ছেলেটা যেকোন মিছিলের প্রথমে বুক চিতিয়ে হাঁটত। গুলি লাগলেই বাঁচুক মরুক; পরিবারটার হিল্লে হয়ে যাবে। চোখে স্বপ্ন এবার ভোটের পর বিধায়ক দেখা করতে বলেছেন। এইতো কটা দিন; পার্টির সুনজরে আছি। সবই তো আমাদের হাতে জিত অনিবার্য; কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে দেবেন দাদাবাবু। এইতো চন্ডিতলায় দু দুটো অ্যাম্বুলেন্স দান করল। অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে লেখা নব্যেন্দু অধিকারী। আহা-কি দয়ার শরীর। কার বাপের টাকায় দান ধ্যান, ছেলেটা কি জানে না? না কি জেনেও না জানার ভান করে। আজ সকালে বিরোধী পার্টির নমিনেশন জমা বাধা দিতে গিয়ে বচসা গোলাগুলি। ছেলেটার বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ হল। বডিতে বিধায়কের নাম লেখা অ্যাম্বুলেন্সে গ্রাম থেকে কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতালে আসতে আসতে ছেলেটি মারা গেল। গ্রামের বাড়িতে তার ছোট ভাইয়ের মোবাইলে কলকাতা থেকে ঘন ঘন আসতে লাগলো ফোন। নেতাদের ফোন! “দিলদার কে হারিয়ে আমরা গভীর শোকাহত। সমবেদনা জানানোর ভাষা নেই। সবরকম ভাবে আমাদের পাটি আপনাদের পাশে আছে!” মিডিয়ার ফোন; “দিলদার কোন পার্টির সমর্থক ছিলেন?” এ বলে আমাদের ও বলে আমাদের। শহীদ দিলদারের বডিটা নিয়ে রাজনৈতিক শৃগালেরা দড়ি টানাটানি করে চলে। বিরোধী পক্ষের নেতা ছুটে এলো দিলদারের ভাইয়ের রেলের চাকরি করে দেবে ওরা। এক চোখে ছানি শীর্ণকায় দিলদারের আব্বা বললেন, “এরা খুব জোর দু'লক্ষ টাকা দেবে। তাও বিডিও, পঞ্চায়েত নানা হাত ঘুরে কাঠখড় পুড়িয়ে যখন আমাদের হাতে পৌঁছবে তলানি। আর চাকরিই বা কই ও-ইতো ওই সিভিক পুলিশ না পুলিশ না দরোয়ান। তাও দুই দিন অন্তর কোর্ট রায় দেয় তুলে দাও সিভিক ভলান্টিয়ার!” দিলদারের ভাই বলে; “আব্বা! থামো! ভাইয়াকে এখনো মাটি দিলাম না আর তুমি...” দিলদারের আব্বা বলে, “ভোট ফুরলে কোনও শালার টিকি খুঁজে পাবি না এই বলে রাখলাম। এই মওকা, হাতি পাঁকে পড়েছে। চুল তো এমনি পাকল না পৃথিবীটা কম দেখলাম না!” দিলদারের আম্মা কঁকিয়ে কেঁদে ওঠে, “কিচ্ছু লাগবে না আমার দিলদারকে ফিরিয়ে আনো!” কিছুক্ষণের মধ্যে টিভি চ্যানেল আর খবরের কাগজের লোক গ্রাম ছেয়ে গেল। তারা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে চলল হত্যাকাণ্ডের। ঠিক তখনই হয়ত কাঁটা পুকুরে দিলদারকে চেরাই করে তৈরি হচ্ছে ফরেনসিক রিপোর্ট। সেখানে হয়ত লেখা থাকবে গুলি কত দূর থেকে ছোঁড়া হয়েছে, কতক্ষণ সময় লেগেছে দিলদারের শরীরে বিষক্রিয়া হতে। হয়ত এও থাকবে সেখানে কত ঘণ্টা আগে মারা গেছে। কিন্তু ওরাও জানতে পারবে না দিলদারের বুকের গুলিটা নীল, লাল, না গেরুয়া নাকি ত্রিবর্ণ।! হাজার চেষ্টা করে হৃদপিণ্ড নাড়াঘাঁটা করলেও ওরা কিছুতেই জানতে পারবে না কী রং তার হৃদয়ের। তবু ওরা তা জানতে চাইবে এক্ষুনি একটা অপ্রস্তুত গ্রাম্য ছেলেকে আলো ঝলসানো ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে। যন্ত্রটার পেছন থেকে প্রশ্ন করা হবে, “দিলদার কোন পার্টির সমর্থক ছিলেন?” দিলদারের আব্বু দিলদারের ছোট ভাইটার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, “একটু ভেবে চিন্তে বলিস। মুখের কথা আর হাতের ঢিল বেরিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না!”