলাপ হবে না জিনি।''

“তাহলে কী ভাবে আলাপ হতে পারে স্যার?''

''সময়! বুঝলে সময়! সময় তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেবে।''

হা হা করে হেসে ওঠে গগনেন্দ্র তরফদার।

৪

মা এখনো ফেরেনি। এই ফাঁকে কাজটা সেরে ফেলতে হবে। অষ্টাদশী জিনসির ছিপছিপে কোমরের সঙ্গে জুড়ে থাকা পকেট থেকে বেরিয়ে আসে একটা ছোট্ট যন্ত্র। 

''হ্যালো, হ্যালো, যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে আমি পৃথিবীতে সেই মানুষটার সন্ধান পেয়েছি যিনি এই গ্রহকে যান্ত্রিক গ্রহে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছেন। তিনি বিজ্ঞানী সেজে রয়েছেন এই গ্রহে। কিন্তু আদতে একজন প্রতারক। আপাতত আমি তার কার্যপদ্ধতির সন্ধান করছি, খোঁজ পেলেই আমি বাকিটা চেষ্টা করব।''

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে শেষ করে যোগাযোগ যন্ত্রটা রেখে দেয় জিনি। মা এখুনি ফিরে আসবে কলেজ থেকে। মা, শীতকাল আর কফি এই তিনটের জন্যেই পৃথিবীতে থেকে যেতে ইচ্ছে করে জিনির। তবে উপায় নেই, ফিরে যেতে হবে কাজ শেষে। 

কিন্তু মা! মায়ের জন্য এত কষ্ট হয় কেন! জিনিকে তো মিস অনামিকা দেবীর দত্তক সন্তানরূপেই পাঠানো হয়েছিল অন্য গ্রহ থেকে। যন্ত্রমানব তৈরীর প্রযুক্তি মানুষের তৈরি। অনেক বিজ্ঞানী নানা কল্যাণকর কাজে ব্যবহার করছেন এই প্রযুক্তি। কিন্তু কিছু যন্ত্রমানব পৃথিবীর মানুষকেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। জিনিদের গ্রহে এইসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ হয়। অন্য গ্রহে পাঠানো হয় সংকটের সমাধানের জন্য। এলিয়েন X-FJ। এটাই জিনির আসল নাম। দত্তক কেন্দ্রে কয়েক মাস আগে এসেছিল ও। মানে ওকে পাঠানো হয়েছিল। মানুষের পরিচয় দিয়ে এখানে জায়গা পেতে বেশ কষ্ট হয়েছিল জিনির। তারপর নিজ গুণে বিশ্বাস আদায় করে দত্তক কেন্দ্রেই থাকতো এলিয়েন X-FJ। সেখান থেকে মায়ের হাত ধরে জিনি হয়ে ওঠা। মা কলকাতার একটা কলেজের বিজ্ঞানের অধ্যাপক। তাই জিনির জন্য একেবারে নিরাপদ আশ্রয়। কারণ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর মন এই নিয়েই কাজ করে জিনি। জিনিদের গ্রহের বিশেষ যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করা ছিল। এই দত্তক কেন্দ্রে আসা, অনামিকার সঙ্গে জিনির দেখা হওয়া, সবটাই কোথাও যেন ''প্রোগ্রামড''। জিনিদের গ্রহে মানুষের অপরাধপ্রবণতাকে আটকানোর জন্য মন নিয়ে গবেষণা করা হয়। ‌ পৃথিবীতে হওয়া সব অন্যায়ের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার কাজ চলছে। পৃথিবীতে থাকতে অসুবিধা হয় না জিনিদের। আসলে ওদের অবিকল মানুষের মতো দেখতে। শুধু কোমরের কাছে একটা আলাদা ছোট্ট যন্ত্র আর একটা বিশেষ ক্ষমতা। ওটাই ওদের আলাদা করে। আবার প্রয়োজনে ওটাই জিনিদের যোগাযোগ যন্ত্র। জিনির মায়ের একা থাকতে মানসিক সমস্যা হচ্ছিল। তাই বন্ধুরূপী সন্তানকে খুঁজছিল অনামিকা। অষ্টাদশী জিনি এখন মায়ের ফ্রেন্ড, ফিলোসফার, গাইড।

মায়ের আসার সময় হয়ে গেছে। তার আগে একবার জিনি ঘেঁটে দেখবে‌ মায়ের কম্পিউটার। জিনি যা সন্দেহ করছে তার উত্তর পাবে ওখানেই।

৫

পৃথিবীর মশাগুলো বেশ ভালই ছাপ ফেলেছে জিনির পায়ে। ভোরবেলাতেও এত মশা কামড়াতে পারে, মাথায় আসেনি জিনির। মশাদের কি মন বলে কিছু থাকে! জিনি নিশ্চয়ই ওদের গ্রহে ফিরে গিয়ে এটা নিয়ে গবেষণা করবে। ‌ আপাতত গগনেন্দ্রনাথ তরফদারের গবেষণাগারের পাশের ছোট্ট ঘর থেকে ঠিক ২০ মিটার দূরের একটা ঝোপের ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে জিনি। এই সময়টায় প্রত্যেকদিন নাকি হাঁটাহাঁটি করে। গত কয়েকদিন ধরে সামনের রাস্তা, ছাদ, গগন স্যারের বাড়ির বাগান, প্রায় সব জায়গায় আকুলি বিকুলি করে খুঁজেও গগনস্যারের পদচর্চার দেখা পায়নি জিনি। সন্দেহটা ওর অনেকদিন আগেই ছিল। এবার বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। সকালের ওই নির্দিষ্ট সময়টাতেই এমন কিছু হয় যা হিসেবের বাইরে। কল্যাণসাধনকারী বিজ্ঞানীর ছদ্মবেশের আড়ালের প্রতারককে ধরার জন্য এই সময়টাই বেছে নিয়েছে জিনি। 

ল্যাবরেটরি ঘরটাতে খুটখাট করে আওয়াজ হচ্ছে। ওখানেই কিছু একটা হচ্ছে। জিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় গবেষণাগারের কাছে। তবে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওই ছোট্ট ঘরটায় সবুজ রঙের আলো জ্বলছে। বাক্সের ভিতর থেকে দুটো ছোট্ট পুতুল বার করে আনছে গগনেন্দ্র তরফদার। তারপর তাদেরকে একটা গোলাপি তরল ভরা কাচের পাত্রে ভালো করে পরিষ্কার করে টেবিলের ওপর রাখতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো। ছোট্ট পুতুলগুলো আস্তে আস্তে যেন খোলস ছেড়ে দুটো বড় মানুষে পরিণত হল। মানুষ দুটোকে দেখতে অবিকল গগনেন্দ্র তরফদার আর নকুল। তবে এই গগনেন্দ্র তরফদার আর নকুলের চোখের রং সবুজ নয়। বাদামি। এবার সব গুলিয়ে যাচ্ছে জিনির। জিনি দেখছে ওই মানুষগুলোর গলা থেকে ধাতব শব্দ বেরোচ্ছে। সবুজ চোখওলা গগনেন্দ্র তরফদার ওই পুতুল-মানুষদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। তারা যেন যন্ত্রের মত। অনুভূতিহীন। তার মানে জিনি যা ভাবছিল সবটা সত্যি নয়! গগনেন্দ্রনাথ তরফদারের ভেক ধরে বসে আছে কেউ। সেই আসলে প্রতারক। এমনকী  নকুলেরও একজন ড্যামি রয়েছে। সবুজ চোখওলা গগনেন্দ্র তরফদার আর নকুল আসলে নকল। আসল বিজ্ঞানী আর তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গীকে যন্ত্রমানবে পরিণত করেছে নকল গগনেন্দ্র তরফদার! মানুষই কি ঠকাচ্ছে মানুষকে! নাকি ওই সবুজ চোখের আড়ালে অপেক্ষা করছে কোন গূঢ় রহস্য।

৬

জিনি নিজেও ভাবতে পারেনি ও এমন একটা দুঃসাহসী কাজ করবে! ওদের গ্রহের বাসিন্দাদের একটা বিশেষ ক্ষমতা- হঠাৎ করে খানিকক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। তবে সারাদিনে একবারই এর ব্যবহার করা যায়। পৃথিবীতে আসার পর কোনদিনই এই ক্ষমতা প্রয়োগ করার একেবারেই প্রয়োজন হয়নি ওর। আজ হল। পৃথিবীর মানুষকে বাঁচানোর জন্য। অদৃশ্য হয়ে থাকার সময়টুকুতে জিনি পৌঁছে গেল গগনেন্দ্র তরফদারের পরীক্ষাগারে। তারপর এক ঝটকায় গগন স্যার আর নকুলের চোখ থেকে সবুজ রঙের মণিটা খুলে ফেলল। মণিহীন যন্ত্র-স্বরূপ গগনেন্দ্রনাথ তরফদার আর নকুল ধীরে ধীরে পরিণত হল দুটো যন্ত্রমানবে। বাকিটা করতে জিনিকে খুব একটা কষ্ট পেতে হয়নি। জিনির মনে হয়েছিল সূত্রটা কোথাও রোজিট্রালেই আছে। সবুজ রঙের মণিগুলো কন্টাক্ট লেন্সের মতো করে জিনি পরিয়ে দিল সেই পুতুল থেকে রূপান্তরিত হওয়া মানুষদুটোকে। ধীরে ধীরে তারা চোখ মেলল। আর সেই প্রতারক বিজ্ঞানী আর নকল নকুল কর্কশভাবে ধাতব চিৎকার করে চলেছে। জিনিও আবার দৃশ্যমান হয়।

''আপনি তাহলে সত্যিকারের বিজ্ঞানী!'' জিনি প্রশ্ন করে।

''সত্যি-মিথ্যে জানি না, আমি এই যন্ত্রমানবদুটোকে তৈরি করেছিলাম মানুষের অবসাদ মেটানোর জন্য। এই যন্ত্রমানব ব্যবহার করে মানুষের মনের গভীর স্তর পর্যন্ত পৌঁছোনো যেত। চিকিৎসাবিজ্ঞানে সাড়া ফেলে দিত আমার তৈরি এই দুটো যন্ত্রমানব।''

“আর এরা আপনাকেই যন্ত্রমানবের পরিণত করল?”

''আমার তৈরি রোজিট্রাল আর এই সবুজ রংয়ের লেন্স ব্যবহার করে আমি যন্ত্রমানব দুটো তৈরি করেছিলাম মানুষের সব বৈশিষ্ট্য দিয়ে। মানুষ নিজের কাজের ছাপ রাখতে চায় মৃত্যুর পরেও, তাই এদেরকে আমাদের মত মানে আমার আর এই নকুলের মতো দেখতে করেছিলাম। এরা দুজন সমস্ত মানুষী-গুণ সম্বলিত। আমার রোজিট্রালের মাধ্যমে মানুষের মনের কথা জানা যায়। ভেবেছিলাম ধীরে ধীরে ওটাও চিকিৎসাবিজ্ঞানে কাজে লাগানোর কথা ভাবব।

“'তাই বোধহয় এতো সহজেই ঈর্ষা আর নিষ্ঠুরতায় আক্রান্ত হতে পেরেছে এই যন্ত্রমানবেরা। এই পুরো পৃথিবীকে যন্ত্রমানব চালিত গ্রহে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। মানুষের অন্ধকার দিকগুলোরই প্রকাশ ঘটল আগে এদের মধ্যে।''

''আমার দুর্ভাগ্য! ভাগ্যিস তুমি এসে আমায় বাঁচালে! তোমার কাছে, তোমাদের গ্রহের কাছে আমি কৃতজ্ঞ জিনি! তোমাদের গ্রহ থেকে বিশেষ সিগন্যালের মাধ্যমে আমায় জানানো হয়েছিল তোমার বর্তমান অবস্থানের কথা। যদিও তোমার এই গ্রহে আসার আসলে উদ্দেশ্যর কথা জানতাম না আমি।''

-''আমরা খোঁজে পেয়েছিলাম পৃথিবীর বড় বিপদ, পৃথিবীকে যন্ত্রমানবের গ্রহে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চলছে। আমি এখানে আসার আগেই আপনাকে আর নকলবাবুকে যন্ত্রমানবে রূপান্তরিত করা হয়ে গিয়েছিল। আমি গগনেন্দ্র তরফদার হিসেবে যাকে চিনেছিলাম সে আসলে ছিল আপনার তৈরি যন্ত্রমানব। আমি এটা তখনও বুঝতে পারিনি। তাই ভেবেছিলাম আপনিই হয়তো পৃথিবীকে যন্ত্রমানবের গ্রহে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছেন।''

“এভাবেই বিজ্ঞান কলঙ্কিত হয়! আমার তৈরি এই দুই যন্ত্রমানব বেশ কিছুদিন ধরে আমারই আড়ালে অদ্ভুত কাজ চালাচ্ছিল। আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী নকুলকেও ছাড়ে নি। রোজিট্রাল আমার তৈরি, যে কোনো সমস্যার সমাধানকারী বিশেষ রাসায়নিক। পৃথিবীর এত যুদ্ধ, লড়াই, দ্বন্দ্ব, নিষ্ঠুরতা সব মনের অসুখ। সবকিছু সারানোর জন্যেই আমি রোজিট্রাল তৈরি করেছিলাম। আর এই দুই যন্ত্রমানবের সরাসরি মনস্তত্ত্ববিদদের সাহায্য করার কথা ছিল মানুষের মনের অসুখ সারাতে। কিন্তু এই দুই যন্ত্রমানব আমায় আর নকুলকে আমারই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যন্ত্রমানবে পরিণত করেছিল। ওই সবুজ মণিও আমারই তৈরি। এটার মাধ্যমেই মানুষ থেকে যন্ত্রমানবের রূপান্তর ঘটে। ওটাই ছিল ওদের প্রাণভোমরা।''

''মায়ের কম্পিউটারে আপনার ছবি দেখেছিলাম, আপনার চোখের রং একেবারে স্বাভাবিক। বাদামি। তখনই বিষয়টা আঁচ করেছিলাম। ওরা রোজিট্রালের অপব্যবহারও শুরু করেছিল। অথচ পৃথিবীর এখন আপনার মত মানুষের তৈরি ভালোবাসার ওষুধ দরকার।''

জিনি লক্ষ্য করে বয়স্ক মানুষটার বলিরেখার পাশে দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতার রেখাও অস্পষ্ট। শুভ-অশুভের চিরন্তন লড়াইয়ের সুস্পষ্ট ছাপ। জিনির কাজ সম্পন্ন। ওকে ফিরে যেতে হবে। নকল গগন স্যার আর নকুলের গলা থেকে ধাতব চিৎকার তখনো ভেসে আসছে। জিনি পা বাড়ায় বাইরের দিকে। 

''তোমার যোগাযোগ যন্ত্রটা এখানে রেখে যাও জিনি। আমি জানি তুমি তোমাদের গ্রহে ফিরে যেতে চাও না। এই পৃথিবীতে তোমায় দরকার। তোমার গ্রহে আমি যোগাযোগ করে সব বুঝিয়ে বলবো। তুমি পৃথিবীতে এসে ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছো, তুমি যেওনা।''

জিনি উত্তর দেয় না। শুধু গগনেন্দ্রনাথ তরফদারের গবেষণাগারের টেবিলে রেখে আসে ওর যোগাযোগ-যন্ত্র। ও জানে বিষয়টা অতটা সহজ নয়। ওদের গ্রহে প্রত্যেকের নির্দিষ্ট অ্যাসাইনমেন্ট থাকে। জিনির বর্তমান অ্যাসাইনমেন্ট সমাপ্ত। পরের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার আগে ওরা ঠিক যোগাযোগ করে নেবে জিনির সঙ্গে। অন্তত ততদিন মায়ের স্নেহের স্বাদ জিনি মন ভরে আহরণ করবে। তবুও জিনি গগনস্যারকে কিছু বলে না আর। ও যখন ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে, ধাতব চিৎকার থেমে গেছে। কর্কশ কোলাহলের পর যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে।

বৈশাখী ২০২৪